ইরানের চলচ্চিত্রকার জাফর পানাহির ২০০৬ সালে নির্মিত ছবি “অফসাইড” বহুলচর্চিত এবং ইরান সহ আন্তর্জাতিক মহলে যথেষ্ট বন্দিত। একটি ফুটবল খেলার প্রেক্ষাপটে বলা গল্প নিয়ে তৈরি এই ছবিটি দুটি অতি গুরুত্বপূর্ণ দিক ধরেছিল - জাতীয় জীবনে ফুটবল খেলার জনপ্রিয়তা এবং ধর্মীয় গোঁড়ামির সরকারী বেড়াজালে আটকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে থাকা নারীদের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। সংবাদমাধ্যমের তৈরি করে দেওয়া ভাবমূর্তিতে অন্ধবিশ্বাস রাখা যাঁদের ইরান বলতেই মধ্যযুগীয় অবয়বের একদল ধর্মান্ধ ছাড়া কিছু মাথায় আসে না এই ছবিটি দেখলে তাঁরা বুঝবেন সে দেশের সরকার এবং সাধারণ মানুষকে এক করে দেখাটা কত বড় ভুল।
ধর্মীয় অনুশাসনকে হাতিয়ার করে মানবাধিকারের দফারফা করা, বিশেষত নারীদের সরকারীভাবে নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে অন্তঃপুরে আটকে রাখা ইরানের সরকারী নীতি বিগত চার দশক ধরে যতই রক্তচক্ষু দেখাক না কেন, হৃত মানবাধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য প্রতিবাদের সংস্কৃতিও সে দেশে যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যমান। আজকের ভারতবর্ষে বসে, একটি গণতান্ত্রিক পরিসরে আছি ( ভোট দিয়ে সরকার বদলাতে পারিতেই শুরু আর শেষ যদিও) এই আত্মতৃপ্তির উদ্গার তুলতে তুলতেও যে জিনিসটি আমরা কল্পনাও করতে পারি না তা হল সরকারী নীতির বিরুদ্ধে প্রাক্তন বা বর্তমান খেলোয়াড়দের মুখ খোলা। অথচ আলোকপ্রাপ্ত, মুক্তমনা, গণতান্ত্রিক আমাদের কাছে পশ্চাদপদ, গোঁড়া, ধর্মীয় মৌলবাদের আখড়া ইরানে সে দেশের প্রতিবাদের সংস্কৃতির পথে সোচ্চারে হাঁটেন তাদের প্রথম সারির ক্রীড়াবিদ, বিশেষত ফুটবলাররা।
এই বিশ্বকাপে তাদের প্রথম ম্যাচে গোটা ইরান দলের মৌন প্রতিবাদ গোটা বিশ্বের নজর কেড়েছিল। দেশের হয়ে খেলা মানে একপ্রকার রাষ্ট্রের প্রতিনিধি, সুতরাং ফুসফুসে হাওয়া ভরে জাতীয় সঙ্গীত তথা রাষ্ট্রগান গাইতে হবে, তবেই তুমি জাতীয় আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে উঠতে পারবে,আন্তর্জাতিক খেলাধুলায় এ একরকম স্বতঃসিদ্ধ। অথচ জাতীয় সঙ্গীত চলাকালীন ইরানের ফুটবল দল সেদিন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নীরব থাকলেন। তাঁদের শক্ত চোয়াল সেদিন অন্যরকম ইরানের প্রতীক হয়ে উঠেছিল, যে ইরান পশ্চিমী সংবাদমাধ্যমের লেন্স দিয়ে চেনা ইরানের চেয়ে আলাদা। তাঁরা যোগ্য সঙ্গত করছিলেন সেপ্টেম্বরে ২২ বছরের তরুণী মাহসা আমিনির রাষ্ট্রীয় হত্যা এবং তারপর ক্ষোভে ফেটে পড়া গণতান্ত্রিক চেতনার ইরানের আশা আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে। ইরান সমর্থকদের গ্যালারি, যেখানে একটা বড় অংশে ছিলেন প্রবাসী ইরানীয়রা, তাঁরা সমর্থন যুগিয়েছিলেন জাতীয় সঙ্গীতকে টিটকিরি দিয়ে, কখনও দেশে নৃশংস অত্যাচারের শিকার হওয়া মানুষগুলির কথা ভেবে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। সবটা মিলিয়ে এমন ফ্রেম খেলার মাঠে আগে দেখা গেছে কি? সেদিন মাঠের খেলায় ইংল্যান্ডের কাছে ৬-২ গোলে দুরমুশ হলেও, যার কারণটা অনেকটাই ফুটবলীয়, ক্রীড়ামোদী এবং গণতান্ত্রিক চেতনার পৃথিবীর হৃদয় জিতে নিয়েছিলেন তাঁরা।
এই ঘটনা আকস্মিক কিছু নয়। এর প্রেক্ষাপট তৈরিই ছিল। শুরু হয়েছিল জাতীয় দলের স্ট্রাইকার, জার্মান বুন্দেশলিগায় বায়ার্ন লেভারকুসেন দলের সদস্য সর্দার আজমৌনের প্রতিবাদ দিয়ে। ২৯ শে সেপ্টেম্বর আজমৌন সমাজমাধ্যমে লেখেন “ বড়জোর জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ব। আমাদের মেয়েদের এক গোছা চুলের মূল্যের তুলনায় এ তো হিসেবেই আসে না। শাসক তোমার লজ্জা নেই? এত সহজে মানুষ মার? ইরানের নারীরা দীর্ঘজীবী হোন। “ পরে কোন অদৃশ্য চাপে সেই পোস্ট মুছে দিয়ে তুলনায় নরমসরম একটি পোস্ট দিলেও এটা স্পষ্ট করে দেন যে তিনি মতামত বদলাচ্ছেন না। আজমৌনের পথ ধরে অক্টোবর মাসে সেনেগালের বিরুদ্ধে বিশ্বকাপের প্রস্তুতি ম্যাচে বাকি খেলোয়াড়রা মাঠে আসেন কালো জ্যাকেট পরে। সেই জ্যাকেটে ঢাকা পড়ে জাতীয় দলের লোগো। পিছিয়ে থাকেননি বিশ্বকাপ দলে না থাকা কিছু বর্তমান খেলোয়াড়। ইরানের জাতীয় লিগের খেলোয়াড় মহম্মদ জুবেইর নিকনাফস নীরব প্রতিবাদ রেখে যান তাঁর মাথা ন্যাড়া করে। তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়েন ২০১৮ বিশ্বকাপ দলের সদস্য ভোরিয়া ঘাফৌরি। ঘাফৌরি দীর্ঘসময় ধরে ইরানীয়ান কুর্দদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে সোচ্চার। ২০১৯ সালে ‘অফসাইড’ ছবির গল্পের মতই একটি ঘটনা বাস্তবে ঘটে। স্টেডিয়ামে খেলা দেখার চেষ্টা করার অপরাধে সাহার খোদায়ারি নামের এক মহিলাকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। প্রতিবাদে গায়ে আগুন লাগিয়ে মৃত্যুবরণ করেন সাহার। সাহারের স্মরণে নীল জার্সি বিলি করেন ঘাফৌরি। ২০২১ সালে মহিলা ফুটবল সমর্থকদের উপর ঘটা আক্রমণের ঘটনার নিন্দা করে ঘাফৌরি বলেন “ ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে এটা ভাবতে লজ্জা লাগে যে আজও আমাদের মেয়েরা স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখতে পারেন না। “ স্বভাবতই ঘাফৌরি সরকার এবং তার পিছনে থাকা মৌলবাদীদের চক্ষুশূল। তাঁকে শুনতে হয়েছে তিনি কুর্দ বিচ্ছিন্নতাবাদী। নাম না করে খোমেইনি দিয়েছেন তির্যক হুমকি “ এদেশে কেউ কেউ আছে যারা আমাদের খেয়ে, পরে, আমাদের জনপ্রিয় খেলায় বিখ্যাত হয়ে আমাদেরই পিছনে লাগে। “ মাহসা আমিনির ঘটনার পরেও তাঁর তীব্র সমালোচনা সরকারকে এতটাই বিচলিত করে যে “ গুজব রটিয়ে ফুটবল দলের মনোবলে চিড় ধরানো এবং সরকারের ভাবমূর্তিতে কালিমা লেপনের” অভিযোগে ২৪ শে নভেম্বর তাঁকে গ্রেফতার করা হয়।
পিছিয়ে থাকেননি প্রাক্তন হয়ে যাওয়া সামনের সারির ফুটবলাররাও। আলি করিমি, যাকে এশিয়ার মারাদোনা বলা হত এবং ইরানের হয়ে সর্বাধিক আন্তর্জাতিক গোল (১০৯ টি) করা, বায়ার্ন মিউনিখের মত বিশ্বসেরা ক্লাবের হয়ে দীর্ঘদিন খেলা, আলি দাই সোচ্চার হয়েছেন ইরান সরকারের দমননীতির বিরুদ্ধে, আজমৌনদের সমর্থনে। তাঁদের এই মুখ খোলাও আচম্বিতে নয়। আলি করিমি ২০১০ সালে একটি আন্তর্জাতিক ম্যাচে নেমেছিলেন সবুজ রং এর রিস্টব্যান্ড পরে, ইরানে সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে হওয়া রিগিং এর প্রতিবাদে। তার খেসারত হিসেবে কিছুদিন জাতীয় দল থেকে বাদ পড়তে হয়। ২০১৭ সালে মহিলাদের স্টেডিয়ামে খেলা দেখার দাবি জোরালো হয়ে উঠতে করিমি বলেন “ লাখো লাখো মহিলা সমর্থকের আন্তরিক ইচ্ছাকে সম্মান দিতেই হবে।” সেদিন করিমির মত প্রভাবশালী বিখ্যাতের সমর্থন ২০১৯ সালে মেয়েদের জন্য ইরানের স্টেডিয়াম খুলতে সাহায্য করেনি এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় না। মাহসা আমিনির ঘটনার পর বর্তমানে দুবাইয়ে বসবাসকারী করিমির সমাজমাধ্যমের বার্তাগুলি কারও কারও এতটাই মাথাব্যথার কারণ হয়েছে যে অক্টোবর মাসে তাঁকে অপহরণ করে ইরানে নিয়ে আসার চেষ্টা হয়। এক অনামা শুভানুধ্যায়ী সময়মত সতর্ক করে দেওয়ায় সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। সেই মাসেই ইরান প্রশাসন আর এক প্রতিবাদী আলি দাইয়ের পাসপোর্ট কেড়ে নেয়। এক সপ্তাহ পরে তা ফেরত দিলেও প্রতিবাদের রাস্তা থেকে সরেননি আলি। বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য ফিফার আমন্ত্রণ সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করে জানিয়েছেন “এই মুহূর্তে আমি দেশের মানুষের পাশে থাকতে চাই।”
বিশ্বকাপের পরপর দুটি খেলায় ইরানের খেলোয়াড়দের প্রতিবাদ করিমি, দাইদের উত্তরাধিকার মেনেই। প্রথম ম্যাচে জাতীয় সঙ্গীতে গলা মেলানোর সাহসী প্রতিবাদের পরে অধিনায়ক হাজসাফির গলায় সেই জেদ “ আমাদের দেশে সব ঠিক নেই। আমার দেশে মানুষ ভাল নেই। এখানে এসে গেছি মানে তাঁদের কথা ভুলে যাব তা হতে পারে না। আজ আমরা যা কিছু সব ওঁদের জন্যই। আমাদের লড়তে হবে, খেলতে হবে, জিততে হবে, ওঁদের জন্যই। “ দ্বিতীয় ম্যাচে তাঁদের প্রতিবাদের ভিন্ন ধরণ, জাতীয় সঙ্গীতে কোনমতে ঠোঁট নাড়ানো যাতে স্পষ্ট বার্তা যে এ কাজ তাঁরা মন থেকে করছেন না দেশবাসীর চোখে তাঁদের অনেক উঁচুতে বসিয়ে দিয়েছে, নিশ্চিতভাবেই।
প্রাক্তন থেকে বর্তমান, ইরানের ফুটবলারদের কথায়, কাজে একটি জিনিস পরিষ্কার - তাঁরা দেশ বলতে সরকার নয়, দেশের মানুষ বোঝেন। দেশের মানুষের উপর অত্যাচার হলে তাঁরা দেশের মানুষের পাশে দাঁড়াবেন, সরকারের পাশে নয়। কেবল ভারতবর্ষ নয়, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ক্রীড়াবিদরা হাঁটেন ঠিক উল্টোপথে। ইরানের ফুটবলাররা রাষ্ট্রের হাতে সব খোয়ানোর ঝুঁকি সত্ত্বেও একবার বেঁচে নিতে চেয়েছেন, মার খেতে খেতে, বেধড়ক মার খেতে খেতেও লড়াই না ছাড়া মানুষগুলোর সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করে।
ইরান কখনও বিশ্বকাপ ফুটবলের নক আউট পর্যায়ে যেতে পারেনি। প্রথম ম্যাচে অসহায় আত্মসমর্পণের পর ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্বিতীয় ম্যাচে চমৎকার ফুটবল খেলে ওয়েলশকে হারিয়েছেন তাঁরা। শেষ ম্যাচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। সেই ম্যাচে একটি পয়েন্ট পেলেই ইতিহাস গড়ে পরবর্তী রাউন্ডে যাবেন তাঁরা। মাঠের বাইরে যে লড়াইয়ের ইতিহাস গড়লেন ইরানের ফুটবলাররা এরপর নক আউট পর্যায়ে যাওয়া হবে কাব্যিক বিচার। ফুটবলের মত কাব্যিক খেলায় জীবন কি এইটুকু দেবে না? উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতে হবে ৩০ নভেম্বর ভোররাত পর্যন্ত। সেইদিন মেসি - রোনাল্ডো - নেইমার তর্জা মুলতুবি রেখে দমবন্ধ উত্তেজনায় ইরানের সাহসী ফুটবলারদের সমর্থনে গলা ফাটাবে আমাদের এই ছোট্ট ফুটবলপ্রেমী পৃথিবীর সমস্ত গনতন্ত্রকামী মানুষ।