সকালে শ্রমিক বস্তিতে কলের জলের লম্বা লাইনে দুই শ্রমিক নেতার বউ ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়ে। তখন এক নেতা এসে নিজের বউয়ের পক্ষ নিয়ে অন্য জনকে দু চার কথা শুনিয়ে দেয়। সেই দেখে অন্যজনের স্বামী এসে ওই শ্রমিক নেতাকে এক চড় কষায়। "মেয়েদের ঝগড়ায় তুই কেন নাক গলিয়েছিস"। দুই নেতার এই গোলমাল জানতে পেরে, তৃতীয় দালাল ইউনিয়নের নেতা মালিকের কানে খবরটা পৌঁছে দেয়। কারণ ওই দিনই শ্রমিকদের বোনাস নিয়ে আলোচনা হবে মালিকের সাথে। তার আগে লড়াকু দুই ইউনিয়নের বিরোধ মালিকের কাছে যথেষ্ট উৎসাহব্যাঞ্জক। কিন্তু মালিকের চক্ষু চড়ক গাছ, যখন দেখলো দুই নেতা কাঁধে হাত দিয়ে বন্ধুর মতো আলোচনায় ঢুকলো। একজোট হয়ে মালিকের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের হয়ে সওয়াল করলো। দালাল ইউনিয়নের নেতা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সভা শেষ হলো। দুই নেতা বাইরে এলো। একজন অপরজনকে বলতে গেল, "জানো তো দাদা আজকে...." । কথা শেষ করতে না দিয়ে অন্যজন বলল " কোনো কথা না। তোকে তখন একটা চড় মারা কম হয়েছিল। মেয়েদের গোলমালে তুই কেন নাক গলাতে যাস? আর কখনো গেলে মেরেই ফেলবো তোকে"। স্মৃতি থেকে গল্পটা বললাম, মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোট গল্প "কলহান্তরিত"।
গৌরচন্দ্রিকা বোধ করি একটু দীর্ঘ হল। লক্ষ্য করে দেখবেন, এই দুই শ্রমিক নেতা যখন কারখানায় প্রবেশ করছে তখন শ্রমিকের দাবি দেওয়ার প্রশ্নে এদের সাধারণ আত্মপরিচয় হল শ্রমিক। কিন্তু যখন এটা বস্তিতে অবস্থান করছে তখন দুজন দুটি পরিবারের পৃথক আত্মপরিচয়। সেখানে তারা কোন ইস্যুতে বিরোধিতায় লিপ্ত হয়। আবার এরাই বস্তির কলে জল না থাকলে সমবেত হবে, বস্তিবাসী আত্মপরিচয় নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়। মানুষের অসংখ্য আত্মপরিচয়, আমি পরিবারের মধ্যে একটি পরিচয় নিয়ে থাকি। কিন্তু ফুটবল খেলা দেখতে গেলে আমি মাঠে ইস্টবেঙ্গল বা মোহনবাগান হই। মুখের ভাষা পর্যন্ত বদলে যায়। আবার ক্রিকেট খেলা দেখতে বসলে আমি ভারতীয় হই। এভাবেই খাদ্যাভ্যাসের প্রশ্নে আমি মাছে ভাতে বাঙালি। একেকটি বিশেষ মুহূর্তে বিশেষ বিশেষ পরিচয় সক্রিয় হয়। বলা ভালো উদ্দেশ্যমূলকভাবেও বিশেষ বিশেষ সময়ে কোন বিশেষ পরিচয় কে জাগিয়ে তোলা যায়।
অর্থাৎ দেশব্যাপী যে হিন্দুত্বের জিগির তুলছে বিজেপি ও আরএসএস, সেই আবহে একটি বড় অংশের হিন্দু জনগণ ঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন। এর বিপরীতে একটি ভিন্ন আত্মপরিচয় কে জাগিয়ে তুলে হিন্দুত্বের জিগির কে প্রতিহত করা সম্ভব। খুব সঙ্গতভাবেই আঞ্চলিকভাবে তামিল আত্মপরিচয়, বাঙালি আত্মপরিচয়, মারাঠি আত্মপরিচয় এক একটা উপায় হতে পারে। তবে সারা দেশব্যাপী এই আত্মপরিচয় সক্রিয় হয় না। তার জন্য ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্য, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের পরিচয়, নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধানের আত্মপরিচয়, হাতিয়ার হতে পারে। কিন্তু এই বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য এবং ধর্মনিরপেক্ষতার শ্লোগানটি ২০১৪ পূর্ববর্তী কেন্দ্রীয় শাসকদের বহু ব্যবহারে ক্লিশে হয়ে পড়েছে। মানুষের কাছে রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতা খুব সুখাদায়ক অভিজ্ঞতা নয়। বরং আমাদের রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতা অনেকাংশেই সংখ্যাগুরু ঝোঁক প্রবণ, মৌখিক ভাবে সংখ্যা লঘু ত্রাতা, নরম হিন্দুত্ববাদীর পন্থা অনুসরণ করে। বাংলায় যেমন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় "ধর্ম যার যার উৎসব সবার" বলে একটা সর্বধর্ম সমন্বয়ের পথ বেছে নিয়েছেন। আবার আংশিকভাবে বাংলার সংস্কৃতি বাংলার ঐতিহ্য বাঙালিয়ানাকেও আশ্রয় করে কেন্দ্রের উগ্র হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে লড়াই চালান। মনে আছে, ১৯৯২ এ দাঙ্গা ও কারফিউর সময় মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু দুপুরে আড়াই ঘন্টার জন্য কারফিউ শিথিল করেন, মানুষের বাজার হাট ইত্যাদির স্বার্থে। কিন্তু বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। কারণ দিনটি ছিল শুক্রবার, জুম্মা বার। কট্টরপন্থী হিন্দু রা ওই ঘোষণায় ঘৃণা ছড়াতে সুযোগ ছাড়ে নি। মনে আছে পরিচিত রিকশা চালক হাদীস বলেছিল, সরকার কেন এইসব ছাড় দেয়, এরজন্য আমাদের কপালে আরও গালাগালি জোটে।
সে যাই হোক, এই পরিচয় ছাড়াও একটি পরিচয় হতে পারত শ্রেণি পরিচয় শ্রমজীবী শ্রেণি র জাতি ধর্ম বর্ণ বিচার হয় না। তাদের একটাই পরিচয় তারা শ্রমের বিনিময়ে মজুরি লাভ করে, শ্রমিক। সে ক্ষেত্রে মালিক হিন্দু-মুসলমান খ্রিস্টান হোক বা বাঙালি বিহারী গুজরাটি মারাঠি হোক। তার পরিচয় উৎপীড়ক মালিক। এই শ্রেণি পরিচয় আসমান থেকে আসে না। যদি শ্রেণি আন্দোলন না চালু থাকে, তীব্র না হয়, তাহলে শ্রেণি পরিচয়ে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না। এ প্রসঙ্গে এঙ্গেলস জোসেফ ওয়েডমেয়ার কে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, শ্রেণি পরিচিতি একটি সাধার্ণ পরিচিতি নয়। যখন শ্রেণি সংগ্রাম তীব্রতর রূপ নেয়, একমাত্র তখনই শ্রেণি পরিচিতি সত্য হয়ে ওঠে। অতএব বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদের বিপরীতে দুটি পথ খোলা আছে
(এক) ধর্মনিরপেক্ষতা বা নরম হিন্দুত্বের পথ
(দুই) শ্রেণি সংগ্রাম ও শ্রেণি পরিচিতি।
নেহেরু মডেলের ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের দৃঢ়তা কম, কারণ বিগত ষাট বছরের কংগ্রেস ও অকংগ্রেসী সরকারের আমলে মানুষের দুঃখ ও দুর্দশা বিপন্নতা বেড়েছে মানুষ দেখেছে গুটিকয়েক শিল্পপতির উত্থান মানুষ তার স্বপ্নের স্বাধীনতাকে বিধ্বস্ত হতে দেখেছে। আর এর সাথে চলেছে একনাগাড়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্ম মতের তোষণ, ভয়ংকর দুর্নীতি এবং জরুরী অবস্থার মত স্বেচ্ছাচারিতা। একটু পর একটি সংবিধান সংশোধন ও তার মাধ্যমে অঙ্গরাজ্যের ক্ষমতা হ্রাস মানবাধিকার খর্ব নাগরিক অধিকার হরণ। ফলে প্রথম পথটি সম্পর্কে মানুষ মোহ মুক্ত। দ্বিতীয় পথটি শ্রেণি সংগ্রামের পথ। আর শ্রেণি সংগ্রাম ছাড়া শ্রেণি পরিচিতি, শ্রেণি ঐক্য, গড়ে উঠবে না। কিন্তু শ্রমিক শ্রেণি র পার্টি গড়ে তোলাই এক কঠিন পরীক্ষা। যা যথাযথ ভাবে সম্পন্ন হয়নি। শ্রমিক শ্রেণি র মতাদর্শ অথচ তার ব্যাখ্যা দাতা শিক্ষিত এলিট মধ্যবিত্ত। এর ফলে শ্রেণি সংগ্রামে লঘুত্ব (ডাইল্যুশন) আসবেই। শ্রেণি সংগ্রাম বিকৃতভাবে ব্যাখ্যা করা হবে এলিটের স্বার্থে। শ্রেণি সংগ্রাম কার্যত অনুপস্থিত অধরা। এই প্রসঙ্গে একদম শেষে আলোচনা করা যাবে।
এই অবস্থায় তৃতীয় মডারেট পন্থা হল আঞ্চলিক স্বার্থ, প্রাদেশিক ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, সংস্কৃতির ঐক্য প্রতিষ্ঠা। আবার এর মাধ্যমে সংবিধানের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো রক্ষা, আঞ্চলিক স্বার্থের সুরক্ষা, রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতা, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে রাজ্যের ভাগের প্রাপ্য অংশ বৃদ্ধি, কেন্দ্র থেকে চাপিয়ে দেওয়া রাজ্যপাল- কেন্দ্রীয় এজেন্সি- কেন্দ্রীয় সামরিক- আধা সামরিক বাহিনী নিয়োগ, সর্বোপরি কেন্দ্রীয় আইএএস- আইপিএস ক্যাডার গোষ্ঠী, এইসবের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ। এর মাধ্যমে, একদিকে যেমন এককেন্দ্রিক একনায়কের ক্ষমতার বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব, তেমনি বিভিন্ন রাজ্যে আঞ্চলিক শিক্ষা সংস্কৃতি বিকাশ যথাযথভাবে সম্ভব। এভাবেই তো একটি যুক্তরাষ্ট্রীয়, সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রক্ষা করা সম্ভব। এমনকি অঙ্গরাজ্যগুলির প্রত্যেকের সম অধিকার স্বীকৃতির নিদর্শন হিসেবে সমস্ত রাজ্য থেকে রাজ্যসভায় সম সংখ্যার প্রতিনিধিত্ব দাবি করা যেতে পারে। গণতন্ত্রে নির্বাচিত প্রতিনিধিকে ফিরিয়ে নেওয়া অধিকার রাইট টু রিকল দাবি করা যেতে পারে।
ধনখর বা আনন্দ বোসের সাথে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধ কাজিয়ায় হাওয়া না দিয়ে, বরং যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় রাজ্যপাল পদের অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ নিয়ে সরব হওয়া প্রয়োজন। জিএসটি বাবদ বকেয়ার দাবি জানিয়ে অমিত মিত্র বিবৃতি দিলে তা নিয়ে ঠাট্টা মশকরা নয়, কেরলের অর্থমন্ত্রী টমাস আইজ্যাকও কিন্তু বকেয়া জিএসটির ২২ হাজার কোটি টাকা দাবি করেছিল। সেই দাবি নিয়ে সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন। রাজ্যের হাতে অধিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক ক্ষমতা বামপন্থীদেরই এককালের দাবি। বিরোধী মুখ্যমন্ত্রীদের সম্মেলন ডেকে সেই দাবিকে তুলে ধরা, এভাবেই তো সম্ভব একটি বিকল্প ধারার আন্দোলন। কেন্দ্র বিরোধী, বিজেপি বিরোধী শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
সিপিআইএম এই আন্দোলনটি থেকে বহু যোজন দূরে অবস্থান করে। কারণ তার লক্ষ্য বাংলায় ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করা। তাই তাদের প্রধান শত্রু তৃণমূল সরকার, বিজেপি নয়। অতএব সেই কাজে বাংলার বর্তমান তৃণমূল সরকার যত বেশি অসুবিধায় পতিত হবে, ততই তার সুবিধা। এভাবে রাজনীতির প্রতিটি বিষয়কে যদি রাজ্যের ক্ষমতা দখলের একমাত্র উপায় হিসেবে দেখা হয়, তাহলে বিকল্প বাম আন্দোলন সম্ভব হয় না, ক্ষমতা দখলও অধরা থেকে যায়। আমি নিট ও নেট দুর্নীতির বিরোধিতা করতে গিয়ে যে ব্যাপক ঐক্য গড়তে চাইছি, তার মধ্যে বাংলার টেট দুর্নীতিকে কখনোই অঙ্গীভূত করব না। একইভাবে প্যালেস্টাইনের সমর্থনে ইসরাইলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আলোচনা করতে গিয়ে আমি সন্দেশখালিতে শাহজাহানের আগ্রাসন টেনে আনবো না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সিপিআইএম ঠিক সেটাই করে। ঠিক যেমন প্রধানমন্ত্রী মণিপুর নিয়ে বলতে গিয়ে বাংলা মহারাষ্ট্র পাঞ্জাবের কথা টেনে আনেন।
আসলে সমস্যা হল সিপিআইএম যে কোনো আন্দোলনের ইস্যুকেই এই রাজ্যে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠা পাওয়ার লক্ষ্যে পরিচালনা করতে চায়। ছাত্রনেতা সুদীপ্তর মৃত্যু, কামদুনি, ভাঙড় কিংবা আনিস যা কিছুকেই সে টি-টোয়েন্টি খেলার মত ছক্কা হাঁকাতে যায়। বামপন্থী শক্তিকে সংহত করা, সংসদীয় গণতন্ত্র, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ, এগুলিকে মান্যতা দিয়ে নীতিগতভাবে দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যে লড়াই চালাতে হবে। তাৎক্ষণিক ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে নয়।
আজ পশ্চিমবাংলার মানুষ বিজেপি বিরোধী শক্তি হিসেবে তৃণমূলকেই বিশ্বাসযোগ্য দল বলে মনে করছে। যদি বাম শক্তি জিএসটির প্রশ্নে বিজেপির বিরুদ্ধে ধারাবাহিক প্রচার আন্দোলন চালাত, যদি নোট বন্দি- রাফায়েল চুক্তি- তিন কৃষি আইন- এনআরসি- অন্যায় ভাবে গণ কন্ঠকে কারাগারে পাঠানো- এনআইএ ইডি- সিবিআই এর বাড়াবাড়ি ও ব্যবহার এগুলো নিয়ে লড়াই করলে বিজেপি বিরোধী শক্তি হিসেবে বামেদের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়তো। পরিবর্তে বামেরা এসবই তৃণমূল কে এই রাজ্যে দুর্বল করবে ধরে নিয়ে দূর থেকে মজা দেখেছে। মণিপুর নিয়ে বামেরা এরাজ্যে পথে নামে নি। রাজ্য সরকারকে সরাসরি অভিযুক্ত করে যে সমস্ত ইস্যু এসেছে, কেবলমাত্র সেগুলি নিয়েই বামেরা পথে নেমেছে ভাবা যায় কেরলে আরএসপি প্রার্থী কংগ্রেসের সমর্থনে জয়ী হওয়ার কারণে তাকে বাম প্রার্থী হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না কোন নিয়মে? তাহলে তো মহম্মদ সেলিমও বাম প্রার্থী নন। ইন্দোরে বিজেপির কৌশলে কংগ্রেস প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল হল। ওই কেন্দ্রে কেন এসইউসির প্রার্থীকে ইন্ডিয়া জোটের সকলে মিলে সমর্থন করা হলো না। এমনকি সেখানে যদি অন্য যে কোন প্রার্থী থাকে, বিজেপির বিরুদ্ধে তাকেই সমর্থন জানানো উচিত ছিল।
বামেরা নির্বাচনকে একটা কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু কার্যত মধ্যবিত্ত এলিট নেতৃত্বের হাতে পড়ে পার্লামেন্ট সর্বস্ব রাজনীতির কবলে পড়েছে। এখন তারা প্রতিটি পদক্ষেপে ভোটে কতটা লাভ লোকসান হবে তার বিচার করে। এটাকেই তো পার্লামেন্টারি ক্রেটিনিজম বলা হয়। অথচ এই পার্লামেন্টারি ক্রেটিনিজম নিয়ে সতর্ক থাকার কথা পার্টি কর্মসূচিতে বলা আছে। আমরা যারা বামপন্থীরা সংসদীয় গণতন্ত্রটাকে ব্যবহার করব বলে ভেবেছিলাম, ভেবেছিলাম এটায় অংশগ্রহণ করে এই গণতন্ত্রের অসাড়তা প্রমাণ করব। বাস্তবে শেষ পর্যন্ত আমরাই এটার একান্ত অন্ধ ভক্ত হয়ে পড়েছি। চরম রক্ষণশীল বুর্জোয়া দলগুলি বরং এটাকে ব্যবহার করেই নিজের অভীষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে। ১৯৭৭ এর পর জমি দখলের লড়াই শিকেয় তুলেছি, সরকার ভেঙে যাবে এই আশঙ্কায়। অথচ সরকার ভাঙবে কি থাকবে তার পরোয়া না করে বিজেপি মসজিদ ভাঙতে দ্বিধা দেখায়নি। এমনকি কল্যাণ সিংয়ের সরকারকে ভেঙে দেওয়ার পরেও তারা দ্বিধাগ্রস্ত নয়। পার্লামেন্টকে ব্যবহার করার বামপন্থী কৌশলেই কোন ত্রুটি বিচ্যুতি আছে কিনা ভাবা দরকার।
পা জোড়া বেঁধে, উল্টো করে ঝুলিয়ে মারবো ..... চুনাওকে বাদ, এক এক করকে, চুন চুন কে মারুঙ্গা .... হাসপাতালে বেড বুক করে আসবেন, কারণ পরে আর জায়গা পাওয়া যাবে না ...... এমন মারব যে মলম লাগানোর জায়গা থাকবে না ..... সিআরপিকে বলবো বুক লক্ষ্য করে গুলি করতে ..... কেন্দ্রীয় বাহিনী এসে যাবে, আর তারপর সন্ধ্যের পর সব তৃণমূল ঘরে ঢুকে যাবে। একটাকেও কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না ..... ভোটের পর জামাকাপড় খুলে বাড়ি পাঠিয়ে দেবো ...... এইসব উক্তিগুলো মনে পড়ছে? এগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিভিন্ন জায়গায় কখনো নরেন্দ্র মোদি কখনো অমিত শাহ, কখনো বা দিলীপ ঘোষ, শুভেন্দু অধিকারী, সুকান্ত মজুমদারদের দেওয়া। রেখা পাত্র তো ভোটের দিন দলীয় কর্মীদের সোজাসুজি বলল আয়, দড়ি আন। এটাকে বাঁধ। জামাকাপড় খুলে পাঠিয়ে দেবো। উক্তিটি করা হয়েছিল একজন উচ্চপদস্থ মহিলা পুলিশ আধিকারিককে লক্ষ্য করে। আবার আহ্লাদের আতিশয্যে ও ধমকানি চমকানির বাড়াবাড়িতে অমিত শাহ শ্রীরামপুরে বললেন, শ্রীরামপুরে যদি আমরা ভোটে জিতি, সীমান্ত দিয়ে একটা পরিন্দাও অনুপ্রবেশ করতে পারবে না। বোধহয় উনি শ্রীরামপুর কে সীমান্ত অঞ্চল ভেবেছিলেন।
এই কথাগুলো মনে করাতে হলো, কারণ ইদানিং একটা প্রবল আওয়াজ তুলেছে আদালত থেকে শুরু করে রাজ্যপাল, কেন্দ্রের সরকার, বিজেপির সংসদীয় দল, সকলে -- বাংলায় নির্বাচন পরবর্তী এত সন্ত্রাস কেন হয়? বামপন্থীরাও এই একই প্রশ্নে চিন্তিত। বিজেপির সাথে স্বর ও সুর একাকার। বামপন্থীরা একবারও বলবেনা যে প্রাক নির্বাচনী ঘৃণা ভাষণ, নির্বাচন পরবর্তী সন্ত্রাসের অন্যতম একটি কারণ? নির্বাচন পরবর্তী প্রায় এক ডজন গুজব ছড়ানো, গণ পিটুনি ও প্রার্থনাশের ঘটনা যেভাবে নিয়মিতভাবে ঘটছে, তাতে স্পষ্ট একটা পরিকল্পনার ছাপ আছে। এমনকি চোপড়ার বিশেষ একটি ঘটনাকে নির্দিষ্ট করে রাজ্যপাল, মানবাধিকার কমিশন, প্রশাসনের কাছে রিপোর্ট তলব করছে। বোঝাই যাচ্ছে, রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা, অর্থনীতির কাঠামো ভেঙে পড়া, এসব নিয়ে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপের একটা পটভূমি তৈরীর চেষ্টা চলছে। বামপন্থীরা কি এই ঘটনায় বাংলায় তৃণমূলের বিড়ম্বনায় পুলকিত হবে? নাকি কেন্দ্রের অন্যায় হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করবে। এগুলোর মধ্য দিয়েই তো বামেরা প্রধান বিজেপি বিরোধী হিসেবে বিশ্বাসযোগ্য হয়েও উঠবে।
আসল মোদ্দা কথাটা হলো ক্ষমতার বাইরে থাকা একটা দল যখন ডাঙ্গায় তোলা মাছের অবস্থা হয়, সেই দলটাকে বামপন্থী বলা কতটা যুক্তিসঙ্গত তারা উচিত। টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলবে, কত তাড়াতাড়ি ক্ষমতায় ফিরে আসা যায় তার সুযোগ খুঁজবেই। কিন্তু ক্ষমতা বৃত্তের বাইরে যে বাম, তাকে দীর্ঘস্থায়ী পাঁচ দিনের টেস্ট ম্যাচ খেলার কথা ভাবতে হবে। অনেক সুপরিকল্পিত, তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নয়। কেরাম বোর্ডে আমাদের এক সিনিয়র দাদা বলতেন, ডাবল টাচ শট্ নেওয়ার সুযোগ থাকলে ও দরকার থাকলে সেটা নাও। কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই সিঙ্গল গুটি খেলার অভ্যেস থাকা চাই । কারণ তাহলে হাতের সাজানো বোর্ডটা ঘেঁটে যায় না। আশার কথা, খবরে দেখলাম, পার্লামেন্টে ইন্ডিয়া জোটের সদস্যরা অরবিন্দ কেজরিওয়াল মণীশ সিসোদিয়ার সঙ্গে পশ্চিমবাংলার তিন মন্ত্রীর অন্যায় গ্রেফতারি কে প্রতিবাদ জানিয়েছে। শুধু দিল্লি নয় বাংলাতেও রাস্তায় নেমে এই প্রতিবাদ করতে হবে।
শ্রমিক শ্রেণি র পার্টি গঠনের বিষয়ে আমার একটা গোঁড়ামি আছে। আমি বিশ্বাস করি একটা টেক্সটের বহুমুখী ব্যাখ্যা হতে পারে। কে সেটা ব্যাখ্যা করছে তার ওপর বহু কিছু নির্ভরশীল। তিতুমিরের বিদ্রোহ তো কোন বিপ্লবী দর্শন ছিল না, বিশুদ্ধ একটি মৌলবাদী ধর্মীয় দর্শন তারিখ ই মহম্মদিয়া। কিন্তু তাকে ব্যাখ্যা করেছিল নিম্নতম বর্গের ভূমিহীন মজুর জোলা হস্তশিল্পী লেঠেল কুস্তিগীর এই সম্প্রদায়। ফলে সেই মৌলবাদী দর্শন অপবর্গের ব্যাখ্যায় একটি বিদ্রোহের দর্শনে পরিণত হয়েছিল। তাই পার্টিতে কোন শ্রেণির আধিপত্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আসলে আমার একটা নিজের বিশ্বাস ও ধারণা কাজ করে, ব্যক্তির উপর। একজন ফুটবল কোচ অসাধারণ দক্ষ ও কুশলী হতেই পারেন, কিন্তু তার খেলোয়াড় যদি মেসি, এমবাপে, রোনান্ডো, না হন, তাহলে হাজার কৌশল মাঠে নেমে প্রতিপক্ষের কৌশলের সামনে ব্যর্থ হতে বাধ্য। কথাটা হল দক্ষ কোচ কিছু তথ্য কৌশল পজিশনিং পজেশনিং শেখাতে পারে। কিন্তু সেগুলিকে মাঠে নেমে যথা সময়ে এক্সিকিউশন করে খেলোয়াড় নিজে। খেলোয়াড়ের ওপর নির্ভর করে কোচের শিক্ষার তাৎক্ষণিক প্রয়োগ। ঠিক তেমনি বিপ্লবী তত্ত্বকথা থাকে পুঁথির পাতায়, তার বাস্তবায়ন করতে হবে ফিজিক্যালি ময়দানে। ফলে কে সেটা করছে সে প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ। একটি শ্রমিক শ্রেণি র বিপ্লবী তত্ত্ব যদি মধ্যবিত্ত এলিটের হাতে পড়ে সেটা অ্যাডভেঞ্চারিজমের লাইনে চালিত হতে পারে, আবার সেই তত্ত্বের সর্বনাশ ঘটিয়ে সংসদ সর্বস্ব সহজপথে চালিত হতে পারে। কারণ এলিট এককভাবে কাজ করতে অভ্যস্ত।
একইভাবে বিপরীতটাও সত্য। ১৮৭১ সালের প্যারিস কমিউন একটি ভ্রান্ত পথে ক্ষমতা দখল। কার্ল মার্কস এর কথায় "হতাশার মূর্খতা"। কিন্তু শ্রেণি চরিত্রটি ছিল শ্রমিক শ্রেণির, ফলে সংসদের মধ্যেই বহু বিপ্লবী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হয়েছিল। ভারতের ইতিহাসে ১৯৪২ এর দেশব্যাপী ভারতছাড়ো অভ্যুত্থানে কমিউনিস্ট পার্টির ঘোষিত নীতি ছিল আন্দোলনের বিরোধিতা। তারা ব্রিটিশ যুদ্ধ প্রয়াসকে কোন আন্দোলন দিয়ে বিব্রত করতে, বাধা সৃষ্টি করতে চায়নি। অথচ সারা দেশের বহু কমিউনিস্ট নেতা ও কর্মী, বহু কৃষক সভার কর্মী, এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। এমনকি নেতৃত্ব দিয়েছিল। "ইন্ডিয়ান নেশন ১৯৪২" গ্রন্থে অধ্যাপক জ্ঞানেন্দ্র পান্ডে, হিতেশ রঞ্জন সান্যাল প্রমুখরা দেখিয়েছেন, অসংখ্য কমিউনিস্ট ও কৃষক সভার কর্মী পার্টির ঘোষিত ও গৃহীত ভুল লাইনের বিরোধিতা করে, অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিল। আসলে বিপ্লবী তো সুকুমার রায়ের "এই দেখো নোটবুক পেন্সিল এ হাতে" করে চলে না। "পাগলা ষাঁড়ে করলে তাড়া, কেমন করে ঠেকাবো তায়" নোট বই খোঁজে না। সে বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিকে নিজের অবস্থান অভিজ্ঞতা দিয়ে বিশ্লেষণ করে, নিজ সামর্থের বিচার করে, তারপর সিদ্ধান্ত নেয় । তাই অ-বিপ্লবী তত্ত্বও সঠিক শ্রেণি র হাতে পড়ে বিপ্লবী অভ্যুত্থান ঘটাতে পারে। তা না হলে খৃষ্টীয় আদর্শ, ইসলামী আদর্শ কৃষক অভ্যুত্থান ঘটাতে পারে। এমনকি গান্ধীজীর অহিংস অসহযোগ আইন অমান্য আন্দোলন, শ্রমিক শ্রেণি র হাতে শোলাপুরে, আমেদাবাদে, জামশেদপুরে, সশস্ত্র অভ্যুত্থানে পরিণত হয়েছিল। কৃষকের হাতে চৌরিচৌরায় সশস্ত্র হিংসাত্মক অভ্যুত্থানে পরিণত হয়। তাই দল পরিচালনা, কর্মসূচি ব্যাখ্যা করার জন্য শ্রমিক শ্রেণি র পার্টির আবশ্যকতা জরুরী শর্ত।
আমি আন্তরিকভাবে, একজন ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে আজও বিশ্বাস করি যে, নেতারা কিছু প্রস্তাব করেন মাত্র। কিন্তু প্রস্তাবনাকে বাস্তবায়ন করে জনগণ তার নিজস্ব কায়দায়। না সরকার না বিরোধী কেউ তা টের পায় না। এ প্রসঙ্গে একটা গল্প দিয়ে শেষ করি :
গল্পের নায়ক ফিলিপ, রাষ্ট্রের গোয়েন্দা বিভাগের উচ্চপদস্থ অফিসার। তিনি কতগুলি সংখ্যা পেয়েছেন, মানে তার হাতে এসেছে, একটি কাগজে হাতে লেখা। সংখ্যাগুলো বিশেষ বিশেষ সালকে নির্দিষ্ট করেছে। আরো উল্লেখযোগ্য যে ওই প্রতিটি সাল ইতিহাসে ওই দেশে এক একটা বিদ্রোহের বর্ষ ছিল। এখানেও সমস্যা নয় । সমস্যা হলো শেষ সালটি হলো চলতি বছরের পরের বছর। বলা ভালো আগামী বছরের উল্লেখ আছে এই তালিকায়। অর্থাৎ এটা কোন গোপন গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ড যারা আগামী বৎসর একটি বিদ্রোহের পরিকল্পনা করছে, সরকারকে একটা সূত্রের ঢঙে হুমকি পাঠিয়েছে। রাষ্ট্র পুলিশ প্রশাসন সেনাবাহিনী সকলেই ভয়ংকর ভাবে তৎপর। যে কোনো মূল্যে এর উৎস খুঁজতে হবে ও আসন্ন বিদ্রোহ সম্ভাবনাকে নির্মূল করতে হবে। কথাটি শুধু সরকারি প্রশাসনের অভ্যন্তরেই চাপা থাকে নি, গোপন কথাটি গোপন থাকেনি। দেশের সাধারণ মানুষও জেনে গেছে যে, আগামী বছর হবে বিদ্রোহের বছর, একটা পরিবর্তন ঘটতে চলেছে।
সে যাই হোক সরকারের পক্ষে বিদ্রোহ প্রতিহত করার কোন ব্যবস্থায় খামতি রাখেনি। যে কোন মূল্যে বিদ্রোহ রুখতে হবে। গোয়েন্দা দপ্তরের কর্তা ব্যক্তি ফিলিপ, এই গল্পের নায়কটি খুবই ব্যস্ত। নাওয়া খাওয়া ভুলে দপ্তরে দিনরাত পড়ে আছে। কিন্তু এত চেষ্টা করেও গুপ্ত সংগঠনটির কোন হদিস পাওয়া যায়নি এবং কেন ওভাবে ওই সালগুলি নির্দিষ্ট করে পাঠানো হয়েছে কাগজে লিখে তাও বোঝা যায় নি। এটা প্রচ্ছন্ন হুমকি। এমতাবস্থায় একদিন নায়কের স্ত্রী লিজা বাড়িতে তার প্রয়োজনের একটি কাগজ কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও দরকারী কাগজটা খুঁজে পাচ্ছে না। হ্যাঁ, সেই কাগজ, যেখানে সে লন্ড্রির বিল নাম্বারটি লিখে রাখে নিয়মিত। সে স্বামী ফিলিপকে জিজ্ঞেস করে আমার প্রয়োজনের একটা কাগজ লন্ড্রির বিল নম্বর লেখা, সে কাগজটা কোথাও দেখেছো কি? ফিলিপ শুনে অবাক হয়ে যায়। ওগুলো কতগুলো সালের উল্লেখ নয়, ওগুলো লন্ড্রির বিলের নম্বর! কি আশ্চর্য! আর এই নিয়ে গোটা রাষ্ট্র গোয়েন্দা দপ্তর তৎপর! যাই হোক, ফিলিপ গোয়েন্দা দপ্তরে সবটা জানায়। সরকার আর প্রকৃত সত্যটি বাইরে প্রকাশ করেনি। বরং বিদ্রোহ প্রচেষ্টা ব্যর্থ করার কৃতিত্ব অর্জন করার সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় নি। পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনার বেশি, ষোলো আনা প্রাপ্তি। সরকারের মূর্খামি সম্পূর্ণ চেপে যায়। মনে মনে হাফ ছেড়ে বাঁচে। যাক বাবা কোন বিদ্রোহের সম্ভাবনা নেই।
আশ্চর্যের ব্যাপার হলো রাষ্ট্রপ্রশাসন কিছুটা হাফ ছাড়লেও, ততদিনে দেশের মানুষের ভেতর এই বিশ্বাস জন্মেছিল যে, আগামী বছর হবে বিপ্লবের বছর। বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছিল, কারণ মানুষ পরিবর্তন চাইছিল। ফলে পরের বছর দেশব্যাপী একটা অভ্যুত্থান ঘটেছিল। কোন তত্ত্ব কথার জোরে নয়, বিশ্বাসের জোরে, ইচ্ছা আকাঙ্খা, ইমানের জোরে। এই জোরটাই প্রধান শর্ত, বাঁচার মতো মন চাইতো।