সন্তান জানে না তার প্রকৃত বাবা কে? একমাত্র তাদের মায়েরাই পারবেন এই প্রশ্নের উওর দিতে। তবে এখানে মায়ের পক্ষে তাদের সন্তানদের পিতা কে? তা না জানাই স্বাভাবিক। আর এতে কোন কলঙ্কও নেই। কারণ, এই মায়েদের কাছে রয়েছে একাধিক পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হওয়ার সুযোগ। এটাই তাদের সমাজের প্রচলিত রীতি। এই মায়েদের সন্তান হেসে খেলে বেড়ে ওঠে মামা, মাসি, মা দিদিমার সঙ্গে। অর্থাৎ মামা বাড়িতে। দিদিমা- ই সেই সংসারের শেষকথা। সেখানে বাবা, কাকা, পিসি, ঠাকুমার কোন জায়গা নেই। বাচ্চার সারাদিনের দেখভাল থেকে শুরু করে জীবনকে সুন্দর করে গড়ে তোলা - সবটার দ্বায়িত্ব মামার, বাবার নয়। সন্তানরা তাদের বাবা কে জানলেও তারা বাবার থেকে দূরে। এতক্ষন যাদের কথা হল তাঁরা হলেন ‘মসুও’ উপজাতির মানুষ। এরা পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন মাতৃতান্ত্রিক সম্প্রদায়। দক্ষিণ পশ্চিম চীনের ইউনান প্রদেশে পাহাড়ের প্রায় ৩ হাজার মিটার উচ্চতায় হিমালয়ের কোলে 'লুগু লেক' এর চারপাশে এঁদের বাস। পৃথিবীতে এদের সংখ্যা মাত্র ৫০, ০০০। এঁদের সমাজে নারী - ই সর্বেসর্বা। এ এক অভিনব সাম্রাজ্য। যে সমাজে পুরুষরা গৌণ। এখানে পুরুষের প্রয়োজন শুধু বংশ বৃদ্ধিতে।
চু ওয়াই হং তাঁর “দ্য কিংডম অফ উইমেন” নামের বই- এ খুব সুন্দর করে মসুও উপজাতিদের জীবন- জীবিকা, তাদের ভালোবাসা, ঈশ্বর বিশ্বাস সমস্তটা বর্ণনা করেছেন। মসুও সমাজে নারী ও পুরুষের কী ভূমিকা তাও তিনি বলেছেন। যা তিনি নিজে তাঁদের সঙ্গে বাস করে প্রত্যক্ষ করেছেন। অনুভব করেছেন তাদের সুখ দুঃখ, হাসি কান্না। সামনে থেকে দেখেছেন তাদের বেঁচে থাকার লড়াই। চু ওয়াই হং একজন প্রবাসী আইনজীবি। চীন তাঁর পূর্বপুরুষের দেশ। তিনি শহুরে ব্যস্ত জীবন থেকে মুক্তি পেতে নিজের পূর্বপুরুষের দেশ চীনে বেড়াতে যান। সেই সময় তিনি লক্ষ্য করেন পাহাড়ের কোলে ঝাউবনে ঘেরা সুন্দর এক পাহাড়ি হ্রদ। পর্যটকদের আনাগোনা প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে বাইরের মানুষের প্রভাব এখানে নেই। সব মিলিয়ে ওখানকার নির্জনতা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের প্রেমে পড়ে ওখানেই অস্থানা গাড়েন চু ওয়াই হং। খুঁজে পান ওই অঞ্চলের পাহাড়ি বাসিন্দা বিচ্ছিন্ন সম্প্রদায়ের মসুও উপজাতিকে। ভালোবেসে ফেলেন তাঁদের জীবনযাত্রাকে।
মসুও উপজাতি প্রাচীন সম্প্রদায়ভুক্ত ছোট্ট একটা জনপদ। মূলত স্বনির্ভর। কৃষিকাজ যাদের মূল জীবিকা। এঁদের জীবন আবর্তিত হয় কঠোর ধর্মবিশ্বাস আর বিশেষ এক সংস্কৃতিকে ঘিরে। ভাবলে অবাক লাগে পিতা ছাড়া একটি সমাজ! যেখানে বিবাহ নেই অথচ সন্তান আছে। এঁরা একক পরিবারের পরিবর্তে যৌথ পরিবারে বিশ্বাসী। শুধু তাই নয় যে বাড়িতে তাঁরা থাকেন সেখানে তাঁদের কয়েক প্রজন্মের বাস। পরিবারের মাথায় থাকেন ‘গ্র্যান্ড মাদার’। অর্থাৎ এঁদের সমাজে মাতামহী সবচেয়ে ক্ষমতাশালী। যেহেতু মসুওদের সমাজ মাতৃতান্ত্রিক তাই তাঁদের শরীরে প্রবাহিত হয় সংসারের যিনি কর্ত্রী তাঁর রক্ত। মসুও সমাজে কন্যাদের সন্তানরাই পরিবারে থাকবে - এটাই নিয়ম। চলতি কথায় বলা যায় বাচ্চারা মামা বাড়িতে বেড়ে ওঠবে। এখানে ভাগ্নে ভাগ্নিদের মসুও সংস্কৃতিতে বড় করে তোলার দায়িত্ব বর্তায় মামার উপর । সেই বাচ্চাদের শিক্ষা, জীবনযাপন, মূল্যবোধ সবকিছু যথাযথভাবে শেখানোর ভার মামার – ই, বাবার নয়। মসুও সমাজে পুরুষরা অনেকটা ‘স্পার্ম ডোনার’ বা শুক্রাণু দাতা। এঁরা মহিলাদের গর্ভ সঞ্চারণ করলেও সেই সন্তানের লালন-পালনে খুব একটা ভূমিকা পালন করেন না।
“দ্য কিংডম অফ উইমেন” বইতে চু ওয়াই হং এও বলছেন নারীরা মসুও সমাজে দারুণ ক্ষমতাশালী। এঁরা আত্মবিশ্বাসে যেন টগবগ করছে! এই আত্মবিশ্বাস তাঁদের সহজাত যা অন্যান্য সমাজের নারীদের মধ্যে সচরাচর দেখা যায় না। এঁরা খুব একটা শিক্ষিত নয়, তবে জীবনধারণের সমস্ত কাজ নিজেরাই করে নেয়। পারিবারিক চাষবাস থেকে পশুপালন সবটা মসুও মহিলারা সামলায়। এমন কী জ্বালানির কাঠটুকুও তাঁরাই সংগ্রহ করেন। ঘর পরিষ্কার, রান্না করা এবং চরকা কাটা সহ- ঘরের সমস্ত কাজ মসুও মহিলার নিজে হাতে সামলায়। তবে অতীতে যোগাযোগের অভাবে মসুও মহিলারা তাদের সমস্ত গৃহস্থালির সামগ্রী নিজেরাই উৎপাদন করত। ইদানিং, যোগাযোগ বৃদ্ধির ফলে আশেপাশের গ্রাম এবং শহর থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসের অনেকটাই তাঁরা জোগাড় করে নিচ্ছেন।
উল্টোদিকে, মসুও সমাজে পুরুষদের তেমন কোনো কাজ নেই। শুধুমাত্র বোনের সন্তান লালন-পালন ও পশু শিকার। ফলে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষরা দিনের বেলায় গ্রামের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ায় এবং নারীদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। প্রত্যাশায় থাকে রাতে যদি কোনও নারির ডাক আসে।
তবে, মসুও সমাজে মহিলাদের জীবনে পুরুষের আগমন, সেটাও বেশ চমকপ্রদ। মসুও মেয়েদের বয়স তেরো বছর পেরোলে তারা নিজেরাই নিজেদের পছন্দের পুরুষ সঙ্গী নির্বাচন করতে পারে। পুরুষ সঙ্গীটি মেয়ের বাড়িতেই এক বা একাধিকবার রাত্রিযাপন করতে পারে তবে সবটাই মেয়ের ইচ্ছানুযায়ী। কিন্তু দিনের আলো ফুটলে ছেলেটিকে নিজের বাড়িতে ফিরে যেতে হয়। যে ঘরে রাত্রিযাপন করে, মিলিত হন একে অপরের সঙ্গে, তাকে ‘ফ্লাওয়ার রুম’ বলে। মসুও সমাজে পুরুষ-নারীর সম্পর্ক তত দিনই স্থায়ী হয় যত দিন পর্যন্ত ওই নির্বাচিত পুরুষ সঙ্গীটিকে মেয়েটি পছন্দ করবে। এখানে কেউই কারও উপর কোনও জোর খাটান না। একজন মসুও মহিলা চাইলে একাধিক পুরুষ সঙ্গী নির্বাচন করতে পারেন। অন্তঃসত্তা মসুও মহিলার ভবিষ্যত শিশুটি বেড়ে ওঠবে তার মায়ের কাছেই, তার ‘মামার বাড়ি’তে ফলে মসুও দের সন্তানের পিতৃ পরিচয়ের কোনও প্রয়োজন পড়ে না।
ধর্ম মসুও জীবনের একটি প্রধান অংশ। ‘গামু’ হলেন মসুওদের দেবী। পাহাড়ের মাথায় তার মন্দির। মসুও নারীদের বিশ্বাস দেবী গামুই তাঁদের সবদিক থেকে রক্ষা করেন। তাঁদের আরও বিশ্বাস, নাচ, গান, মদ্যপান এবং বহুগামিতা দেবীর খুব পছন্দের। তাই এই দেবীকেই মসুও নারীরা অনুসরণ করে। মসুও নারীরা বলেন - দেবীর মত তাঁদের জীবনেও একাধিক পুরুষসঙ্গীর প্রয়োজন। তাঁরা একজনের সাথে আটকে থাকতে চায় না। দেবীর উৎসব উদযাপনের সময় -"মসুও নারীরা তাদের প্রথাগত উজ্জ্বল সাজপোশাক পরেন। খুব মজা করে নাচ-গান করে, আগুন জ্বালিয়ে খাবার বানায়। আর গামু দেবীর সামনে ধূপ জ্বালানোর জন্য সবাই কষ্ট করে পাহাড় ভেঙে উপরে উঠেন। মসুও দের ধর্মীয় বিশ্বাসে ডাবা এবং তিব্বতীয় বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব পরিষ্কার।
মসুও সমাজে নারীদের প্রতি পুরুষের সম্মানবোধ নজর কাড়ার মতন। মসুও পুরুষরা ছোটবেলা থেকেই এই সম্মানবোধ নিয়েই বেড়ে ওঠে। তাই তাঁরা নারীদের সম্মান করতে শেখে।এই সুন্দর জীবন দর্শন লেখককে মুগ্ধ করেছে। তিনি তাঁর নিজের কর্ম জীবনে দেখেছেন আধুনিক সমাজে, পুরুষ সহকর্মীদের মধ্যে কোনো মহিলার নিজের মতামত প্রতিষ্ঠা করা কতটা কঠিন! সেই দিক থেকে বিচার করলে মসুও সমাজ একটা বিরল দৃষ্টান্ত।যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় মেয়েরা লাঞ্ছিত, নিপীড়িত। তার নিরিখে দেখলে মসুও উপজাতিদের সমাজ নিঃসন্দেহে একটি ব্যতিক্রমী সমাজ ব্যবস্থার উদাহরণ।
পুরুষ প্রধান দুনিয়ায় পুরুষরা নারীদের প্রতি যে আচরণ করে, তাঁদের যে চোখে দেখে, মসুও সমাজ নারীপ্রধান হলেও নারীরা কিন্তু পুরুষদের সেই ভাবে দেখে না। তাঁরা পুরুষের ওপর প্রভুত্ব করে না। পুরুষদের কুকথা বলে না। তাদের প্রতি মসুও নারীরা খুবই মমতাশীল। পুরুষরাও মসুও সমাজে কখনো নিজেদের অবহেলিত বলে মনে করে না। তাঁদের সমাজে নারী ও পুরুষের মধ্যে একটা সাম্য রয়েছে। সেটাও চু ওয়াই হং লেখায় পাওয়া গেছে।
আধুনিক প্রগতিশীল, নারীবাদী বিশ্বে কালব্যতিক্রমী এই ‘মাতৃতন্ত্র’ - বছরের পর বছর ধরে ‘সিঙ্গল মাদার’ বা একক মাতৃত্বের অধিকারকেই প্রাধান্য দিয়ে আসছে। যা আধুনিকতার চূড়ান্ত চেহারাকে তুলে ধরে। বর্তমানে, মসুও এলাকায় পর্যটকের সংখ্যা বেড়েছে। ফলে তাঁরা এখন চীনের আধুনিক জীবনধারার সাথে পরিচিত হবার সুযোগও পাচ্ছেন। নিজেদের ভাবনায় পরিবর্তন আনছেন। একজন জীবনসঙ্গীর সাথে ঘর বাঁধার যে ধারণা সেই দিকে মসুও নারীদের অনেকেই ঝুঁকতে চাইছেন। সাধারণ সমাজে নারীর সম্পর্কে পুরুষের যে প্রচলিত ধ্যানধারণা রয়েছে প্রাচীন এই মসুও সমাজ তার অনেক কিছুকেই চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে। মসুওদের জীবন নিয়ে চু ওয়াই হং লেখা বইয়ে সবচেয়ে মূল্যবান ও শিক্ষণীয় কথা হল, মাতৃতান্ত্রিক একটা সমাজ কতটা সুশৃঙ্খল ও কার্যকর হতে পারে মসুও সমাজ তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।