পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

ইমাম রশিদির গুনাহ

  • 18 September, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 1172 view(s)
  • লিখেছেন : সৌরভ হোসেন
হুলুস্থুল তখন রাস্তা থেকে দরজায় ঠকঠক করছে। ফিসফিস ফুসুরফুসুর। অতকিছু কান করেনি মিরাজ। বাপ তাবারকও নিষেধ করেনি। এ মফসসল শহরে পিড়ির পিড়ি জন্মে বেঁচেবর্তে খেয়ে-পরে আবার মরে ভূত হয়ে গেল, সেই শহরকে কেন সে নিজের থেকে লুকিয়ে নেবে? পড়শি তো আপনই। পড়শির ইট-কাঠ-পাথরও আপন। এত বড় জীবনে দুটো তো কাল। ইহকাল আর পরকাল। সেই ইহকালে পেটের ভাত জোগাচ্ছে যে শহর সে শহর কি কখনও দুশমন হয়?

এই শহরের মানুষগুলোর জন্যে কতদিন দোয়া চেয়েছে আল্লাহর কাছে তাবারক। তাবারক ফজরের নামাজ শেষে মসজিদের গেট দিয়ে যখন এই শহরের রাস্তা দিয়ে হাঁটে তখন পাশাপাশি রসুল কাশেম আশিস নিমাইদের বাড়ি দেখে তার বুকটা গর্বে ফুলে ওঠে। নূরানি মসজিদের ইমাম তাবারক রশিদি তখন আসমানের ফেরেশতাদের ডেকে বলে, হে আল্লাহর ফেরেশতারা, তোমরা দেখে যাও আমার শহরে কীভাবে কাঁধে কাঁধ মিলে হিন্দু-মুসলমান বাস করছে। তোমাদের বেহেশতে কি এমন সৌন্দর্য আছে?

সেই সৌন্দর্যে যে এত বিষ কোথা থেকে ঢুকেছিল তা ঠাহর করতে পারেনি তাবারক। ঠাহর করতে পারেনি মিরাজও। তাই সে সাহস করেই অখিলদের মহল্লায় গিয়েছিল। যাওয়ার হেতু অত আহামরি কিছু ছিল না। অখিলকে ইদের দাওয়াত দেওয়া। মিরাজের মায়ের হাতের পায়েস সিমাই না খেলে তার নাকি জান ভরে না। সঙ্গে পোলাও বিরিয়ানি। সেদিন মিরাজের সামনে ওরা খিলখিল করে হেসেছিল। তবে সে হাসির মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন হেঁয়ালি ছিল। সে হেঁয়ালি বুঝতে পেরেছিল ‘আলিম’ পাশ মিরাজ। পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চেয়েছিল। উচ্চিংড়ে ছেলেগুলোর আচরণ তার ভালো ঠেকছিল না। এমন করে তিড়িং বিড়িং করে লাফাচ্ছিল যেন মনে হচ্ছিল মাদারি খেলার বাঁদর। মিরাজকে খুব সহজেই তারা তাদের শত্রু হিসেবে চিনতে পেরেছিল। মিরাজের মাথার ফেজ টুপি আর মুখের সুন্নত দাড়ি। কপালের নামাজ পড়ার কালো-খয়েরি ঘটাটাও হয়ত কারও কারও চোখে পড়েছিল। আরও অনেক চিহ্নত চোখে পড়েছিল তাদের। যেমন মিরাজের পায়ের গুল্লের ওপরে ঝুলে থাকা পাজামা, চাঁছা গোঁফ, কানের লতিতে গোঁজা আতরের ঘ্রাণ, চোখের সুরমা। চিনতে বাকি ছিল শুধু, মিরাজের সুন্নতটা। মিরাজ আশঙ্কা করেছিল সেটা জানার জন্যেও হয়ত কেউ হুট করে বলে বসবে, ‘বেটার পাজামা খুলে দেখ, বেটা কাটার জাত কি না?’ না সে পর্যন্ত হাত আসেনি কারও। তার আগেই ‘বুলি’ বলানোটা শুরু হয়ে গেছিল। মিরাজের একটাই দোষ সে তাদের শিখিয়ে দেওয়া ‘বুলিটা’ বলেনি। উল্টে ‘তওবা’ করেছিল বারবার। আর তাতেই ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো ক্ষেপে উঠেছিল রামভক্ত ছেলেগুলো। ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনিতে মহল্লাটা তেতে উঠছিল। বাড়ির দরজা-জানালা বন্ধ করার ধুপধাপ শব্দও ভেসে আসছিল কানে। আর বেশি কিছু শব্দ শোনা যায়নি। শুধু গদ্দনটা কেটে পড়ার আগে মিরাজ একবার জোড় গলায় ‘বাপ গো, আল্লাহ গো’ বলেছিল। আর রামভক্ত ছেলেরা হনুমানের মতো ড্যাং ড্যাং করে লাফিয়েছিল মিরাজের লাশের ওপরে। তাদের মধ্যে দেখা গেছিল একজনকে দাঁত বের করে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসতে। তার মুখের ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি-গোঁফ, পরনের খদ্দর-পাঞ্জাবি আর রিমলেশ চশমার আড়ালের কুতকুতে চোখ ভিলেনের মতো ছুকছুক করছিল।

তখন রাত নামাজের কাতারে নামা তো দূরের কথা মসজিদের মিনারেই নামেনি। শিবমন্দিরের ঘণ্টাটা সদ্য বেজেছিল। আর মোয়াজ্জিন শমসের আলি মাগরিবের আযান দেওয়ার জন্যে কেবলই ওজুর পানি ভরছিল বদনায়। পশ্চিম দিগন্ত কান পেতে শুনছিল ডুবন্ত সূর্যের দিন ফুরোনোর গল্প। সে গল্পে খুশির সঙ্গে সঙ্গে বেদনাও যে ছিল তা আকাশের গায়ের রক্তের রঙ দেখে বোঝা যাচ্ছিল। এই নামতি সন্ধ্যায় ঘটনাটা ঘটেছিল। খবর ঝড়ের গতিতে ছড়িয়ে পড়েছিল। চারিধারে মার মার কাট কাট রব। হিন্দু মহল্লার মুসলমান আর মুসলমান মহল্লার হিন্দুদের তখন ভয়ে ধরে জান নেই। শহর জুড়ে দাউ দাউ করছে দাঙ্গার আগুন। এ আগুন কখন যে কার গায়ে লাগবে কেউ বলতে পারছিল না। তাবারক তখন দুনিয়াদারির চিন্তা দূরে সরিয়ে রেখে নামাজে দাঁড়িয়ে গেছিল। ফরজ নামাজ শেষ করে সুন্নত, সুন্নত শেষ করে নফল নামাজ আদায় করছিল। তসবিহ গোনা শেষ হলে আল্লাহর কাছে দু হাত তুলে করছিল মোনাজাত। পরকালের জাহান্নামের আগুন থেকে যেন সে আর তার পরিবার রেহাই পায় তার দোয়া মাঙ্গছিল খোদার কাছে। ছেলে মিরাজের জন্যে আল্লাহর কাছে ফরমাইশ করছিল, ছেলে যেন ইমানদার নেক বান্দা হয়ে ওঠে। ‘বে রাহমোতিকা ইয়া রাহমানের রাহিম’ বলে যেই মোনাজাতের ইতি টানতে যাবে অমনি হুলুস্থুলটা কানে এসেছিল। পুবদুয়ারি মসজিদের দক্ষিণদিকি জানালা দিয়ে দক্ষিণি হাওয়াটা হুহু করে বইছিল। সে হাওয়াতে ভর করেই হুলুস্থুলটা ধেয়ে এসেছিল। তাবারক মসজিদের ইমাম। সব কাতার(সারি) ভাঙলে তবেই বাইরে বেরিয়েছিল। মছলেম সেখ তিড়িং বিড়িং করে লাফাতে লাফাতে এসে তাবারককে বলেছিল, “একটা ঘোষণা দেন খতিব সাহেব, সবাই যেন তির-বল্লম-হেঁসো-লাঠিসোঁটা লিয়ে প্রস্তুত হয়। বোম-পিস্তুল যা লেওয়ার লিয়ে লিয়েছি।“ মছলেমকে একবার ধমকেছিল তাবারক। বলেছিল, “মসজিদ শান্তির জায়গা। যুদ্ধ-মারামারির জায়গা নয়।“

“ইডা যে সে যুদ্ধ লয়? এ যে ধর্মযুদ্ধ ইমাম সাহেব?” কন্ঠ তলোয়ার করে বলেছিল মছলেম। তাবারক তবু নরম হয়নি। সে কড়া করে বলেছিল, “মসজিদের মাইক শুধু আজানের জন্যে। এখানে অন্য কিছু ঘোষণা হবে না মছলেম।“ মছলেম আর জোর খাটায়নি। সে জানত, মসজিদ হল আল্লাহর ঘর। সেখানে দুনিয়াদারির কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি কেন ঢুকবে? এই হুলুস্থুলের মাঝে তাবারক যখন বাড়ি ফিরেছিল তখন বাড়িতে কান্নার রোল। ছেলে মিরাজ এখনও বাড়ি ফেরেনি! সে অখিলদের মহল্লায় গেছে! অখিলদের মহল্লা মানে তো হিন্দু পাড়া! তাবারক আল্লাহকে ডেকেছিল। মনে মনে ‘আয়তাল কুরশি’(বিপদ-আপদ থেকে উদ্ধারের দোয়া) পড়েছিল।

দুই

গোটা দেশ তখন তোলপাড়। ‘জয় শ্রীরাম’ না বলায় মছলন্দপুরে এক ইমামের ছেলেকে হত্যা করেছে রামসেনারা। এক শ্রেণির মিডিয়ায় খবরটা ধেরিয়ে পড়ছে। আরেক শ্রেণির মিডিয়া চুপ। যাতে দাঙ্গা না ছড়িয়ে যায়! যে যুগে আঙুলের ক্লিকে মিডিয়া সে যুগে কি এসব ধাপা চাপা থাকে? না কেউ চুপ থাকতে পারে? তবে তাবারক রশিদি চুপ। অদ্ভুতভাবে চুপ। যার জ্বলজ্যান্ত বেটা খুন হল সেইই চুপ! তাবারকের এই নীরবতা মহল্লার তো বটেই দেশের স্বজাতির স্বধর্মের লোকেরা কোনভাবেই মেনে নিতে পারল না। তাদের একটাই দাবি, বদলা নিতেই হবে। ওরা আমাদের গদ্দন কেটেছে আমরাও ওদের গদ্দন কাটব। খুন যখন ধর্মের কারণে হয় তখন মৃত ব্যক্তি তো শুধু যার বেটা সেই বাপের কিম্বা যার ভাই সেই ভাইয়ের অথবা যে মহল্লার শুধু সে মহল্লার মানুষ থাকে না, তামাম ‘কওম’এর হয়ে যায়। মিরাজও যে তাই। তার জন্যে তামাম মুসলিম দুনিয়া ফুঁসছে। কিন্তু ফুঁসছে না তাবারক রশিদি। তাবারক রশিদির চোখে তখন ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টি। কোল খালি হওয়া তাবারক মনকেও খালি করল। সে বলতে চাইল, আর কোন বাপ-মায়ের কোল যেন খালি না হয়। মছলেম যখন মাস্কেট হাতে এসে চোখগুলোকে বারুদের মতো করে বলল, ‘হুকুম দেন খতিব সাহেব, শালোর বাচ্চাদের খতম করে আসি’ তখন তাবারক বলল, ‘খুনের বদলা খুন, কোনও সমাধান নয় মছলেম? আল্লাহ মানুষকে ভুলের জন্যে ক্ষমা করতে বলেছেন।’ “এটা ভুল? জেনে বুঝে ফন্দিফিকির করে একটা তরতাজা ছেলেকে খুন করল আর আপনি বলছেন, ভুল?” মাস্কেটের গুলির মতো তেতে উঠেছিল মছলেম। তারপর মছলেম বলেছিল সেই মোক্ষম কথাটা, ‘শুনুন খতিব সাহেব, মিরাজ খুন মানে শুধু আপনার ছেলে খুন নয়, মিরাজ খুন হয়েছে মানে আমাদের ধর্মকে খুন করার চেষ্টা হয়েছে। আর ধরে এতটুকু জান বেঁচে থাকতে সে চেষ্টা আমরা কখনই মেনে নেব না। এর বদলা আমরা নেবই।‘ এবার সকেট বোমের মতো দুম করে উঠল মছলেম। তাবারক জানে, মছলেমের ক্ষমতা তালগাছের মতো লম্বা। ভাড়াতে মানুষ খুন করে বেড়ায়। বোম বাঁধতে হায়ারে যায়। রাজ্যের শাসক দলের নেতাদের ডান হাত। এসব বললে মছলেম আবার খিখি করে হাসে। হাত কচলানোর মতো করে বলে, ‘অত কিছু না। আমি হলেম, সামান্য ভোট মেশিন মাততর।‘ মছলেমের আরও একটা গুণ আছে। হ্যাঁ, লোকে সেসবকে যতই ‘দোষ’ বলুক মছলেম ‘গুণ’ই বলে। সে বুথ দখল, ছাপ্পা আর রিগিং মাস্টার। মছলেম নামাজের ধারে কাছে থাকে না। অত নিয়েত করে রোজাও রাখে না। আসলে সে মুরুব্বি পরেশগার লোকেদের মতো আল্লাবাল্লা নয়। কোরানের এক পারাও জানে না। ভেঙে ভেঙে গোটা তিনেক ‘সূরা’ মুখস্থ বলতে পারে। ‘জানাযা’ কিম্বা ‘ইদের নামাজে’ মাঝেমধ্যেই ভুল করে বসে। কখন কত রাকাতের নামাজ সেসবও মাঝেসাজে ভুলে যায়। সেই মছলেম ধর্মের জন্যে খড়গ হয়ে উঠছে! তাবারক সেদিন দেখেছিল, মছলেমের ভেতরে কীভাবে আল্লাহ-রসুল পুঁতে আছেন। ভোটের জন্যে নয়, নেতার জন্যে নয়, ধর্মের জন্যে প্রাণ দিতে প্রস্তুত মছলেম! এটা এক দিক দিয়ে ভালো হলেও আরেক দিক দিয়ে ভয়ঙ্কর খারাপ। এ রাগ আগুনে পরিণত হলে আল্লাহর সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে! তাবারকের ভয় সেখানেই। সে ধ্বংস চায় না। সে চায় না রক্ত-মাংসের মানুষ তলোয়ার-খড়গ হয়ে উঠুক। তার বিশ্বাস, আল্লাহ হয়ত এভাবেই তার ছেলের মৃত্যু লিখে রেখেছিলেন। আর আল্লাহর সে লিখন কে খণ্ডাবে?

তিন

তাবারককে প্রথম ধাক্কা লেগেছিল যখন স্বাগত বড়াল দল বদলটা করলেন। গেরুয়া ছেড়ে সবুজে নাম লেখালেন। শুধু তাবারক অবাক হয়নি, অবাক হয়েছিল তামাম কওম। তাবারক আরও অবাক হয়েছিল যখন স্বাগতকে তার নতুন দল তড়িঘড়ি রাজ্যসভার সাংসদ করেছিল। যে লোকটা দাঁড়িয়ে থেকে দাঙ্গা বাঁধালেন সেই লোকটাকে দলে নিল সবুজ দল! কোনও হিসেব মেলাতে পারছিল না তাবারক। কিন্তু যারা স্বাগতকে দলে নিয়েছিলেন তারা ঠিকই হিসেব কষে নিয়েছিলেন। ধাক্কা। কেন্দ্রের গেরুয়া শাসক দলকে একটা বড়সড় ধাক্কা দিতে চেয়েছিলেন তারা। দল ভেঙে ভেঙে দলটা শেষ করে দেওয়ার হিসেব। রাজনীতির এ সেই চির সরল অঙ্ক। কোন কিছু ভাঙলে ঝরে গেলে খসে গেলে উড়ে গেলে বিয়োগ হয়। সেজন্যেই সবুজ দলের সর্বভারতীয় নেতা মাঝেমধ্যেই হুমকি দিচ্ছেন, এখনও গেরুয়া দলের অনেক এমপি এমএলএ তাদের দলে যোগদানের জন্যে লাইনে আছেন। এ যেন উলোটপুরান! বিধানসভা ভোটের আগে এর ঠিক উল্টোটাই ঘটেছিল। সবুজ ছেড়ে গেরুয়াতে যাওয়ার হিড়িক দেখা গেছিল। আর এখন সবুজে আসার হিড়িক। তাই বলে সাদা না কালো, ভালো না মন্দ দেখবে না? চরিত্রে কলঙ্ক আছে না নেই, হাতে খুনের রক্ত লেগে আছে না নেই, যাচাই করবে না? শুধু দু পেয়ে দু চোখে মানুষ হলেই হল? সে মানুষের ভেতরে ‘মানুষ’ নামক জিনিসটা আছে কি নেই পরখ করবে না? পার্টিতে এলেই সবাই ধোয়া তুলসি পাতা! মৃগনাভির মতো সুভাসি? তার আগে যে নোংড়া আবর্জনা বিটকেলি গন্ধ তা ঠাহর করবে না? তাহলে আদর্শ কোথায়? প্রশ্নটা মনে উঁকি দেয় তাবারকের। সেই প্রশ্নকে ছাড়খার করে দিয়ে রাজ্যের শাসক দল আরও কঠিন প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় তাবারককে। তাবারকের তখন ভেতরের পাঁজর কটকট করে ভাঙে। গলায় উঠে আসে কষ্টের দলা। চোখের সামনে তিন জাহানের অন্ধকার। মাথা শূন্য হয়ে যায় তার। মনে হয়। চরকের বড়শিতে বিঁধে বনবন করে ঘুরছে সে। তাবারক মনে করে সবুজ পার্টি তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। যাকে পাত কুড়িয়ে ভোট দিয়ে জেতালাম তারাই এমন নাফরমানি করল! তবে কি আমাদেরকে সবুজ পার্টির দরকার নেই? প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খায় তাবারকের মাথায়। ইদানিং ভুলও বকছে তাবারক। ব্লাড প্রেসার বেড়েছে। হাঁটুর গিঁটের ব্যামুটাও নতুন করে উস্কেছে। চোখেও ঝাপসা দেখছে। এক-আধবার তিতিবিরক্ত হয়ে বলে ‘এ দুনিয়া আর দেখতে ইচ্ছে করে না।‘ সবাই বলে, ছেলের শোকে লোকটা আধমরা হয়ে গেল। তাবারকের সেই হৃষ্টপুষ্ট শরীরখানা আর নেই। মহম্মদপুরের মসজিদে জায়গির থেকে যে গাট্টাগোট্টা শরীরটা বানিয়েছিল সেটা এখন কাঠখড়ি। মাচার লাউয়ের মতো ভুঁড়িটা শুকিয়ে খোল। এখন পিঠের হাড় পেটে দেখা যাওয়ার অবস্থা। মুখের দাড়িতেও পাক ধরেছে। চামড়া জড়জড় ভাব। গায়ের জামাটা খুললেই হিলহিল খিলখিল করে চামটা শরীরটা। হাড়-পাঁজরগুলো ঠিক যেন বিত্তির খিল। তাবারক নিজেকে ঠাট্টা করে বলে, ‘খিল্লি শরীরের ঝিল্লি কপাল।‘ যদিও তাবারক কাউকে কখনও খিল্লি করে না। বলে, ‘পরের গিল্লা করা আর পরকে খিল্লি দেওয়া লোকেদের আল্লাহ পছন্দ করেন না।‘ তাবারক পরনিন্দা পরচর্চা না করলেও স্বাগতর ব্যাপারটা কোনভাবেই মন থেকে মেনে নিতে পারছে না। যে দলকে ভোট দিয়ে জিতিয়েছে তাবারক সেই দলকে মনে মনে দুষছে। বাম দলের উস্তুমের কথাটা বার বার তাবারকের মনে গায়ছে। উস্তুম বলেছিল, ‘কোন পার্টিকে মাথায় তুলে নাচছ তাবারক? দেখবে, এই পার্টিই একদিন ছোবল মারবে।‘ দলটা গোখরো সাপ না কেউটে সাপ তা পুরোপুরি বুঝে উঠতে না পারলেও হেলে সাপ যে নয় তা ঠারে ঠারে বুঝছে তাবারক। তাবারক আরও ঠাহর করছে, দলটার একটা প্রচ্ছন্ন মুখ এবার ধীরে ধীরে সামনে আসছে। সে মুখ হল জাত-ধর্মের মুখ। ধর্মকে বারুদ করার আর বারুদকে আগুন করার মুখ। এই মুখকেই সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে তাবারক। সবকত মৌলানা তাকে ‘তুমি মুসলমানের বেটা মুসলিম লিগ দল কর না কেন’ বললে তাবারক তার মুখের ওপর বলে দেয়, ‘আমার ধর্ম মনের, বিশ্বাসের, হাটের-ঘাটের নয় মৌলানা সাহেব?’ সবকত মৌলানাকে আরও একটা সতর্কবাণী শুনিয়ে দিয়েছিল তাবারক, ‘এই ধর্ম ধর্ম করে দেশ ভেঙেছে একবার। তুমি কি চাও বাকি দেশটাও এবার কবর হয়ে যাক?’

তাবারক খবরটা প্রথম শুনল জামসেদের কাছ থেকে। জামসেদ শাসক দলের চুটকে নেতা। কিন্তু হাম্বিতাম্বিতে ডাঙ্গার বাঘ। মনে মনে তাবারক দুঃসংবাদ শুনলে যে দোয়া পড়তে হয় সে দোয়া পড়ল। গালি দেওয়া পাপ তা জেনেবুঝেও এই প্রথম একটা কাঁচা খিস্তি দিল রাজ্যের শাসক দলের প্রার্থী তালিকা চুড়ান্তকারিদেরকে। এতদিন হাড়ে এক খামচা যাও মাংস লেগেছিল খবরটা শোনার পর তাও ঝরে যাওয়ার অবস্থা হল। রগে রক্ত থেমে যাওয়ার উপক্রম হল। যেন কোন হাল্কাপাতলা ডাপ-বাঁশ নয়, আস্ত ছাদ তার মাথার ওপর খসে পড়ল। গায়ে ছাদ খসে পড়লে শরীরের হাড়গোড় ভেঙে যায়। খুব বেশি হলে রুহুটা বেরিয়ে যায়। কিন্তু এ খবরটা যে কেবলমাত্র শরীরের হাড়গোড় নয় মনের হাড়গোড়ও ভেঙে দিচ্ছে! শরীর থাকলেও সে শরীরে রুহু থাকছে না তাবারকের। কীর্তনের খোল-করতাল হয়ে যাচ্ছে। তাবারক সন্ধ্যা নামলেই রাতের খাবার খেয়ে নেয়। তারপর কিছুটা উঠোনে-দাওয়ায় হাঁটাহাঁটির পর মসজিদে যায়। এশার নামাজ আদায় করে। আজ মসজিদে গেল না তাবারক। রওশানারার নামাজ পড়া শেষ হলে ফিসফিস করে বলল, “খবরটা শুনেছ মিরাজের মা?”

“কী খবর?” হাতের তসবিহ রেখে জিজ্ঞেস করল রওশানারা। তাবারক মুখ ভেংচে বলল, “ওই খুনিটা এবার ভোটে সবুজ দলের প্রার্থী হচ্ছে।“

“খুনি! কোন খুনি?” কিছুই আন্দাজ করতে পারল না রওশানারা। সে ভ্যালভ্যাল করে তাবারকের দিকে তাকিয়ে থাকল। তাবারক এবার দাঁতে দাঁত চিবোল। চোখ লাল করল। ‘ছেয়’ করে কুকুরের নাম নেওয়ার মতো বলল, “স্বাগত বড়াল।‘ সঙ্গে সঙ্গে রওশানারা ‘তওবা’ পড়ল। আর মনে মনে ‘শুয়োর’ ‘খবিশ’ বলে গালি দিল। এমন করল তার ‘ওয়াক’ ওঠার উপক্রম হল। তাবারক ক্ষমা করলেও রওশানারা মন থেকে ছেলের খুনিকে ক্ষমা করেনি। উল্টে ছেলের সে খুনি স্বাগত বড়ালের ‘জাহান্নাম’ যাওয়ার দোয়া করেছে আল্লাহর কাছে। রওশানারা অবাক হয়ে বলল “যে দলকে গালি দিল সে দলই ওকে ভোটের টিকিট দিল!”

“শুধু কি টিকিট? দেখো, জিতলে মন্ত্রীও করবে।“ বলল তাবারক। “তাহলে আমরা কী করব এবার? বেইমানটাকে দলে নিয়ে সবুজ দলও তো বেইমানি করল।“ বলল রওশানারা। তাবারক একবার হেঁয়ালি হাসি হাসল। বলল, “এসব হওয়ারই ছিল মিরাজের মা। আসলে এসব দলের আসল মুখ এবার বেরিয়ে গেছে। এতদিন সম্প্রীতির মুখোশ পরে ছিল। স্বাগত বড়ালকে দলে নিয়ে এবং ভোটে প্রার্থী করে সে মুখোশ খুলে গেছে।“

“তাহলে আমরা এবার কাকে ভোট দেব? তেল-জল তো সব এক হয়ে গেল!” হাপিত্যেশ করে উঠল রওশানারা। তাবারক হেঁয়ালি করে বলল, “সব ফুল এক হলেও সব কূল তো এক হয়নি?”

“আর কি কোন কূল বাকি আছে বলে তোমার মনে হয়?” চোখ ঘুলিয়ে উঠল রওশানারার।

“নদী থাকলেই নদীর কূল থাকে, মিরাজের মা। এক কূল ভাঙলে আরেক কূল গড়ে ওঠে।“ খেয়ালি হয়ে উঠল তাবারক। রওশানারা ফুট কাটল, “তোমাকে আবার বাউলের ব্যামুতে কবে ধরল?”

“সব মানুষেরই মধ্যে কখনও না কখনও বাউলভাব আসে। জীবনটা তো শুধু আযানে আর নামাজে নয়? জীবনটা বাজনাতেও। যখন যেমন বাজে বাজতে হয়।”

“তুমি না খতিব, জামাতের ইমাম? তোমার যে এসব হারাম। গুনাহ হবে।“ ধর্মের বাঁধনের কথা স্মরণ করাল রওশানারা। তাবারক এবার ফিক করে হাসল। সে হাসি ঠোঁটে রেখেই বলল, “এর থেকে বড় গুনাহ তো গত ভোটেই করেছি। আল্লাহ আমাকে কটা জাহান্নাম দেবেন?” গত ভোটে গুনাহ! তাও আবার বড় গুনাহ! কিছুই ঠাহর করতে পারছে না রওশানারা। মনের মধ্যে হাজার প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। রওশানারার মনকে আরও ভাবুক করে তাবারক বলল, “সে গুনাহ আর এবারের ভোটে করছি না। এবার বদলা নিতে হবে।“

“বদলা! তুমি নেবে বদলা! জ্বলজ্যান্ত ছেলেকে পিটিয়ে গদ্দন কেটে খুন করল যারা তাদেরকে বেকসুর মাফ করে দিলে, একবার ‘শালা’ ‘বাহিঞ্চত’ বলে গালি পর্যন্ত দিলে না, লোকের সামনে ফেরেশতা সাজলে আর এখন বলছ, বদলা নেব!” খ্যাঁক করে উঠল রওশানারা। তাবারক বলল, “আমি দুনিয়ার শাস্তি মাফ করেছি, পরকালের শাস্তি তো মাফ করিনি? আল্লাহর বিচার আল্লাহ ঠিক করে নেবেন।“

“তোমার সব কিছুতেই ওই পরকাল আর পরকাল। ইহকালের যে পিন্ডি হয়ে গেল?” গজগজ করে উঠল রওশানারা। তাবারক রওশানারার ব্যাথাটা বুঝল। ছেলে হারা মায়ের ব্যাথা জন্মভর মিটে না। রওশানারার পিঠে আলতো করে হাত রাখল তাবারক। স্বামীর হাতের পরশ পেয়েই ফুঁপিয়ে উঠল রওশানারা। তাবারকের চোখও ছলছল করে উঠল। ফিসফিস করে তাবারক বলল, “এবার ভুল শুধরোতেই হবে। আর সে ভুল শুধরানোর আসল জায়গা ব্যালট।“

“তাতে কিছু হবে?” অসহায়ের মতো বলল রওশানারা। তাবারক বুকে বল নিয়ে বলল, “হওয়াতেই হবে যে।“

চার

প্রাইমারি স্কুলের দুই নম্বর বুথ। লম্বা লাইন। লাইনটা কচ্ছপের গতিতে এগোচ্ছে। গেটের যেখানে নিরাপত্তাকর্মী রাইফেল তাক করে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে এগিয়ে গেল তাবারক। রাজ্যে সরকার গঠনের ভোট। তার ভোটেই বিধায়ক নির্বাচিত হবেন। ভেতরের লোকটি বেরিয়ে আসতেই তাবারক ঢুকে গেল। তার হাতের স্লিপের সিরিয়াল নম্বর দেখে ফার্স্ট পোলিং অফিসার চিৎকার করে বলে উঠলেন, “একশ তিরিশ, শেখ মুহাম্মদ তাবারক রশিদি”। উল্টো দিকে বসে থাকা প্রিজাইডিং অফিসার ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিলেন। ভোটার কার্ডটা দেখানোর পর ‘চোদ্দ’র এ’ ফর্মে সই করল তাবারক। পরের ভোটকর্মী তার বাম হাতের তর্জনীতে কালি লাগালেন। ‘ব্যালট ইস্যু’ করে তাবারককে বললেন, “যান। ভোট দেন এবার।“

টেবিলের ওপরে এক খোপ জায়গা। কার্টুন দিয়ে তিন দিক ঘেরা। ওপরের ক্যান্টিলিভারের ফোকর দিয়ে ঘুলঘুল করে পড়ছে সকালের হলুদ রোদ। গা লাগা জানালার ফাঁকফোকরগুলো কাগজ দিয়ে ঠেসেঠুসে বন্ধ করা। বাইরের আলোর তো দূরের কথা হাওয়া-বাতাসের বাপেরও ক্ষমতা নেই একবার গলা ঢোকাতে পারে। কেমন একটা আলো-আঁধারির ঘুলঘুলি। ভ্যাপসা গন্ধ। ইভিএম’এর সামনে গিয়ে দাঁড়াল তাবারক। চিৎ করে রাখা আছে ব্যালট মেশিনটা। আসমানের খোদা, কাঁধের দুই ফেরেশতা আর সে নিজে ছাড়া দুনিয়ার আর কেউ এই মেশিনটা দেখতে পাচ্ছেন না। তার ‘অধিকার’ কত সুরক্ষিত। সে কত দামি। তার একটি ভোট কত মূল্যবান! আসল ক্ষমতার চাবিকাঠি তো তার আঙ্গুলেই। এই গণতন্ত্র নিয়ে কত গর্ব তাবারকের। সে কথা মনে পড়লে একবার ফিক করে হাসল তাবারক। পান জর্দা খাওয়া দাঁতের ফাঁকে সেই হেঁয়ালি হাসিটা দেখা গেল। আরও এক ধাপ সামনের দিকে এগোল তাবারক। ওপরের কোণায় একটা সবুজ আলো জ্বলছে। যেখানে আঙুল টিপবে তাবারক তার বাম পাশে জ্বলজ্বল করছে প্রতীকগুলো। তাবারকের প্রথমেই চোখ পড়ল সেই প্রতীকটার ওপর যেটাতে গত কয়েকবার আঙুলের চাপ দিয়েছে। সে চাপ ছিল সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে চাপ, তার ছেলের খুনের বিরুদ্ধে চাপ, দেশে মানুষ উচ্ছেদের বিরুদ্ধে চাপ। চোখ ওপর থেকে নীচে নামতে থাকল তাবারকের। নামতে নামতে একটা জায়গায় এসে থেমে গেল। আর তখনি তাবারকের মাথায় এসে ভর করল ছেলে মিরাজের মরা মুখ। দাঁতে দাঁত কিষল তাবারক। চোখ বারুদের গোলা হয়ে উঠল। ভেতরের হাড় কলকব্জা তলোয়ার-বল্লম হয়ে উঠল। মগজ বলল, ‘বদলা’ ‘বদলা’। তাবারক সে ডাক শুনতে পেল। তার ডান হাতের আঙুলটা নীচের একটা বোতামে চাপ মারল। সঙ্গে সঙ্গে ‘টি-ই-ই’ করে একটা শব্দ গেয়ে উঠল। তাবারকের প্রতিশোধের চোখ পাশে লাগানো ভিভি প্যাডের কাঁচ ফুঁড়ে দেখল, একটা ক্রশ চিহ্ন মার্কা কাগজ খসে পড়ল নিচে।

0 Comments

Post Comment