পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

সবুজ বিপ্লবের ডায়েরি

  • 05 October, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 816 view(s)
  • লিখেছেন : অংশুমান দাশ
১৯৭২-৮০ সালের সময়কালে আইসিএআর-এর ডিরেক্টর হন ডঃ স্বামীনাথন। দেশের কৃষিচর্চার সর্বময় অধিকর্তা, ১৯৭৯ সালে ভারত সরকারের প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারি, তারপর প্ল্যানিং কমিশনে আসছেন তিনি। তিনি সম্প্রতি মারা গিয়েছেন, তাঁর চিন্তা এবং কাজ কি সত্যিই দেশকে খাদ্যতে স্বয়ম্ভর করে তুলেছিল? নাকি আরো কিছু আছে?

স্বাধীনতা। দুর্বল কৃষি পরিকাঠামো, দুশো বছরের শোষণ, খাদ্যের জন্য অতিরিক্ত বাজার ও সরকারমুখিতা – এই সবে নাজেহাল দেশ। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় প্রায় পয়তাল্লিশ শতাংশ বাজেট বরাদ্দ কৃষি, গ্রামোন্নয়ন, সেচ ও শক্তির ক্ষেত্রে। অন্যতম প্রধান খাবার হিসাবে ধান গবেষণায় নজর দেয় সরকার। কটকে কেন্দ্রীয় ধান গবেষণা কেন্দ্র (CRRI) শুরু হয় ১৯৪৬ এ। খরা/বন্যা প্রতিরোধী, কম সময়ের ধান, ধানে কম চিটে, ঢলে না পড়া, সার প্রয়োগে ভালো ফলন দেওয়া, উৎপাদন – এইরকম ন’টি লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। ১৯৫৯ সালে ডঃ রিচারিয়া এর নির্দেশকের দায়িত্বে আসেন। দেশীয় প্রজাতিগুলি থেকে জীন সংগ্রহ করে সেগুলির উৎপাদনের হার বাড়ানোর কাজ চলছিল। তাইওয়ানের কিছু প্রজাতি নিয়েও কাজ শুরু হয় – সেখানে বৈজ্ঞানিকেরা তাইচুং ধানের ফলনশীলতা আর রোগ/পোকা প্রতিরোধী গুণ দেখতে পান। পাশাপাশি জাপান এর উচ্চফলনশীল ও রাসায়নিক সারে ভালো উৎপাদন দেয় এইরকম ধান ভারতের ধানের সঙ্গে মেশানোরও চেষ্টা চলতে থাকে। ভালো হয় না, সমস্যা থাকে – কারণ জাপানের ধানের মত ভারতীয় ধান রাসায়নিক সারে অভ্যস্ত নয়। জাপান ও তাইওয়ানিজ ধান নিয়েও গবেষণা চলতে থাকে। ঝড়ের গতিতে কাজ এগোচ্ছিল, এমন কথা বলা যাবে না। কারণ কোনও জাতকে জলবায়ুর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া, স্থিতিশীল করা এবং রোগ ও পোকা প্রতিরোধী করে তোলা সময় সাপেক্ষ কাজ।

 
এই ৫৯ সালেই আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্র (IRRI) শুরুর কথা হয় রকফেলার ফাউন্ডেশন ও ফোর্ড ফাউন্ডেশনের টাকায়। এর উদ্দেশ্য মূলতঃ এশিয়ার বাজার নিয়ন্ত্রণ করা – কারণ ধান যেহেতু এ অঞ্চলের প্রধান খাদ্য – আর খাদ্য দিয়ে বশ করা, এ তো সভ্যতার প্রাচীনতম অস্ত্র। প্রথমে ভারতবর্ষে করার কথা হলেও যেহেতু এটি একটি বেসরকারী সংস্থা – নিরপেক্ষতা কম থাকতে পারে, তাই সরকার রাজী না হওয়ায় তা  ফিলিপিন্সে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। শুরু হয় আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্র – যদিও কাজকর্ম শুরু হয় ৬২ সাল নাগাদ। 
 
 

ডঃ স্বামীনাথন এবং ডঃ নর্মান বোরলাগ ইতিমধ্যে একসঙ্গে কাজ করা শুরু করেন আইএআরআই-এ। মেক্সিকোর বেঁটে গম আর জাপানের গম মিশিয়ে ভালো ফল পাওয়া যায়। ১৯৬৪ তে এক হেক্টর জমিতে কৃষকদের দেখানোর জন্য ১৫০ প্রদর্শনী ক্ষেত্রে এই গম ফলানো হয়। বিদেশী প্রযুক্তি ও জাতের উপর ভরসা বাড়তে থাকে।

ওদিকে IRRI-এ ১৯৬৬ নাগাদ প্রথম সাফল্য আসে IR৮ ধান নিয়ে। ইন্দোনেশিয়ার লম্বা ধান আর তাইওয়ানের খাটো ধান জুড়ে এই ধান তৈরি হয় যা বেশি সার ও জলে ভালো ফলন দেয়। অতিরিক্ত সার ছাড়া এদের ফলন এমন কিছুই নয় – এই ধানের সঙ্গে সঙ্গে এশিয়া জুড়ে আমেরিকার সারের বাজারও খুলে যায়।

CRRI ও কিন্তু তাইওয়ান ধান নিয়ে কাজ শুরু করেছিল, এবং প্রায় সফলের মুখে ভারত সরকার IR৮ আনতে চায়। যখন ডঃ রিচারিয়ার কানে এই কথা যায় – তিনি বাধা দেন। যেহেতু CRRIও একই তাইওয়ান ধান নিয়ে কাজ করছে – তারা রিচারিয়ার এই বেঁকে বসার কারণ ধরতে পারেননি। তাদের হয়ত জীনবিজ্ঞানে ব্যুৎপত্তি ছিল না, কিন্তু তাদের অধীনে থাকা বিজ্ঞানীরাতো বুঝেছিলেন যে এদেশে বারবার প্রজন্মান্তরে পরীক্ষা ও দেশীয় ধানের জীনের মিশ্রণ কোনও জায়গায় নতুন ধানের স্থিতিশীলতা ও তার রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে নির্দিষ্ট করে! IRRI-এর এত কিছু ভাবার সময় ছিল না। আশংকা ছিল, CRRI সফল হলে তাদের ধানবীজের বাজার যাবে।  প্রচুর পরিমানে বীজ রপ্তানি করার জন্য তারা চাপ দিতে থাকে। আমেরিকার তখন ভারতের কংগ্রেস সরকারের সঙ্গে বিশাল দহরম মহরম। IRRI কোয়ারেন্টাইন সার্টিফিকেট ছাড়াই এই বীজ ভারতে পরীক্ষা করতে থাকে বেআইনি ভাবে। ডঃ রিচারিয়ায় বাধায় সরকার তাকে ১৯৬৬ সালে অবসর নিতে বাধ্য করে IRRI নির্দেশক ডঃ শ্যান্ডলারের চাপাচাপিতে। তাঁর অফিসে তালা পড়ে। গবেষণা পত্র খোয়া যায়।

এই সময়, ১৯৬৫-৬৬তে ভারতে ধানের ফলন বেশ কমে যায়, ফলে IR৮-এর ব্যাপক প্রচলনে সরকার আরও বদ্ধপরিকর হয়ে পড়ে। বস্তা বস্তা বীজ আসতে থাকে যা কোনোরকম পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়াই মাঠে মাঠে ছড়িয়ে পড়ে।  

রিচারিয়া উড়িষ্যা হাইকোর্টে গিয়েছিলেন, যেখানে তিন বছর ধরে তিনি একা সরকারের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই লড়ে ১৯৭০এ তার পদ ফিরে পান। কিন্তু ততদিনে তিনি মধ্যপ্রদেশে সরকারের কৃষি উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দিচ্ছেন ১৯৭১ সালে। রায়পুরে ১৯০০০ ধানের এক জার্মপ্লাজম ব্যাঙ্ক গড়ে তুলছেন।

 ১৯৭২-৮০ সালের সময়কালে আইসিএআর-এর ডিরেক্টর হন ডঃ স্বামীনাথন। দেশের কৃষিচর্চার সর্বময় অধিকর্তা। ১৯৭৯ সালে ভারত সরকারের প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারি, তারপর প্ল্যানিং কমিশনে আসছেন তিনি। এর মাঝে কী হল?

১৯৭৩ নাগাদ তেলের দাম অসম্ভব বেড়ে যাওয়ায় সারের দাম প্রচন্ড বেড়ে যায়, ফলে ভর্তুকি ছাড়া IR৮ চাষ অসম্ভব হয়ে ওঠে। উপরন্তু সমস্ত ধানের একইরকম জীনগঠন হওয়ার জন্য হওয়ায় রোগ ও পোকাও বাড়তে থাকে হু হু করে। স্বামীনাথন অনেক পরে নিজেই লিখছেন - ৬৮, ৬৯এ ব্যাক্টেরিয়াল ব্লাইট, ৭০-৭১এ টুংরো ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় নতুন প্রতিরোধী প্রজাতি আসে IR২০। ১৯৭৩ IR২০তেও ব্রাউন প্ল্যান্ট হপার দেখা যায়। তা আটকাতে IR২৬ আসে ১৯৭৩এ। ১৯৭৬ এ IR২৬এ নতুন জাতের ব্রাউন প্ল্যান্ট হপার আক্রমণ হয়। এরপর IR৩৬। এরকমভাবে অনন্ত চক্র চলতেই থাকে। ডঃ রিচারিয়ার সব আশংকা একে একে সত্যি হতে থাকে। উচ্চ ফলনশীল ধান প্রায় ৩০-১০০% উৎপাদন হারায় শুধু মাত্র পোকার আক্রমণে। উঁচু আর নীচু জমিতে উচ্চ ফলনশীল ধান প্রায়শই ব্যর্থ হতে থাকে। অথচ ভারতের অধিকাংশ জমিই তাই। সে সময় তা আটকানোর একমাত্র উপায় ছিল পুরোনো জাতগুলির জীনকে আবার ফিরিয়ে আনা, যাদের প্রতিরোধী ক্ষমতা ছিল, সেই ইন্ডিকা জাত রয়েছে ভারতে। সুতরাং সেই সব চাই।

পথ আগলে আবার ডঃ রিচারিয়া।

IRRI-এর চোখ মধ্যপ্রদেশ রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটে (MPRRI) রিচারিয়ার ১৯০০০ জাতের উপর পড়ল। রিচারিয়া বললেন এই সমস্ত ধান আদও চাষের উপযোগী কিনা তা তিনি পরীক্ষা করে দেখার আগে বিনিময় করতে পারবেন না। পয়সার অভাবে MPRRI প্রায় লাটে উঠে যায়। আবার তালা। আবার ডঃ রিচারিয়ার গবেষণাপত্র গায়েব। ধান গায়েব।   

 

উচ্চফলনশীল ধানের সাফল্যের পিছনে কারণ হচ্ছে খাটো উচ্চতা আর শক্ত খড় (এই জন্যে গরু পছন্দ করে না) – অতিরিক্ত নাইট্রোজেন প্রয়োগ সহ্য করতে পারা, ঢলে না পড়া। কিন্তু এবারে যখন ভারত থেকে নিয়ে যাওয়া আরও দেশী ধানের জীন পোকা তাড়ানোর জন্য হুড়োহুড়ি করে উচ্চফলনশীল ধানে ঢোকানো হতে লাগল – তা এই খাটো থাকার চরিত্রে প্রভাব ফেলতে থাকে। ফলে সত্তরের শেষ দিক, আশির শুরুতে উৎপাদনও কমতে থাকে।  

 

১৯৭০-৭১ সালে ৫ মিলিয়ন হেক্টর থেকে শুরু করে ১৯৮২ অবধি ১৮ মিলিয়ন হেক্টর জমি এই উচ্চ ফলনশীল ধানের অধীনে গেছিল। যেখানে সেচ ও সারের সুবিধা বেড়েছে অনেক। ৬৫ থেকে ৭০এর মধ্যে শুধু নাইট্রোজেন সার প্রয়োগই বেড়েছে ১১০%। ১৯৭০ থেকে ৮২, এই সময় ধানের উৎপাদন ৪২.২৩ মিলিয়ন টন থেকে ৪৬.৪৮ মিলিয়ন টন হয়েছে। অর্থাৎ ১৩ মিলিয়ন হেক্টর জমি বাড়া পিছু ৪ মিলিয়ন টন উৎপাদন বেড়েছে। এটুকু উৎপাদন বৃদ্ধি বোধহয় শুধু গ্রামের প্রাকৃতিক সম্পদ আরও গুছিয়ে ব্যবহার করলেই হত। যেহেতু তথ্য নেই, আমরা ধরেই নিয়েছি

IR ধান ছাড়া অন্য ধানের এই সময় কোনও উৎপাদন হয়নি, বাড়েও নি – বাড়লেও ও সব জানার দরকার নেই।

 

১৯৫০-৫৯ থেকে গড়ে ২৬.২৯ মিলিয়ন টন থেকে ১৯৮০-৮৯ এ গড়ে মোট ধানের উৎপাদন হয়েছে ৫৯.৭৮ মিলিয়ন টন, গমের ৮.৩৬ থেকে ৪৪.৭৬, জোয়ারের ৭.৫৬ থেকে ১১.১২, বাজরার ৩.৩৫ থেকে ১১.১২, রাগির ১.৮৫ থেকে ২.৫২, ডাল ১০.৯৭ থেকে ১০.৬৩, যব ২.৮২ থেকে ১.৯৬, প্রোসো মিলেট ২.০৭ থেকে ১.২২ হয়। এই সময়কালে জন পিছু মিলেটের প্রাপ্যতা ২২ কেজি থেকে ৩০ কেজি, গম ২৩ থেকে ৪৫ কেজি, অন্যান্য শস্য ৪০ কেজি থেকে ৩৫ কেজি, ডাল ২২ থেকে ১৫ কেজি তে এসে দাঁড়ায়। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।

 

১৯৭৮এ ডঃ রিচারিয়া ভোপালে নিজের বাড়িতে ফিরে যান। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৮, কুখ্যাত IRRIএর নির্দেশক হয়ে বসছেন ডঃ স্বামীনাথন। ১৯৫৯ থেকে এই সময়টায় কেন্দ্রে প্রায় পুরোটাই কংগ্রেস সরকার। কিন্তু তারপরে বা ওই সময় অন্য কোনও দলের রাজ্য সরকার এই ইতিহাসের পুনরাবৃতি করতে অন্যথা করেননি ও করতেন বলেও মনে হয় না।

 

তথ্য

১। https://www.indiabudget.gov.in/budget_archive/es1969-70/2 Agricultural Production.pdf

২। ভরত ডোগরা-র প্রবন্ধ

৩। ক্লড আলভারেজের নেওয়া ডঃ রিচারিয়ার সাক্ষাৎকার

৪। দ্য গ্রেট জীন রবারি – ক্লড আলভারেজ

৫। https://countercurrents.org/2021/02/top-rice-scientist-dr-richharia-who-sacrificed-much-to-protect-interests-of-farmers/

৬। https://journalofethnicfoods.biomedcentral.com/articles/10.1186/s42779-019-0011-9/
 
0 Comments

Post Comment