ভারতের বর্তমান প্রধান বিচারপতি ধনঞ্জয় যশোবন্ত চন্দ্রচূড় (ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়) গত কয়েকমাসের মধ্যে তাঁর বেশ কয়েকটি অভিনিবেশ যা প্রকাশ্যে ব্যক্ত করেছেন বা কোথাও কোথাও প্রদর্শন করেছেন তা নিয়ে বেশ কিছু অভিমত যেমন আইনজীবীদের মধ্যে থেকে উঠে এসেছে তেমনই সাধারণের মধ্যেও নানা বিতর্কের অবতারণা করেছে। এখন তাঁর যাবার বেলা। অবসরের দিনক্ষণ যেমন নির্ধারিত হয়ে গেছে তেমনই তাঁর স্থলাভিষিক্ত কে হবেন তা ও ঘোষিত হয়েছে। দেশের শীর্ষ আদালতের প্রধান চেয়ারটির একটি সাংবিধানিক ঐশ্বর্য রয়েছে। সংবিধান তাঁর কাছে পবিত্র এনসাইক্লোপিডিয়া। তার ছত্রে ছত্রে যেমন বিধানের মান্যতা আছে তেমনই বিচারব্যবস্থার নীতি- নৈতিকতা নিয়ে অনুসৃত নির্দেশের সার্বজনীনতাও আছে সম্যক ভাবে।সংবিধান প্রয়োগকারীদের যেমন একটি দায় থাকে তেমন তাকে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে জানা ও বোঝার একটি চর্চাও প্রাসঙ্গিক থাকে; তাতে সমর্থন জোগায় রাষ্ট্র। অর্থাৎ জোগান দেওয়া দরকার। কিন্তু সেই সংবিধানকে যারা কুক্ষিগত করে রাখতে চায়; সংবিধানের প্রতিটি শব্দ ও বাক্য সংহতির অন্য অর্থ করে জনমানসে ধোঁয়াশা তৈরি করে তাদের এই কাজ করার পিছনে অভিসন্ধি থাকে। আমাদের অবাক হয়ে যেতে হয় তখনই যখন দেখি আইনসভার সদস্যরাই সংবিধানের ’ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘গনতান্ত্রিক’ শব্দ নিয়ে প্রশ্ন তোলাই শুধু নয় তাকে বাদ দেওয়ার জন্য প্রস্তাব আনেন।রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক সত্তার এ হেন দুর্বুদ্ধির অন্তরালে সংগঠিত ভাবনার ঐক্য প্রকট হয়ে ওঠে।সেখানেই মানুষের অধিকার বোধে থাবা বসায় রাষ্ট্র। সংবিধানের প্রতিটি শব্দের যে ওজন তাকে একার করে নেওয়ার যে দর্শন তার মধ্যে দিয়ে একনায়কতন্ত্রের জন্ম হয়।
শীর্ষ আদালতের প্রধানের সাম্প্রতিক কার্যক্রমের মধ্যে যে ইঙ্গিত মেলে তাতে তাঁর নিরপেক্ষতা নিয়ে আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক নয়! অবসরের শেষ লগ্নে দাঁড়িয়ে পূর্ববর্তী নিদানের কেন বা অকেন নিয়ে যদি তাঁর অভীক্ষা এভাবে ধরা দেয় তখন তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতার অন্তরালে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যই ধরা পড়ে ঘটনাটি এমনই যে, প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় যখন বলেন,রাম জন্মভূমি মামলার সঠিক সমাধানের জন্য তিনি ঈশ্বরের কাছে পরামর্শ চেয়েছিলেন তখন ‘ঈশ্বর’ ও ‘সংবিধান’ দুই বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে মানুষের ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রশ্ন চিহ্নের সামনে এনে দাঁড় করায়। কিছুদিন আগে তিনি মহারাষ্ট্রের খেদতালুকের কানহেরসর গ্রামে একটি জনসমাবেশে যোগ দিয়ে তাঁর ঈশ্বরপ্রীতির কাহিনি শোনাতে গিয়ে বলেন,“আমাদের কাছে অনেক মামলা আসে। সিদ্ধান্ত নিতেও যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। অযোধ্যা মামলার ক্ষেত্রেও সেরকমটি হয়েছিল।মামলাটি আমার কাছে তিনমাস বিচারাধীন ছিল। আমি আমার ঈশ্বরের কাছে গিয়ে বসলাম। তাঁর কাছে প্রার্থনা করলাম, তিনি যেন আমাকে সমাধানের পথ দেখান”; পরে আরও যুক্ত করে বলেন, ‘আমার কথা বিশ্বাস করুন। যদি আপনার মনে বিশ্বাস থাকে, ঈশ্বর আপনাকে অবশ্যই পথ দেখাবেন। ’ রামজন্মভূমি-বাবরি মসজিদ বিতর্কে দুই ধর্মের মানুষের মধ্যে যে আবেগের জন্ম হয়েছিল তার কোনো একটি পক্ষে আদালতের সিলমোহর দেওয়ার ক্ষেত্রে জটিলতা ছিল সন্দেহ নেই এবং দীর্ঘ লালিত আবেগের ক্ষতি হতে পারে তা ও সকলের অজানা নয়,সর্বোপরি রাষ্ট্র যখন একটি পক্ষের প্রতিনিধিত্ব করার ইচ্ছা প্রকাশ করে মাঠ ময়দান তাতিয়ে তুলছেন তখন পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সর্বোচ্চ আাদালতের শীর্ষ কর্তার সংবিধানের কাছেই হাঁটু গেড়ে বসা সমীচীন। সংবিধানের ওপর হাত রেখে তার সমাধানের উপায় জানতে চাওয়াটাই স্বাভাবিক। অথচ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের শীর্ষ আদালতের প্রধানের ঈশ্বরের কাছে সমাধান চাওয়ার মধ্যে সেই ঐশ্বরিক শূন্যতাকেই তিনি উপায় হিসাবে বেছে নিয়ে রাষ্ট্রকেই খুশি করলেন, আর এই কথা জনসমক্ষে তিনি যখন বললেন তার আগেই নিজের বাড়ির গণেশপুজোর ছাতনা তলায় তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ করে এনে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে গণেশবন্দনায় মগ্ন হলেন!
দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার যে এসেন্স তাকে চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন ও আমাদের অনেক কথা বলার সুযোগ করে দিলেন। যে ধর্ম আচরণের তার সঙ্গে আমাদের চেনাজানা দীর্ঘ লালিত কিন্তু ধর্ম যখন মানুষের ভাবনার ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে চায় তখন তা আর আচরণের মর্মবস্তু থাকে না।আবার সর্বোচ্চ স্তর থেকে যখন তার সমর্থন মেলে তখন পক্ষ অবলম্বন স্থায়িত্ব পেয়ে যায়। প্রধান বিচারপতির কাছে ঈশ্বর ভজনা কোনো দোষের নয়, যখন তার সঙ্গে সংবিধানের কার্যকারিতা ঐশ্বরিক মডেল পেয়ে যায় তখনই তা আর সর্বজনীন থাকে না। প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় কোট আনকোট যে নিজের ওপর বিশ্বাসের কথা বলেন তা সত্য তবে সেই বিশ্বাস কোনো বিমূর্ত সত্তার কাছে নয় বরং তা সমাজ নিগড়ে যূথবদ্ধতায় যাদের কান্না হাসির শব্দ শোনা যায় তাদের জন্য। তাহলে রায়দানের আগে ঈশ্বর ভজনা যা সংবিধানের ভাবনার বিরুদ্ধে চলে তাতে তাঁর আস্থা বেশ চমকপ্রদ একইভাবে বিস্ময়ের!
এর উল্টোটাও যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক। ধনঞ্জয় যশোবন্ত চন্দ্রচূড় এসবের পরে পরেই যোগী সরকারের ২০০৪ সালের মাদ্রাসা শিক্ষা আইনের (২০১৭ সালে কার্যকর) বৈধতা নিয়ে এলাহাবাদ হাইকোর্টে যখন মামলা হয় এবং এলাহাবাদ হাইকোর্ট সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ নীতি অস্বীকৃত হয়েছে বলে খারিজ করে দেন এবং যোগী সরকার যথারীতি শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হয় তখন তার রায়দান প্রসঙ্গে চন্দ্রচূড় যখন বলেন,‘ধর্মনিরপেক্ষতার অপরিহার্য অর্থই হলো বাঁচো ও বাঁচতে দাও’; এই আইনে ধর্মীয় শিক্ষার জন্য যে বোর্ড গঠনের যে নির্দেশিকা রয়েছে তা অসাংবিধানিক এবং সে ক্ষমতা রাজ্য সরকারের নেই। দুই ভিন্ন চন্দ্রচূড়কে চিনতে আমাদের কষ্ট হলেও মানতে আপত্তি নেই। আবার দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ১৯৭৬ সালে সংবিধানের ৪২তম সংশোধনী এনে যখন তার মূল প্রস্তাবনায় ‘সার্বভৌম গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র’কে বদলে তাতে বিজ্ঞানসমত ভাবেই যুক্ত করেন ‘সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র’ যুক্ত করেন এবং বিজেপি নেতারা তার সংশোধনী প্রস্তাব এনে বলেন এখানে সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক শব্দ ত্রয়ীর ব্যবহার ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্ব করার লক্ষ্যে তখন তা খারিজ করে দেন প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ, তখন শীর্ষ বিচারপতিকে চিনতে আমাদের কষ্ট হলেও তা মান্যতা পেয়ে যায়। ২০২২ সালে বোম্বে হাইকোর্টে বিচারপতি নিযুক্ত হওয়ার সময় ১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধীর দেশময় জরুরি অবস্থা জারির সিদ্ধান্ত সম্পর্কে যখন মন্তব্য করেন,‘বিচারব্যবস্থার নির্ভীক ও নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত দেশকে ১৯৭৫ সালে রক্ষা করেছিল। বিচারপতি রানের মতো মানুষ সেই সময় সত্য ও ন্যায়ের বিচারব্যবস্থার শিখা জ্বালিয়ে রেখেছিলেন। সময় ও প্রেক্ষিতের যে প্রসঙ্গটি আগেই তুলেছিলাম তার বদল ঘটাটা অন্যায়ের কিছু নয়, কিন্তু বিচারের মানদন্ড যদি ভারসাম্যের অনিয়তাকার বলয়ে আবর্তিত হয় তখন প্রশ্ন তোলাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আর একটি বিষয়ও সহজাত ভাবে মনে পড়িয়ে দেয়, জলবায়ু বদল ও উষ্ণায়নের দায় নিয়ে একটি মামলায় আমরা অন্য এক চন্দ্রচূড়কে দেখেছিলাম, যিনি বলেছিলেন বিশ্বজুড়ে শিল্পস্থাপনের সময় আমাদের পূর্বপুরুষরা যে গ্রিনহাউজ গ্যাস গুলির নির্গমন ঘটিয়েছিলেন তারই ফল ভোগ করছি আমরা। আরও বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তন শুধু মাত্র উন্নত সমাজকেই যে প্রভাবিত করবে এমনটি নয়,একা হয়ে যাওয়া মানুষকেও তা প্রভাবিত করবে। এই ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়কে তাঁর কর্মজীবনের শেষ বেলায় আমাদের অচেনাই লাগছে! যিনি ঈশ্বরকে তাঁর আরাধ্য সংবিধানের আগে বসিয়ে সেই অনিয়তাকার সত্তার কাছে পরামর্শের প্রণামীর থালা বাড়িয়ে দেন। ভারতের প্রধান বিচারপতি শপথ নেওয়ার সময় নিশ্চিতভাবে উচ্চারণ করেছিলেন যে, তিনি ভারতের সংবিধানের প্রতি সত্যিকারের বিশ্বাস ও আনুগত্য প্রদর্শন করবেন এবং যথাযথ ও বিশ্বস্তভাবে তার অনুকূলে কাজ করবেন। অযোধ্যার রাম মন্দির দর্শন ও রামলালার কাছে নিবেদনের ছবিও সোসাল মিডিয়ায় দুর্লভ নয়। সেটা তাঁর ব্যক্তিগত ধর্মাচরণ; যার সঙ্গে রায়দানের ঈশ্বর তত্ত্ব একেবারেই যায় না!