গত বছর এক অবিশ্বাস্য সমাপতনের সাক্ষী হয়েছি আমরা। লোকসভা নির্বাচনের এক ঐতিহাসিক মুহূর্তেই জর্জ অরওয়েলের ‘নাইন্টিন এইট্টি ফোর’-এর প্রকাশের ৭৫তম বছর পূর্ণ হয়েছিল। বিখ্যাত সেই বইয়ের কথা আজ আর কারও অজানা নয়। বরং প্রায় সকল সচেতন নাগরিকই এখন চোখে দেখা বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে টের পেয়েছেন ‘দ্য মিনিস্ট্রি অফ ট্রুথ’ আসলে কী বস্তু! কাকতালীয় হলেও ২০১৯ সালেই ডোরিয়ান লিন্সকি ‘দ্য মিনিস্ট্রি অফ ট্রুথ : আ বায়োগ্রাফি অফ জর্জ অরওয়েল’স ১৯৮৪’ নামেই একটি বই লিখে বিরাট হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। বইটিতে লেখক সময়ের বিপ্রতীপে যাত্রা করে দেখিয়েছিলেন কীভাবে অরওয়েলের মাথায় এই ধরণের একটা মন্ত্রণালয়ের ধারণা দানা বেঁধেছিল যারা নাকি ক্রমাগতই মিথ্যার বেসাতি করে, নানান উপায়ে এরা জনগণের মধ্যে মিথ্যাকে এমনভাবে মিথ বানিয়ে প্রোপ্যাগান্ডা চালায় যে তার সত্যানুসন্ধানের প্রায় কোনো হদিস মেলে না!
আজ থেকে পাক্কা এক বছর আগে, এই শীতের জানুয়ারিতেই ‘দ্য ওয়্যার’ দীর্ঘ দু-বছর অনুসন্ধান চালিয়ে প্রকাশ করে দিয়েছিল বিজেপি দ্বারা পরিচালিত হুবহু সেরকম কাজেই ব্যবহৃত হওয়া একটি গোপন অ্যাপ ‘টেক ফগ’-এর কথা। সেই অ্যাপের দ্বারা নাকি মুহূর্তের মধ্যেই অসংখ্য (এখন এক্স)ট্যুইটার-ফেসবুক আকাউন্ট বানিয়ে ফেলা যায়। এই অ্যাপের সাহায্যে যে-কোনো বিষয়কে গাদা-গাদা ট্যুইটের সাহায্যে ট্রেন্ড করিয়ে দেওয়া যায়। সত্যকে ছাপিয়ে মিথ্যাকে সবার সামনে চোখের পলকে তুলে ধরা যায়। বিরোধী মতবাদীদের হেনস্থা করা থেকে প্রাণের হুমকি দেওয়া পর্যন্ত সবই নাকি হয় এই অ্যাপের একটা বোতামের মাধ্যমে। এমনকি দীর্ঘদিনের অব্যবহৃত হোয়াটসঅ্যাপ আকাউন্টকে হ্যাক করে সেখানকার যাবতীয় সঞ্চিত কনট্যাক্ট-এর কাছে ইচ্ছেমতো বার্তাও পাঠানো যায়। হিংসাত্মক ও উসকানিমূলক কাজে এই অ্যাপ নাকি এক ব্রহ্মাস্ত্র। কাজ মিটে গেলে আবার এক বোতামেই সমস্ত আকাউন্ট ডিলিট অব্দি করে দেওয়া যায় যাতে কোনোরকম অপকর্মের চিহ্ন অবশিষ্ট না থাকে। ডেরেক ও’ব্রায়েন এই নিয়ে বেশ সরব হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর চেঁচানোই সার। হালআমলের বাংলাদেশ থেকে আর জি কর অব্দি যে সেই একই ট্রাডিশন ফলো হয়ে আসছে এবং আরও হবে তা সম্ভবত তিনি তখন টের পাননি।
এরই সঙ্গে আবার শোনা যাচ্ছে আরও দুটি নতুন শব্দ – ট্র্যাডস ও রাইতাস। এগুলি কী? এরা নাকি এমন দুটি চরমপন্থী জনগোষ্ঠী যারা নিজেদেরকে অখণ্ড হিন্দুত্ব ও হিন্দুরাজ্য প্রতিষ্ঠার যোদ্ধা হিসাবে মনে করে। এদের নিজেদের মধ্যে যদিও মূলগত পার্থক্য আছে, কিন্তু মোটের ওপরে এদের প্রধান কাজ মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি, হিংসার মনোভাব প্রতিষ্ঠা করা, দাঙ্গাপ্রবণ কাজকর্মে প্ররোচনা জোগানো (অংশগ্রহণ করাও) ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের হ্যাঁটা করা ইত্যাদি। এসব দেখে-শুনে স্তব্ধবাক হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় সভ্য নাগরিকের নেই। এ-যেন ইতিহাসে পড়া ডকুমেন্টারিতে দেখা নাৎসি যুগের পুনরুত্থানের আরেক চেহারা। আর যাই হোক এসবের সঙ্গে সনাতন হিন্দুত্বের বিশেষ সম্পর্ক নেই। এই কাজে যারা ব্যবহৃত হচ্ছে তারা বেশিরভাগই যুব-সম্প্রদায়ভুক্ত। পালের গোদা যারা তাদের সন্তানরা বিদেশের ভালো-ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে আর এখানকার মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত শ্রেণির যুবক-যুবতীরা শিখছে কখনও সুল্লি-বুল্লি আবার কখনও হরিদ্বারের গুরুমন্ত্র। এই হল এখনকার পরিস্থিতি। কিন্তু এর আদলটাকে যুগোপযোগী আধুনিকতা দিয়ে বুঝতে হবে। কেননা আমরা একুশ শতকে এসে দাঁড়িয়েছি এমন এক প্রযুক্তি-নির্ভর সাইবার-বিশ্বে যেখানে ভূ-রাজনীতি নয়, বরং ডিজিটাল রাজনীতির যুদ্ধমঞ্চেই সংগঠিত হচ্ছে সত্যের বস্ত্রহরণের খেলাখানি। এখানে ইতিহাস কাল্পনিকতাকে যেমন প্রভাবিত করছে, তেমনই কল্পনাও বাস্তব হয়ে উঠে লিখতে থাকছে ইতিহাস।
২০১৪ সালের পর থেকে ভারতে এক অন্য ইতিহাসের সূচনা হয়েছে। তার সঙ্গে অনেকেই অরওয়েলিয়ান ডিস্টোপিয়ার সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন, অনেকে রামরাজত্বের (ইংরেজিতে যাকে বলা হয়্য ইউটোপিয়ার) গন্ধও পেয়েছেন। দল-উপদল-বিরোধী দলে জনমানুষ ভাগ হয়ে গিয়ে নিজেদের মতো করে সময়টাকে যুঝে নিচ্ছেন, বুঝে নিচ্ছেন। এখানে সমাজতান্ত্রিক, রক্ষণশীল, নৈরাজ্যবাদী, উদারনৈতিক, স্বাধীনতাবাদী ইত্যাদি নানান ধরণের আদর্শে বিশ্বাসী মানুষ বসবাস করছেন। প্রত্যেকেই নিজেদের মতো করে ‘টেক ফগ’ ইত্যাদির ঘটনাগুলিকে ব্যাখ্যা করছেন। কিন্তু আমরা প্রাকৃতজনেরাও কি অন্তর্ভুক্ত হব কোনো না কোনো দলে? হয়তো নয়। আর তাই যখন ‘দ্য ওয়্যার’ ‘টেক-ফগ’-এর পর্দাফাঁস করে দিয়েছে বলে জানা যাচ্ছে তখনও আমজনতাকে ব্যাপারটা যাচিয়ে নিতে হবে। বহু লিবারাল ও বামমতাবলম্বী বিদগ্ধজনেরা এই পর্দাফাঁসের পক্ষে কথা বলবেন কিন্তু তার মানে এটা নয় যে সেখানে অস্বচ্ছতা কিছু নেই, প্রশ্ন করার সংশয় কিছু নেই।
হ্যাঁ একথা সকল সচেতন নাগরিকই জানেন যে এইরকম অ্যাপ থাকলেও থাকতে পারে। কেননা এসব বানানোর মতো ইচ্ছা, প্রয়োজন, অর্থ ও লোক সবই বিজেপির আছে। কিন্তু এই সব থাকার পরেও কি ‘টেক-ফগ’-এর অস্তিত্ব সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া যায়? যায় না। বিজেপির বিরুদ্ধে পেগাশাস বা এই ধরণের কোনো ষড়যন্ত্রের সম্ভাবনা আছে বলেই যে যতটুকু ফাঁস হয়েছে তাকে না যাচিয়ে গ্রহণ করে ফেলব এমন চিন্তার পঙ্গুত্ব যেন কারও না হয়। ‘দ্য ওয়্যার’ হিংসা ও প্ররোচনা ছড়ানো অ্যাপ ‘টেক ফগ’ সম্বন্ধে মূলত চারটি দাবি করেছে – এক, এটা এর কাজের কোনো ‘ট্রেস’ পিছনে ফেলে রাখে না; দুই, তারা মুহূর্তের মধ্যেই এক ক্লিকে অসংখ্য সোশ্যাল-মিডিয়া আকাউন্ট বানিয়ে ফেলতে পারে ও বন্ধও করে দিতে পারে; তিন, এদের কাছে সঞ্চিত থাকা বিভিন্ন স্তরের মানুষের প্রায় সমস্ত (ব্যক্তিগত থেকে ডেমোগ্রাফিকাল, রাজনৈতিক ঝোঁক থেকে পেশার ইত্যাদি) তথ্যের সেট থেকে নিমেষে কাকে কীভাবে আক্রমণ করতে হবে তা ঠিক করে নেয় ও অবস্থানুযায়ী নানা বিষয়ের ওপরে হ্যাশট্যাগ করে প্রচুর ট্যুইটের মাধ্যমে সেটাকে ট্রেন্ড বানিয়ে দেয় ও চার, নিষ্ক্রিয় হোয়াটসঅ্যাপ আকাউন্টে সঞ্চিত কন্ট্যাক্টের কাছে একসঙ্গে প্রচুর প্রোপ্যাগান্ডামূলক বার্তা পাঠাতে পারে।
এরকম কিছু একটার অস্তিত্ব যে থাকতেই পারে সেটাকে অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু আদতে সেটা আছে কিনা সে সম্বন্ধে ‘দ্য ওয়্যার’ কী পাকাপোক্ত কোনো প্রমাণ হাজির করেছে। সম্ভবত না। তারা তাদের সোর্সের পাঠানো কয়েকটা স্ক্রিনশটের ছবি তুলে দিয়েছে আর বলেছে ৩২টা আকাউন্ট ও ১০০টা ট্রেন্ড হওয়া বিষয়ের ভিত্তিতে তারা এই দাবি করছে। তাদের উদ্দেশের সততা নিয়ে প্রশ্ন নেই কিন্তু তাদের দাবি প্রসঙ্গে কয়েক সংশয় ও প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে যা সমর্থ বনশল তুলেছেন।
প্রথম প্রশ্ন, ট্রেস ফেলে রাখে না কথা অর্থ যদি হয় যে তারা সমস্ত আকাউন্ট ডিলিট করে দেয় বা প্রাইভেট নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে তবে দুটি সন্দেহ থেকে যায় – এক, ফেসবুক-ট্যুইটারে আকাউন্ট ডিলিট করার ঝক্কির কথা আপনার জানা। তারা প্রথমে জানতে চায়বে কেন আপনি আকাউন্ট ডিলিট করছেন, তারপরে বোঝাবে কেন আপনার এটা ডিলিট করা উচিত নয়, তারপরে পাসওয়ার্ড-ওটিপি ইত্যাদি থাকবে। সুতরাং যদি কোনো অ্যাপ এক ক্লিকেই অসংখ্য আকাউন্টের জন্য এটা করতে পারে তাহলে তারিফ করতেই হবে যে দুনিয়ার জায়ান্ট প্রযুক্তিবিদদের সিকিউরিটি-সিস্টেমকে ভারত একেবারে কাবু করে দিয়েছে। আর তারা এটা দেখে-শুনে চুপ করে বসে আছে। দুই, প্রাইভেট অ্যাপের জন্য এপিআইয়ের ব্যবহারের কথা ওঠে যখন ‘স্ন্যাপচ্যাট’-এর মতো সংস্থার জড়িত থাকার দবিটি করা হয়।
দ্বিতীয় প্রশ্ন, অসংখ্য মানুষের তথ্য যদি তাদের কাছে মজুত থাকে তবে তার কী প্রমাণ হাজির করেছে ‘দ্য ওয়্যার’? কতকগুলি মামুলি স্ক্রিনশট ছাড়া কোনো তথ্যই দেখাতে পারেনি। তারা বলেছে এইসব তথ্যভাণ্ডার নাকি বিশাল ব্যাপক। অথচ একইসঙ্গে দাবি যে তাদের হাতে আছে মাত্র ৩২টা আকাউন্ট ও ১০০টা মতো ট্রেন্ড হওয়া বিষয়। এর ভিত্তিতে কী হাজার কিংবা লক্ষ-লক্ষ আকাউন্টের অস্তিত্বের দাবিতে পৌঁছানো যায়? ‘দ্য ওয়্যার’ ১৮% প্রোপ্যাগান্ডামূলক ট্যুইটের দায় চাপিয়েছে ‘টেগ ফগ’ অ্যাপের ওপরে, কিন্তু যদি সর্বমোট সংখ্যাই জানা না থাকে তাহলে কীসের ভিত্তিতে এই শতাংশের গণনা করা হল সেটা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়।
তৃতীয় প্রশ্ন, ‘টেক ফগ’ আদৌ অ্যাপ নাকি কোনো ধারণা বা কনসেপ্ট অথবা কোড সে নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। তারা বলেছে যে এটা একটা মেটাওয়ার্ল্ডের বিষয়, এর ব্যবহারকারীদের নানাজনের কাছে নাকি নানারকমের ভার্সন থাকতে পারে। এখানে ভয়ঙ্কর ধোঁয়াশা তারা রেখে দিয়েছে।
চতুর্থ প্রশ্ন, ‘টেগ ফগ’-এর সঙ্গে ‘শেয়ারচ্যাট’ কোম্পানির আর্থিক লেনদেনের দাবি করা হয়েছে এমন একটি ট্রাঞ্জাকসানের ছবির ভিত্তিতে যেখানে সময় দিন ক্ষণ নাম ধাম ইত্যাদি কোনো কিছু নিয়েই স্পষ্টতা নেই। কেন নেই – উত্তরও নেই।
পঞ্চম প্রশ্ন, ধরে নেওয়া যায় যদি যে ‘দ্য ওয়্যার’-এর দাবিগুলো সব সত্য। তাহলে যদি জিজ্ঞেস করা হয় যে এই সমস্ত কর্মকান্ডটা কি তারা নিজের চোখে দেখেছে বা নিজেরা ব্যবহার করে সত্যতা যাচাই করেছে? তারা কিন্তু নির্দিষ্ট জবাব দিতে পারে না। তারা শুধু দাবি করে যে কোনো এক অসন্তুষ্ট বিজেপির আইটি সেলের কর্মী যিনি এইসব কাজে যুক্ত হয়েছিলেন পরের টার্মে বিজেপি ক্ষমতায় এলে সরকারি চাকরি পাবেন এই আশায় তিনিই ‘দ্য ওয়্যার’-কে এইসব নানা বিষয় সম্বন্ধে জানিয়েছেন।
এখন কথাখানি হল যে, বিজেপি পুষ্ট ‘টেক ফগ’ থাকতেই পারে। সেটা নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু সেটা আদৌ আছে কিনা সে সম্বন্ধে আমাদের আরও একটু নিশ্চিত হতে হবে। এখনই ‘দ্য ওয়্যার’-এর দাবিকে বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করা যাচ্ছে না। কিন্তু যদি তাদের এই দাবি আরও ঠাসবুনোটে থাকা প্রমাণ পেয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় তবে একথা বলা অপেক্ষা রাখে না যে ভারত এক ভয়াবহ অন্ধকারের মধ্যে প্রবেশ করে গিয়েছে। মানুষকে সচেতন হতেই হবে। কেননা যেখানে এক ক্লিকেই বাস্তবতা পাল্টে গিয়ে ডিজিটাল ব্যঙ্গ, ভবিষ্যদ্বাণী, সতর্কতা, রাজনৈতিক মতাদর্শ, কল্পবিজ্ঞানের স্বাপ্নিকতা, গুপ্তচরবিদ্যার রোমাঞ্চ, মনস্তাত্ত্বিক ভয়বাদ, দুঃস্বপ্ন, উত্তরাধুনিক অস্তিত্ববাদ ও যাপনের নৈসর্গিকতার দুর্নীতিতে পরিণত হয় সেখানে নিজেকেও বদলাতে হয়। এ এক অনতিক্রম্য ভোগান্তির টানেলে প্রবেশ করা যেন। যখন কানের কাছে লাগাতার একটাই ভাষ্য উচ্চারিত হয় যে, ‘এই দুনিয়ায় কেউ স্বাধীন নয়, এমনকি কেউ নিরাপদ অব্দি নয়। এখানে একইসঙ্গে সৎ থাকা ও বেঁচে থাকা অসম্ভব’, তখন মনের ঝোঁক যাইই হোক সমস্ত কিছুকে সংশয়ের প্রশ্নবাণে পরখ করে নিতেই হবে। নইলে এক টানেলের থেকে মুক্তি পেতে অন্য টানেলের পরাধীনতাতেই থেকে যেতে হবে, আলো আর পাওয়া যাবে না।