"তুমি শুনেছ কেউ ওই চারজনের কাজটা এপ্রিশিয়েট করেছে? শুনেছ কাউকে বলতে যেটা করেছে সেটা দম আছে বলে করেছে? আমরা ভীতু বলে যে প্রশ্ন করতে ভয় পাই সেই প্রশ্নটাই ওরা করেছে - শুনেছ কাউকে এমন বলতে?" গমগম করছিল সহকর্মীর গলা। ভাষা বাংলা হলেও কয়েকটা শব্দ বোধহয় ছিটকে ঢুকছিল অ - বাংলাভাষী যাত্রীদের কানেও। ঘুরে তাকাচ্ছিলেন তাঁরা।
রাজস্থানের ভরতপুর থেকে ফিরছি কাজ সেরে। দিল্লি এয়ারপোর্টে প্লেনে ওঠার লাইনে দাঁড়িয়ে আছি বহুক্ষণ। এমন সময় দেখা এই সহকর্মীর সঙ্গে। সে দিল্লি এসেছিল কাজে, একই ফ্লাইটে ফেরা। এদিকে যাত্রীদের প্লেনে ওঠার লাইনে দাঁড়ানোর ঘোষণার পর আর কিছুই হয় না। সহকর্মী রসিকতা করেই বললেন “ যেখানে যত খুশি ছবি তোলাও না কেন, শেষমেশ এই অনন্ত প্রতীক্ষার লাইনে দাঁড়াতেই হবে।”
আমি বললাম - “সেই। নিরাপত্তার বজ্র আঁটুনি, এদিকে ফস্কা গেরো ঠিক থেকেই যায়। “ ছেলেটি সিরিয়াস হয়ে গেল এবং শুরু করল পার্লামেন্টের ধোঁয়া বোমার ঘটনা দিয়ে।
" চাকরি বাকরি নেই, মানুষের রোজগার নেই - পার্লামেন্ট তো এইগুলো আলোচনার জায়গা। সে আলোচনার ধার কাছ দিয়ে যখন কী সরকার, কী বিরোধী কেউ যাচ্ছে না তখন কাউকে তো কথাটা শোনাতে হবে। ডেসপারেট সময়ে মানুষ ডেসপারেট কাজই করে। বিশেষত যাদের করার কথা ছিল তারা যখন প্রশ্নগুলোর চেয়ে নতুন বাড়ির সিকিউরিটি নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন, তখন কাউকে না কাউকে অন্য রাস্তা বাছতে হয়। "
" সরকার বল আর বিরোধী , সবাই মহা প্যাঁচে পড়ে গেছে। না পারছে ফেলতে না পারছে গিলতে। দুদিন ধরে চেষ্টা করে সুইস ব্যাংকের ফান্ডিং পর্যন্ত পৌঁছে গেছে , তাও আবার আমাজনে কিনতে পাওয়া যায় এমন একটা জিনিসের জন্য! কোনটাই ধোপে টিকছে না।"
এবার আমি বললাম - " তাও দেখবে বেশ কিছু মানুষ এই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বিশ্বাস করে ফেলেছে। "
" ফেলবেই তো। লোকের তলিয়ে ভাবার ইচ্ছেটাই নেই। ঠিক এই কাজটা করে ভগৎ সিং পূজ্য আর এই চারজন টেরোরিস্ট! ভগৎ সিংকে দূর থেকে দেবতা বানানো যায় কিন্তু ওনার কাজটা এপ্রিশিয়েট করা যায় না। এই চারজন আমাদের এই দ্বিচারিতা উন্মুক্ত করে দিল বলেই না রাতের ঘুম ভাল করার স্বার্থে এইসব উদ্ভট ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব বিশ্বাস করতে হবে!"
“ সরকারপক্ষ কী করবে জানা। ওরা ওদের দিক দিয়ে সৎ। যা মনে করে দ্বিধা না করে করে দেয়। কিন্তু বিরোধীদের দেখ। ঠিক করে উঠতে পারছে না কী করবে। বেকারীর মত এত হাতে গরম ইস্যু। এই ঘটনাটাকে ঠিকঠাক ব্যবহার করলে একটা কাজের কাজ হত কি না? এরা আর কবে বুঝবে? “
“বুঝলে শুভ্র দা। আমার একমাত্র ভরসা এদেশের যুব শক্তি। চাকরি নেই, জীবনের স্থিতি নেই, দেখবে তুমি যুবশক্তি জাগবেই, জাগতে হবেই। এই ঘটনাটা তারই প্রমাণ। “
ওর উদ্দীপনায় মন সায় দিচ্ছিল না। যে তথাকথিত শিক্ষিত জনগণ সমাজের ন্যারেটিভ তৈরি করে, জনগণকে তা গুলে খাওয়াতে সাহায্য করে, তারা নিশ্চয় কাজের সুযোগের অভাবের চেয়ে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ইস্যুকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। অমৃতকালে সেটাই স্বাভাবিক কারণ কাজের সুযোগ এবং কাজের নিরাপত্তার ধারণা এ যুগে বদলে গেছে। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তের মতাদর্শগত দোগলাপনা অবশ্য নিজের শ্রেণীর প্রাত্যহিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও বেরিয়ে পড়ে। ভরতপুর জংশনে ট্রেন ধরতে গিয়ে দেখলাম প্ল্যাটফর্মটি মরণফাঁদ। সংস্কারের অজুহাতে মাঝ বরাবর একটি প্রায়-পরিখা খুঁড়ে রাখার ফলে ট্রেন আসার পরের হুড়োহুড়িতে দুর্ঘটনা অবধারিত। অথচ শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কামরায় আলোচনা চলছে মিডিয়া কীভাবে রাজ্য বিজেপিতে না-থাকা মতবিরোধকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে পরিবেশন করছে সেই নিয়ে। উচ্চবিত্তের বাহন বিমানেও কাহিনী কিছু ভিন্ন নয়। আমার চারপাশের একাধিক সিটে স্বাস্থ্যবান কয়েকজন পুরুষ একাধিক মোবাইল অন রেখে বসে রইলেন , বুকে আসাম পুলিশের ব্যাজ ঝোলান। আমি কিছু না বলে টেক অফের আগে কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম, দৃকপাত করলেন না। প্লেন থামার সঙ্গে সঙ্গে দুদ্দাড়িয়ে উঠে পড়লেন প্রত্যেকে। বুঝলাম প্রথম সারির সিটে কোন কেষ্টবিষ্টু আছেন, এঁরা তার নিরাপত্তায় নিয়োজিত। নামার সময় দেখলাম ভি আই পি টি খোদ আসামের মুখ্যমন্ত্রী! যাত্রীদের কারও কোন হেলদোল নেই। বরং জানি অনেকেই নিয়মিত এই কাজটি করে থাকেন, বিমানসেবকদের সাবধানবার্তার তোয়াক্কা না করেই। এবং তারপরে এঁরাই “ সবার উপরে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা” র ভাষ্যে সজোরে গলা মেলান। এঁদের সর্বগ্রাসী প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে দ্রোহ করা যুবশক্তির পক্ষে সম্ভব?
প্লেনে বসে আমি ওর কথাগুলো তাও ভাবছিলাম আর অবাক হচ্ছিলাম। ছেলেটিকে যতদূর জানি তাতে সে মন দিয়ে পড়ায়, গবেষণা করে, মতামতের দিক থেকে “লিবারাল” বলে খোপে ফেলে দেওয়া যায়। বাড়ীর আর্মি ব্যাকগ্রাউন্ডের জন্য ভেবেছিলাম তার কাছে দেশের নিরাপত্তা, গণতন্ত্রের মন্দিরে হামলা ইত্যাদি প্রভৃতি চেনা শব্দ শুনব কিন্তু শুনলাম সম্পূর্ণ উল্টো ভাষ্য। অবশ্য অমৃতকালে ঘটা প্রায় সবই চেনা হিসেবের উল্টোখাতে বইছে। না হলে কংগ্রেসের মত দক্ষিণপন্থী দলের মুখ রাহুল গান্ধী “গণতন্ত্রের মন্দিরের” নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন ঐ অনামা যুবক, যুবতীদের তোলা প্রশ্নের উপর আর বিরোধী জোটে থাকা কমিউনিস্ট পার্টিগুলির নেতৃত্বের কাছে বেশি গুরুত্ব পায় সংসদের রঙিন ধোঁয়ার জন্য দায়ী কে, একজনকে ক্লাসরুম থেকে বের করে দেওয়ায় অন্যজনকেও কেন দেওয়া হবে না সেই নিয়ে তর্জা?
ভগৎ সিং এর রাজনীতির উত্তরাধিকারী বলে যারা দাবি করে থাকেন, স্লোগানে, মিছিলে যারা অহরহ ভগৎ সিং এর নাম নেন, প্রায় ১০০ বছর আগে বটুকেশ্বর দত্তকে সঙ্গে নিয়ে ভগৎ সিং যে ঘটনাটা ঘটিয়েছিলেন, আজকে অন্তত মোডাস অপারেন্ডির দিক থেকে একই ঘটনায় তাঁরা দিশাহারা। রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের হাতিয়ার দানবীয় আইনে ছেলে মেয়েগুলিকে অভিযুক্ত করার বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ দূর, তাদের তোলা প্রশ্নগুলি নিয়েও তাঁদের প্রতিক্রিয়া মিইয়ে যাওয়া মুড়ির মত।কয়েক বছর আগে একটি দেশের এক নামী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কথায় কথায় এক অধ্যাপক বলে বসেছিলেন “ ভগৎ সিংদের এই সময়ে আর কোন প্রয়োজন নেই। এখন বেশি দরকার প্রযুক্তিবিদ আমলার। “সেই কথা অনেকেই ভাল মনে নেননি, প্রতিবাদ করেছিলেন। তবে সে প্রতিবাদ নিছকই ভগৎ সিং এর মূর্তিপূজায় ব্যাঘাত ঘটায়। সন্দেহ হয় বিরোধী জোটের কমিউনিস্ট পার্টিগুলির কাছেও ভগৎ সিং তাদের ক্রমাগত মধ্যমুখী যাত্রা, তার আনুষঙ্গিক দোদুল্যমানতা, দ্বিচারিতার স্মোকস্ক্রিন বৈ কিছু নন। ১৩ ডিসেম্বরের রং বোমার ধোঁয়ায় সেই স্মোকস্ক্রীন বোধহয় খসে পড়ল।