অনেক রক্তপাতের পর বাংলার পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা হল। এই ফল প্রত্যাশিত ছিল যারা দাবি করছেন, তাদের পরিবেশের প্রতি এক উদাসীনতা ছিল, তা অস্বীকার করার জায়গা নেই। তাদের কোন ইস্তেহারে পরিবেশের কথা নেই। কিন্তু জনতার রায় শেষ কথা বলে। কাজেই বাকিদের অভিযোগগুলো জনতার আদালতে ধোপে টেঁকে না। মানুষ ভুলে যায়। এটা মানুষের ধর্ম।
পরিবেশকে প্রচারের হাতিয়ার করে উত্তরবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলাতে যে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন, পঞ্চায়েত ভোটের বৈতরণী তিনি পেরিয়েছেন।অর্থাৎ জিতেছেন। যদিও তিনি একটি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি ছিলেন।তবে নদীর জন্য যে ভোট চেয়েছিল মানুষের কাছে,সেই জলঙ্গী নদী সমাজের প্রতিনিধি তারক ঘোষ পেলেন মাত্র ৫৮টি ভোট। জামানত জব্দ হলো। এতে লজ্জার কিছু নেই। যে ৫৮ জন মানুষ নদীর পক্ষে রায় দিয়েছেন তাদেরকে কুর্নিশ। পরিশ্রম কখনো বৃথা যায় না। নদীর পক্ষে আটান্ন জন মানুষকে জোড়া গেল, এটাই প্রাপ্তি। তারকের মতো দিন আনা দিন খাওয়া অতি সাধারণ পরিবেশ কর্মীরা মৃতপ্রায় জলঙ্গীর জন্য ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন বলেই, নদীর সমস্যাগুলো অনেক বেশি করে দল নির্ভর সাংবিধানিক কাঠামোর সামনে উঠে আসছে। আলোচনা হয়েছিল এবং আগামীদিনেও হবে। কাজেই পরিবেশের প্রশ্ন সরাসরি রাজনীতির উঠোনেই আজ পরিবেশ ও নদীকর্মীদের দাঁড়াতে হবে।জন্মগত ভাবে প্রত্যেকটি মানুষ রাজনৈতিক জীব। কাজেই পরিবেশ কর্মীদের অরাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে আর পরিচয় দিলে হবে না। রাজনীতির মাঠে নামা ছাড়া তাদের সামনে আর কোন বিকল্প নেই। আসলে পরিবেশ বলতে জীবনের যাপনের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত বিষয়গুলো পরিবেশের বিষয় হঠে। যেমন সলিড ওয়েস্ট ম্যানজমেন্টের ক্ষেত্রে শহরগুলোতে ভাবনা চিন্তা হলেও পঞ্চায়েত স্তরে একেবারেই তা নিয়ে ভাবা হয় না। আবার সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যবহার শহরে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনা গেলেও, গ্রামে সম্ভব হয়নি। ইটভাটাগুলো অনিয়ন্ত্রিত ভাবে যেখান সেখান থেকে 'টপ সয়েল' কেটে নিচ্ছে। যার ফলে ক্ষতি হচ্ছে মাটির। মাটি হারাচ্ছি আমরা। এই রকম অনেক বিষয় যা জীবন ও জীবিকার সঙ্গে যুক্ত হয়েও ভোটের ময়দানে একেবারেই উঠে আসছে না। কাজেই পলিসি লেভেলে সে কথাগুলো পৌঁছে যেতে পারছে না।
নর্মদা আন্দোলনের নেত্রী মেধা পাটেকরও ভোটে দাঁড়িয়ে ছিলেন মুম্বাইয়ে। পরিবেশের প্রশ্নই দাঁড়িয়ে ছিলেন। নদীর পক্ষ হয়েই কথা বলেছিলেন। বড় বাঁধের বিরোধিতা করেছিলেন। পরিবেশের প্রশ্নে মানুষ তাঁকে ভোট দিয়েছিলেন। ভোটের পরিমাণ ছিল খুবই অল্প। তা দিয়ে জিততে পারেননি মেধা। তার মানে তো এটা নয়, যে পরিবেশের প্রশ্নগুলো অবান্তর। নদীর প্রশ্নগুলো সময়োপযোগী নয়। আবার সেই মেধাজী যখন নর্মদা আন্দোলনের ডাক দিচ্ছেন ভারুজে,তখন লেখিকা অরুন্ধতী রায়, পরিবেশবাদী হিমাংশু কুমারের মত মানুষেরা সর্দার সরোবর এর উচ্চতা বৃদ্ধির বিরুদ্ধে সমর্থন জানাচ্ছেন।
সামাজিক আন্দোলনে কোন বিষয়ে মানুষ তার প্রতিক্রিয়াকে ব্যক্ত করবে, সেটা সম্পূর্ণ নির্ভর করে তার ব্যক্তিগত মননের বিকাশের ওপর। পরিবেশকর্মীরা সেই মননে কিছুটা চিন্তার খোরাকি জুটিয়ে দিতে পারেন।এটা পরিবেশ কর্মীদের কাজ। এই দায়বদ্ধতার বিকাশে সমাজ যে বিশেষ ভূমিকা নেয় -এমনটা নয়। দায়বদ্ধতা নির্মাণ হয় তার 'প্রতিবেশ' থেকে উঠে আসা নানা বিষয়ের সংঘাতের মধ্যে দিয়ে। যে বিষয়গুলো জুড়ে থাকে তার দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে। যে বিষয়গুলো জীবন ও জীবিকার উপর প্রভাব বিস্তার করে।
ভারতবর্ষের নদী আন্দোলনের এক বিশাল পরিসরের মধ্যে জলঙ্গি নদী যে জায়গা করে নিয়েছে মানুষের মধ্যে তা উল্লেখযোগ্য। সাংবিধানিক পরিকাঠামোর মধ্যে থেকে যে ৫৮ জনকে নদীর পক্ষে ভাবাতে পেরেছেন তারক ও তার সাথীরা, তা ভবিষ্যতে একটা দিক তৈরি করল।এবং একটা প্রশ্ন উসকে দিল। তা হল এক বড় সংখ্যক মানুষ তাহলে নদীর পক্ষে কবে ভাববে? সরাসরি কোন উত্তর নেই। তবে ঔপনিবেশিকতা আমাদের মজ্জায় মজ্জায় যে ভাবে ঢুকে আছে, তা আমাদের চিন্তার অন্তরায় নির্মাণ করে। এই কথা ভুললে হবে না, উনিশ শতকের নবজাগরণের যে চিন্তার জোয়ার এসেছিল, সেই জোয়ারের টানে ভাটা আসতে শুরু করে ষাটের দশকের দশকের শেষ। সত্তরের উত্তাল রাজনৈতিক সময় পেরিয়ে, ভূমি সংস্কারে বিপ্লব এনে যে মাটি বাংলায় নির্মাণ হল, সেখানে ধীরে ধীরে ভেঙ্গে ফেলা হল স্বতন্ত্র চিন্তন।
কাজেই সাধারণ মানুষ সমস্যাগুলোকে পরপর গুছিয়ে উঠতে পারেন না একসঙ্গে। গুলিয়ে ফেলে অন্যের সঙ্গে, অন্য সমস্যার সঙ্গে। এখানেই সমস্যাগুলো শ্রেণীবিভাগ প্রয়োজন হয়। আর সেই সমস্যার শ্রেনী বিভাগে পরিবেশের প্রশ্নে নদীর স্বার্থে মানুষের কাছেই বার বার পরিবেশ ও নদী কর্মীদের ফিরে যেতেই হবে। নদী বাঁচানোর জন্য লড়াই-এ অনেক পথ বাকি। পঞ্চায়েত থেকে শুরু হয়ে এই লড়াই আদালত পর্যন্ত গড়াতে হবে। সব কথাগুলোকে সঙ্গে সাপ্টে নিয়ে বলতে হয়- কতটা পথ পেরোলে নদী বাঁচানো যায়? এই প্রশ্নটাই এই মুহূর্তে সব থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাসঙ্গিক।
কারণ আন্দোলনের শেষ হয় না, হয় শুরুয়াত।