পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী: স্মৃতির আঁচড়ে দু-চার কথা

  • 02 October, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 1245 view(s)
  • লিখেছেন : অশোক মুখোপাধ্যায়
গান্ধীকেও এক সময় দক্ষিণ আফ্রিকাতে পরিচিতি কার্ডের বিরোধিতা করতে হয়েছিল। তিনিও এক কালে ব্রিটিশের ধামাধরা প্রেস বয়কটের ডাক দিয়েছিলেন। বিজেপি-শাসকরা নিশ্চয়ই এসব খবর জানে। তাই দেশের রাজনীতির সামনে গান্ধীর ব্যক্তিগত ভাবমূর্তিকে মুছে দিতে তারা বদ্ধপরিকর। আজ গান্ধীর জন্মদিনে, তাঁকেই আবার নতুন করে বোঝার চেষ্টা।

আমি একজন কট্টর গান্ধীবাদ বিরোধী লোক। তবু আজ তাঁর জন্ম দিবসে তাঁকে স্মরণ করে দুচারটে প্রীতি ও অপ্রীতির কথা বলতে চাই।

তাঁর সৌভাগ্যই বলতে হবে, হিন্দু ধর্ম নিয়ে অনেক বাড়াবাড়ি করা সত্ত্বেও তিনি যে মনের গভীরে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী ছিলেন না, মরণে সেটা প্রমাণ করার সুযোগ পেলেন। নাথুরাম গডসেরা মোহনদাসকে শুধুই মারেনি, তাঁর সম্মানকে বাঁচিয়েও দিয়েছে। আরএসএস বিজেপি-দের ধর্মোন্মত্ততার সঙ্গে যে তাঁর ধর্মীয় চেতনার বিরোধ ছিল সেটা উভয় তরফই সেদিন প্রমাণ করেছিল।

গান্ধীর মধ্যে প্রচণ্ড স্ববিরোধ ছিল। ভালো মন্দের। ভুল ঠিকের। জাতিবাদ বনাম উদারতার। ধর্মীয় রক্ষণশীলতা আর প্রশস্ততার। নীতি গ্রহণ ও বর্জনের। জেদ ও শোধনের। না, বিবেকানন্দের মতো নয়। একই কালে দুই দেশে দুরকম বক্তব্য নয়। শ্রোতা অনুযায়ী বক্তব্যের সুর পালটানো নয়। এ ছিল এক ধরনের দোলাচল। মানসিক দৃঢ়তার অভাব। কিছু কিছু ক্ষেত্রে জ্ঞানের অভাব। শেষ বিচারে শ্রেণিগত ভূমিকা পালনের বাধ্যতা বনাম অনিচ্ছা। শ্রেণিস্বার্থ আর সদিচ্ছার দ্বন্দ্ব নিরসনে অপারগতা।

স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর যোগদান যথেষ্ট বিলম্বিত। টাকা রোজগারের উদ্দেশ্যে দক্ষিণ আফ্রিকায় গমন করে তিনি নিজেকে স্বেচ্ছায় এই বৃহৎ কর্মযজ্ঞ থেকে সরিয়ে রেখেছিলেন। সেই দেশের কোনো এক স্টেশনে সেই সাদা সাহেব তাঁকে রেল গাড়ির প্রথম শ্রেণির কামরা থেকে কালা নেটিভ ভেবে নামিয়ে না দিলে ভারতীয়দের কিন্তু জাতি হিসাবে পিতৃহীন হয়েই থাকতে হত আজও। সেই সাহেবকে মরণোত্তর ধন্যবাদ দিই আমি, না জেনে এই একটা ভালো কাজ করে ফেলার জন্য!

স্বাধীনতা আন্দোলনে গান্ধীর দুটো বড় অবদান আমাদের স্বীকৃতি দিতে হবে।

এক

তিনি এই আন্দোলনকে ইংরেজি শিক্ষিতদের সীমাবদ্ধ প্রতিবাদী অভিভাষণ ও স্মারকলিপি নিবেদন থেকে বের করে এনে গণ আন্দোলনের আকার দিতে সক্ষম হন। তাঁর চরকা, তাঁর বিশ্বাস যাই হোক, স্বাধীনতার পক্ষে কোনো বড় হাতিয়ার না হলেও আম জনতার হাতে দেশের কাজের একটা রূপক কর্ম হিসাবে জায়গা পায়। তিনি অহিংসার নাম করে যে সমস্ত আন্দোলন পদ্ধতি নির্বাচন করেন – সত্যাগ্রহ, আইন অমান্য, অনশন, ইত্যাদি – অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য সহজপাচ্য কর্মসূচি হয়ে ওঠে। সকলেই অক্লেশে সানন্দে যোগদান করতে পারে। সেই থেকে আজ অবধি অনেক বামপন্থীরাও একই ক্রিয়াপন্থা ব্যবহার করে চলেছেন। একটাও নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করে বের করতে পারেননি। যদিও, সময় হয়েছে নতুন পদ্ধতি খুঁজে পাওয়ার।

দুই

তিনি আন্দোলনে যুক্ত সার্বক্ষণিক সেবকদের জন্য আশ্রমের পরিকল্পনা করেছিলেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে স্থাপনও করেছিলেন বেশ কয়েকটি আশ্রম। সেই সব গান্ধী আশ্রম আজও নিবু নিবু হয়ে টিকে আছে। এমনকি, বাংলাদেশেও। অথচ বামপন্থীদের অনেক কমিউন পার্টি মেস উঠে গেছে।

স্বাধীনতা আন্দোলনের গতি প্রবাহে গান্ধী ক্ষতি করেছেন তিন জায়গায়।

এক

“অহিংসা”কে একটা রণকৌশল হিসাবে গ্রহণ করার বদলে একে তিনি একটা মৌল নীতি হিসাবে চালু করতে চান। বাস্তবে তাঁর এই অহিংসা ছিল কেবলমাত্র ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রযোজ্য। ব্রিটিশদের ব্যবহৃত হিংসাকে তিনি সর্বান্তঃকরণে সমর্থন ও সাহায্য করেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় স্থানীয় আদিবাসীদের বিরুদ্ধে, চিনের বিরুদ্ধে আফিম যুদ্ধে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও। টাকাপয়সা তুলে দিয়েছেন, মাল সরবরাহ করেছেন, সেনা নিয়োগে সহায়তা করেছেন। সেই সব ক্ষেত্রে অস্ত্রের ব্যবহারে তাঁর প্রাণ মন বিবেক কাঁদেনি। তার পরেও যে তিনি বিশ্বে অহিংসার পূজারী হিসাবে গণ্য হয়েছেন, সে নিতান্তই ক্ষমতাশীল ও ক্ষমতাসীনদের নিরন্তর প্রচারের গুণে। আর সেই সুযোগে হিংসা অহিংসার প্রশ্নটা আন্দোলনের মূল লক্ষ্যের চাইতেও বড় হয়ে উঠেছে। মূল লক্ষ্যকে গৌণ করে ফেলা সম্ভব হয়েছে।

দুই

অহিংসাকে নৈতিক শক্তি হিসাবে প্রচার করলেও রাজনীতিতে বিরোধীদের ক্ষেত্রে এই অহিংসার পূজারী বরাবরই অত্যন্ত অনৈতিক অবস্থান নিয়েছেন। সে গোপীনাথ সাহার ঘটনায় হোক, যতীন দাস-এর আত্মাহুতি বা ভগত সিং-দের ফাঁসির ঘটনায় হোক, অথবা সুভাষ বসুর দ্বিতীয়বার সভাপতি নির্বাচনের সময় হোক। কিন্তু শুধু মাত্র অর্থ উপার্জনের সময়কার কোটপ্যান্ট ছেড়ে কংগ্রেসে যোগ দিয়ে যোগী বেশ পরে থাকার দরুন সেই সব অনৈতিক কার্যাবলি ইতিহাসে অনায়াসে চাপা পড়ে গেছে। এর ফলে কংগ্রেসি তথা ঘরোয়া রাজনীতিতে দ্বিচারিতা অনৈতিকতা একটা প্রামাণ্য আচরণ বিধি হিসাবে মর্যাদা পেয়েছে। জনমনে গ্রাহ্য হয়েছে। আজকের শাসকেরা সেই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে বেশ ভালো মতো।

তিন

এক ধর্মীয় ভাবাবেগ থেকে তিনি এক দিকে স্বাধীনতা আন্দোলনকে হিন্দু ধর্মীয় সংস্কৃতির সাথে প্রায় একাত্ম করে দিতে চেয়েছেন। করতে গিয়ে হিন্দু ধর্মের সমস্ত আচার বিচার কুপ্রথাগুলিকে বিভিন্ন ভাবে সমর্থন যুগিয়েছেন, সম্মান বৃদ্ধি করতে চেষ্টা করেছেন। অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে অনেক কথা বললেও জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেননি, বরং নানা কায়দায় তাকে যুক্তিসম্মত প্রমাণ করার চেষ্টা চালিয়েছেন। ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত গোরক্ষা আন্দোলনের উচ্চবাক প্রবক্তা ছিলেন তিনি।

ফলে তিনি যখন মুসলমান সম্প্রদায়কে স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর কর্মসূচিতে টেনে আনতে চেয়েছেন, সেও মুসলিম সমাজের পিছিয়ে পড়া চেতনাকে আশ্রয় ও প্রশ্রয় দিয়েই। খলিফাতন্ত্র নামক এক মধ্যযুগীয় ধর্মাশ্রিত সামন্তরাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে তিনি স্বাধীন ভারত গড়ার স্বপ্নের সাথে মেলাতে গিয়ে না পেরেছিলেন মেলাতে, না পেরেছিলেন বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষকে সামনের দিকে তাকাতে বলতে। রাম কাম খলিফা মিলে সাম্প্রদায়িক “সম্প্রীতি”র যে স্বপ্ন তিনি খাড়া করেন, তা যত দিন গেছে স্বাধীনতা আন্দোলনকে বিভক্তই করেছে, ঐক্যবদ্ধ করেনি। মুসলিম লিগের স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন তাই স্বাধীনতা আন্দোলনের সমান্তরালে তারই হাত কেটে বাড়তে থাকে।

তিনি যে হিন্দু ধর্মের সুর বাঁধতে থাকেন তা শেষ বিচারে ব্রাহ্মণ্যবাদেরই গুনগুনানি হয়ে উঠতে থাকে। তথাকথিত নিম্নবর্গের মানুষ তাঁর প্রকল্পিত আসন্ন রামরাজত্বে শূদ্রত্ব প্রাপ্তির যে নিশ্চিন্তি পান তাতে তাদের দুশ্চিন্তা জেগে ওঠে। তাই তারাও শেষ অবধি যে স্বতন্ত্র দলিত মুক্তির আন্দোলন গড়ে তোলেন তা স্বাধীনতা আন্দোলনের অংশ নয়, অন্য পক্ষ হয়ে ওঠে।

পক্ষান্তরে, ব্রাহ্মণ্যবাদীরা অনুভব করে, গান্ধীর আন্দোলনে ব্রাহ্মণ্যবাদের স্পষ্ট ঘোষণা নেই। সনাতন ধর্মকেই প্রতিষ্ঠা করার সংকল্প নেই। এক উদার সর্ব ধর্মের সমন্বিত ভারতের স্বপ্নই তাতে দুর্বলভাবে হলেও বন্দিত। সুতরাং তারাও আর এক ভিন্ন ধারায় ব্রাহ্মণ্যবাদের নিজস্ব ইন্দ্রপ্রস্থ স্থাপনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

গান্ধীর শক্তিশালী নেতৃত্বের আবেশেই স্বাধীনতা আন্দোলন এই ভাবে চতুর্ধারায় বিভক্ত হয়ে যায়।

মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী এই ভুলগুলি বুঝতে পেরেছিলেন। আজাদ হিন্দ সেনাবাহিনীর আভ্যন্তরীন সাফল্য ও বাহ্যিক ব্যর্থতার খবর থেকে। সেই একই গান্ধী রাজনীতি থেকে ধর্মকে ছেঁটে ফেলতে আগ্রহী হয়ে পড়েন। সেই গান্ধীই অহিংসার ঠুনকো চুরিগুলি ফেলে দিয়ে আজাদ হিন্দ বাহিনীর আটক শস্ত্রধারী সেনাদের নানা ভাবে সাহায্য করতে ব্যস্ত হন। সেই তিনিই তখন গোরক্ষার আওয়াজকে কংগ্রেসের মঞ্চ থেকে সরিয়ে দিতে, সংবিধানের পাতায় লেখার বিরুদ্ধে কলম তুলে নেন। তখন তিনি যেন এক অন্য চরিত্র।

দুঃখের কথা হল, একমাত্র তখনই তিনি আবিষ্কার করলেন, তিনি ছাড়া পৃথিবীতে আর কোনো গান্ধীবাদী নেই। তাঁর পদপ্রান্তে ভিড় জমিয়ে বসে থাকা গান্ধীটুপি পরিহিত নেতারা তাঁকে তখন গুদামে বা শো কেসে পুরে ফেলতে চান। হাসাহাসি করেন। দেশ ভাগের পরিকল্পনায় কীভাবে তাঁকে প্যাঁচে ফেলে রাজি করানো যায় তার অঙ্ক কষেন!

ভারতের বুর্জোয়াদের গান্ধী নির্ভর কাজ তখন প্রায় হাসিল হয়ে গেছে। জনরোষ জাগিয়ে ইংরেজকে ঠেলে গণবিপ্লবকে আপাতত (এখন আমরা জানি, বেশ অনেক দিনের জন্য) ঠেকিয়ে দেওয়া গেছে। দেশের বাজার, প্রাকৃতিক সম্পদ আর শাসকীয় কুর্সি হাতের নাগালে এসেই গেছে। ফলে “রঘুপতি রাখব ...” গানের ধুনে গলা মেলাতে তারা আর গান্ধীর পেছন পেছন হাত জোড় করে ঘোরে না।

গান্ধীকে তখন সরিয়ে দেওয়া সহজ হয়ে যায়! নানা তরফে। আজ থেকে পঁচাত্তর বছর আগে।

শোনা যায়, গান্ধীকেও এক সময় দক্ষিণ আফ্রিকাতে পরিচিতি কার্ডের বিরোধিতা করতে হয়েছিল। তিনিও এক কালে ব্রিটিশের ধামাধরা প্রেস বয়কটের ডাক দিয়েছিলেন।

বিজেপি-শাসকরা নিশ্চয়ই এসব খবর জানে। তাই দেশের রাজনীতির সামনে গান্ধীর ব্যক্তিগত ভাবমূর্তিকে মুছে দিতে তারা বদ্ধপরিকর। যাতে এসব খবরে দেশের আম জনতা প্রভাবিত না হয়। যারা দাঙ্গা লাগিয়ে দেশভাগকে ত্বরান্বিত করেছিল সেই শ্যামাপ্রসাদ বা সাভারকরদের মরচে পড়া মুখগুলিকে ঘসে ঘসে উজ্জ্বল করতে হলে যিনি দাঙ্গা থামাতে নোয়াখালি বা ভাগলপুরে ছুটে যেতেন, তাঁর মুখচ্ছবিকে ঝাপসা করে দিতেই হবে।

আমাদেরও এটা বুঝে নেবার সময় বোধ করি এসে গেছে।

লেখাটি গুরুচন্ডালী ব্লগে পূর্বে প্রকাশিত লেখকের একই বিষয় সংক্রান্ত লেখা রদবদল করা হয়েছে।

 

0 Comments

Post Comment