চন্দ্রযানের সাফল্য নিয়ে ভারতে আমরা সবাই গর্বিত। এই সাফল্যের অনেকটা জুড়ে আছে আমাদের স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতে বিজ্ঞান চর্চার ধারাবাহিকতা। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি থেকেই বেড়িয়ে এসেছেন সফল গবেষকদের সিংহভাগ - নারী, পুরুষ নির্বিশেষে।
ইসরোর অসামান্য সাফল্য নিঃসন্দেহে দেশকে সারা বিশ্বের বিজ্ঞান সাধনার জগতে এক পোক্ত আসন করে দিল। অবশ্য ইসরোর এটাই প্রথম সাফল্য নয়, প্রতিষ্ঠানটি ভারতে মহাকাশ বিজ্ঞানের চর্চায় তাদের সাফল্যের ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন রেখেছে।
এতো গেল বিজ্ঞানের ও বিজ্ঞানীদের কথা। এবার আসি আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কথায়। বিজ্ঞানের দান যারা প্রতিনিয়ত গ্রহণ করছি অথচ নিজেদের চারপাশে তৈরি করে রেখেছি অপবিজ্ঞান তথা কুসংস্কারের পরিমণ্ডল, আর তার ভিত্তি ধর্ম তথা পুরুষতান্ত্রিক আচার। অনেকে বলবেন আনন্দের মুহূর্তে এসব কথা আবার কেন? আমার মনে হয় এই কথাগুলো ভেবে দেখার এটাই সঠিক সময়; সাফল্যের আলোয় আমাদের দ্বিচারিতার অন্ধকার ঘুচে যাক।
কিছুদিন আগে পুনে যাবার পথে প্লেনে একদল ইংরেজি বলিয়ে, লেখা পড়া জানা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, এদের পোশাকি নাম 'প্রাণিক হিলার। এনারা পরি, ড্রাগন, ক্রিস্টাল এসবের সাহায্যে মানুষের শারিরীক ব্যাধি পর্যন্ত সারান। এই দলে দুই - তিনজন ডাক্তারও ছিলেন। অবশ্য 'প্রানিক হিলার' পর্যন্ত যেতে হবে না, চারপাশে তাকান- সান স্টোন থেকে মুন স্টোনের আঙটি পরিধান করে ঘুরছেন অনেকেই, শিক্ষক থেকে বৈজ্ঞানিক বা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়াররা। কলকাতার এক বিখ্যাত ডাক্তারের কব্জিতে বিপত্তারিনীর লাল সুতো, তিনিই আবার সমাজের অবক্ষয় নিয়ে জ্ঞান দিয়েই থাকেন, নানান প্রথম সারির টেলিভিশনে। এই জন্যই বোধহয় চন্দ্রযানের মডেল নিয়ে মন্দিরে পুজো দিতে ছোটেন কিছু বিজ্ঞানী আর ইসরোর প্রায় প্রতিটি বড় কর্মকাণ্ডের আগে হয় পুজা পাঠ। যেমন মুম্বাই আই আই টি তে গোশালা খোলার বিধান জারি হয়ে যায় প্রায় বিনা প্রতিবাদে। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের নতুন পার্লামেন্ট ভবন উদ্বোধনেও হয় যজ্ঞ। করোনার সময় থালা বাজানো বা আলো নেভানো কে অনেকে সলিডারিটি বলে চালাতে চাইলেও, বাস্তবে সেটাও একটা অন্ধ সংস্কারের ফসল। দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী করা হয়, এমন একজনকে, যিনি কোভিড সারাতে, 'ভাবিজি পাঁপড়' খাওয়ার নিদান দিয়েছিলেন। অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়, সেই উদাহরণে ছোট বড় কোন ধর্মই বাদ যাবে না, তবে তার প্রয়োজন নেই। এককথায় বিজ্ঞান ও ধর্মীয় সংস্কার হাত ধরাধরি করে চলে আজকের ভারতে। তাছাড়া লক্ষনীয় সরকারি সংস্থা গুলিতে শুধু যে ধর্মীয় আচার পালন করা হয় তাই নয়, পালন করা হয় সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মাচার। ভারতের মতো ধর্মনিরপেক্ষ দেশে তা কতটা সংবিধান সম্মত এই প্রশ্ন এখন অবান্তর।
বিশ্বের যেখানেই সঙ্কীর্ণ ধর্মীয় পরিমণ্ডল বিস্তার লাভ করছে, সেই সব ক্ষেত্রেই পুরুষতান্ত্রিকতার রমরমা বেড়েছে, মহিলাদের উপর নেমে এসেছে নানা নিষেধাজ্ঞা। এমনকি প্রিভিলেজপ্রাপ্ত মহিলারা, যারা নিজ নিজ পেশায় সফল, তারাও এর হাত থেকে মুক্তি পান না। চন্দ্রায়ণের সাফল্যে আনন্দিত কিছু সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট দেখে সেটাই আবার বোঝা গেল। এর মধ্যে একটি পোস্ট জনৈক বাংলাদেশের বিজ্ঞানীর লেখা। তিনি নিজের দেশের সব মহিলাদের পরোক্ষভাবে বোরখা ও হিজাব পরিহিতা বলে উল্লেখ করে মন্তব্য করেছেন, ভারতের মত সমাজেই নারীদের ইসরোর বিজ্ঞানী হয়ে ওঠা সম্ভব। কথাটা যে শুধু একপেশে, তথ্যের ভুলে ভরা তাই নয়, এতে ওনার রাজনীতিও স্পষ্ট। আমাদের দেশে কন্যা ভ্রুণ হত্যা থেকে শুরু করে প্রতি ঘন্টায় মহিলাদের হেনস্থা করার ৪৯টা ঘটনা পুলিশের কাছে জমা হওয়া বা প্রতিদিন ৮৬ টি নতুন ধর্ষণের অভিযোগ (এন সি আর বি ২০২১) - নারীদের প্রতি বৈষম্যর অবসানের কতটা নির্দেশক সেটা ভাবার বিষয়। আর যারা এত প্রতিবন্ধকতা ঠেলে সামনের সারিতে আসতে পেরেছেন, ওনার বক্তব্যর এই অতিসরলীকরণ সেই নারীদের লড়াইকে উপেক্ষা করে না কি? এছাড়া বাংলাদেশের অগ্রণী মহিলাদের কৃতিত্বকেও যে একেবারেই নস্যাৎ করে দেওয়া হয়। সদ্য প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের খবর এশিয়ার শীর্ষ ১০০ বিজ্ঞানীর তালিকায় স্থান পেয়েছেন বাংলাদেশের দুজন নারী বিজ্ঞানী। তাঁরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক গাউসিয়া ওয়াহিদুন্নেসা চৌধুরী ও অণুজীববিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহা।
যাই হোক এ তো হলো প্রতিবেশীর প্রতিক্রিয়া। আরেকটা পোস্টে দেখলাম সোশ্যাল মিডিয়ায় বহু মানুষ ইসরোর মহিলা বিজ্ঞানীদের শাড়ি পরা, শাখা সিঁদুর পরা নিয়ে অতি আপ্লুত। তাদের মতে এরাই হলেন আদর্শ ভারতীয় নারী। এরা রাঁধে আবার চুলও বাঁধে (মহাকাশ গবেষণাও করে)। এই ধরনের স্তুতির আড়ালে 'অন্য মেয়ে' যারা দেগে দেওয়া ভারতীয় নারীদের মতো পোশাক পরেন না, তাদের বিরুদ্ধে ও নারীদের সমানাধিকার নিয়ে যারা কথা বলেন, তাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানানো হয়েছে। ফেসবুকে এক মহিলাকে দেখলাম, তার পোস্টে এই সব মানুষের পুরুষতান্ত্রিক চরিত্রটি তুলে ধরে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন শাখা - সিঁদুর এর ব্যক্তিগত ব্যবহারের সাথে বৈজ্ঞানিক গবেষণার সাফল্যের সম্পর্ক কি? তার লেখায় মাত্র তিনটা লাইক আর যারা নারী বিজ্ঞানীদের বেশভূষার বিশ্লেষণই কালাতিপাত করলেন, তাদের পোস্ট ভাইরাল। এই ভাইরাল পোস্ট কি সত্যিই আমাদের নারী বিজ্ঞানীদের সম্মান জানায়? জানা উত্তর নিয়েও আবার গভীরভাবে ভাবার সময়।
আমরা দেখেছি দেশের প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপ্রধান নারী হলেও তাতে দেশে নারী বৈষম্য কমে না। এখানেই ধর্ম - পুরুষতান্ত্রিকতা - রাজনীতির গাঁঠছড়া। প্রায় সব ধর্মীয় মৌলবাদ মেয়েদের স্থান নির্ধারণ করে সন্তান পালন, গৃহকর্ম ও ধর্মাচরণের মধ্যে। এর বাইরে পা রাখা মহিলাদের নিয়ে এরা বিব্রত, তাই সাততাড়াতাড়ি তাদের চেনা ছকে ফেলার এতো তোড়জোড়, না হলে নষ্ট মেয়ে বলে দাগিয়ে দেওয়ার পুরনো খেলা তো আছেই।
তবে এই গাঁঠছড়ার বিরুদ্ধে জনগণের যৌথভাবে প্রতিবাদও আরেক বিজ্ঞান।
এ নিয়ে বিস্তারিত লেখা যায়, স্বল্প পরিসরে আমি সামান্য দু'চারটা কথা বললাম মাত্র। চন্দ্রায়ণের সাফল্যকে যারা বিজ্ঞানের থেকেও বেশী ব্যক্তি তথা রাজনীতির সাফল্য হিসেবে দেখছেন, তাদের সংখ্যা অনেক, আর এদের মাঝেই রয়েছেন মহিলাদের সার্টিফিকেট দেওয়ার পণ্ডিতরা, রয়েছেন কুসংস্কারের পূজারীরা, রয়েছেন সব বুঝেও অবুঝ কিছু মানুষেরা যারা একইসাথে প্রবল আস্থা রাখেন দৈব ও বিজ্ঞানে।
এই পরিস্থিতিতে আমাদের কি করণীয় তা নিয়ে বেশী কিছু বলার নেই। আমি কারোর ধর্ম বিশ্বাসে হস্তক্ষেপ করার পক্ষে নই, কিন্তু ধর্মকে ব্যক্তিগত পরিসরে রাখাই সমীচীন মনে করি। ধর্ম যখন ধর্মীয় গোঁড়ামিতে পর্যবসিত হয়, তা যখন হয় রাজনীতির চালিকাশক্তি, ধর্ম যখন বৈষম্য কে তীব্র করে, ধর্ম যখন মানবধর্মের সামনে চ্যালেঞ্জ তৈরি করে, তখন সেই ধর্ম, বিজ্ঞানের চুড়ান্ত সাফল্যের মাঝেও নিজের সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করতে পারে। সেটাই আশঙ্কার কথা। আশা করব আগামীতে দেশে বিজ্ঞানের প্রসার আমাদের মতন সাধারণ মানুষের মনের অন্ধকার দূর করবে আর সেটা সত্যি হলে, সেই সাফল্য চাঁদের বুকে নামার সাফল্যের মতনই হবে যুগান্তকারী।