প্রায় এক বছর আগে সাক্ষী মালিক, বিনেশ ফোগত, বজরঙ্গ পুনিয়া সহ কতিপয় কুস্তীগির ব্রিজ ভূষণ শরণ সিং নামে কুখ্যাত বাহুবলি, পাঁচ বারের সাংসদ ও রেসলিং ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ার তৎকালীন সভাপতির বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থা ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ জানাতে, জানুয়ারি মাসের হাড়কাঁপান ঠান্ডায়, দিল্লির যন্তর মন্তরে তাঁদের অবস্থান শুরু করেছিলেন। ২০২৩ সালে ক্রীড়াক্ষেত্রে দেশের কিছু নজরকাড়া সাফল্য এসেছে --- এশিয়ান গেমসে ১০৭টি পদক, বুদাপেস্টে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ানশিপে নীরজ চোপড়ার সোনা, ব্যাডমিন্টনের পুরুষ ডাবলসে চিরাগ শেট্টি ও সাত্ত্বিক সাইরাজ রাঙ্কিরেড্ডির শীর্ষ স্থান দখল ইত্যাদি। কিন্তু এসব কিছুকেই ব্রিজ ভূষণের চরম, বেলাগাম পিতৃতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে সাক্ষীদের অনমনীয় লড়াই সমস্ত সাফল্যকেই ছাপিয়ে গেছে। কুস্তীগিরদের লড়াইটা ছিল ইতিহাসের আদিমতম লড়াই, যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে, লিঙ্গসাম্য, ইজ্জত, মর্যাদা রক্ষার লড়াই। সারা বছরের সংগ্রামের পর, অবশেষে সুড়ঙ্গের শেষে আলো!
গত ২৭শে ডিসেম্বর ইন্ডিয়ান অলিম্পিক অ্যাসোশিয়েশন (আইওএ) সদ্য নির্বাচিত রেসলিং ফেডারেশনের কমিটিকে সংগঠনের সংবিধান লঙ্ঘনকারী, বিধিবহির্ভুত সিদ্ধান্তের জন্য বরখাস্ত করে। প্রসঙ্গত নতুন কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন ব্রিজ ভূষণের ব্যবসার পার্টনার, পরম সুহৃদ সঞ্জয় কুমার সিং যিনি শুরু থেকেই তাঁর প্রভুর মর্জি মাফিক সংগঠন পরিচালনা শুরু করেন। নির্বাচনের ফলাফলের প্রতিবাদে সাক্ষী মালিক কুস্তি থেকে অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন, বিনেশ, বজরঙ্গ, বীরেন্দ্র সিং যাদব বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় তাঁদের বহু কষ্টার্জিত মেডেলগুলি ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ক্ষমতার গর্বে বলীয়ান নতুন কমিটি কোনও রীতিনীতির পরোয়া না করে অনূর্ধ্ব-১৫ এবং অনূর্ধ্ব-২০ জাতীয় প্রতিযোগিতার স্থান নির্ধারণ করেন উত্তর প্রদেশের গোন্ডাতে, যে এলাকা ব্রিজ ভূষণের গড়। সাক্ষী মালিক প্রশ্ন করেন গোন্ডাতে ব্রিজ ভূষণের নিজের জায়গায় কী পরিবেশে অল্প বয়সী মেয়েদের প্রতিযোগিতার জন্য পাঠানো হচ্ছে, দেশে কি আর কোনও জায়গা নেই? সরকার, আইওএ নড়েচড়ে বসে। তিন মাস বাদেই লোকসভা নির্বাচন, ভোট বড় দায়। কাশ্মীরে সেনা হেফাজতে তিনজন মুসলিম গুর্জর মানুষের মৃত্যুর পর তাঁদের পরিবারকে সমবেদনা জানানোর জন্য স্বয়ং প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সেখানে পৌঁছে গেছেন, যা এক অতি বিরল ঘটনা। উপায় নেই, রাজ্যে হিন্দু মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত করতে হলে ওই সম্প্রদায়ের সমর্থন অপরিহার্য। একই ভাবে যে কোনও উপায়ে হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশের জাট ভোট মাথায় রাখতে হবে। সুতরাং নতুন কমিটি বরখাস্ত এবং সত্ত্বর ব্রিজ ভূষণও কুস্তি থেকে সন্ন্যাস নেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।
কুস্তীগিরদের এই বছরব্যাপী প্রতিবাদ শিক্ষণীয়। তাঁরা ধৈর্য ধরেছেন, সরকারের সাথে কথা বলেছেন, আলোচনা করেছেন, কখনো এগিয়েছেন, কখনো পিছিয়েছেন, কিন্তু কখনো হাল ছাড়েননি এবং সর্বদা নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল থেকেছেন। বিনেশ ফোগত একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে গত বছরের ১৯শে জানুয়ারি যখন তাঁরা প্রথম অবস্থানে বসেছিলেন তাঁরা সত্যিই ভাবেননি যে ঘটনা এতদূর গড়াবে। তাঁরা ভেবেছিলেন যে তাঁরা চ্যাম্পিয়ান, দেশের হয়ে মেডেল জিতেছেন, তাঁদের কথা নিশ্চয়ই সবাই শুনবে। তাঁরা কল্পনাও করতে পারেননি যে ব্রিজ ভূষণের এতো ক্ষমতা! তিন দিন বাদে একটা কমিটি গঠন করা হয়, সরকার থেকে সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেওয়া হয়, অবস্থান তুলে নেওয়া হয়। দেখা যায় সবই কথার কথা, তিন মাস বাদেই তাঁদের অবস্থান স্থলে ফিরে আসতে হয়। এই সময় তাঁরা প্রচুর অজানা, অচেনা মানুষ, সংগঠনের সাহায্য পেয়েছেন, একই সাথে তাঁদের বিরুদ্ধে বেলাগাম কুৎসা রটনা করা হয়েছে। ব্রিজ ভূষণের বিরুদ্ধে শুধুমাত্র এফআইআর করার জন্য তাঁদের সুপ্রীম কোর্টের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। তাঁর পেটোয়া লোকেরা নানা ভাবে চাপ দিয়ে অনেক অভিযোগকারিণীকে আন্দোলন থেকে সরিয়ে দিয়েছে। তাঁকে দোষী সাবস্ত্য করার জন্য এক নাবালিকার বয়ান খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাঁর পরিবারকে হুমকি দিয়ে অভিযোগ প্রত্যাহার করান হয়। ২৮শে মে নতুন সংসদ ভবন উদঘাটনের দিন সাক্ষীরা সংসদ অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন। বিশাল পুলিশ বাহিনী তাঁদের ঘিরে ধরে। প্রকাশ্য রাজপথে তাঁদের বেধড়ক মারধোর করে, টেনেহিঁচড়ে ভ্যানে তুলে দেওয়া হয়। দেশের উজ্জ্বল ক্রীড়া ব্যক্তিদের ওপর পুলিশের এই নির্মম আচরণ সবাইকে স্তম্ভিত করে দেয়। এর কিছু দিন পরে সরকার থেকে পুনরায় আশ্বাস পেয়ে সাক্ষীরা অবস্থান স্থগিত করে দেন।
এই সমগ্র পর্যায় জুড়ে তাঁদের ক্ষমতাশালী পুরুষদের মোকাবিলা করতে হয়। প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তাঁদের প্রকট নারী-বিদ্বেষের মুখোমুখি হতে হয়। নতুন কমিটির একজন এমনও উপদেশ দেন যে ব্রিজ ভূষণ তোমাদের পিতাজির মতো, তাঁর সরল মন, তাঁর কোনও বদ উদ্দেশ্য ছিল না, তাঁকে তোমরা ভুল বুঝছ। উচ্চপদস্ত আধিকারিকরা তাঁদের কাছে বারবার জানতে চায়, ঠিক কী করা হয়েছে তাঁদের সাথে, কোনও মেয়েটার সাথে হয়েছে......ইত্যাদি। কেউ হয়তো কুৎসিত, ইঙ্গিতপূর্ণ ভাবে হেসে বলেছে, খুব মজা করেছে এই তো, প্রমাণ কী আছে, প্রমাণ! পি টি উষা, মেরি কমের মতো প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তি, যাঁরা ক্রীড়া প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত, তাঁদের আচরণও ছিল রীতিমত পিতৃতান্ত্রিক। তাঁরাও কখনো এঁদের পাশে দাঁড়াননি। পি টি উষা তাঁদের শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্য দায়ী করেছেন, বলেছেন তাঁরা যা করছেন তা খেলাধুলোর জন্য শুভ নয়। মেরি কম আশ্চর্যজনক ভাবে মহিলাদের কাছে যৌন নিগ্রহের অডিও ভিডিও প্রমাণ চেয়েছেন। ক্রীড়াজগতের হাতেগোনা কয়েক জন মাত্র তাঁদেরকে সমর্থন করেছেন।
মহিলা কুস্তিগীরদের প্রতি রাষ্ট্রের এই নিরাসক্ত, নিষ্ঠুর আচরণ সমাজের এক আদিম এবং অতি গভীর অসুখের ইঙ্গিত মাত্র। সমস্ত সমীক্ষা জানাচ্ছে ভারতে কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের অংশগ্রহণ দ্রুত হারে কমছে। এর নানা কারণ আছে, কিন্তু অন্যতম হচ্ছে কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার অভাব, যৌন হেনস্থা, অসম্মানের ভয়, পুরুষ কর্মচারীদের আজন্মলালিত পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা, প্রবল নারী-বিদ্বেষী, নারী-লাঞ্ছনাকারী পরিবেশ। একটি আরটিআইয়ের উত্তরে জানা যাচ্ছে যে ২০১০ থেকে ২০২০র মধ্যে ‘স্পোর্টস অথরিটি অফ ইন্ডিয়া’ (SAI) এর কাছে ৪৫টি যৌন হেনস্থার অভিযোগ জমা পড়ে, এর মধ্যে ২৯টা ছিল প্রশিক্ষকদের বিরুদ্ধে (অনেকের মতে এটা শিখরের চূড়া মাত্র, অধিকাংশ ঘটনাই পারিপার্শ্বিকের চাপের কারণে প্রকাশ্যে আসে না)। এর মধ্যে দুজনের চুক্তি বাতিল করা হয়, একজনকে সাসপেন্ড করা হয়, পাঁচজনের পারিশ্রমিক কমিয়ে দেওয়া হয়, একজন আত্মহত্যা করেন (সিটজেন্স ফর জাস্টিস এন্ড পিস-০৩/০৬/২৩)। এই ধরণের কিছু ঘটনার ওপর চোখ বুলানো যেতে পারে। (১) হরিয়ানার ক্রীড়া মন্ত্রী সন্দীপ সিং তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা যাবতীয় যৌন হেনস্থার অভিযোগ অস্বীকার করেন, যদিও ‘নীতিগত’ কারণে তিনি মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। (২) এক মহিলা জিমন্যাস্টের অভিযোগের কারণে ‘সাই’ তাঁর কোচ এবং এক পুরুষ জিমন্যাস্টের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। প্রশাসনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে তাঁরা তদন্ত চলাকালীনই এশিয়ান গেমসে যোগদান করতে চলে যান। (৩) এক মহিলা হকি খেলোয়াড় তাঁর প্রশিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। তিনি পদত্যাগ করেন কিন্তু তদন্তে তাঁকে নির্দোষ ঘোষণা করা হয়।
এই রকম আরও ভুরিভুরি উদাহরণ দেওয়া যায়। যৌন নিপীড়নের এই দুর্বিষহ চিত্র শুধু ভারতবর্ষে নয়, সারা বিশ্বেই বিরাজমান। স্পেনের একটি ঘটনা তো সর্বত্র আলোড়ন ফেলে দিয়েছে। গত অগস্ট মাসে স্পেন মহিলা ফুটবলে বিশ্ব কাপ জয়ী হয়। খেলোয়াড়রা যখন উৎসবে মেতে তখন স্প্যানিশ ফুটবল অ্যাসোশিয়েশনের সভাপতি লুই রুবিয়ালেস সর্বসমক্ষে জাতীয় দলের খেলোয়াড় জেনি হার্মোসোকে ঠোঁটে চুম্বন করেন। হার্মোসো স্তম্ভিত হয়ে যান। তিনি সঙ্গে সঙ্গে অভিযোগ করেন। রুবিয়ালেস বলেন ঘটনাটি সম্মতিমূলক, হার্মোসো অস্বীকার করেন। বিস্ময়কর ভাবে ঘটনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে স্প্যানিশ ফুটবল সংস্থা হার্মোসোকে চাপ দেয় এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি মারফত স্বীকার করে নিতে যে তাঁর সম্মতিতেই সভাপতি তাঁকে চুম্বন করেন! বলাই বাহুল্য তিনি সেটা করতে অস্বীকার করেন। ঘটনা এতদূর গড়ায় যে রুবিয়ালেসের শাস্তির দাবীতে হার্মোসোর মা অনশন শুরু করতে বাধ্য হন। রুবিয়ালেস পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ফিফা তাঁকে ফুটবল সংক্রান্ত যে কোনও কাজকর্ম থেকে তিন বছরের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
মহিলা ফুটবলে পুরুষ কর্তৃত্ব চূড়ান্ত। যৌন নির্যাতনের ভয় এতোটাই যে এক ক্লাব কর্তা মহিলা ফুটবল দল গড়তে অস্বীকার করেন। এছাড়াও আছে বেতন, পারিশ্রমিকে অসাম্য, এবং বহু ক্ষেত্রে তা প্রকট। দীর্ঘ আন্দোলনের পর ২০২২ এর ফেব্রুয়ারি মাসে আমেরিকার ফুটবল ফেডারেশন পুরুষ ও মহিলাদের জন্য সমপরিমাণ বেতন চালু করতে রাজি হয়। বিশ্বজয়ী ফুটবল দেশ স্পেনের অন্যতম প্রধান ক্লাব বার্সেলোনায় বেতন অসাম্য চূড়ান্ত। পুরুষ খেলোয়াড়দের বেতন যেখানে আকাশছোঁয়া, ৫০ লক্ষ ইউরোর উর্ধ্বে, বিশ্বজয়ী মহিলা ফুটবলারদের জোটে মাত্র ৬০০০০-১২০০০০ ইউরো। আমাদের দেশে বেতন অসাম্য এতোটাই প্রকট যে সেটা উল্লেখ করা হাস্যকর হয়ে যাবে।