পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

আমরাও দেশদ্রোহী

  • 29 July, 2019
  • 0 Comment(s)
  • 2111 view(s)
  • লিখেছেন : সহমন
কাউকে সরকারের বিরোধিতা করার জন্য দেশবিরোধী বা আরবান নকশাল হিসেবে চিহ্নিত করা উচিৎ নয়। শাসক দলকে সমালোচনা করার অর্থ দেশকে সমালোচনা করা নয়। শাসক দল ও দেশ এক নয়। ক্ষমতায় থাকা কোন শাসক দল আর দেশ সমার্থক নয়। ফলে সরকারিবিরোধী অবস্থানকে দেশবিরোধী অবস্থান হিসেবে পরিগণিত করা যায় না।

ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর খতিয়ান বলছে ২০১৬ সালে দলিতদের উপরে কমপক্ষে ৮৪০টি অত্যাচার সংঘটিত হয়েছে। ফ্যাক্টচেকার.ইন ডাটাবেসের তথ্য অনুযায়ী ১ জানুয়ারি, ২০০৯ থেকে আজ পর্যন্ত ২৯৭টি ধর্মীয় পরিচিতি ভিত্তিক ঘৃণা-অপরাধ (হেট ক্রাইম) সংঘটিত হয়েছে, যেখানে অন্তত ১০০ জনকে হত্যা করা হয়েছে ও ৭৩৮ জন আহত হয়েছে। ৫৯% ক্ষেত্রে আক্রান্তরা মুসলমান (জনসংখ্যার ১৪% মুসলমান হলেও), ১৪% ক্ষেত্রে আক্রান্তরা খ্রিষ্টান (জনসংখ্যার ২% খ্রিষ্টান হলেও), ১৪% হিন্দু (জনসংখ্যার ৭৮% হিন্দু হলেও)। ওই অপরাধগুলির ৯৩% মে, ২০১৪র পরে ঘটেছে।২০১৩র পর থেকে প্রতি বছরে অনুরূপ ঘটনা বেড়ে চলেছে। ২০১৩, ২০১৪, ২০১৫, ২০১৬, ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ (জুলাই পর্যন্ত)এ ধর্মের ভিত্তিতে অপরাধের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৯, ১৮, ৩০, ৪২, ৭৩, ৯২ ও ১৯। অন্তত ২৭% ক্ষেত্রে গোরক্ষার নামে, ১৩% ক্ষেত্রে ভিনধর্মে সম্পর্করোধের জন্য আক্রমণ করা হয়েছে। কমপক্ষে ৫৯% ক্ষেত্রে আক্রমণকারীরা ছিল হিন্দু, ১২% ক্ষেত্রে মুসলমান।

এরকম একটি ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বাতাবরণের প্রেক্ষিতে অপর্ণা সেন, শ্যাম বেনেগাল অনুরাগ কাশ্যপ, আশীষ নন্দী, কৌশিক সেন, বিনায়ক সেন, জয়া মিত্র, ড: দেবল সেন, জয়া মিত্র, বোলান গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ ৪৯ জন সংবেদনশীল ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে চিঠি লিখে মুসলমান, দলিত ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের দানবিকভাবে দলবদ্ধ হয়ে পিটিয়ে হত্যার প্রতি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে পিটিয়ে হত্যা বন্ধ করার জন্য যথাবিহিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে অনুরোধ করেন। তাঁরা বলেন যে, "জয় শ্রীরাম"কে একটি যুদ্ধ ধ্বনিতে পরিণত করা হচ্ছে ও বহু পিটুনিই ওই ধ্বনি তুলে করা হচ্ছে। ভারতের সংখ্যা গরিষ্ট জনগণের কাছে রামের নাম পবিত্র ও দেশের মুখ্য প্রশাসক হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাঁরা অনুরোধ করেন যে, এই ভাবে রামের নামকে অপবিত্র করার দুষ্কর্মকে বন্ধ করতে সচেষ্ট হতে। তাঁরা সমস্ত পিটিয়ে হত্যায় অভিযুক্তদের জামিন অযোগ্য অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করার ব্যবস্থা করার অনুরোধ করেন।

সংবিধানের ১৯ নং ধারার উল্লেখ করে তাঁরা বলেন যে, কাউকে সরকারের বিরোধিতা করার জন্য দেশবিরোধী বা আরবান নকশাল হিসেবে চিহ্নিত করা উচিৎ নয়। শাসক দলকে সমালোচনা করার অর্থ দেশকে সমালোচনা করা নয়। শাসক দল ও দেশ এক নয়। ক্ষমতায় থাকা কোন শাসক দল আর দেশ সমার্থক নয়। ফলে সরকারিবিরোধী অবস্থানকে দেশবিরোধী অবস্থান হিসেবে পরিগণিত করা যায় না।

দেশজোড়া অসহিষ্ণুতাবিরোধী এই চিঠিকে বিরোধিতা করে সরকারি চাটুকার ও সুবিধাভোগী বা প্রসাদাকাঙ্খি কিছু সংবাদপত্রের তৃতীয় পাতার নামকরা ব্যক্তি আসরে নেমে যথাবিহিত 'আগে বলেন নি', 'কাশ্মিরি পণ্ডিতদের জন্য বলেননি', 'এখন কেন বলছেন' গোছের যুক্তি নিয়ে আক্রমণ করেন। ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্টতাবাদি ওইসব শাসক দলের তাঁবেদাররা সাম্প্রতিক কালে নির্বাচন পরবর্তীতে ঘটে যাওয়া ঝাড়খন্ড, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গে দলিত সমেত ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর ধারাবাহিক আক্রমণের ঘটনাকে হয় এড়িয়ে যেতে চান নয় সমর্থন করেন। ধর্মভিত্তিক হেট ক্রাইমের ঘটনার বাড়বাড়ন্তকে তারা অস্বীকার করে ৪৯ জন সংবেদনশীল ব্যক্তির বক্তব্যকে মিথ্যা বলতে কোন লজ্জা তাদের হয় না। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ব্যতিরেকেই দেশের অখন্ডতা ও স্বাধীনতা বজায় রাখা যায় বলেই তাদের বিশ্বাস, তাই ৪৯ জন সংবেদনশীল ব্যক্তির মতপ্রকাশের স্বাধীনতার দাবিকে তারা গুরুত্বহীন বলে মনে করে তাদের লেখা চিঠিকে দেশের বিরুদ্ধে জাতিকে অবমাননা করার চক্রান্ত হিসেবে ঘোষণা করেন।

অপর্ণা সেন-অনুরাগ কাশ্যপ প্রমুখের চিঠিকে বিরোধিতা করে শাসকের তাঁবেদারদের চিঠিটিই একটি চক্রান্ত, ধর্মের ভিত্তিতে হেট ক্রাইমকে স্বাভাবিক হিসেবে মান্যতা দেওয়ার একটি চক্রান্ত বলে আমরা মনে করি। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ব্যতিরেকেই দেশের অখন্ডতা ও স্বাধীনতা বজায় রাখার কথা বলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার দাবিকে গুরুত্বহীন করাও শাসক দলের সাম্প্রতিক গণতন্ত্র ধ্বংসকারী বিল বা আইনগুলির (আরটিআই সংশোধনী, ইউএপিএ সংশোধনী, এনআইএ সংশোধনী) সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

৪৯ জনের ওই চিঠির বিরোধিতার ধারাবাহিকতায় তাদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা করা হয়েছে, বিহারের মজফফরপুর আদালতে। শাসক দলের তাঁবেদার পত্র লেখকদের অভিযোগকে অনুসরণ করে ওই ৪৯ জনের বিরুদ্ধে দেশের সম্মানহানি, দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়েছে। সাক্ষী করা হয়েছে ওই বিরোধিতাকারী পত্রলেখকদের।

আমরা মনে করি ওই ৪৯ জন সংবেদনশীল পত্রলেখক যা লিখেছেন তা সম্পূর্ন সত্যি। তাদের যারা বিরোধিতা করছেন তারাই চাইছেন এক বিভাজিত ভারত, ধর্মের ভিত্তিতে, জাতপাতের ভিত্তিতে। তাই অপর্ণা সেন, শ্যাম বেনেগাল অনুরাগ কাশ্যপ, আশীষ নন্দী, কৌশিক সেন, বিনায়ক সেন, জয়া মিত্র, ড: দেবল সেন, জয়া মিত্র, বোলান গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ ৪৯ জন সংবেদনশীল ব্যক্তি যদি দেশদ্রোহী হন তাহলে আমরাও দেশদ্রোহী, তাঁরা যদি দেশের সম্মানহানি করার জন্য অভিযুক্ত হন আমরাও তাদের সাথী।

0 Comments

Post Comment