বাঙালীর বুদ্ধি নিয়ে রসিকতা করা উচিৎ কাজ হয় না। বিশেষ কলকেতার বাবু বিবি হলেন বুদ্ধির বেস্পতি। বিলাতে ডারউইন সায়েব গবেষণা করে বলেচেন বানর হতে ইভলিউশন হয়ে মানুষ হয়েচে, বানরের যে জাতি মানুষ হয়েচে সে জাতি গত হয়েচে। কলকেতার বাবু বিবিদের দেখে মালুম হয় ইভলিউশন একুনো চলেচে। এনারা আরো উন্নত নমুনা হবার জন্যি বিলক্ষণ পরিশ্রম কচ্চেন।
বাঙালীর আয়ু ফুরিয়ে এসেচে। অসমে পেয়াদায় বাঙালীকে ঘর থেকে টেনে নিয়ে যাচ্চে হাজতে, মেঘালয়ে বলচে কেটে পত্তে হবে নয় মত্তে হবে। এদিকে কর্ণাটকে গরীব গুরবো বাঙালীর ঘরে দোরে আগুন দিয়ে দিলে। দেশের জন্যি দলে দলে প্রাণ দিয়ে একন বাঙালীর বিদেশী হওয়া হল। তবে কলকেতার বাবুরো একুনো তোফা আচেন। মনে কচ্চেন বাংলায় তেনাদের কেউ কিচু বলবেন না। নাহক অনেক বাংলাদেশী গাঁয়ে গঞ্জে সমে অসমে সেঁধিয়ে আচে, সেগুলি বিদেয় হলেই সুজলাং সুফলাং হবে।
এ নিয়ে বঙ্কিমবাবুকে শুধোলেম। তিনি বল্লেন মা কী ছিলেন আর কী হইয়াছেন এদানি ধাঁধা লাগচে। আমি বল্লেম এই মা-টি কে? ভারতমাতা নাকি বঙ্গমাতা?
মাথার শামলাটি আঁট হওয়ায় তিনি খুলে চুলকোতে পাল্লেন না, তবে মুখটি ব্যাজার করে শুধোলেন, ভারতমাতা কে? নূতন দেবী প্রকট হয়েছেন নাকি?
বল্লেম, বলচেন কী গো? এদিক সেদিক চাঁদোয়া খাটিয়ে পুজো অবধি হচ্চে স্বাধীনতা দিবসে।
বল্লেন অত জানি না। আমাদের কালে স্বাধীনতা ছিল না। আমি জানি জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী। সে ভূমি হল বাংলা। আর সে মাটিতে জন্মে বাঙালী হল হাসিম শেখ আর রামা কৈবর্ত।
বল্লেম একেলে বাবুরা যে বলচেন আরবি ফারসী নাম বাঙালীর হয় না, ওসব দিশি নয়?
বাবু বঙ্কিম হয়ে শুধোলেন, যারা বলছে তারা কি সব বাবাকে পিতা বলে ডাকে? বাবা শব্দটা দেশী? চেয়ার টেবিল দেশী? যে আলু ছাড়া বাঙালীর রান্না হয় না সে আলু কি এ দেশের জিনিস? পরে আপনমনে বল্লে, বিনাশ কালে বিপরীত বুদ্ধি।
তা বাঙালীর বুদ্ধি নিয়ে রসিকতা করা উচিৎ কাজ হয় না। বিশেষ কলকেতার বাবু বিবি হলেন বুদ্ধির বেস্পতি। বিলাতে ডারউইন সায়েব গবেষণা করে বলেচেন বানর হতে ইভলিউশন হয়ে মানুষ হয়েচে, বানরের যে জাতি মানুষ হয়েচে সে জাতি গত হয়েচে। কলকেতার বাবু বিবিদের দেখে মালুম হয় ইভলিউশন একুনো চলেচে। এনারা আরো উন্নত নমুনা হবার জন্যি বিলক্ষণ পরিশ্রম কচ্চেন। এনাদের দুটি দল আচে।
এক দল আরো উন্নত বানর হবার চেষ্টা কচ্চেন। রামের নাম কচ্চেন আর হনুমানের মুখোশ পরে সার্জারির খরচ বাঁচাচ্চেন যেহেতু রোজগার এদানি মন্দ। তবে এনাদের মার্গটি সোজা, সাধ হলেই দলে ভিড়ে যাওয়া যায়।
দ্বিতীয় দলে ভিড়তে অনেক হ্যাপা। এনারা আরো উন্নত মানুষ হবেন কিনা। এ দলে ভিড়তে পয়লা কাজ হচ্চে দেবেন ঠাকুরের সবচে নামী সন্তানটির লেকা যে গানগুলি সকলেই গায় সেগুলি জানতে হবে। জানা হলে চাট্টি কাঁচা খিস্তি শিখতে হবে। হলে পথে ঘাটে ফোনে বা সুমুখে সে খিস্তি ছাতি ফুলিয়ে নিক্ষেপ কত্তে হবে। পরে বাজারে রোদ্দুর রায় বলে ইভলিউশনে সবচে এগিয়ে থাকা যে বাবুটি নাম করেচেন তেনার শ্রীমুখে রবি ঠাকুরের খিস্তীন্দ্রসঙ্গীত শুনে প্রতিবাদ, বিদ্রোহ, খিস্তির প্রয়োজনীয়তা ও ফ্রিডম অফ স্পিচ সমন্দে নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ ভেবে ফেলতে হবে। কাজটি কিন্তু খতম হল না। ফেসবুকে গম্ভীর ডিপি সহযোগে পোস্টও কত্তে হবে।
তবে সবচে জরুরী কথাটি হচ্চে আপনাকে নিদেন গ্রাজুয়েট ও শহুরে হতে হবে। গাঁয়ের ছেলেপুলে কি গরীব হলে, উল্টো গাইলে বাদ যাবেন, যেহেতু সাবল্টার্ন জানেন না তিনি কেমন ভাষায় কথা বলেন। জানেন কলকেতার বাবু বিবিরা। তেনাদের ওটি মনোপলি ব্যবসায়।
ভটচায্যি, মুখুয্যে, চাটুয্যে, বাঁড়ুয্যে, চক্কোত্তি, সেনগুপ্ত, দাশগুপ্ত বাবুরো পাঁচো ইয়ার মিলে সাব্যস্ত করেচেন সাবল্টার্নে খিস্তি ছাড়া কথা বলে না। সাবল্টার্নের সাধ্যি কী চিঁ চিঁ করে, না বাবুরা, আমরা কথায় কথায় মেয়েছেলেদের গতর নিয়ে রঙ্গ রসিকতা করি না। ইয়ার দোস্তের মধ্যে দু চার খিল্লি চলে বৈ কি, মাথায় খুন চল্লে নাহক মন্দ কথা বলি না এম্নি নয়। তবে সে কথায় তোমাতে আমাতে তফাত কী?
বাবুদের সাবল্টার্নের ভাষার জন্যি এই মড়া কান্না সহ্য না হওয়ায় সম্পাদককে বল্লেম ভায়া, ভাবচি চাট্টি বাবুকে রাতের বেলা ভির্মি খাওয়ালে কেমন হয়? সম্পাদক রসিক মানুষ। বল্লে মন্দ কী?কলকেতার গণ্যিমান্যি বাবুরা হুতোমের ভূত দেখে কেমন খাবি খাচ্চেন সেটি মুখরোচক হবে বৈ কি।
তা ভর সন্দেবেলা এক বাবুর বাড়ী হাজির হলেম। বাবুটি লেখক, এদানি বেশ নাম করেচেন। না, ফেসবুকের লেখক নন। ঘরে সরকার বাহাদুরের দেয়া রৌপ্য ভোঁদড় না কী যেন আচে। লেকার ঘরে বাবুটি সব আলো নিবিয়ে জানালার ধারে বসে ফুটপাতের ভিখিরি মায়ের ছেলেকে মাই দেয়া নিয়ে স্ল্যাভয় জিজেক মাফিক ন্যারেটিভের প্লট ভাবচিলেন। আমায় দেকেই ভ্যাবাচ্যাকা। অবিশ্যি সে ভূত দেকে না তিনি যে ভিখিরির মাই দেকচিলেন সেটি ধরা পড়ে গ্যাচে বলে তা বলতে পারিনে। প্রায় দাঁতকপাটি লাগে দেকে বল্লেম, ভায়া অত ভয় পেয়ো না। এ ভূত ঘাড় মটকানোর ভূত নয়।
সে ঘেমে নেয়ে বল্লে, সেই তো সেই তো। আচ্ছা আপনাকে কেমন চেনা চেনা লাগছে?
চেনা তো লাগবেই। তোমাদের পূর্ণেন্দু পত্রীর আঁকাওলা হুতোম প্যাঁচার নকশার ব্যাক কভারে এই শর্মারই ফোটো আচে যে।
বলতেই ছোকরা সাষ্টাঙ্গে পায়ে পল্লে। বলে আপনি গুরুদেব লোক। নিজের সময়ের চেয়ে কত এগিয়ে ছিলেন! ভাষা নিয়ে আপনার কি দারুণ পরীক্ষা নিরীক্ষা! ন্যারেটিভ স্টাইল নিয়ে...
বলি, রোসো। কদিন যে সোশাল মিডিয়ায় বিপ্লব কচ্চিলে কেউ সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়, বাঙালী গুরুবাদে অন্ধ, তাই একান হতে বড় লেখক আর হয় না? তুমি তো বাপু বাজারী পত্রিকার লেখক নও, তুমি হলে গে প্রগতিশীল। তবে এম্নি ভণ্ডামি কেন?
আরে ওসব তো কনফর্মিস্টদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। আপনি হচ্ছেন নন কনফর্মিস্টদের গুরু। আপনি ন্যারেটিভটাকে যেভাবে...
এই কথা? তালে বলো তোমাদের ওদের গুরুটিকে পচন্দ নয়। খামোকা বড় বড় ইংরেজি বুলি ঝাড়চ কেন হে ছোকরা?
অফ কোর্স। কী করে পছন্দ হবে বলুন তো? ওদের গুরুদেব তো ভাষাটাকে এমাস্কুলেট করে দিয়ে গেছেন। করল, পড়ল, খেল, গেল --- এটা বাংলা? এটা ন্যাকামি। বাংলা কত পাওয়ারফুল একটা ভাষা। মাইকেলের বাংলা, ত্রৈলোক্যনাথের বাংলা। তারপর আপনার বাংলা...
দাঁড়াও বাপু। তোমার দেকচি বেশ পাণ্ডিত্য আচে। তা পণ্ডিত মানুষ এম্নি ঘেঁটে ফেল্লে চলবে কেন? মাইকেলের বাংলা, আমার বাংলা এক দলে ফেলে দিচ্চ কী বলে? “সম্মুখ সমরে পড়ি বীর চূড়ামণি” আর “আজব শহর কলকেতা” এক বাংলা হল? তুমি লেখক না জেলেপাড়ার সঙ?”
না, মানে অন্যরকম তো। নন কনফর্মিস্ট...
আবার ইংরেজি? বাংলায় লিকে স্বর্ণ ভোঁদড় পেয়েচ, কথায় কথায় ইংরেজি বিদ্যে ফলাও কেন? নিজেদের থিওরি বানাতে পার না, সায়েবদের থেকে টুকে চলচে, আবার যারা তোমার লেকার ভাষাটি বানিয়ে দিয়েচে তাদের অমুকে বাংলা লিকেচে তমুকে এমাস্কুলেট করেচে এসব এঁচড়ে পাকামি হচ্চে?
লেখকবাবুর গালের আফটার শেভ তকনো তাজা, তাই চুলকোবার মতন দাড়ী পেলেন না। না পেয়ে মুখে কথা যোগাল না। বল্লেম দেবেন ঠাকুরের পোকে দু চক্ষে দেখতে পারো না সে নয় ক্ষমা কল্লেম। বলি বিদ্যাসাগরমশায়কে নিয়ে টানাটানি জুড়েচ কোন লজ্জায়?
বাবুটি যেম্নি আকাশ থেকে পল্লে।
বল্লেম আমার কাচে বোকা সেজে পার পাবে না। কিসব লিকে চলেচ তোমরা ফেসবুকে? দ্রজু সায়েব, রামমোহন, বিদ্যাসাগর সকলের পাছে লেগেচিল বাঙালী অন্য কথা সহ্য হয় না বলে... তোমাদের রোদ্দুর রায়ের পাছেও নাকি সে জন্যি লেগেচে?
লেখক অম্নি গা ঝেড়ে উঠে বল্লে, কথাটা কি মিথ্যে? আপনিই বলুন?
দ্রজু সায়েবকে প্রায় না খেয়ে মত্তে হয়েচিল জানা আচে? এই যে মাইকেল মাইকেল করে নেত্য কচ্চিলে, দ্রজু সায়েব নইলে মাইকেল হয়? তোমাদের পেয়ারের গুরু কে আচে তাকে শুধোও তো বাছা। নকশায় হুতোম স্বয়ং ইয়ং বেঙ্গল নিয়ে রসিকতা কম করেননি। তা বলে ভুলো না তোমাদের মাইকেলের করা নীলদর্পণ অনুবাদের জন্যি পাদ্রী লং এর ফাইনও এই শর্মাই দিয়েচেন।
আর রামমোহন, বিদ্যাসাগর? তেনারা না থাকলে তোমার ফটর ফটর ইংরেজি বলা হত কিনা সন্দ আচে। একুনো পাঠশালে মক্তবে আদ্যিকালের বদ্যিবুড়ো তোয়ের হতে আর দশটা বে করে দেশের অন্নসঙ্কট বাড়াতে। যারা পিঠে খিস্তি লিকে আধুনিক হচ্চেন সে মা জননীদের এনারা নইলে কী দুর্দ্দশা হত সে কথা না-ই বল্লেম। এনারা এত সব করেচেন। তোমাদের রোদ্দুর রায় কী করেচে? অন্যের গানে খিস্তি বসিয়ে শস্তায় নাম করেচে। এর চে বাপু পূর্ণিমার চাঁদের সাথে ষাঁড়ের পশ্চাদ্দেশের তুলনা কল্লে কম দোষ হত।
ভোঁদড়জয়ী লেখক ততক্ষণ সিগ্রেট খুঁজে পাওয়ায় কথা ফিরে পেয়েচে। ধুয়ো ছেড়ে বিজ্ঞের মতন হেসে বল্লে, আপনার আপত্তি তাহলে খিস্তি নিয়ে। এদিকে নকশায় যে খিস্তির ছড়াছড়ি?
নকশায় খিস্তি আচে হে, খিস্তিতে নকশা নেই। এই তো পায়ে ধরে বল্লে আমার ন্যারেটিভ স্টাইলটি নাকি নূতন। সে স্টাইল তো কারো দেখে টুকিনি ভায়া। তা তোমাদের রোদ্দুরকে বল না রবি ঠাকুরের রোদ্দুরে গা না সেঁকে নিজের কিচু বানিয়ে দ্যাকাতে। দেকি ইউটিউবে কত হিট হয়? আড়াই হাজার গান আচে, আহ্লাদে খিস্তি বসিয়ে নাম কল্লেই হল। কিচু নূতন কত্তে এলেম লাগে।
নাছোড় ভোঁদড়শ্রী বল্লেন, তাহলে আপনি রেবেলিয়নকে কোন জায়গা দেবেন না? ছেলেমেয়েগুলোকে এই দোষে পুলিশে দেয়া আপনি সাপোর্ট করেন? ওরা ভুল করেছে, অপরাধ তো করেনি।
কচি ছেলেপুলে তো ভুল করেচে, তোমরা ধাড়িরা ভুল ধরে না দিয়ে থিওরি কপচে আবার ভুল কত্তে ঠেলচ কেন শুনি? আর রেবেলিয়নটি কিসের বিরুদ্ধে ছিল বাপু? হাজার বচ্ছর ধরে হয়ে আসা উৎসবে দিব্য সেজে গুজে নাচাগানা আবার রেবেলিয়ন হল কোন তিথিতে? নাকি এটি ওই হনুমানগুলোর প্রো সি এ এ প্রতিবাদের মতন? কিচুর পক্ষে আবার প্রতিবাদ হয় জম্মে শুনিনি।
গেরুয়া বানরে সোনার বাংলা ছারখার কচ্চে, দেবেন ঠাকুরের জমিতে তোমাদের না পসন্দ গুরুর ইউনিভার্সিটিতে বাংলা ভাষা তুলে দেবার যোগাড় আর এরা বুকে পিঠে খিস্তি লিকে রেবেল সাজচে? বাঙালীকে সারা দেশের বানর মিলে ন্যাকার জাত বলচে, তোমরা প্রগতিশীলরা তাতে ধুয়ো দিচ্চ। বুঝি একেই শাস্ত্রে বলেচে বিনাশ কালে বিপরীত বুদ্ধি।
বকে বকে মুখে ফেনা উঠে গ্যালো, দেখলেম বাবুর মুখ হতে কেবল গোঁ গোঁ বার হচ্চে। বোধ হল নূতন দাড়ী না গজানো অবধি বাবুটির বাক্যি ফুটবে না। তাই হুতোম বিদেয় হলেন।