২০১৭ সালে হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রোহিত ভেমুলা তাঁর সুইসাইড নোটে লিখেছিলেন তাঁর স্বেচ্ছামৃত্যুর জন্যে কেউ দায়ী নয়, আর ২০২৩ সালে যাদবপুর মেইন হোস্টেলের তিন তলা থেকে পা পিছলে পড়ে (ইচ্ছে করেই লিখলাম পিছলে পড়ে, অনেকেই সিস্টেমের অজ্ঞাতসারে এরকম পিছলে পড়ে যায় রোজ) মারা যায় এবং সেখানেও সম্ভবত কেউ দায়ী নয়। এটাও সম্ভবত আত্মহত্যা। রবীন্দ্রনাথের “স্ত্রীর পত্র” গল্পে পরিবারের আশ্রিত, সকলের চোখে গলগ্রহ বিন্দু যখন পতিগৃহে মানিয়ে নিতে না পেরে আত্মহত্যা করে সমাজের মান্যজনেরা বলেন – স্বেচ্ছামরণ এখন ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। অধুনা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আত্মহত্যার বাড়বাড়ন্ত নিয়েও অনেকেরই অনুরূপ অভিমত। জনৈক সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন যে যাদবপুরের এক জটলায় স্বপ্নদীপ সম্পর্কে উড়ো মন্তব্য শোনা গেছে – “দু দিন মাত্র নিতে পারলি না, কদিনই বা র্যাগিং হত!” পরিবারের নব্য বধূরা, অফিসে সদ্য জয়েন করা কর্মীরা এরকম কত আঘাত, অপমান, অত্যাচার সহ্য করে থাকে। যারা পারে না তাদের মৃত্যুর জন্য কিন্তু কেউ দায়ী নয়। প্রাচীন মিশরে দুর্বল শিশুদের নাকি নাইল নদের জলে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া দস্তুর ছিল।
আমরা সবজান্তারা আজকাল খুব ভালো করেই জানি যে নিম্নবর্গ কথা বলতে পারে না। কিন্তু ভেবে দেখলে বোঝা যায় সব জায়গায় সব কথা বলা যায় না। এটাই তো ছোটবেলা থেকে আমরা শিখে এসেছি – তাই না? বেঁচে থাকতে গেলে, টিকে থাকতে গেলে চুপ থাকতে হয়। সিস্টেমের ভিতর কেউ কেউ মানিয়ে নিতে না পেরে মরবে এটাই দস্তুর – কেউ কেউ বলিপ্রদত্ত না হলে দেবীর পূজা হয় কিভাবে? বরং আমাকে বার বার প্রমাণ করে যেতে হবে সিস্টেম ঠিক মতোই চলছে। বর্তমান ভারতে যেমন কোনো ধর্মীয় মৌলবাদ নেই, স্বৈরতন্ত্র নেই, পশ্চিমবঙ্গে খুন-ধর্ষণ-দুর্নীতি যেমন হয় সাজানো ঘটনা, অথবা যদি বা ঘটেও থাকে সে সব খুবই ছোট – নগণ্য ঘটনা – গণতন্ত্রের পূজায়, উন্নয়নের উড়ন্ত পালে যেন তার কোনো দাগছাপ না থাকে। তেমনই যাদবপুরের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র্যাগিং কালচারের বাস্তবতা নিয়ে একাধিক ছাত্রের সাক্ষ্য উঠে আসা সত্ত্বেও, ইহা যাদবপুর নয়, ইহা একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা প্রমাণ করিতেই হইবে। কারণ – আমি যাদবপুরে পড়েছি, অথবা পড়াই তাই আমি গর্ব বোধ করি! ঠিক নেশন স্টেটের মতো এখানেও আমি অনুগত মেম্বার। সমালোচনা মানেই এখানে বিশ্বাসঘাতকতা। একদা দাঙ্গার ঐতিহাসিকরা দেশভাগোত্তর দাঙ্গা নিয়ে মহা ফ্যাসাদে পড়েছিলেন। নেশন স্টেটের ১৯৪৭ কেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদের, সাহেবি বহির্শক্তির বিরুদ্ধে মস্ত জয়ের মহাগপ্পে চন্দ্র কলঙ্ক যেন দেশভাগোত্তর খুনোখুনি। এইসব ব্যতিক্রমকে সারিয়ে তোলা যাবে যেন মূল মহাগপ্পটিকে অক্ষত রেখে। আর এভাবেই আমাদের দৃষ্টির অগোচর তৈরি হয় অজস্র না-দেখা। কারণ আমরা গ্যালেলিওর টেলিস্কোপের ভিতরে চেয়ে আত্মকেন্দ্রিক সব উদযাপনের মহাগপ্প ভেঙে পরতে দেখতে ভয় পাই। যে যাদবপুর লিবারেল, প্রতিবাদী, যে যাদবপুর নারীর, সমকামী মানুষের, দলিত ও সংখ্যালঘুর অধিকারের জন্য সোচ্চার, তার ভিতর কি কোনো অনুচ্চারণ ছিল? নাহ! এ কথা মেনে নেওয়া বুঝি বা দুষ্কর। তাই আমাকে সৌভাতৃত্ব ও উদারতার বড় গল্পের এই ব্যতিক্রমকে নিয়ে ত্রস্ত হতে হয়, বলতে হয় আগে ডিউ প্রসেসের মধ্যে দিয়ে গিয়েই বলা যাবে র্যাগিং ঘটেছিল। আসলে আমাদের সিস্টেমকে চলতে দিতে, পাঁচতারা বিশ্ববিদ্যালয়ের মান বাঁচাতে বলতে হবে - স্বপ্নদীপের মৃত্যুর জন্যে কেউ দায়ী নয়। সুসান জর্জেট নামক “যৌন কর্মী” হিসেবে চিহ্নিত মানবীটির ধর্ষণ যেমন রাজ্য-প্রধানের কাছে “সাজানো ঘটনা” ছিল।
সুতরাং মান্যবর পাঠক আপনি এতক্ষণে বুঝে গেছেন – যে কোনো ব্যবস্থায় কার জীবনের কতটুকু দাম, কোন অবিচার আলোচনা ও দৃষ্টিগোচর হওয়ার যোগ্য তার একটি নির্দিষ্ট পরিমাপ থাকে। আমাদের রাজ্যের বঙ্গীয় রেনেসাঁসের সীমানা যে নাগরিক উচ্চবংশীয় সে কথা বহু আগেই বিনয় ঘোষ বলিয়া গেছেন। তাই যাদবপুরের মতো প্রতিষ্ঠানের প্রতিবাদী সংস্কৃতির দৌড় কলকাতা ছেড়ে উত্তর বা দক্ষিণ চব্বিশপরগনায় পা রাখতেই ভয় পায়। কেবল তাই নয়, এই নাগরিক সভ্যতার নৈতিকতার, সহমর্মিতার হাত বহিরাগত নিম্নমধ্যবিত্ত, স্বল্প আয়ের সহনাগরিক ছাত্রের লেখাপড়া চালানোর জন্য মাথা গোঁজার ঠাঁই যাদবপুর মেইন হোস্টেল অবধিও পৌঁছয় না। আমাদের রাজনৈতিক সঠিকতার যেমন বৃত্ত আছে, একটি চেনা স্ক্রিপ্টও আছে। নারীর ওপর পুরুষের নির্যাতন, গরীবের ওপর পয়সাওয়ালার, মুসলমানের ওপর হিন্দু সংখ্যাগুরুর, বা কুইয়র মানুষের ওপর নরম্যাটিভ সমাজের – এগুলো যাদবপুরের মতো লিবারেল চিন্তার পীঠস্থানে সহজে চিহ্নিত হতে পারে; কিন্তু হোস্টেলে থাকা সাধারণ পরিবার থেকে আসা, কলকাতা শহরে নবাগত প্রথমবর্ষের পুরুষ ছাত্রটির পুরুষাঙ্গের দৈর্ঘ্যপ্রস্থ র্যাগিংয়ের নামে হোস্টেলের দাদাদের বলতে হলে সেটা বোধহয় যৌন হেনস্থার চেনা স্ক্রিপ্টে পড়ে না। এভাবেই রোজ যারা অগোচরে, বলা কথার আড়ালে থাকে, যাদের প্রত্যেক দিনের নির্যাতন নিষ্পেষণ অনুচ্চারিত অথবা স্বাভাবিক বড় হয়ে ওঠার অংশ তারা নিম্নবর্গ হয়ে ওঠে এই সমাজে। যাদের কথা বলা হয় না, বলতে দেওয়া হয় না – জাতপাত, ধর্ম, লিঙ্গ, যৌনতা, নাগরিক সভ্যতা, আর্থিক সচ্ছলতা অথবা সংস্কৃতিপ্রবণ বাঙালির প্রিয় গ্যাসবেলুন কালচারের নিরিখে যারা প্রান্তিক তারা কেবল মাঝে মাঝে বলে ওঠে – “আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়!” তবেই বোধহয় আমরা শুনে উঠতে পারি নৈশব্দ ভেঙে। দৃষ্টিগোচর না হলেও কর্ণগোচর হয়, কান দিয়ে দেখা যায় সিস্টেমের ভিতরের ভূত। চোখ দিয়ে শোনাও যায় – যেমন স্বপ্নদীপের ডেডবডি। হে মাননীয় বিশ্ববিদ্যালয় – মৃতদেহ কি কথা বলতে পারে? জবাব চাই, জবাব দাও! র্যাগিং থেকে আজাদি, প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা থেকে আজাদি, এলিটিজম থেকে আজাদি, ওয়েস্টবেঙ্গল চাইছে আজাদি, কলকাতা চাইছে আজাদি, যাদবপুর চাইছে আজাদি! মৃতের মিছিল জমুক মেইন হোস্টেলের সামনে।
লেখক ঃ শিক্ষক, সিধো-কানহ-বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়, পুরুলিয়া