শেকসপিঅর-এর কিং লিঅর নাটকে গ্লুসেস্টর-এর মুখ দিয়ে বলানো হয়েছিল : পতঙ্গ যেমন খেয়ালি বালকদের হাতে নিকেশ হয়ে যায়, আমরাও তেমনই ঈশ্বরের হাতে নিকেশ হই—তাঁরা তাঁদের খেলার ছলে আমাদের খুন করে থাকেন।—রাস্ট্রের পোষিত বাহিনী তেমনই নিছক খেলার ছলে দেশের অনপরাধ মানুষদের খুন করার নেশায় মেতে ওঠে। সরকার প্রথমত তাঁদের পোষিত এই বাহিনীর কার্যক্রমকে নানান যুক্তির মাধ্যামে ন্যায্যতা দিতে থাকেন এবং তারপর প্রবল গণঅসন্তোষের মুখে পড়ে কখনোসখনো তদন্ত কমিটি গঠন করে কিম্বা গঠনের কথা বলে বিষয়টিকে শেষ অবধি ধামাচাপা দেন। অথচ এই সশস্ত্র সরকারি বাহিনীকে দেশের ক্ষুব্ধ, অশান্ত জনসাধারণকে দমন করতেই পরিকল্পিতভাবেই ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
আফস্পা (আর্মড ফোর্সেজ স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট) নামক জনস্বার্থবিরোধী ঔপনিবেশিক আইন আমাদের দেশের সরকার দেশের মানুষের গণক্ষোভ দমনের জন্যেই ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দের ১১ অক্টোবর জারি করেছিলেন। সময়টা ছিল ১৯৪৭-এর পনেরোই অগাস্টের এগারো বছর পর। দেশীয় শাসকেরা দেশের জনচিত্তের স্বাভাবিক ক্ষোভ-অশান্তচিত্ততার নিরসনের প্রয়াস না পেয়ে তাঁদের দমনের উদ্দেশ্যেই এই ঔপনিবেশিক কালা কানুন জারি করেছিলেন।
‘উপদ্রুত’ এলাকায় ‘অশান্ত’ জনসাধারণকে দমন করার এবং সেখানকার শান্তি শৃঙ্খলার বজার রাখার লক্ষ্যে এই আইন জারি করা হয়েছিল কংগ্রেস সরকারের আমলে। এই আইনের বলে দেশের সশস্ত্র বাহিনী কোনও ‘উপদ্রুত’ এলাকায় গণঅসন্তোষের মোকাবিলায় ইচ্ছেমতো গুলি চালাতে পারে, বলপ্রয়োগ করতে পারে এবং এমনকি কোনো কারণ ছাড়াই নিছক সন্দেহের বশেই যে কোনও নাগরিককে গ্রেপ্তার করতে পারে। নাগাল্যান্ডে এই কুখ্যাত আইন আফস্পা জারি আছে দীর্ঘদিন। এছাড়া অসম, মণিপুর, অরুণাচল প্রদেশেও এই আফস্পা জারি রয়েছে। এই আইনের নামে এইসব অঞ্চলে জনজীবনে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে সেখানকার মানুষ রীতিমতো ক্ষুব্ধ। গত ৪ ডিসেম্বর সশস্ত্র রাষ্ট্রীয় বাহিনীর গুলিতে নাগাল্যান্ডের মন জেলায় আটজন নিরীহ খনি শ্রমিক সহ মোট পনেরো জন নিরীহ গ্রামবাসীর হত্যার বিরুদ্ধে স্বভাবতই সেখানে এর প্রচণ্ড বিরূপ প্রতিক্রিয়া বিস্ফোরণের আকারে ফেটে পড়েছে। নাগা জনসাধারণের ঐতিহ্যবাহী হর্নবিল উৎসব যা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ১ ডিসেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত, গত ৪ ডিসেম্বর কোনও সঙ্গত কারণ ব্যতিরেকেই সশস্ত্র রাষ্ট্রীয় বাহিনী গুলিচালনায় এই পনেরোজন গ্রামবাসীর নিহত হওয়ার ঘটনা প্রেক্ষিতে, এই উৎসব নাগা জনসাধারণ এবারের মতো ইতিমধ্যেই স্থগিত রেখেছেন। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সেখানে ইস্টার্ন নাগা পিপলস অর্গানাইজেশন এবং নাগা স্টুডেন্টস ফেডারেশান বন্ধের ডাক দিয়েছেন। আফস্পা-র নামে রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র বাহিনীর এধরনের হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন থেকে এই কুখ্যাত ঔপনিবেশিক আইন প্রত্যাহার তথা বাতিলের দাবি উঠেছে।
আজ থেকে দেড় দশক আগে ২০০৭ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে সেকন্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রিফর্ম কমিশন-ও এই কুখ্যাত আফস্পা বাতিলের সুপারিশ করেছিল। কিন্তু সরকার সেই সুপারিশকে সম্মান জানান নি! দেশের বিভিন্ন স্থানে এই আফস্পা আইনকে সামনে রেখে ভারতীয় রাষ্ট্রীয় বাহিনীর তরফে নির্মম অত্যাচারের পাশাপাশি নারী ধর্ষণের ঘটনাও উল্লেখযোগ্যভাবে সংঘঠিত হয়েছে। এই আইনকে সামনে রেখে ভারত সরকারের রাষ্ট্রীয় বাহিনীর তরফে ১১৪টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বলে সংবাদ সূত্রেই প্রকাশ পেয়েছে।
স্বভাবতই গত ৪ ডিসেম্বরের গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার পর থেকে এই কুখ্যাত আফস্পা বাতিলের দাবি এখানে জোরদার হয়েছে। ‘মোরাং একসপ্রেস’ পরিবেশিত এক তথ্যে জানা যায় যে গত ৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সরকার স্বীকার করেছিল যে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর গুলিচালনায় তেরোজন সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। পরে সেই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে পনেরোয় দাঁড়ায় এবং একইসঙ্গে জানা গিয়েছে যে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর গুলিতে আহত হয়ে আরও দুজন হাসপাতালে ভর্তি আছেন। এই ঘটনাকে আমাদের দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ অবশ্য বাহিনীর ‘ভুল’বশত সংঘটিত হত্যাকাণ্ড বলে আখ্যা দিয়ে পরোক্ষে রাষ্ট্রীয় বাহিনী তরফে সংঘটিত এই অপরাধকে লঘুকরণের অপপ্রয়াস পেয়েছেন! অন্যদিকে গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি দুজনের অন্যতম ২৩ বছর বয়সি শিওয়াং দৃঢ়তার সঙ্গে জানিয়েছেন যে সশস্ত্র রাষ্ট্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা কোনরকম প্ররোচনা এবং সঙ্গত কারণ ছাড়াই তাঁদের ‘ডাইরেক্ট মারিসে’। তিনি তাঁর বুক এবং কনুইয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে ডিব্রুগড়ে আসাম মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল-এ ভর্তি আছেন। আহত আরও একজন ৩০ বছর বয়সি ইওয়াং, যিনি আরও সাতজনের সঙ্গে গাড়িতেই ছিলেন, তাঁর কানের পাশে গুলিবিদ্ধ হয়ে এই হাসপাতালে ভর্তি আছেন। জ্ঞান থাকলেও তিনি ‘ইন্ডিয়ান একসপ্রেস’-এর সাংবাদিকদের সঙ্গে ঠিকমতো কথা বলতে পারেন নি। তবে তিনি এটুকু জানিয়েছেন যে তাঁদের আদৌ থামতে বলা হয়নি, বরং সেনাবাহিনীর জওয়ানরা সরাসরি গুলি চালিয়েছিল, তাঁরা পালানোর চেষ্টাও করেন নি, তাঁরা গাড়ির মধ্যেই ছিলেন।—অথচ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ রাজ্যসভায় সরাসরি সেনাবাহিনীকে অভিযোগ-মুক্ত করার লক্ষ্যেই বলেছেন যে সেনাবাহিনীর জওয়ানরা গাড়ি থামাতে নির্দেশ দিয়েছিলেন, কিন্তু সন্দেহভাজনরা গাড়ি না-থামিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলেন, ফলে সেনাবাহিনীর জওয়ানরা গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছিলেন।—এভাবেই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী খুনী রাষ্ট্রীয় বাহিনীর তরফে সংঘটিত হত্যালীলাকে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন!
অপরপক্ষে গ্রামবাসীদের তরফে জানানো হয়েছে সেনাবাহিনীর লোকেরা শুধু যে এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়েছিল হত্যার উদ্দেশ্যেই তাই নয়, গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত শ্রমিকদের পরনের পোশাকও সেনাবাহিনীর লোকেরা পালটে দিয়েছিল। এমনকি শ্রমিকদের গাড়ি থামানোর নির্দেশ দেওয়া হয় যে চেকপোস্ট থেকে, অকুস্থলে তেমন কোনও চেকপোস্টের অস্তিত্বই ছিলনা! সামনের দিক থেকেই গুলি চালনো হয়েছিল এবং এই অভিযানে সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত গাড়ির নম্বর পালটে ফেলা হয়েছিল বলে সংবাদে প্রকাশ পেয়েছে।—এরপর আর কী করে এই খুনী সেনাবাহিনীর জওয়ানদের তরফে ‘ভুল’ করে গুলি চালনা বিষয়ক স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অপযুক্তি জনগ্রাহ্য হতে পারে? বরং এমত ভাবনার অবকাশ থেকেই যায় পূর্ব পরিকল্পিতভাবেই রাষ্ট্রীয় বাহিনী এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে এবং তারা নিহত শ্রমিকদের লাশ গায়েব করার চক্রান্ত করেছিল যা গ্রামবাসীদের প্রতিবাদের ফলে আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। শোমওয়াং নামীয় এক নিহত শ্রমিকের পরিবারের লোকজন অভিযোগ করেছেন যে তাঁরা নিহত শোমওয়াং-কে অর্ধ-উলঙ্গ অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকতে দেখেছেন। গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত শ্রমিকের দেহ অর্ধ-উলঙ্গ অবস্থায় পড়ে থাকা কোন সত্যকে সামনে নিয়ে আসে?
নাগা ন্যাশনাল পোলিটিক্যাল গ্রুপ (এনএনপিজি)-র আহ্বায়ক এন কিথোভি জিমনি এক বিবৃতিকে জানিয়েছেন যে নাগা জনগণ যখন শান্তির জন্যে উন্মুখ হয়ে উঠছিলেন ঠিক তখনই ভারতীয় সেনাবাহিনীর তরফে সংঘটিত এই গণহত্যা নাগাল্যান্ডের শান্তিপ্রিয় জনসাধারণের ভাবাবেগকে নির্মমভাবে আঘাত করলো। পাশাপাশি এনএসসিএন (ইশাক-ম্যুইভা)-এর তরফে প্রচারিত এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে যে, ইন্দো-নাগা শান্তি উদ্যোগ জারি থাকার সময়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর তরফে এই নির্মম গণহত্যা সভ্যতার সংকটকেই আরও ঘনীভূত করলো।—আর এই পরিস্থিতিতে নাগাল্যান্ডে আফস্পা মতো কালা কানুন বাতিলের দাবি আরও জোরালো হয়ে উঠছে। নাগাল্যান্ডের বিভিন্ন সংগঠন এই কালা কানুন বাতিলের দাবিতে আরও বেশি বেশি করে সংঘঠিত হচ্ছে। এমনকি নাগাল্যান্ডের মুখ্যমন্ত্রী নেফিউ রিও এই রাজ্য থেকে আফস্পা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন।
দ্য নর্থ ইস্ট স্টুডেন্টস অরগানাইজেশন (নেসো) গতকাল সারা নাগাল্যান্ড জুড়ে ধর্না বিক্ষোভে সামিল হয়ে নাগাল্যান্ডের মন জেলায় রাষ্ট্রীয় বাহিনীর তরফে সংঘটিত এই গণহত্যার যথাযত বিচার এবং এই কুখ্যাত আফস্পা বাতিলের দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন। অল অসম স্টুডেন্টস য়ুনিঅন (আসু)ও এই গণহত্যার প্রতিবাদে অবস্থান বিক্ষোভে সামিল হয়েছেন।
অসমের রাইজোর দলের সভাপতি অখিল গগৈ বলেছেন যে কুখ্যাত আফস্পা-র বলে বলীয়ান রাষ্ট্রীয় বাহিনী প্রথাগত আইন এবং কোর্টকে তোয়াক্কা করেনা, এই গণহত্যাকে তিনি ভারতীয় সরকারের এক ধরনের ‘ক্যারিকেচার’ বলে অভিহিত করে অবিলম্বে এই আফস্পা বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। অসম জাতীয় পরিষদ-এর সভাপতি লুরিনজ্যোতি গগৈ, সিপিআই এবং সিপিএম-ও এই কালাকানুন বাতিলের দাবি করেছেন। নাগা পিপলস মুভমেন্ট ফর হিউম্যান রাইটস-ও তাঁদের এক প্রেস বিবৃতিতে এই গণহত্যার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন এবং এই কুখ্যাত আফস্পা-কে ‘ফ্যাসিস্ত আইন’ বলে আখ্যাত করেছে।
পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের তরফ থেকে একটি সংসদীয় দলের প্রতিনিধিরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে এই আফস্পার অপব্যভারের দাবি জানিয়েছেন। এই দাবির অর্থ এটাই যে তাঁরা এই ঔপনিবেশিক কালা কানুনের প্রত্যাহারের পক্ষে সওয়াল করছেন না, তাঁরা এই আইন বাতিলের দাবিও জানাচ্ছেন না, তাঁরা এই আইনের অপপ্রয়োগের দাবি জানাচ্ছেন! রাজনৈতিক দলগুলি শাসক হিসেবে ক্ষমতায় বসে গণঅসন্তোষ দমনে এই কুখ্যাত আইনগুলিই প্রয়োগ করতে চায়, তাই তারা এইসব কালাকানুনগুলি বাতিলের দাবি জানানোর পরিবর্তে এই অপপ্রয়োগের মতো হাস্যকর দাবি জানিয়ে থাকে। কিছুদিন আগে আর এক কুখ্যাত য়ুএপিএ-আইনে অভিযুক্ত স্টান স্বামীর পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলি এই কুখ্যাত আইনের প্রয়োগহীনতার পক্ষে সওয়াল করলেও এই আইনের অবসান দাবি করেন নি!
আমাদের দেশের ফ্যাসিস্ত সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখার সঙ্গে আফস্পা, ইউএপিএ প্রমুখ কুখ্যাত আইনগুলো অবিলম্বে বাতিলের দাবিও অত্যন্ত জরুরি। এক্ষেত্রে কোনরকম শৈথিল্য ঘুরিয়ে এই ফ্যাসিস্ত শক্তির হাতই শক্ত করে। কিছুদিন আগে ‘ছাব্বিশ জন মাওবাদী’কে এই রাষ্ট্রীয় বাহিনীই হত্যা করেছে। এবং এই হত্যাকাণ্ড সংঘঠনের সঙ্গে সরকারের ‘মাওবাদী’ নিকেশের সাফল্যের অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক রয়ে গিয়েছে।
একজন ইংরেজ কবি লিখেছিলেন : ভগবান যা করেন তা যথার্থ! দেশের ফ্যাসিস্ত সরকারও তো এই ‘ভগবান’ সদৃশ। বিজেপি সমর্থক তথা আমাদের দেশের হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্তরা তো নরেন্দ্র মোদিকে তাঁদের ‘ভগবান’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকেন। স্বভাবতই এই সরকার যা করেন (গণহত্যা সহ) তা-ই যথার্থ। এটাই এই ফ্যাসিস্তদের কাছে ‘সেটেলড’, আর আজ এই ‘সেটেলড’কে ‘আনসেটেলড’ করাই ফ্যাসিবিরোধী সংগ্রামের আশু কর্তব্য বলে বিবেচিত হওয়া উচিত।
ডিসেম্বর ৯-১০, ২০২১
কভার ছবি ঃ অভিজিৎ সেনগুপ্ত