পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

মাতৃভাষা

  • 21 February, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 1313 view(s)
  • লিখেছেন : মীর রাকেশ রৌশান
বন্ধুর মা নাম জিজ্ঞেস করলেন। আমি বললাম 'রাকেশ'। তারপর এটা ওটা খেতে দিলেন।অনেক যত্ন সহকারে ভালোবেসে খাইয়ে,গল্প শুরু করলেন। সেদিনের অনেক জমজমাটি আড্ডা। শেষের দিকে বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করলেন। বাবার নাম জিজ্ঞেস করলেন। বাবার নাম যখন শুনলেন নুরুল ইসলাম। তারপর উদ্ভুত একটা কথা বেরিয়ে আসলো "ওহ,তোমরা মুসলমান? আমি রাকেশ নাম শুনে ভেবেছিলাম বাঙালি। "

সেদিন ছিলো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। মানে অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। সেই উপলক্ষ্যে সপ্তম শ্রেণির  ছাত্র-ছাত্রীদের একটা কবিতা পড়াচ্ছিলাম। বিখ্যাত হিন্দি ভাষী কবি কেদারনাথ সিং এর কবিতা 'মাতৃভাষা'। কবিতাটি বাংলায় তর্জমা করেছেন আধুনিক বাংলা ভাষার অন্যতম পরিচিত  মহিলা কবি মল্লিকা সেনগুপ্ত।কবিতার লাইনগুলো ছিলো

"পিঁপড়ে যেভাবে ফেরে
নিজের গর্তে
কাঠঠোকরা পাখি
কাঠে ফেরে
বায়ুযান একে একে ফিরে আসে
লাল আকাশে ডানা মেলে
বিমানবন্দরে

ও আমার ভাষা
আমি তোমারই ভিতরে ফিরি
চুপ করে থাকতে থাকতে যখন
আমার জিভ অসাড় হয়ে যায়
আমার আত্মা দু:খ হয়ে ওঠে।"

ক্লাসের কিশোর-কিশোরীদের কবিতার প্রতিটি লাইন বোঝাতে বোঝাতে হঠাৎ কোথায় হারিয়ে যাচ্ছি।অনেক অনেক দূরে হারিয়ে যাচ্ছি।অন্য দিকে চোখের জল আঁটকে রাখতে পারছিনা।বুকের ভেতরটা কেমন ধুকপুক করছে।অদ্ভুত একটা চাপা কান্না আর চোখের সামনে যেন ফেলে আসা জীবনের অনেক মুহূর্তের কোলাজ তৈরি হচ্ছে এবং কানে সেই মুহূর্তের শোনা কথাগুলো একটার সাথে আরেকটা, আরেকটার সাথে আরেকটা কেমন প্রতিধ্বনি তৈরি করছে।এ যেন ঠিক সিনেমার মতন।হয়তো সিনেমা এই ভাবেই তৈরি হয়।প্রতিটি মুহুর্তের স্পর্শ দেওয়ার জন্য চোখ,কান থেকে শরীরের লোমকূপগুলো তার স্বাদ পায়।হঠাৎ এক ছাত্র স্যার,স্যার বলে চিৎকার করাতে টের পেলাম ক্লাসের মাঝে অনেকটা সময় আমি নিশ্চুপ ছিলাম।কোন কথা না বলে বই রেখে হাঁটতে শুরু করলাম।হাঁটতে হাঁটতে সেই সব দৃশ্যগুলো কেমন আলাদা আলাদা ভাবে নাড়া দিতে লাগলো।সংক্ষেপে সেই দৃশ্যগুলো আলোচনা করলে এমন দাঁড়ায়

 দৃশ্য-১

আমি কলেজ পড়ুয়া। সদ্য ক্লাস শুরু করেছি। কলেজে নতুন নতুন শহরের কিছু বন্ধু তৈরি হয়েছে। কলেজে ক্লাসে একটা বিষয়ে পুনরায় বলার জন্য বললাম "স্যার আরেকবার বলেন।" স্যার মুচকি  হাসলেন। ক্লাসের অনেকেই মুচকি হাসলে। সবটাই ব্যঙ্গাত্মক। পরে বুঝলাম কথাটা ' বলেন হবে না, বলুন হবে'।এমন অনেক শব্দ শুনে শহরের ভদ্দলোকের ছেলেরা ব্যঙ্গাত্মক হাসত। যেমন বিহ্যান,লোদী,লালহা,শাগ,নুচি।কথায় কথায় বলতো গাঁইয়া।কেমন হতাশায় ভুগতাম।বেশি কথা বলতেই ভয় পেতাম। যদি ভদ্দর বৃত্তের বাইরে কোন আঞ্চলিক শব্দ বলে ফেলি। আসলে আমি রাঢ় বাংলার মানুষ। তার আঞ্চলিক টান,আঞ্চলিকতা সবটাই ছিলো। না, ঠিক ছিলো বলা ভুল হবে, এখনও আছে।ভাষাবিদরা এই বিষয়টি খুব ভালো ভাবে বিশ্লেষণ করতে পারবেন। যেমন ধরুন  অভিশ্রুতির ব্যবহার রাঢ়ী  উপভাষার একটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। যেমন – রাখিয়া > রাইখ্যা > রেখে; করিয়া > কইর‍্যা > করে।
আবার ‘ল’ কোথাও-কোথাও ‘ন’-রূপে উচ্চারিত হয়। যেমন - লুচি > নুচি; লেবু > নেবু।অন্যদিকে নাসিক্যীভবন এবং স্বতােনাসিক্যীভবনের প্রবণতা দেখা যায়। যেমন – কণ্টক > কাঁটা; বন্ধ> বাঁধ।এছাড়াও শব্দের শেষে বা মাঝে অবস্থিত অঘােষ ধ্বনি (বর্গের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ণ) কখনাে কখনাে সঘােষ ধ্বনিতে, অর্থাৎ বর্গের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম ধ্বনিতে পরিণত হয়। যেমন শাক > শাগ; ছাত > ছাদ।স্বরসংগতির প্রবণতা এই উপভাষায় লক্ষণীয়। যেমন – বিলাতি > বিলিতি; পূজা > পুজো।এই রকম অসংখ্য বিষয় আছে।যা প্রথাগত ভদ্দরলোকের ছেলে-মেয়েদের কাছে অট্টহাসির বিষয় হয়।মজার খোরাক হয়।অসংখ্য ছেলে-মেয়েরা এই র‍্যাগিং টা করে থাকে।যা কান্না হয়ে জমে থাকে।

দৃশ্য -২

কোন বন্ধুর বাড়ি গেছি। বন্ধুর মা নাম জিজ্ঞেস করলেন। আমি বললাম 'রাকেশ'। তারপর এটা ওটা খেতে দিলেন।অনেক যত্ন সহকারে ভালোবেসে খাইয়ে,গল্প শুরু করলেন। সেদিনের অনেক জমজমাটি আড্ডা। শেষের দিকে বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করলেন। বাবার নাম জিজ্ঞেস করলেন। বাবার নাম যখন শুনলেন নুরুল ইসলাম। তারপর উদ্ভুত একটা কথা বেরিয়ে আসলো "ওহ,তোমরা মুসলমান? আমি রাকেশ নাম শুনে ভেবেছিলাম বাঙালি। " আমি কোন উত্তর করতে পারিনি। সেদিন সাইকেল চালাতে চালাতে রুবি বুবুর বাড়ি পেরিয়ে খাগড়া,ফরাসডাঙ্গা পৌঁছে গেছি বুঝতে পারিনি। এখনও কেন যেন মনে সেই রাস্তায় কেমন হারিয়ে গেছি।সবাই যেন আমার মুখের দিকে তাকাচ্ছে আর ফিসফিস করে বলছে  "ওই দ্যাখ রাকেশ, আমরা ভেবেছিলাম বাঙালি কিন্তু ও মুসলমান...মুসলমান... মুসলমান... "

দৃশ্য - ৩

মাধ্যমিকের পর পরবর্তী পড়াশোনার জন্যে বহরমপুর শহরে এলাম।বহরমপুর শহরে রুবি বুবুর কাছেই আমার আশ্রয়। রুবি বুবু আমার ছোট বেলার সঙ্গী। আমরা একসাথেই তিন বোন আর আমি মানুষ হয়েছি।রুবি সবার বড়। বড় বোনকে ছোট থেকেই 'বুবু' বলে জানতাম।চারপাশে সকলেই বড় বোনকে বুবু বলে।আমিও তার বাইরে নই।কিন্তু সমস্যাটা শুরু হলো বহরমপুর এসে।পড়াশোনা শেষ করে যখন বাড়ি ফিরে দরজার কাছে বুবু বলে ডাকতাম,ধাপির কাছে বসে থাকা চারপাশের মানুষ ব্যঙ্গাত্মক হাসি দিত।প্রথম প্রথম বুঝতে পারতাম না।পরে একদিন একজন হাসতে হাসতে বললেন "বুবু আবার কি গাঁইয়া কথা,দিদি বলতে পারিস না?" এরপর চারপাশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দিদির চাপে আমার সংখ্যালঘু বুবু কোথায় হারিয়ে গেলো বুঝতে পারলাম না।এখন বুঝতে পারি, এটাও এক ধরনের আগ্রাসন।সেই আগ্রাসনের ঠেলায় আমার ভালোলাগা কত শব্দ আমি হারিয়ে ফেলেছি।যা আমার সমাজ থেকে শেখা।যা আমার মায়ের ভাষা।প্রয়োজন নেই জানার সেই শব্দ কোথা থেকে এসেছে।

দৃশ্য - ৪

অনেক দিন আগেকার ঘটনা। আমার ছোট ফুপাজি পরিযায়ী শ্রমিক।পেটের দায়ে গেছেন সৌদি আরব। কোলে দুই মেয়ে নিমি আর নুপুরকে নিয়ে আমার ছোট ফুপু একাই থাকতেন।ছোট ফুপাজী পাড়ার প্রথম বিদেশে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিক।ফুপাজীর কাজ মরুভূমিতে উট চরানো। উটের দেখভাল করা।তখন গ্রামে টেলিফোন,মোবাইল ফোন আসেনি।যোগাযোগের মাধ্যম বলতে চিঠি।কিন্তু ওপ্রান্ত থেকে চিঠি আসলেও এ প্রান্ত থেকে চিঠি যেতো না।আসলে মালিক পক্ষের শ্রমিকদের এতো দায় নেওয়ার সময় ছিলো না।শ্রমিক সে তো দাসের মতই।এই সমস্ত বিষয়ে সমাধানের জন্য ফুপাজী একবার একটা টেপরেকর্ডার আর কয়েকটি ক্যাসেট পাঠালেন। ক্যাসেটে রেকর্ড করা প্রতি মুহুর্তের কথা মনে পড়ে। বারবার মনে পড়ে যায়।যখন পোস্টম্যান চিঠির বদলে ক্যাসেট ফুপুর বাড়ি দিয়ে যেত। পাড়ার সকলেই ফুপুর বাড়ির আঙিনায় উপস্থিত হত।একটার পর একটা ক্যাসেটের কথাশুনে অনেকেই চোখের জল ফেলতেন। সেই ক্যাসেটের কয়েকটি লাইন আমাকে বড় হয়ে অনেক কাঁদিয়েছে।লাইনটা এমন ছিলো " জানো নিমির মা,এইখ্যানে কেহু বাংলা কথা জানেনা।আমি অনেদিন কাহুরির সাথে বাংলায় কথা বুলিনি। এই ক্যাসেটেই শুধু বাংলায় কথা বুলা হয়।"

উপসংহারের বদলে

ভাষা আসলে ভাবের আদান প্রদান।পৃথিবীর প্রতিটি জাতির মানুষের কাছেই তার মাতৃভাষা সবচেয়ে প্রিয়। কিন্তু শুধু বহুল প্রচারিত ভাষায় শুধু অন্য ছোট ভাষাকে গ্রাস করছে এমনটা নয়। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্থান এর ধারনা যেমন দেশের বৈচিত্র্যকে নষ্ট করছে।গ্রাস করে চলেছে আঞ্চলিক দল,ভাষা,গোষ্ঠী, ধর্ম,খাদ্যাভ্যাস, পোষাক কে।ঠিক তেমনি আমাদের চারপাশে ব্রাহ্মণ্যবাদ,সামন্তবাদ থেকে ভদ্দরলোকেরাও গ্রাস করে চলেছে উপভাষাগুলোকে তাদের খিল্লি,মস্করা,ব্যঙ্গ কোলাজ হয়ে আমার মত অসংখ্য মানুষকে কাঁদায়। ঘুম কেড়ে নেয়।এ যেনো আমার বিভাজিত হয়ে যাওয়া বাংলা থেকে অ,আ,ক,খ এর উপর প্রতিমুহূর্তের আঘাত।এ আমার রক্ত দিয়ে পাওয়া ভাষা।এ আমার বরকত, রফিকুল,জাব্বার । এ আমার ঢাকা,মুর্শিদাবাদ,মানভূম,শিলচর। সেই আঘাত মাথার মধ্যে প্রতিটি দৃশ্য তৈরি করছে। কানের মধ্যে ভেসে আসছে সেই ব্যঙ্গাত্মক শব্দের কোলাজ।কোনটা কিভাবে সাজানো আমি জানি না।শুনতে পাচ্ছি, "রাকেশ আমি ভাবলাম তুমি বাঙালি... ওই বুবু বলছিস কেন দিদি বল...এই দ্যাখ দ্যাখ গাঁইয়াটা শাক কে শাগ বলছে...জানো নিমির মা আমি কতদিন বাংলা কথা বুলিনি..."
বাড়ি ঢুকতেই সহধর্মিণী বলছে " কী গো তোমার চোখে জল কেন? কী হয়েছে? আমি তাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলাম " চুপ করে থাকতে থাকতে আমার জিভ যখন অসাড় হয়ে যায়, ও আমার মাতৃভাষা, ও আমার অ,আ,ক,খ আমি তোমায় জড়িয়ে ধরে কাঁদি..."

0 Comments

Post Comment