ভোটে মাছ-মাংস-মুগল-মঙ্গলসূত্র-মুসলমান এনেও ‘আব কি বার ধাই’শ পার’ নিশ্চিত হচ্ছে না বোধহয়, তাই মিশন-মহান্ত-মহারাজদের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা কেন হঠাৎ ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ, ইসকন, রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজাদের পিছনে পড়লেন তা বলতে পারব না। এমনিতে হিসেব করে কথা বললেও এক্ষেত্রে তিনি বাচাল হয়ে ফাউল করে ফেলে পরে সামলাতে পারছেন না। তবে, এসব করে উনি ওনার ভোটব্যাঙ্ককে তুষ্ট করতে চেয়েছেন এটা যাঁরা বলছেন তাঁদের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ না থাকলেও যুক্তি হিসেবে তা একদমই ছেঁদো। রামকৃষ্ণ মিশনকে আক্রমণ করে তিনি ভোটে ফায়দা লুটবেন এটা শুনলে ঘোড়াও হাসবে। কিন্তু মোদিজি কেন সাধু-সন্তদের আগলাতে নেমে পড়লেন তা বুঝতে কোনো সমস্যা হয়নি। তিনি তাঁর হিন্দু ভোট ব্যাঙ্ককে একজোট করতে সাধু-সন্তদের রাজনীতির উর্ধে এক অমৃতলোকের বাসিন্দা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে নেমে পড়লেন। ফলে এখন ভোটের বাজারে পাঁচ নয় দশ দশটা ‘ম’ ম ম করছে। মাছ-মাংস-মুগল-মঙ্গলসূত্র-মুসলমান-মিশন-মহান্ত-মহারাজ-মমতা-মোদি।
মুর্শিদাবাদের ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের কার্তিক মহারাজ তথা স্বামী প্রদীপ্তানন্দ যে সঙ্ঘ পরিবার তথা বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন ‘হিন্দু জাগরণ’ তথা ‘হিন্দু গৌরব পুনরুদ্ধারের’ লক্ষ্যে, এবং ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুত্বের রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠিত ও জয়ী করার জন্য বিবিধ পন্থায় সক্রিয় তা গত ডিসেম্বর মাসে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কৌশিকী দাশগুপ্তর নিবন্ধতে উল্লেখ করা হয়েছিল। তাঁর নিবন্ধটির নাম ছিল, “দি সিফটিং ট্রাজেক্টরিস অফ হিন্দুত্ব-ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ এন্ড দি মেকিং অফ এ স্যাফ্রন ওয়েভ ইন ওয়েষ্ট বেঙ্গল”। সেটি প্রকাশিত হয়েছিল, সেন্টার ফর দি স্টাডি অফ ডেভেলপিং সোসাইটিস-এর পত্রিকা (সেজ জার্নাল) স্টাডিস ইন ইন্ডিয়ান পলিটিকস-এর ভল্যুম-১১, ইস্যু-২, ডিসেম্বর ২০২৩, পৃষ্ঠা-১৮০-১৯১। ওই ১২ পৃষ্ঠার নিবন্ধে অধ্যাপক দাশগুপ্ত লিখেছেন, “পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে, বিজেপি এবং তাদের সহযোগীরা মতুয়া মহাসঙ্ঘ, গৌরীয় মঠ, ইসকনের মত আঞ্চলিক ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলির সংযোগ তৈরি করতে প্রভূত উৎসাহ দেখায়; তবে, ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের মত অন্যতম প্রতিষ্ঠিত আধ্যাত্মিক-মানবিক হিন্দু সংগঠনের সঙ্গে তাদের (বিজেপির) যোগাযোগ বাংলায় সমমনস্ক ব্যক্তিদের সুগঠিত নেটওয়ার্কের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার এবং বৃহৎ হিন্দু জনতার মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার ক্ষেত্রে পার্টিকে সর্বাধিক কাঙ্খিত সুযোগ প্রদান করে।“
ওই নিবন্ধের থেকে উদ্ধৃত করছি: “ইতিমধ্যে ২০১০ সালে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের সর্বভারতীয় সভাপতি, স্বামী বুদ্ধানন্দ হিন্দু সংহতির নির্দেশানুসারে লিখিত মুসলিম সংরক্ষণ নীতির বিপজ্জনক প্রভাব বিষয়ক পুস্তক প্রকাশ ও প্রচার করেন (সংহতি সংবাদ, ২০১০ক, পৃষ্ঠা ৪)। এই ঝোঁক বজায় রাখতে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের কিছু সাধু গোয়াতে জুন, ২০১২র ঐতিহাসিক হিন্দু রাষ্ট্র সম্মেলনে এবং বাংলায় সেটির আঞ্চলিক উদ্যোগে (হিন্দু অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম, ২০১২) অংশগ্রহণ করেন। ২০১৩ সালে আরএসএস, ভিএইচপি, বজরং দল, হিন্দু সংহতি এবং ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের একটি ছোট গোষ্ঠী যৌথভাবে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগণার শেওড়াতলাতে হিন্দু মিলন মন্দির ভবনে একটি ৩ দিনের যুব শিবির (প্রণবানন্দ যুব শিবির) সংগঠিত করেন। চরিত্রগঠন ও শারীরিক প্রশিক্ষণের কর্মসূচির পাশাপাশি বক্তারা বাংলায় হিন্দুদের বর্তমান অবস্থার বিষয়ে আলোকপাত করেন এবং তা থেকে নিস্কৃতি পাওয়ার জন্য কী করা যেতে পারে তা বলেন। ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের স্বামী শুভ্ররূপানন্দ, স্বামী দিব্যাজ্ঞানান্দজি এবং স্বামী প্রদীপ্তানন্দজি সেখানে উপস্থিত ছিলেন (হিন্দু অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম, ২০১৩)।“ “ ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের অন্যতম অতিসক্রিয় সাধু, স্বামী প্রদীপ্তানন্দজি ওরফে কার্তিক মহারাজকে, যিনি মুর্শিদাবাদের বেলডাঙ্গা শাখার কর্তা, দক্ষিণপন্থী সংগঠনগুলির বিভিন্ন মঞ্চে দেখা যায়। আরএসএস দ্বারা প্রকাশিত স্বস্তিকায় ২০১৬ সালে প্রকাশিত একটি সাক্ষাতকারে স্বামী প্রদীপ্তানন্দজি বলেন যে, হিন্দু বিরোধী ক্রিয়াকলাপের অন্যতম সংবেদনশীল ও উত্তপ্ত স্থান হল মুর্শিদাবাদ। “ফলে, সামগ্রিকে বোঝাই যাচ্ছে যে, ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের সাধুরা কেবল রাজনীতিতে অল্পবিস্তর জড়িয়ে পড়ছেন তাই নয়, তাঁরা দস্তুরমত রাজনীতি করছেন, বিজেপি-আরএসএস-ভিএইচপি-বজরং দল-হিন্দু সংহতি যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করে থাকে সেটিই করছেন। কেবল তাঁরাই নয়, নিবন্ধে উল্লেখিত মতুয়া মহাসঙ্ঘ তো হরিচাঁদ-গুরুচাঁদের মতাদর্শকে উপেক্ষা করে জয় শ্রীরামের পদতলে নিজেদের নিক্ষেপ করেইছে, এবং ইসকন বা গৌড়ীয় মঠের মহারাজরাও অবশ্যই বিজেপি-আরএসএসের মত সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তিগুলির রাজনীতিতে ইন্ধন দিচ্ছেন। সাধু সন্তদের রাজনীতিতে যুক্ত করে বাংলায় রবীন্দ্রনাথের বিশ্বজনীন সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করতে চাইছে বিজেপি।
২০২০ সালের ৩টি বিষয়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল ‘স্ক্রোল’এর সেপ্টেম্বর, ২০২১এর সংখ্যায়। নিবন্ধটির নাম ছিল, “কেন বিবেকানন্দ থাকলে বিজেপির সঙ্গে রামকৃষ্ণ মিশনের বোঝাপড়ায় আপত্তি করতেন”। ১২ জানুয়রিতে বেলুড় মঠে নরেন্দ্র মোদি উপস্থিত হন ও নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের পক্ষে ওকালতি করেন। দ্বিতীয়ত, আগস্ট মাসে অযোধ্যা রাম মন্দিরের শিলান্যাসের জন্য মঠ থেকে মাটি পাঠানো হয়। তৃতীয়ত, যদিও এটি ঘটনা নয় রটনা, ২০২০র ওই সময়ে মঠের একজন জ্যেষ্ঠ সাধু, স্বামী করকৃপানন্দের নামে শোনা যায় যে তিনি ভারতীয় জনতা পার্টিতে যোগ দিতে চলেছেন, এবং রাজ্যের মুখ হতে চলেছেন ২০২১ এর নির্বাচনে। ২০২০ সালের ১২ জানুয়ারি বিবেকানন্দের ১৫৭ তম জন্মবার্ষিকীতে জাতীয় যুবদিবস হিসেবে যখন রামকৃষ্ণ মিশন উদযাপন করছে সেই সময়ে মোদিজির ভাষণ থেকেই বোঝা যাচ্ছিল মনে হয় মিশনে রাজনীতি বিশেষত হিন্দুত্বের রাজনীতির ছায়া গাঢ় হচ্ছে। যদিও সেই সময় মোদির রাজনৈতিক বক্তব্যের সঙ্গে মিশন দূরত্ব তৈরি করতে চেয়েছিল তবুও মনে হয়, “গত কয়েক বছরে রামকৃষ্ণ মিশনের রাজনৈতিকীকরণ বেশ গভীর হয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সঙ্গে সংযুক্ত আধ্যাত্মিক গুরুদের অন্তর্ভুক্তিকরণ ও উন্নতির মাধ্যমে।“ (অয়্যার, জানুয়ারি ১৩, ২০২০, “মোদি’স পলিটিক্যাল কমেন্টস অন সিএএ...”)
হিন্দু জাতীয়তাবাদের বিপরীতে বিবেকানন্দ বিশ্বের জাতি ও ধর্মের ক্ষেত্রে বেদান্তিক দৃষ্টিভঙ্গী প্রচার করেছিলেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী ছিল আন্তর্জাতিকতাবাদী ও ধর্মীয় বহুত্ববাদী। তিনি অন্ধ স্বদেশভক্তির বিরোধী ছিলেন। তিনি তাঁর শিষ্য আলাসিঙ্গা পেরুমলকে লিখেছিলেন, সেপ্টেম্বর ১৮৯৫-এ, “আমার ক্ষেত্রে, মনে রাখবে, আমি কারুর কাছে বাঁধা নেই। আমি আমার জীবনের লক্ষ্য জানি, এবং আমার কোনো অন্ধ স্বদেশভক্তি নেই; আমি যতটা ভারতের ততটাই বিশ্বের, এটাতে কোনো বাড়াবাড়ি নেই। আমি যতটা পারি তোমাদের সাহায্য করেছি, এবার তোমাদের নিজেদেরকে সাহায্য করতে হবে। কোন দেশের আমার উপরে বিশেষ দাবী আছে? আমি কি কোনো দেশের ক্রীতদাস?”বিবেকানন্দর মতে সিন্ধু নদীর অববাহিকায় বাস করা মানুষজন একই ধর্ম অনুসরণ করত বলে তাদের হিন্দু বলা হত। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তাদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তারা বিভিন্ন ধর্ম অনুসরণ করে। ভারতে বহু ধরণের ধর্মবিশ্বাস থাকার ফলে বিবেকানন্দ দাবী করেন যে, ‘হিন্দু’ শব্দটি সেকেলে ও বিভ্রান্তিকর হয়ে পড়েছে। সেটিকে বেদান্ত দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা দরকার। বেদান্তবাদের উপর একটি বক্তৃতায় তিনি বলেন যে, “ আমি হিন্দু শব্দটি ব্যবহার করব না। ... অন্য যে শব্দগুলি আমরা ব্যবহার করতে পারি তা হল, বৈদিকা, বেদের অনুগামী, অথবা আরো ভালো হয়, বেদান্তিক, বেদান্তের অনুগামী।“
অতএব, বিবেকানন্দ প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশনের হিন্দুত্ব রাজনীতিকে সাহায্য করার কোনো কারণ নেই। বরং, হিন্দুত্বের রাজনীতি যেভাবে দেশের সমস্ত বহুত্বকে ধ্বংস করতে চাইছে, অতি-দেশভক্তিকে আশ্রয় করে ফ্যাসিবাদ কায়েম করতে চাইছে তার বিরুদ্ধেই রামকৃষ্ণ মিশনের যাওয়া উচিত। রামকৃষ্ণ মিশনকে আশ্রয় করে মোদি ও বিজেপির এরাজ্যে ক্ষমতা দখলের বাসনাকে বিনষ্ট করাই রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ অনুগামীদের কাজ।
অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, সাধু মহারাজরা রাজনীতি করতে পারবেন না কেন? রাজনীতি কেবল গুন্ডা, বদমায়েশ দুর্নীতিগ্রস্থরাই করবে? উত্তরে বলা যায়, ভারত সেবাশ্রমের মহারাজরা সরাসরি রাজনীতি করুন, ঘোষণা করুন যে, তাঁরা হিন্দুত্বের রাজনীতি, বিজেপি-আরএসএস-ভিএইচপি-বজরং দল-হিন্দু সংহতির রাজনীতি করছেন। সেটা তাঁদের বাস্তবিক ও মতাদর্শগত অবস্থানের সঙ্গে সাযূজ্যপূর্ণ। অপরদিকে, রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজরাও রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের অদ্বৈতবাদী, ‘যত মত তত পথ’ এর মতাদর্শকে অবলম্বন করে আন্তর্জাতিকতাবাদী বহুত্ববাদী মতাদর্শকে উর্ধে তুলে ধরে তা প্রচার করুন, যা তাঁদের মতাদর্শগত অবস্থানের সঙ্গে সাযূজ্যপূর্ণ; বাস্তবেও তাঁরা সেই অবস্থান গ্রহণ করুন।