গত কয়েকদিনে টিভিতে যা দেখছি শুনছি, তার পরিপ্রেক্ষিতে স্কুল জীবনে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে খুব। তখন ক্লাস এইটে পড়ি। ক্লাসে দুই সহপাঠিনীর মধ্যে তুমুল ঝগড়া চলছে। ঝগড়ার বিষয়টা মনে না থাকলেও এটা মনে আছে যে দুজনেরই মেজাজ পুরো সপ্তমে আর ক্লাসে আমরা বাকিরাও ব্যাপারটায় বেশ ইনভল্ভড হয়ে পড়েছিলাম। একটা সময়ে যুক্তি তর্ক সব শেষ - কোমর বেঁধে গালাগাল দিচ্ছে দুজনেই একে অপরকে । আমরা ২০০৫ সালে মেয়েদের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ি - বাংলা কাঁচা খিস্তির বিষয়ে অতটা দড় ছিলাম না। তাই যাবতীয় মধুবর্ষণ ইংরিজিতেই হচ্ছিল। উত্তেজনার পারদ যখন তুঙ্গে , ঠিক সেই সময়ে একজন অপরজনকে বলে ওঠে, You know what? You are a lesbian!
ব্যাস।
গোটা ক্লাসঘরে যেন বোমা পড়ল। এই কথা শুনে অন্য মেয়েটি হঠাৎ কেমন চুপসে গেল। আমরাও কেমন হতবাক। এত বড় অপমান?
কলকাতার রাস্তায় দেশের প্রথম ‘প্রাইড ওয়াক’ তার বেশ কয়েক বছর আগেই চালু হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা সকলেই তখনও একাগ্রচিত্তে হোমোফোবিক ছিলাম। ‘সমকামী’ ডাককে অপমান ভাবার মধ্যে যে ভাষার হিংস্রতা ও মূল্যবোধের হীনমন্যতা লুকিয়ে আছে, তাকে চিহ্নিত করার মতন মনন তৈরি হয়নি। এই অসংবেদনশীলতা হাড় মজ্জায় নিয়ে, এইরকম বাতাবরণেই আরও বড় হয়েছি। কলেজে ইউনিভার্সিটি আকছার শুনেছি একে ওকে খোঁচা মেরে মন্তব্য - ‘দেখিস ওর আবার একটু ওরিয়েন্টেশনের এর গোলমাল আছে’ । কখনও ঠাট্টার ছলে, কখনও সিরিয়াস হয়ে। কিন্তু ‘গোলমাল’, ‘গণ্ডগোল’ , ‘ভুলভাল’ - এই ধরণের ভাষা আমরা কেন প্রয়োগ করি সমকামিতার প্রতি? নারী-পুরুষ সম্পর্কের বাইরে যে সব প্রেম, ভালবাসা বা যৌনতা থাকে , সেগুলো বুঝি বিকার?
তারপর বহু বছর পেরিয়ে গেছে। তবে সেই রামও আছেন, সেই অযোধ্যাও থেকে গেছে। বর্তমান কালে আমাদের দেশে রামরাজ্য রমরমা। সেই রাজ্যের যোগী আদিত্যনাথ এক কালে বলেছেন সমকামী ব্যক্তি আর জন্তুর মধ্যে পার্থক্য নেই। বাবা রামদেব দাবি করেছেন, যোগাসন করে তিনি সমকামিতা ‘সারিয়ে’ দিতে সক্ষম। আর সত্যি বলতে কি, ভারতবর্ষের রাজনীতিতে লিঙ্গ ও যৌনতার সম্পর্ক বোঝার জন্য সুদূর অযোধ্যায় যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। বাংলাতেই আমাদের নেতানেত্রীদের মুখ থেকে হামেশাই নানান মণিমুক্তো ঝরে পড়ছে। পশ্চিম বাংলায় কয়েকবছর আগে একটি মেয়েদের স্কুলে কিছু ছাত্রীদের লক্ষ্য করে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন - সমকামিতা বাংলার সংস্কৃতিবিরুদ্ধ , এসব কখনওই এখানে সহ্য করা যায়না। তাতে শহরের কিছু জায়গায় প্রতিবাদ হলেও রাজনৈতিক স্তরে তার কোনও প্রভাব আজও আমরা দেখতে পাইনা। সম্প্রতি তৃণমূল কংগ্রেস এর কুণাল ঘোষ এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও একই পথে হাঁটছেন। বিরোধীপক্ষের এক পুরুষ নেতাকে আক্রমণ করতে গিয়ে তাঁকে ‘বিকৃত সমকামী’ বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি পুরুষদের প্রতি আকৃষ্ট বোধ করেন বলে ব্যাঙ্গ বিদ্রূপ করেছেন তাঁর প্রতি। এই সব শুনতে আর দেখতে গিয়ে ওই ক্লাস এইটের ঘটনাটাই বারবার মনে পড়ে যায়। একে অপরকে আক্রমণ করতে গিয়ে একটা গোটা প্রান্তিক গোষ্ঠীকে টার্গেট করার মধ্যে যে কুশিক্ষা, তা আমরা এত বছর পরেও বয়ে নিয়ে চলেছি। কারুর সমালোচনা করতে গেলে তাকে সমকামী বা হিজড়ার তকমা দিতে হবে কেন? অন্যের ভিন্নতাকে ছোটো করে, নিজেকে ‘পুরুষ সিংহ’ প্রমাণ করে গর্ববোধ করার মধ্যে যে পিতৃতান্ত্রিক পেশীর আস্ফালন, সেটাই কি সমাজের প্রকৃত অসুখ নয়?
সমকামিতা নিয়ে এত অস্বস্তি কীসের? নিজের থেকে একটু অন্যরকম হলেই তাঁর প্রতি আমাদের এত বিতৃষ্ণা কীসের? এই প্রশ্ন নিজেকেই করা দরকার। ক্ষেত্রবিশেষে অধিকারের ভাষা প্রয়োগ করার বিশেষ প্রয়োজন আছে। এটি শুধু মানবিকতাবোধ নয়, মানবাধিকারের প্রশ্ন। আহা বেচারা ও কি করবে, ও তো এমনটা হয়েই জন্মেছে- এই ভাবনার মধ্যে যে করুণা লুকিয়ে আছে তা প্রান্তিক মানুষকে আরও প্রান্তিক করে দিতে পারে। মনে রাখা দরকার যে তাঁর সমকামী পরিচিতি অত্যন্ত স্বাভাবিক। তাতে কোনও বিকৃতি নেই, কোন অসুখ নেই, কোনো দুঃখ নেই, কোন লজ্জা নেই, কোন অপরাধ নেই। কাজেই করুণার প্রশ্ন উঠতে পারেনা। বরং দাবিদাওয়া অধিকার ইত্যাদির প্রশ্ন আছে। লিঙ্গপরিচয়ের বিভিন্নতা ও যৌনতার রংধনুকে উদযাপন করার প্রয়োজন আছে।
ভারতবর্ষে সমকামিতা আইনত অপরাধ তো নয়েই, উপরন্তু কোর্টে অসংখ্য পিটিশানের শুনানি চলছে, সমলিঙ্গের বিবাহ বৈধকরণের। কাজেই উদযাপন করতে দ্বিধা কোথায়?
রাজনৈতিক দলগুলোর খুব শীঘ্র প্রয়োজন নিজেদের ভাবনার খোলনলচে পালটে ফেলার। তাঁরা কি অধিকারের আন্দোলন, নাগরিক সমাজ বা আইন আদালতের থেকে এতটাই বিচ্ছিন্ন? প্রয়োজন হলে কেঁচে গণ্ডূষ করুন। যৌনতার পাঠ নিন। আর যারা মনে করছেন তাঁদের সেই পাঠ পড়া আছে, তাঁরা লিঙ্গ ও যৌনতা বিষয়ক অধিকার নিয়ে টোকেনিজম এর বাইরে গিয়ে সোচ্চার হন। ‘পৌরুষ’ প্রদর্শনে কোন বাড়তি গর্ব নেই, বিশ্বাস করুন। ছাপান্ন ইঞ্চি ছাতির দৌড় তো দেখতেই পাচ্ছেন! গর্ব করতে চাইলে বরং প্রাইড ওয়াকে এসে যোগ দিন, Ally হয়ে। শহর জুড়ে, রাজ্য জুড়ে, দেশ জুড়ে মিছিল- প্রেমের অধিকার চেয়ে মিছিল। এর চেয়ে সুন্দর সমাগম আর কী বা হতে পারে?