জন্তুর মনে হয় চারবার একশ পর্যন্ত গোনা হয়ে যাবে? হ্যাঁ তা হবে ; তা না হলে ওর চারবার গণনা শেষ করতে না করতে তিন জনের ভাত রান্না হয়ে যায়? জন্তী সেদিন ভাইকে এক থেকে একশ পর্যন্ত গুণতে বলেছিল, সে ততদিনে কেমন শিখেছে তার পরীক্ষার জন্য। পলাশীর উনুনের পিঠে বসে ভাই-বোনে পড়ছিল। একশ পর্যন্ত চারবার গুণতে গুণতে পলাশীর
ভাত নেমে গিয়েছিল উনুন থেকে --- এতটাই সময় লেগে যায় পলাশীর বল্লির বিল থেকে বাড়িতে আসতে।
মাঝে একবার বিশ্রামও নিয়েছিল বস্তা নামিয়ে। প্রথম প্রথম নামানো লাগত না। কিন্তু এখন না নামিয়ে পারে না। মনের সঙ্গে শরীরও কেমন যেন হয়ে এসেছে তার ! বেশ কষ্ট হয় এখন । একটু বিশ্রাম নিয়ে বস্তার মুখ খুলে শামুকগুলো মাটিতে ঢেলে দেয় --- সঙ্গে সঙ্গে কাঁকড়াগুলো ছাড়া পেয়ে ছুটতে থাকে এদিক-ওদিক।
শামুক ধরার সঙ্গে কাঁকড়াও ধরে বস্তায় রাখে পলাশী। কিন্তু কি আশ্চর্য! শক্ত শক্ত শামুকের চাপে বস্তার মধ্যে দিব্যি বেঁচে থাকে তারা! জন্তু কাঁকড়ার ঝাল খুব ভালো খায়। জন্তীও। তাই বিলে গেলে পলাশী কাঁকড়া ধরবেই।খাবারের একটা পদও বাড়ে তাতে। আবার একদিন বাদে মাঠে যাবে সে। আজ ও কাল এই শামুক ও কাঁকড়া দিয়ে চালাতে হবে তাকে। শামুক ও কাঁকড়াগুলো নাদার মধ্যে রাখে ;সামান্য জল দেয়, সতেজ রাখার জন্য।
হঠাৎ 'প্যাঁকপ্যাঁক --- ক্যাঁকক্যাঁক' করে হাঁসগুলো পলাশীকে দেখতে পেয়ে ছুটে আসে। ছাড়িয়ে রাখা শামুকগুলো ঢাকা দেওয়া ঝুড়ি সরিয়ে ওদের খেতে দেয়। পলাশী পাশে বসে ওদের খাওয়া দেখে গর্ব ভরে, পরম তৃপ্তি ভরে। ওরাই তো পলাশীর একমাত্র সম্পদ।
হাঁসের খাওয়া শেষ হতে না হতে মোরগ-মুরগিগুলো সশব্দে ছুটে আসে।পলাশীর দিকে তাকিয়ে কক্ কক্ করতে থাকে। আর বসে থাকতে পারে না সে। 'দাঁড়া --- দাঁড়া দিচ্ছি ' বলে খড়ের চালের ওপর থেকে গামলাটা পেড়ে মাটিতে নামিয়ে দেয়। খুদভাত টপাটপ খেতে থাকে ওরা।
।। ২।।
এই হাঁস আর মোরগ-মুরগি নিয়েই পলাশীর সংসার। বেঁচে থাকার একমাত্র পথ। অনন্ত মমতা দিয়ে ওদের সেবা-যত্ন করে সে। সারাবছর এদের ডিম-ই তার সংসারকে টিঁকিয়ে রাখে। খাওয়া হলে এক পা-দু' পা করে ঘুরতে থাকে ওরা পলাশীর চারপাশে। আবার একটু বসে পলাশী। কষ্টটা কম হয়নি তার। হাঁসগুলোর সব প্রায় টিউবওয়েলের ডোবাতে নেমে যায়। মেটে রঙের হাঁসটা পাড়ে বসে থাকে। প্রচণ্ড খেয়েছে বোধহয় । তাই হয়তো জিরিয়ে নিচ্ছে একটু।পলাশী উঠে ধীরে ধীরে কাছে যায়। হাঁসটাকে ধরে হাত বুলাতে থাকে। তলপেটে হাত দেয় --- টিপে টিপে দেখে। ডিম এসেছে পেটে। দু-একদিনের মধ্যে পাড়বে মনে হচ্ছে।
'মেটে' আজ নড়ে না। হাতের মধ্যে নিশ্চুপ হয়ে থাকে। অথচ অন্যান্য দিন ধরলে একটু না একটু ছটফট করে। হাত বুলিয়ে ডোবাতে স্নান করিয়ে দেয় হাঁসটাকে। ধীরে ধীরে সাঁতার কাটে 'মেটে'। বাড়িতে যত রঙের হাঁস মুরগি আছে তত রকমের নাম রাখে জন্তু- জন্তুী --- ভাই-বোনে। 'মেটে' রঙের হলে 'মেটে ', কালো রঙের হলে 'কালু', সাদা হলে 'সাদু'।আবার একই রঙের দুটো থাকলে তারও নাম রাখে বেশ। একটা 'মেটে' অপরটা 'মেটে-মেটে';' সাদু-সাদু'।
সেবার দুটো নীল রঙের হাঁস হয়েছিল পলাশীদের। ভাই-বোনে নাম রেখেছিল 'নীলা' আর 'নীলু'। একটা পুরুষ আর অপরটা মাদী। মাদীটার ডিম পাড়ার সময় হয়েছিল এমন সময় ওদের পিছনের বাড়ির লোকেরা শত্রুতা করে ধানের সঙ্গে বিষ মাখিয়ে খেতে দিয়েছিল।বাড়িতে এসে মুখে গাঁজলা তুলে নিস্তেজ হয়ে মরে গিয়েছিল নীলা ও নীলু। দুই ভাই-বোন হাঁসদুটোকে নিয়ে সে কি কান্না! পলাশীও সেদিন অনেক কেঁদেছিল। কিন্তু কিছু বলতে পারেনি কাউকে। পাড়ার সবচেয়ে গরীব ওরা।কেউ ওদের পক্ষ নেয় না। বরং তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। তা না হলে ভাই -বোন দু'জনের এমন নাম দেয় ওরা? পাড়ার বেশির ভাগ লোকেই ওদের বিকৃত নামে ডাকে। জয়ন্তীকে বলে 'জন্তী',আর জয়ন্তকে বলে 'জন্তু'।
।। ৩।।
নির্মল থাকতে অবস্থা তাদের খারাপ ছিল না। এত অবহেলাও কেউ করত না। কিন্তু না থাক, আর মনে করবে না পলাশী। এসব কথা মনে এলে চোখে জল এসে যায়। কাজের মধ্যে থাকায় দিনের বেলা কম মনে আসে। কিন্তু রাতে যখন জন্তু -জন্তী ঘুমিয়ে পড়ে, পলাশীর ঘুম আসে না। বালিশ ভিজে যায় কোন কোন দিন।
মানুষ কি এমন হতে পারে! স্ত্রীকে রেখে, ছেলে মেয়েকে রেখে এভাবে পালাতে পারে! নির্মল তো তাকে দেখেই বিয়ে করেছিল? এমন তো নয়, যে, কেউ পলাশীকে তার গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে? দুজন সন্তানও হয়েছে, তবে? .....না আবার মনে পড়ে যাচ্ছে পলাশীর! এসব কখনও ভাববে না বলে প্রতিজ্ঞা করে। কিন্তু বার বার মনে পড়ে যায় তার! ডোবার পাশে জীবনগাছে হেলান দিয়ে বসে পলাশী। কপাল চেপে ধরে, যন্ত্রণাটা যদি কম হয় একটু!
কপাল থেকে হাত সরায়,মুখের ঘাম মোছে। মুখে হাত বুলিয়ে বোঝে মাংস কমে এসেছে মুখে, চোয়ালের হাড় উঁচু হয়ে উঠেছে। চিন্তা যে মানুষকে চিতায় তুলে ছাড়ে!
।। ৪ ।।
উঠে পড়ে পলাশী, না, আর ভাববে না সে। কপালে সুখ নেই, পরের ছেলের দোষ দিয়ে লাভ নেই। কিন্তু উঠতেই মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে; আবার বসে পড়ে। ভাবে ছেলে-মেয়ের জন্য নিজেকে বাঁচতে হবে।
বাঁচবে বলেই তো এমন বৃত্তি নিয়েছে। আগেই তার দুটো হাঁস ও একটা মুরগি ছিল। তারা প্রায়ই ডিম দিত। তা দেখে বুঝল এই ডিমের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা যায়। হাতের টাকা দিয়ে সে তাই দশটা হাঁসের ছানা এবং দশটা মুরগির ছানা কিনে আনে। সন্তান স্নেহে মানুষ করে তাদের।
মেটে আবার জল থেকে উঠে এল,বাদামীও। পাড়ে বসে কেমন যেন ঝিমাতে লাগল। কী হলো মেটে- বাদামীর? পলাশী উঠে পড়ল, এগিয়ে যেতে লাগল ওদের দিকে, যেতে যেতে হঠাৎ চোখ গেল লাউমাচাটার নীচে। দেখল হলুদ মোরগটা ঝিমাচ্ছে। নাক-চোখ থেকে যেন জল পড়ছে? তাই তো। মোরগটার কাছে এগিয়ে যায় সে। মাটির দিকে তাকিয়ে দেখে পায়খানার রংটা যেন কেমন! মোরগের গায়ে -মাথায় হাত বুলিয়ে হাঁসদুটোর কাছে এগিয়ে যায়।
।। ৫ ।।
পলাশী স্থির করে ঝিম রোগেই ধরেছে ওদের। মাথা নীচু হয়ে আসছে, নাক-চোখ থেকে জল ঝরছে।বুঝতে পারে না কেন এমন হলো?
" মা, ও মা শুনিছো,আমাগে মাস্টারমশাই কী কইছে? মুরগি, হাঁসের নাহি রোগ হচ্ছে। সরকারের থে' সব হাঁস- মুরগি মারে ফেলাচ্ছে!" জন্তু ও জন্তী দৌড়ে আসে স্কুল থেকে বগলে বই খাতা চেপে। জন্তীই মাকে খবর দেয়।
" বাটফুলো---- মা, বাটফুলো রো-ও-গ। " জন্তু মাকে শোনায় স্কুল থেকে শুনে আসা কথা।
" বাটফুলো?" পলাশী অবাক হয়। "বাটফুলো রোগ আবার মুরগির হয় নাকি? সে তো গরু-ছাগলের হয়?"
" বাটফুলো!" ব্যঙ্গস্বর জন্তীর," কোতি পারিস না আবার কোস কেন? বার্ড ফ্লু। "
"ইঃ! আমাগে ঘরে শম্ভুমাস্টার কলো বাটফুলো।" জন্তু স্বপক্ষে জোর দেয়।
"সে কী রোগ রে? " উৎসুক হয় পলাশী।
" হাঁস - মুরগি ঝিমেয়,চোখ-মুখ দিয়ে জল পড়ে। তারপরে মরে যায়।"
"এরে বাটফুলো কয়? বিস্ফারিত চোখ পলাশীর। " তা সরকার মারে ফ্যালবে কেন? সরকারের কী? "
"এই রোগ যদি মানষির মধ্যি ছড়ায়ে যায় তো মানুষও মরে যায়। কত কত জা'গায় সরকারের মানুষ হাঁস -মুরগি মারে ফেলাচ্ছে।আমাগে গিরামে নাহি কালকে আসপে। সব হাঁস-মুরগি মারে ফ্যালাবে,যত আছে। "
"সব মারবে! " পলাশীর বিশ্বাস হয় না যেন " তা আমাগে হাঁস-মুরগির তো কিছু হই নেই, তাও মারে ফ্যালাবে নাহি? "
" মা,পোথোম পোথোম হলি বুঝা যায় না। তাও নাহি হয়। রোগ ধত্তি এট্টু সময় লাগে তো ? একবার ধল্লি নাহি আর রক্ষে নেই! সেই জন্যি সব মারে ফ্যালাচ্ছে "। স্কুল থেকে শুনে আসা কথা বিজ্ঞের মত বলে জন্তী।
"যদি আমরা সারে রাহি ?"
"তা নাহি রাহা যাবে না। সরিফা কচ্ছিল ওগে কাছে নাহি কি যন্তর আছে, তাতে নাহি পিক পিক করে বাজে। সারে রাখলিও ধরা পড়ে যায়।"
তাহলে উপায়? পলাশীর মাথা ঘুরতে থাকে। সব হাঁস-মুরগি যদি ওরা মেরে ফেলে তাহলে বাঁচবে কী করে? এই পাখিগুলোই একমাত্র সম্বল। প্রতিদিন হাঁসে আট-ন'টা আর মুরগিতে ছয়-সাতটা ডিম দেয়। তা বিক্রি করে সংসার চলে যায়। কিন্তু সেগুলো যদি --- আর ভাবতে পারে না পলাশী,মাথা ঘোরে! বাঁচার
কোনও পথ দেখতে পায় না সে। বসে পড়ে মাটিতে।
।। ৬ ।।
ছটফট করতে থাকে পলাশী সারারাত--- দুশ্চিন্তায় ঘুম আসে না। বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন যদি মারা পড়ে, তবে বাঁচবে কী করে তারা! ছেলে-মেয়েকে ঠেলে ডেকে তোলে। রাত এখনও অনেক বাকি, তারা উঠতে চায় না। তবু চেষ্টা করে পলাশী। জন্তী আগে ওঠে, জন্তুর তখনও আলসেমি কাটেনি, কথা- চোখ জড়িয়ে আসে। তবু পরামর্শ করে তিন জন। কী করে বাঁচানো ও বাঁচা যায়।
ঠিক হয় ঘরের মধ্যে চৌকির নিচে ভালো হাঁস-মুরগিগুলো ঝুড়ি চাপা দিয়ে রাখবে, আর যে হাঁসদুটো ও মুরগিটার অসুখ হয়েছে তাদের ছেড়ে রাখবে। ও সব যন্ত্র-টন্ত্র মিথ্যে কথা; যন্ত্রে যদি লুকানো হাঁস-মুরগি ধরা যেত,তাহলে এত চোর- ডাকাত লুকিয়ে থাকে, তারা কি ধরা পড়ত না?
।। ৭ ।।
সারা গায়ে কেমন প্লাসটিকের পোশাক পরা, মুখে মুখোশ --- ঠিক যেন হনুমান মনে হলো পলাশীর। স্কুলমাঠে গাড়ি থেকে নামল ছয়জন।হেডমাস্টারমশাই আর দু'জন পুলিশকে নিয়ে সকলে পলাশীদের পাড়ার দিকে চলল। ওদের আগে -পিছে অনেক মানুষ জড়ো হলো। ফিসফাস, গুঞ্জনও বাড়তে লাগল। ফিসফাস ক্রমে ধ্বনিতে পরিণত হচ্ছে দেখে একটা গাছের নিচে মূর্তিগুলো দাঁড়িয়ে পড়ল। একটু যেন দম নিয়ে একজন মুখটা ফাঁক করে বলল-"আমাদের দেখে অনেকের রাগ হচ্ছে বুঝতে পারছি। কিন্তু রাগ আমাদের করা উচিত রোগটার উপরে। রোগটা হেলাফেলা নয়। মারাত্মক! তাই সরকার এমন উদ্যোগ নিয়েছে। আমাদের কথা শুনুন, হাঁস -মুরগি নিধন করে নিজেরা বাঁচুন। এর উপরে নির্ভর করে অনেকের সংসার চলে জানি, কিন্তু কিছু করার নেই! নির্ভরের একটা না একটা বিকল্প পাবেন। ক্ষতি পূরণের টাকা দিয়ে অন্য কিছু করুন। তাছাড়া আট-দশ মাস বাদে আবার হাঁস-মুরগির বাচ্চা সরকার আপনাদের দেবে। তাই এমন ভয়াবহ রোগকে আশ্রয় দেবেন না। হাঁস -মুরগির থেকে এটা খুব সহজে মানুষের মধ্যে ছড়ায়। এটা এমনই এক জীবাণু, যা একটা সর্ষে দানার চেয়ে কয়েক লক্ষ ভাগ ছোট--- তবু কি ভীষণ এর ক্ষমতা!
বাচ্চা ও বয়স্কদের এ রোগ খুব তাড়াতাড়ি ধরে। তাই কেউ নিশ্চয় চাইবেন না,বাড়িতে কারো..."
জনতার মাঝে আবার ফিসফাস কথা শোনা যায়। তা দেখে মূর্তিটা বলে ওঠে -" কারও যদি পায়ের একটা আঙুলে ঘা হয়ে এমন অবস্থা দাঁড়ায় যে, আঙুলটাকে কেটে বাদ দিতে হবে, তবে কি সে আঙুলটা কেটে তখনই বাদ দেবে না পুরো পা-টা পচা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে? "
পলাশীর পাশেই জন্তু -জন্তী দাঁড়িয়ে শুনছিল।হঠাৎ পলাশী তাদের আঁকড়ে ধরে।
।। ৮।।
একটা বড়ো পুকুরের পাশে পতিত জমিতে গর্ত কেটে তার মধ্যে মৃত হাঁস মুরগি ফেলা হচ্ছে। সকলে তাদের হাঁস, মুরগি এনে দিচ্ছে আর হনুমানগুলো পটাপট তাদের গলা মুচড়ে ছিঁড়ে গর্তে ফেলছে।
জন্তী ওদের সেই হাঁস দুটো ও মোরগটা আগে দিয়ে গেছে। এবার দু'ভাই বোন এসে চারটে মোরগ-মুরগি দিয়ে গেল। শেষে এল পলাশী ছেলে মেয়ের সাথে ঝুড়ি কাঁখে নিয়ে হাঁস এবং মুরগি চাপিয়ে।
এক একটা করে হাঁস পলাশীর ঝুড়ি থেকে নিয়ে ওরা গলা মুচড়ে ছিঁড়ে ধপ করে ফেলল গর্তের মধ্যে। পলাশী একটা দেখেই চোখ বুজে ফেলল। জন্তু -জন্তীও মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে রইল। ঝুড়ি খালি হলে ধীরে ধীরে পলাশী বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগল। ওদিকে টেবিল পেতে একজন হিসাব রাখছিলেন কার কটা পাখি মারা পড়ে। পলাশীকে চলে যেতে দেখে ডাক দিলেন। লোকটা গুণে গুণে টাকা দিলেন, আঙুলের ছাপ নিলেন। কোন দিকে না তাকিয়ে পলাশী আবার হাঁটতে শুরু করল। লোকটা কেমন ভাবে তাকিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলে মাথা নাড়লেন। জন্তু -জন্তী মায়ের হাতে টাকা দেখে -" মা কত টাকা! " বলে দু'জনে দুখানা নোট নিয়ে আগে আগে এগিয়ে গেল।
।। ৯ ।।
এই পুকুরে গ্রীষ্মকালে পলাশী কত গুগলি ধরেছে তার হাঁসগুলোর জন্য, বিলের জল শুকিয়ে গেলে। হাঁসগুলোও চরতে চরতে এ পুকুরে এসে কত সাঁতার কেটেছে, খেলা করেছে, গুগলি ধরে খেয়েছে। আর আজ এই পুকুরের পাড়েই তারা সব----। গলাটা বুজে আসে, মনটা হু হু করে ওঠে। পাড় ধরে এগিয়ে যায়। ঘাটের কাছে এসে আর স্থির থাকতে পারে না, ডুকরে কেঁদে ওঠে। একটু পরে নিজেকে সামলায়। টাকাগুলো পাড়ে রেখে ঘাটে নামে চোখে- মুখে জল দিতে। জল দেয়। আঁচল দিয়ে চোখ বন্ধ করে মুখ মোছে, চোখ খুলে দেখে সামনে জলের ওপর তিন -চারটে নোট ভাসছে। নোট না হাঁস হঠাৎ বুঝতে পারে না ? পিছনে ফিরে দেখে যেখানে টাকাগুলো রেখেছিল সেখানে আর গোটা চারেক আছে। আবার পুকুরের দিকে তাকিয়ে দেখে নোটগুলো সাঁতার কাটছে ---- যেন মেটে, সাদু, বাদামি, মেটেমেটেরা। একটুখানি তাকিয়ে থাকে পলাশী, তারপর হাতের গুলোও ছেড়ে দেয় জলের ওপর। এগুলোও আগের গুলোর মতো সাঁতার কাটে --- ওদের খেলাচ্ছলে ধাওয়া করে। এক পুকুর হাঁস কিলবিল করে পুকুর জুড়ে। পলাশী মুগ্ধ ভাবে দেখতেই থাকে।