খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। কোরাসোন দে মারিয়া গ্রামে বাস করত এক বাবা আর ছেলে, দুজনকেই লোকে চিনত এরেমিতে বলে, কেননা দুজনেরই নাম ছিল এউরেমিয়ো। একজন এউরেমিয়ো সেদিয়ো, আর অন্যজন এউরেমিয়ো সেদিয়ো। তাই বলে দুজনের মধ্যে তফাত করতে যে বেগ পেতে হত, এমনটা একেবারেই নয়, কেননা একজন অন্যজনের চেয়ে পঁচিশ বছরের বড়।
ঈশ্বরের কৃপায় বড় এউরেমিয়ো ছিল লম্বা আর শক্তিশালী। কিন্তু ছোট এউরেমিইয়ো ছিল তার সম্পূর্ণ বিপরীত, শুধু চেহারাতেই নয়, বোধবুদ্ধিতেও। অত্যন্ত শীর্ণকায় তার চেহারা। সকলের ঘৃণা সহ্য করে একটা পাথরের মতো যেন সে বেঁচে ছিল, অবশ্য যদি তাকে বেঁচে থাকা বলা যায়। তার জন্ম নেওয়াটাই ছিল তার সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য, একথা বললেও ভুল হবে না।
তাকে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করত তার বাবা, যে সম্পর্কে আমার কোম্পাদ্রে১। কেননা এই ছেলেকে আমিই খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষা দিয়েছি। সে যাই হোক, বাবা যে আচরণটা ছেলের সঙ্গে করত তা যেন তার বড়সড় চেহারার সঙ্গে মানিয়ে যেত। এতটাই দশাসই ছিল যে তার পাশে দাঁড়াতে বা তার ক্ষমতাকে বোঝার জন্য এক নজড় তার দিকে তাকাতেও সাহসের প্রয়োজন হত। ওকে দেখলে যে কেউই হীনমন্যতায় ভুগবে, ওর পাশে নিজেকে নেহাতই নগন্য মনে হবে। কোরাসোন দে মারিয়ায়, যেখানে সবাই বড় হয় প্রস্থে, সেখানে সেই ছিল একমাত্র মানুষ যে দৈর্ঘ্যে বড় হয়েছিল। এমনকি লোকে একথাও বলত যে চাপাররো২ গাছের উতপত্তি নাকি ওখানে। ওখানকার লোকেদের নামও ছিল তাই চাপাররো আর তাদের স্বভাবটাও ছিল একইরকম খর্বকায়। আপনারা কেউ যদি ওই অঞ্চলের বাসিন্দা হন তাহলে আশা করি কিছু মনে করবেন না, কেননা আমি আমার মত পরিবর্তনে অপারগ।
যাই হোক, আগের কথায় ফিরে আসি। সেই যে গ্রামে বহু বছর আগে কোরাসোন দে মারিয়ায় থাকা যে লোকগুলোর কথা আপনাদের বলছিলাম।
বড় এউরেমিয়োর একটা বড় ক্ষেত ছিল, নাম ‘লাস আনিমাস’। বিভিন্ন কারণে, বিশেষত ভালোভাবে দেখাশোনা না করার জন্য, ক্ষেতের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে পড়ে। নিজের ছেলেকেও সে ওই ক্ষেত উত্তরাধীকারী সূত্রে দিয়ে যেতে চায়নি। কেননা নিজেই সবটা গ্রাস করে ফেলে। একটু একটু করে পুরো সম্পত্তিটাই বিক্রি করে দিচ্ছিল, যাতে ছেলেটা বড় হলে তার খাবার সংস্থানটুকুও না থাকে এবং শেষ পর্যন্ত তার উদ্দেশ্য সফল হয়। ছেলেটা কোনমতে মাটির উপর মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, যদিও চেহারাটা একেবারে ডিগডিগে। শুধুমাত্র কয়েকজন দয়ালু মানুষের সাহায্যে তার রোগা শরীরটা কোনওমতে বেড়ে উঠছিল। তার নিজের বাবা কখনও তাকে যত্ন করেনি, বরং ছেলেকে দেখলেই যেন তার রক্ত মাথায় চড়ে যেত।
তবে এসব ব্যাপার বোঝার জন্য অনেকটা সময় পিছিয়ে যেতে হবে। বহু বছর আগে, এই ছেলের জন্মের আগে বা সম্ভবত তারও পেছনে যেতে হবে, ছেলের মায়ের সঙ্গে বাবা এউরেমিয়োর দেখা হওয়ারও আগে।
মায়ের নাম ছিল মাতিলদে আর্কানহেল। সে কোরাসোন দে মারিয়ায় থাকত না, তার থেকে বেশ খানিকটা উপরে চুপাদেরোস বলে একটা জায়গায় থাকত। এই এউরেমিয়ো সেদিয়ো কোনওদিন সেখানে যায়নি। তার সঙ্গে মাতিলদের পরিচয় হয় অন্য একজনের সূত্রে। সেই সময়ে সে ছিল আমার বাগদত্তা। কিন্তু ভবিষ্যতে কি ঘটবে সে ব্যাপারে কি কেউ নিশ্চিত হতে পারে! প্রেমিকাকে নিয়ে একটু বড়াই করার জন্য আর বিয়ের সময়ে বরকর্তা হওয়ার কথা বলার জন্য যখন এউরেমিয়োর সঙ্গে আমি মাতিলদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম তখন ভুলেও ভাবিনি যে অতি শীঘ্রই আমার প্রতি তার আবেগ শীতল হতে শুরু করবে এবং অন্য কেউ তার হৃদয়কে অধীকার করে নেবে। পরে তা বুঝতে পেরেছিলাম।
যাই হোক, সবার আগে আপনাদের বলতে হবে মাতিলদে আর্কানহেল কে এবং সে কেমন। সে কথা আপনাদের একে একে বলব। ধীরে ধীরে। আর শেষ পর্যন্ত তো গোটা জীবনটাই আমাদের সামনে পড়ে আছে।
চুপাদেরোসের এক সরাইখানার মালকিন দোন্যিয়া সিনেসিয়ার মেয়ে ছিল মাতিলদে। সেই জায়গাটা এত দূরে যে পৌঁছতে পৌঁছতে আমাদের দিনের কাজ শেষ হয়ে যেত, সন্ধ্যা নামত। তাই ওই পথে যাওয়া সব খচ্চর চালকেরাই সে মেয়েকে চিনত। তাকে দেখে তাদের চোখের তৃপ্তি হত। সেই সময়ে, ওখান থেকে তার চলে যাওয়ার আগে, কিশোরী মাতিলদে ছিল আমাদের সবার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।
কিন্তু হঠাত একদিন, আমাদের কিছু বুঝে ওঠার আগেই, কিভাবে যেন সে কিশোরী থেকে তরুণী হয়ে গেল। তার দৃষ্টি এমন ঢুলুঢুলু হয়ে উঠল যে তা কারও অন্তরে বিঁধে গেলে আর উপরানো যেত না। তারপর তার ঠোঁটদুটো হয়ে উঠল রক্তিম, যেন মনে হত যেন চুম্বনে চুম্বনে তারা রক্তাক্ত। বলার আর অপেক্ষা ছিল না যে সে সত্যিই সুন্দরী হয়ে উঠেছিল।
আমি জানতাম যে আমি তার যোগ্য ছিলাম না। আপনারা তো জানেন আমি খচ্চর চালক। এই পেশা নিয়েছি ভালোবেসে, দীর্ঘ পথ পারি দেওয়ার সময় নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলার জন্য।
কিন্তু এ জীবনে যত পথ হেঁটেছি তার মধ্যে সবথেকে দীর্ঘ ছিল তার কাছে যাওয়ার পথ। একসময় আমি ভাবতাম যে তাকে ভালোবাসা বোধহয় আমার কোনওদিন শেষ হবে না।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত এউরেমিয়ো তাকে অর্জন করল।
একবার খচ্চর নিয়ে কাজ শেষ করে ফেরার পর জানতে পারলাম যে মাতিলদে লাস আনিমাস ক্ষেতের মালিককে বিয়ে করেছে। ভাবলাম লোভের বশবর্তী হয়ে সে এটা করেছে, কিংবা হতে পারে এউরেমিয়োর বড় চেহারার জন্য। আসলে যুক্তি খুঁজে পেতে আমার কোনও দিনই অসুবিধা হতনা। শুধু পেটের মধ্যে চারিয়ে গিয়েছিল এক যন্ত্রণা, শোকের প্রবল যন্ত্রণা। সে বোধহয় ভুলেই গিয়েছিল এই সব হতভাগাদের, যারা তাকে দেখতাম আর তার চোখের উষ্ণতায় খুঁজে পেতাম পরম আশ্রয়। সেই হতভাগাদের মধ্যে সবার আগে ছিলাম আমি, এই ত্রাঙ্কিলিনো এররেরা, আপনাদের সেবক, যার সঙ্গে সে ভাগ করে নিয়েছিল আলিঙ্গন, চুম্বন এবং আরও অনেক কিছু। আসল কথাটা হচ্ছে যে পেটে খিদে থাকলে সব পশুই খামার ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে আর বাস্তবিক, মাতিলদে যে পুরো পেট ভরে খেতে পেত, এমনটা নয়। তার একটা কারণ হল মাঝে মাঝে আমরা এতজন থাকতাম যে খাবারে কুলোতে না, আর একটা কারণ এই যে আমাদের সবাইকে খাবার দেওয়ার জন্য সে নিজে উপোস করে থাকত।
কিছুদিন পরে সে গর্ভবতী হল। তার একটা ছেলে হল। তারপর মরে গেল। একটা পাগলা ঘোড়া তাকে মেরে ফেলেছিল।
সেই ছেলেকে খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষা দিয়ে আমরা ফিরে আসছি। মাতিলদের কোলে ছিল বাচ্চাটা। আমি ওদের আগে আগে হাঁটছিলাম। তাই আপনাদের বলতে পারছি না ঠিক কি কারণে এবং কিভাবে ঘোড়াটা ক্ষেপে গিয়েছিল। আমার শুধু এইটুকু মনে আছে যে ঘোড়াটা খুবই বিরক্তিকর ছিল। একটা ধূসর মেঘের মতো আমাদের পাশ দিয়ে যখন ছুটে গেল, ঘোড়া নয়, শুধু একটা দমকা বাতাস যেন দেখতে পেয়েছিলাম; একা, সর্বাঙ্গে কাদা মাখা। সেখান থেকে একটু দূরে পড়ে গিয়েছিল মাতিলদে, রাস্তার জমে থাকা জলের মধ্যে মুখ থুবড়ে। সেই মুখ, আমাদের কত আকাঙ্খিত মুখ, এখন প্রায় ডুবে গেছে আর ধরফর করতে থাকা শরীরের ভেতর থেকে ফোয়ারার মতো রক্ত বেরিয়ে এসে ধুয়ে দিচ্ছে তাকে।
কিন্তু তখন আর সে আমাদের কেউ নয়। সে এউরেমিয়োর, একমাত্র পুরুষ যে তার সর্বস্ব গ্রহন করেছিল। কি সুন্দরই না দেখতে ছিল মাতিলদে! সেই রক্তমাংসের শরীর পেরিয়ে অন্তরে গহনে প্রবেশ করে এউরেমিয়ো তাকে সন্তানের স্বাদ দিয়েছিল। তাই, সেই সময়ে, মাতিলদের স্মৃতির ক্ষীণ ছায়া বা বড় জোর তার একটা আভাস ছাড়া আমার কাছে আর কিছুই ছিল না।
তা সত্ত্বেও ওকে আমি দেখতাম। ওর কাছে কাছে থাকার জন্য ছেলেকে দীক্ষা দিতেও আমি রাজি হয়ে যাই। যদিও জানতাম যে তার কাছে ছেলের ধর্মবাবার চেয়ে বেশি কোনও মূল্য আমার নেই। তাই এখনও অনুভব করি সেই দমকা বাতাসটা, যা তার জীবনপ্রদীপ নিভিয়ে দিয়েছিল; যেন বা সেই বাতাসটা এখনও বইছে, আমার প্রতিকূলে বয়ে চলেছে।
তার জলে ভেজা চোখদুটো আমিই বুজিয়ে দিয়েছিলাম। আতঙ্কে বেঁকে যাওয়া মুখ সোজা করে দিয়েছিলাম আমি। সে আতঙ্ক তাকে পেয়ে বসেছিল ঘোড়ায় চড়ার সময় থেকে এবং ক্রমশ তা বাড়তে বাড়তে শেষে পড়ে যাওয়া অবধি তাকে ঘিরে রেখেছিল। আগেই আপনাদের বলেছি যে ছেলেটা ছিল ওর কোলে। দূর্ঘটনার ফলে শরীর থেকে সমস্ত রস বেরিয়ে যাওয়ায় দেহ তখন শক্ত হতে শুরু করেছিল। শুধু চোখদুটো ছিল উন্মুক্ত, তার দৃষ্টি নিবদ্ধ ছেলের দিকে। সারাটা মুখ জলে ভেজা। চোখের জলে নয়, যে নোংড়া জমা জলে সে মুখ থুবড়ে পড়েছিল তার জলে। অথচ সেই মুখে যেন কত প্রশান্তি ছড়িয়ে রয়েছে। ছেলেটার কিছু হয়নি যে, তাই। সেই আনন্দে উদ্ভাসিত তার চোখ। সেই চোখ, আপনাদের আগেই বলেছি, যা আমি বন্ধ করে দিয়েছিলাম, তা তখনও কত আদরের, ঠিক আগের মতোই একান্ত আদরের।
ওকে আমরা কবর দিলাম। সেই ঠোঁট, যার নাগাল পাওয়া ছিল সাধ্যাতীত, তা এখন ঢেকে যাচ্ছে মাটিতে। কবরের গর্তের মধ্যে কিভাবে তার শরীর ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল, তাই দেখছিলাম আমরা। একটা সময়ের পর আর তাকে দেখা গেল না। এউরেমিয়ো সেদিয়ো সেখানে ঠায় দাঁড়িয়েছিল। আর আমি ভাবছিলামঃ “ওকে যদি চুপাদেরোসে শান্তিতে থাকতে দিত তাহলে হয়তো এখনও বেঁচে থাকত।”
“এখনও বেঁচে থাকত”, এউরেমিয়ো বলতে শুরু করল, “যদি না ছেলেটা ওটা করত। যে ঘোড়ায় চেপে আসছিল সেটা খুব ভীতু ছিল, তবুও ছেলেটা প্যাঁচার মতো বিকট আওয়াজ করে ফেলল।” যদিও স্ত্রীকে সে আগে থেকেই বার বার সাবধান করে দিয়েছিল যে ছেলে যেন না চেঁচায়। সে আরও বলছিল, “এমনকি পড়ে গেলেও ও নিজেকে সামলে নিতে পারত; কিন্তু তা করল না, উলটে পড়বার সময় ধনুকের মতো বেঁকে গেল যাতে ছেলেটা কোল থেকে মাটিতে না ছিটকে পড়ে। এই সব কিছু ভাবলে দেখা যাবে দোষ ওই ছেলের। এমন চিতকার করেছিল যে মানুষেই ভয় পেয়ে যেত তো ঘোড়া। আমি কেন ওকে ভালোবাসতে যাব। ও আমার কোন কাজে লাগবে। বরং মাতিলদে বেঁচে থাকলে সে আমায় আরও অনেক ছেলে দিতে পারত। শুধু এই ছেলের জন্য সে সবের কিছুই আমার হল না।” এইভাবে এ কথা সে কথা বলে প্রচন্ড রেগে উঠত এউরেমিয়ো। তখন বোঝা শক্ত ছিল যে মাতিলদের মৃত্যুতে সে দুঃখ পেয়েছে নাকি ক্রুদ্ধ হয়েছে।
তবে একটা জিনিষ বুঝে নিতে কারুর কোনও অসুবিধা ছিল না। তা হল ছেলের প্রতি তার প্রবল ঘৃণা।
আর এই কথাটাই আমি আপনাদের শুরু থেকে বলে আসছি। যাই হোক, এউরেমিয়ো তারপর মদে ডুবে গেল। মদের বোতল কেনার জন্য একটু একটু করে তার সমস্ত জমি-জমা বিক্রি করতে শুরু করল। এরপর ব্যারেল ব্যারেল মদ কিনতে লাগল। একবার আমি তার এই ব্যারেল বয়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম, তার জন্য খচ্চরের পুরো লাইন লাগাতে হয়েছিল। এউরেমিয়ো নিজের সমস্ত শক্তি ব্যয় করত দুটো কাজেঃ মদ খেতে আর ছেলেকে পেটাতে। যতক্ষণ না হাত ব্যথা হত ততক্ষণ পর্যন্ত সে ছেলেকে মারত।
তারপর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। এই সব কিছু সত্বেও ছেলে এউরেমিয়ো বড় হয়ে উঠল। কয়েকজন দয়ালু মানুষের সাহায্য অবশ্যই ছিল, তবে এর সঙ্গে ছিল তার এক অন্তর্গত শক্তি, যা নিয়েই সে জন্মেছিল। তার প্রতিটা দিন শুরু হত বাবার গঞ্জনা সহ্য করে। বাবার কাছে সে ছিল শুধুই একজন কাপুরুষ হত্যাকারি। নিজে হাতে ছেলেটাকে মেরে না ফেললেও, না খেতে দিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিল, এটা ঠিক।
তবুও ছেলেটা বেঁচে রইল। বিপরীতে সময়ের সঙ্গে বাবা এউরেমিয়োর শরীর ভেঙে পড়তে লাগল। মানুষ যত রকমের বোঝা বইতে পারে তার মধ্যে সময়ের বোঝা যে সবচেয়ে ভারি, একথা তো আমি, আপনি, আমরা সবাই জানি। তাই তার ক্রোধ যত গভীরই হোক না কেন, সময়ের সঙ্গে ঘৃণা কমে এসেছিল, কিন্তু দুজনেই ছিল একেবারে একা।
ওদের ব্যাপার নিয়ে আমার বিশেষ মাথাব্যথা ছিল না। এত সব কথা জানি, কারণ লোকে আমাকে বলত। তারাই বলেছিল যে বাবা যখন মাতাল হয়ে ঘুমায়, ছেলে বাঁশি বাজায়। তারা কেউ কারূর সঙ্গে কথা বলত না, মুখদর্শণ পর্যন্ত করত না। কিন্তু রাত নামলেই কোরাসোন দে মারিয়ার মানুষ বাঁশির সুর শুনত, এমনকি কখনও কখনও মাঝরাত পেরিয়ে গেলেও সেই সুর শোনা যেত।
যাই হোক, গল্পটা আর বাড়ানোর দরকার নেই। এক দিন, খুব শান্ত একটা দিনে, এসব জায়গার দিনগুলো যেমন নিরবচ্ছিন্ন শান্তিতে কাটে, তেমনই একটা দিনে, কোরাসোন দে মারিয়ায় এসে হাজির হল কয়েকজন বিদ্রোহরত মানুষ। প্রায় কোনও আওয়াজই হয়নি, কেননা রাস্তা ছিল ঘাসে ভরা। তাই বিভিন্ন জন্তু-জানোয়ারের পিঠে চেপে আসলেও তাদের পদশব্দ শোনা যায়নি। লোকজন বলাবলি করছিল যে এলাকাটা এতই শান্ত ছিল এবং তারা এতটাই নিঃশব্দে এসেছিল যে পাখির ডাক আর ঝিঁঝিঁপোকার কলতান পর্যন্ত শোনা যাচ্ছিল। তারা যখন এরেমিতেদের বাড়ির সামনে দিয়ে গেল তখন সেই শব্দের সঙ্গে যুক্ত হল একটা বাঁশির মিষ্টি সুর এবং তা এগিয়ে যেতে লাগল, দূরে, আরও দূরে, তারপর মিলিয়ে গেল।
কেউ জানে না তারা কোন ধরনের বিদ্রোহী আর কি-ই বা তারা করে চলেছে। তবে লোকের মুখ থেকে শুনেছিলাম যে কয়েকদিন পরে সেখান দিয়ে পুলিশের একটা দল চলে গিয়েছিল, একইভাবে, কোথাও না থেমে। তখন বাবা এউরেমিয়ো, ততদিনে সে বুড়ো হয়ে গেছে, পুলিশদের সঙ্গে যেতে চাইল। সে নাকি তাদের বলেছিল যে, যেসব বিদ্রোহীদের তারা ধরতে যাচ্ছে, তাদের একজনের সঙ্গে তার পুরোন কোনও বোঝাপড়া আছে, তাই সে যেতে চায়। পুলিশও রাজি হয়ে যায়। সে তখন বাড়ি থেকে বের হল একটা ঘোড়ায় চড়ে, হাতে একটা রাইফেল, পুলিশের সঙ্গে তাল মেলাতে টগবগ টগবগ করে ছুটে চলল। সে ছিল বেশ লম্বা, একথা তো আগেই বলেছি, আর মাথায় টুপি না পরায় পতপত করে চুল উড়ছে বাতাসে। তাকে তখন মানুষ নয়, মনে হচ্ছিল একটা লম্বা নিশান।
পরের কয়েকদিন কেউ আর কিছু শুনতে পেল না। সবকিছু শান্ত, স্থির। সেই সময় এলাম আমি। যে নিচে থেকে আমি এলাম সেখানেও কেউ কিছু জানেনা। আর যে সব চাষি-ভুষি মানুষ পাহাড়ের ঢালে ভাগে চাষ করে তাদের কথা তো আপনারা জানেন। তারা তখনি নিচে নেমে এই সব গ্রামে-গঞ্জে আসে যখন তাদের কিছু দরকার পরে বা সমস্যা হয়। এখন তারা ভয়ে নেমে এসেছে। তারা বলছিল যে বেশ কয়েকদিন ধরেই পাহাড়ের উপর গন্ডগোল চলছে আর ওই সব দলের অনেকেই প্রায় এসে পড়েছে এখানে।
বিকেল কেটে গেল, কিন্তু কাউকে দেখা গেল না। তারপর রাত নামল। আমরা কয়েকজন ভাবছিলাম যে তারা বোধহয় অন্য পথ ধরেছে। ঘরের মধ্যে দরজা বন্ধ করে অপেক্ষা করছি। গীর্জার ঘড়িতে ন’টা বাজল, তারপর দশটা। সেই সময় ঘন্টার ধ্বনির সঙ্গে শোনা গেল শিঙার আওয়াজ। তারপর ঘোড়ার খুড়ের শব্দ। আমি এগিয়ে গেলাম দেখতে কারা আসছে। দেখলাম, জরাজীর্ণ ঘোড়ার উপরে চড়ে মলিন পোশাক পরা একদল মানুষ; তাদের কারও গা দিয়ে রক্ত ঝরছে, আর অন্যরা অবশ্যই ঘুমোচ্ছে, কেননা তাদের মাথা ঝুঁকে পড়েছে। তারাও কেউ থামল না, সমানে এগিয়ে চলল।
তারপর যখন মনে হচ্ছিল যে অন্ধকারের মধ্যে মিশে থাকা ছায়াদের এই দীর্ঘ প্যারেড প্রায় শেষ হয়ে গেছে, তখন হঠাত ভেসে এল, প্রথমে আস্তে, পরে বেশ জোরে, একটা বাঁশির সুর। আর একটু পরেই দেখলাম, আমার ধর্মছেলে এউরেমিয়ো আসছে বাবা এউরেমিয়োর ঘোড়ায় চড়ে। সে ঘোড়ার পিঠে পেছনের দিকে বসে বাঁ হাতে বাঁশিটা ধরে প্রাণপনে বাজাচ্ছে আর ডান হাতে ধরে রেখেছে সামনের আসনে রাখা বাবার মৃতদেহ।
গল্পের মূল নামঃ “La herencia de Matilde Arcángel” (লা এরেনসিয়া দে মাতিলদে আর্কানহেল)
টীকাঃ
১। কোম্পাদ্রেঃ যে একটি শিশুকে খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষা দেয় তার আর শিশুটির জন্মদাতা পিতার মধ্যেকার সম্পর্ক।
২। চাপাররোঃ এক ধরণের বেঁটে গাছ।