আষাঢ়ের অঝোর ধারা জলমগ্ন করেছে তিলোত্তমা কলকাতার বুক। আলিপুর হাওয়া অফিস ভারি ভারি বর্ষার সতর্ক বার্তা আগেই দিয়েছিল। বর্ষা আসতে না আসতেই দু’বার জলে ভাসল তিলোত্তমা। একটু বৃষ্টিতেই জল থৈ থৈ কলকাতা। ২০২০ সালের এক নিম্ন চাপের বৃষ্টিতে বই পাড়া কলেজ স্ট্রিটে এক কোমর জলে বই ভেসে গিয়েছিল। ভেজা বই বিক্রি হয়েছিল কেজি দরে। বর্ষার শুরুতেই বঙ্গে দরাজ বর্ষা। কাজেই মহানগরের নাবাল এলাকাগুলো জলমগ্ন। কলকাতার বর্ষার চেনা ছবিটা যত দিন যাচ্ছে তত পাল্টে যাচ্ছে। বৃষ্টির তিন দিন পরেও জল নামছে না তিলোত্তমার বুক থেকে। বেহালা, পার্ক সার্কাস, কলেজ স্ট্রিট মেঘ থেকে ঝরা জলে ভর্তি। আর এই সব কিছু মিলিয়ে এক বড় প্রশ্ন চিহ্নের সামনে দাঁড়াচ্ছে কলকাতার নিকাশি ব্যবস্থা।
আর তার পরেই কলকাতা পুরোসভা তড়িঘড়ি একটি কাজও শুরু করে দিয়েছে। পুরসভার তরফেই এমন কথাই জানানো হয়েছে সংবাদ মাধ্যমকে। কাজের মধ্যে রয়েছে পুরসভার রয়েছে নিকাশি ব্যবস্থার ডিজিটাল মানচিত্র তৈরি। যার মাধ্যম দিয়ে নিকাশি ব্যবস্থার পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তৈরি করতে চাইছেন তাঁরা। কর্তৃপক্ষ বুঝতে চাইছেন শহরের নিকাশি নালার কোথায় কী অবস্থা, কোথায় সমস্যা, সেই সমস্যার উৎস কী, এমন কিছু প্রশ্নের ঠিকঠাক উত্তর।
কলকাতার নিকাশি সমস্যা আজকের নয়। চৌত্রিশ বছরের বাম শাসনের পরেও মা-মাটি-মানুষের সরকারের দশ বছর হয়ে গেল। নতুন সরকারের আমলেও কলকাতা জল জমার ঘটনা একাধিকবার ঘটেছে। তার পরেও এতো দিন কেন নির্বিকার ছিল প্রশাসন? সে প্রশ্নের উত্তর প্রশাসনের তরফ থেকে দেবার লোক না থাকলেও, কলকাতার কিছু পরিবেশপ্রেমী সংগঠন সরাসরি আঙুল তুলছে বেনিয়মের দিকে। তাঁরা বলছেন, পুরসভার তরফ থেকে বিভিন্ন সময়ে টেন্ডার হয় বেহাল নিকাশি ব্যবস্থা ঠিকঠাক করার জন্য। কন্ট্রাক্টর নির্দিষ্ট সময় পর পাওনা গন্ডা পেয়ে যান। কিন্তু কাজ হয় না। আসলে সর্ষের মধ্যেই যে ভূত রয়েছে, সে কথা পরিস্কার হয়ে যায়, মহানগরের মুখ থুবড়ে পড়া নিকাশি ব্যবস্থার দিকে তাকালেই।
মূলত দু’ ধরণের নিকাশি ব্যবস্থা রয়েছে শহর কলকাতায়। শহরে বড় যে সমস্ত রাস্তাগুলো রয়েছে, তার নিচ দিয়ে গিয়েছে ব্রিটিশ আমলের ইটের তৈরি নিকাশি ব্যবস্থা বা ‘ড্রাই ওয়েদার ফ্লো’। এখন অবশ্য এই সিস্টেমটা কিছুটা পাল্টেছে। ইটের নিকাশি ব্যবস্থার বদলে বসেছে হিউম পাইপ। আর ছোট রাস্তাগুলোর নীচ দিয়ে রয়েছে নোংরা জল আর বৃষ্টির জলের জন্য পৃথকে চ্যানেল বা ‘স্ট্রম ওয়েদার ফ্লো’। এই চ্যানেল গুলো প্লাস্টিকে বুজে নাব্যতা কমেছে। প্লাস্টিকের দায় এড়াতে পারেনা কলকাতার মানুষেরা। কলকাতার রাস্তার সকাল বেলার একটা খুব চেনা ছবি রয়েছে। খালি হাতে বেরোচ্ছেন ‘মর্নিং ওয়াক’-এ। আর ফেরার সময় ছোট ছোট অনেক গুলো প্লাস্টিকের প্যাকেটে শাক সব্জি মাছ নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। শেষ পর্যন্ত ক্যারিব্যাগগুলোর পরিণতি হচ্ছে বাতাসে উড়ে বৃষ্টির জলের সাথে ধুয়ে ড্রেনগুলোতে গিয়ে পড়া। কাজেই প্লাস্টিকে ভরছে ড্রেনগুলো।
তাহলে সংস্কারের বিষয়টা কে দেখবে? সেই প্রশ্ন আসলে একটা জটিল আবর্ত তৈরি হয়। কলকাতা মহানগরীর নিকাশি ব্যবস্থা বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের হাতে রয়েছে। শহরের পুরোনো নিকাশি নালাগুলো ও পাম্প হাউজের বড় অংশ দেখাশোনা করে কলকাতা কর্পোরেশন। নতুন যে সব নালা আছে, তার পরিচর্যা করে বিভিন্ন সংস্থা। কিছু পাম্প দেখাশোনা করে সেচ দপ্তর। আর কিছু পাম্প দেখে জন স্বাস্থ্য দপ্তর। আর কিছু খালের দায়িত্ব রয়েছে কলকাতা পৌরসভার হাতে। এই সম্পূর্ণ ব্যবস্থাটি কখনোই সুস্থভাবে পরিচালনা হচ্ছে না। তার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে পরিবেশ কর্মীরা দেখছেন সরকারি দপ্তর গুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। সব দপ্তর গুলোর কারিগরি দক্ষতা ও আর্থিক সঙ্গতি এক নয়। যার ফলে মহানগরের নিকাশি ব্যবস্থার সার্বিক উন্নতি যেমন ঘটছে না, তেমনি আধুনিকীকরণও হচ্ছে না।
জন্মলগ্ন থেকে কলকাতার নিকাশি সমস্যা ছিল। সে কথা অস্বীকার করার জায়গা নেই। গঙ্গার বুকে জোয়ারের সময় বৃষ্টি এলে শহরের জল পাম্পিং স্টেশন গুলো বের করতে পারে না। কিন্তু সেই সময় ইংরেজ সাহেবেরা বিদ্যাধরীর পথ দিয়ে শহরের জল নিকাশি ব্যবস্থাটাকে পূর্ব কলকাতার জলাভূমির সাথে জুড়ে দিয়েছিলেন। যা সরাসারি খাদ্য উৎপাদনের ব্যবস্থার সাথে জুড়ে যায়। আসলে এই বিষয়টিতে স্থানীয় এলাকার মানুষের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগানো হয়েছে। একই সাথে সৃজনশীল চিন্তা ধারা দিয়ে ময়লা জলকে পরিপোষক হিসেবে উপলব্ধি করে একটা বড় কর্ম ক্ষেত্র বা উৎপাদনের ক্ষেত্র তৈরি করেছে। তা সত্ত্বেও পূর্ব কলকাতার জলাভূমিকে বৃষ্টির জল ধরে রাখার গুরুত্বের তালিকায় রাখা হয় নি। প্রতিদিন তিলে তিলে সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে পূর্ব কলকাতার জলাভূমি।
আবার টালি নালা থেকে আরম্ভ করে একই সঙ্গে শহরের প্রতিটা নিকাশি নালা যেমন-- বেগোর খাল, চড়িয়াল খাল, কলাগাছিয়া খাল, সার্কুলার খাল, চেতলা বোট খাল, কৃষ্ণপুর খাল ইত্যাদি খালগুলোর খুব খারাপ অবস্থা। খালগুলোর পাশে অবৈধ ভাবে জমি দখল নিকাশি ব্যবস্থার ভেঙে পড়ার ক্ষেত্রে একটা বড় থ্রেট। একই সঙ্গে কলকাতার পুকুর গুলো স্থানীয় এলাকার অনেকটা বৃষ্টির জল ধরে রাখত। সেই পুকুর গুলোও কলকাতার বুক থেকে হারিয়ে যাচ্ছে, মূলত অবৈধভাবে দখল হয়ে যাবার জন্য।
এত কিছুর পরেও প্রশাসন নড়ে চড়ে না বসে, তাহলে কলকাতা একটু বৃষ্টিতেই বানভাসি হবে, সে ভবিষ্যৎ সাধারণ বুদ্ধিতেই অনুমান করা যাচ্ছে।
স্কেচ এবং ছবি সহযোগিতা পার্থ দাশগুপ্ত