পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

জামলো হাঁটছে, জামলোরা হাঁটছে- আমরা নিশ্চিন্ত ঘরের কোণ থেকে দেখছি

  • 25 June, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 1740 view(s)
  • লিখেছেন : শুভ্রদীপ ঘোষ
আমাদের ছেলে মেয়েরা যদি প্রশ্ন করে এই অন্য পৃথিবী নিয়ে, যদি জানতে চায় কেন আমরা তাদের জানতে দিইনি তাদের সহ নাগরিকদের কথা তখন কী উত্তর দেব? আমরা তো আমাদের সুবিধাবাদ দিয়ে জামলোকে মরে যেতে দিয়েছি, রামপুকার পণ্ডিতের বুকফাটা কান্না আমাদের নাড়া দেয়নি, বিহারশরিফের একরত্তি বাচ্চার মৃত মায়ের মুখ আমরা ভুলে মেরে দিয়েছি। এই প্রজন্ম তবু জানুক তাদের হারিয়ে যাওয়া সহ নাগরিকদের, ভাবুক, তৈরি হোক তাদের বাবা মায়েদের ক্রিমিনাল নীরবতা, অপারগতার গ্লানি কিছুটা লাঘব করতে। কারণ “the sky is still blue. Roads are still long. People are still walking”.

জামলো মকদমকে মনে আছে? গতবছর লকডাউন শুরু হবার পর তেলেঙ্গানায় কর্মরত ১২ বছরের সহ নাগরিক জামলো ছত্তিসগড়ে তার বাড়ী ফিরছিল, পায়ে হেঁটে। সঙ্গী ছিল এক বোতল জল আর মায়ের জন্য নিয়ে যেতে চাওয়া এক পুঁটলি লঙ্কা। জামলো ছিলেন একজন পরিযায়ী শিশু শ্রমিক, রাষ্ট্রের অবহেলা যে বর্গের দৃশ্যমানতা প্রায় শূন্য করে দিয়েছে।

আমরা যখন আকাশের এমন নীল রং আগে দেখা যায়নি বলে বিস্ময়ের আদানপ্রদানে ব্যস্ত , জামলোর আকাশে তখন গনগনে সূর্য, এক পেট খিদে, তেষ্টায় ফেটে যাওয়া ছাতি আর যাত্রা অন্তের আকুতি। ২০০ কিলোমিটারের যন্ত্রণাদায়ক এই যাত্রার থেকে মুক্তি পেয়েছিল মেয়ে পথের উপর লুটিয়ে পড়ে। একতিল জীবনে একমাত্র ইতিবাচক ঘটনা ছিল মৃত্যুর পরে আসা করোনা পরীক্ষার নেতিবাচক রিপোর্ট।

জামলোর গল্পকে, বলা ভাল এই বর্গের শ্রমিকদের কোভিডকালের যন্ত্রণার কাহিনীকে শব্দ আর ছবিতে ধরেছেন সামিনা মিশ্র এবং তারিক আজিজ, পেঙ্গুইন থেকে এই বছরেই প্রকাশিত “ জামলো ওয়াকস” (Jamlo Walks) বইতে। বইটি শুরু হচ্ছে লকডাউনের সপ্তম দিনে যেদিন জামলোর যাত্রা শুরু হয় (যদিও জামলো হাঁটা শুরু করেছিলেন ১৬ ই এপ্রিল যখন লকডাউনের মেয়াদ বাড়ান হল) । মাত্র ৩০ পাতার এই বইটির লক্ষ্য শিশু কিশোররা হলেও এ বই ভীষণভাবে বড়দের। সেই বড়রা যারা work from home করে, যাদের বাচ্চারা ডিজিটাল দুনিয়ায় লেখাপড়া শেখার পূর্ণ সুযোগ পায়। সেই বড়রা যারা ব্যালকনির নিরাপদ অবস্থানে দাঁড়িয়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরার মিছিল দ্যাখে তারিয়ে তারিয়ে কফির কাপে চুমুক দিয়ে। জামলোর ঘরে ফেরার ধারাবিবরণীর মাঝে মাঝে এ গল্পে এসেছে তারা, রাহুল আর আমিরের কথা। তারা হয়ত জামলোর বয়সী কিন্তু তাদের পৃথিবী সম্পূর্ণ আলাদা। তারা সকালবেলায় ভরপেট খেয়ে অনলাইন ক্লাস করতে বসে। জামলোদের পৃথিবী উঁকি দিয়ে যায় তাদের জীবনে। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। সহ নাগরিকদের সঙ্গে বেঁধে বেঁধে থাকার ইচ্ছে ফুতকারে উড়ে যায় কখন তারার মায়ের মাউস ক্লিকে, কখন রাহুলের বাড়ীর পাশের বস্তির বাচ্চাদের অদৃশ্যমানতায় অথবা আমীরের বন্ধুদের কম্পুটার স্ক্রিন থেকে একে একে মিলিয়ে যাওয়া । সামিনা মিশ্র দুই পৃথিবীর বৈপরীত্য চমৎকারভাবে ফুটিয়েছেন এমন রূপক আর ছোট ছোট দৃশ্যকল্পে। যেমন, তারার গল্প শেষ হচ্ছে তার মায়ের প্রশ্নে “আজ কি দোসা খাবে?” ঠিক তখনই অন্য পৃথিবীতে জামলো তাকিয়ে আছে রাস্তার দোকানের তাওয়ার দিকে যেখানে ভাজা হচ্ছে দোসা। জামলোর কাছে পয়সা নেই, তার হাতে চয়েস নেই। দয়াপরবশ দোকানীর তুলে দেওয়া বাসি লাড্ডুই তার পথের খাবার।

তারা, আমির, রাহুলের মা বাবাদের মত আমরাও বাচ্চাদের দেখাতে চাই না পৃথিবীর এই ভয়ংকর দিক। তাদের কম্পুটার স্ক্রিনে যেমন ক্রমশ মিলিয়ে যায় এই অন্য পৃথিবী, সব পেয়েছির দলের আমরাও তেমনি মুখ ফিরিয়ে রাখতে চাই এই পৃথিবী থেকে। সেইজন্যই বোধহয় বাচ্চাদের কাছ থেকেও আড়াল করে রাখতে চাই। কিন্তু সত্যিই কি আড়াল করে রাখা যায়? সত্যিই কি দরকার এটা? ক্রোধ জমতে জমতে যখন পাহাড়প্রমাণ হয়ে দাঁড়ায়, যখন শত শত জামলো আছড়ে পড়ে স্টাফ স্পেশাল ট্রেনের সামনে, তখন ছকের সামনে ঝুলিয়ে রাখা পর্দা কি টিকতে পারে?

এ বই ভাবায় আমাদের। আমাদের ছেলে মেয়েরা যদি প্রশ্ন করে এই অন্য পৃথিবী নিয়ে, যদি জানতে চায় কেন আমরা তাদের জানতে দিইনি তাদের সহ নাগরিকদের কথা তখন কী উত্তর দেব? আমরা তো আমাদের সুবিধাবাদ দিয়ে জামলোকে মরে যেতে দিয়েছি, রামপুকার পণ্ডিতের বুকফাটা কান্না আমাদের নাড়া দেয়নি, বিহারশরিফের একরত্তি বাচ্চার মৃত মায়ের মুখ আমরা ভুলে মেরে দিয়েছি। এই প্রজন্ম তবু জানুক তাদের হারিয়ে যাওয়া সহ নাগরিকদের, ভাবুক, তৈরি হোক তাদের বাবা মায়েদের ক্রিমিনাল নীরবতা, অপারগতার গ্লানি কিছুটা লাঘব করতে। কারণ “the sky is still blue. Roads are still long. People are still walking”.

0 Comments

Post Comment