এইবারের বাদল অধিবেশনে বেশ কিছু বিল পাশ করিয়ে নিয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকার। আরো কিছু বিল সামনে এনেছে, সেগুলোও দ্রুত পাশ করিয়ে নেওয়া তার উদ্দেশ্য। এর অন্যতম, দেশে প্রচলিত মূল তিনটি ফৌজদারি আইনের বদল। এই বদলের মধ্যে দিয়ে কি নতুন কিছু পাওয়া যাবে?
ফৌজদারি কাঠামো বদলের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের তিনটে বিলের সর্বশেষ স্থিতি নিয়ে লেখাটা শুরু করা যেতে পারে। স্বরাষ্ট্র বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির কনভেনর তড়িঘড়ি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে গত ২৪ আগষ্ট কমিটির সভা ডাকেন এই বিলগুলো নিয়ে আলোচনার জন্য l কিন্তু তা হওয়ার কথা ছিল না। কারণ , অন্য একটা বিল নিয়ে আলোচনা চলছিল। সেটা বন্ধ রেখে এত দ্রুত গতিতে বিল গুলো নিয়ে সভা ডাকার বিরোধিতা করেন কমিটির বিরোধীদের একাধিক সাংসদ সদস্য। যেহেতু অধিবেশন শেষ হয়ে যাওয়ার পর বহু সদস্য দিল্লিতে নেই, সেহেতু তাঁরা উপস্থিত থাকতে পারবেন না গুরুত্বপূর্ণ সভাগুলোতে। দুই, তাঁরা সঙ্গত ভাবেই প্রশ্ন তোলেন, এত তাড়া কিসের? কিন্তু এসব ন্যায্য ও সঙ্গত প্রশ্নের কোনও উত্তর না দিয়েই ( উত্তর না দেওয়াটা বর্তমান শাসক দলের অন্যতম একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ) এই চলতি সপ্তাহেও ''আলোচনার" দিনক্ষণ ঠিক করা হয়ে গেছে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় নি: যেহেতু এই তিনটে বিল ভারতের প্রত্যেকটি নাগরিকের জীবনের উপর প্রভাব ফেলবে, সেহেতু ব্যাপক ভাবে সর্ব স্তরে ব্যাপক আলোচনা, মতামত বিনিময় হওয়াটা একমাত্র স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক পদ্ধতি, কেন তা হলো না তার কোনো ব্যাখ্যা আমাদের জানা নেই বা অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে হওয়ার কোনও ইঙ্গিতও সরকার দেয় নি। কয়েকজন মিলে - বিজেপি সাংসদ তথা আইনজীবী মহেশ জেঠমালানি, পুলিশের একজন প্রাক্তন শীর্ষ আধিকারিক, একজন প্রাক্তন সেশন জজ ও বর্তমান স্বরাষ্ট্র সচিব, অজয় ভাল্লা -- এই তিনটে বিল রচনা করেন। অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতে , প্রায় ষড়যন্ত্রের কায়দায় তিনটে বিল দেশবাসীর উপর, সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে চাপিয়ে দেওয়া চূড়ান্ত অগণতান্ত্রিক এবং participatory democracy এর ধারণা ও মূল্যবোধের বিরোধী।
এমনকি সংসদে শীতকালীন অধিবেশনেও যে বেশিক্ষণ আলোচনা না করেই তিনটি বিলকে পাশ করিয়ে নিয়ে চালু করে দেওয়া হবে, তার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় সম্প্রতি আইন রক্ষকদের এক সমাবেশে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর বক্তব্যে: নতুন ফৌজদারি আইনগুলো সম্পর্কে সবাই অবহিত হোন ও প্রয়োগ সম্পর্কে সচেতন হোন!
আমরা অতীতে দেখেছি সরকার কর্তৃক আনীত একটি সুদূরপ্রসারী বিলকে ঘিরে পর্যাপ্ত গভীর আলোচনা, যুক্তি-পালটা যুক্তির অবতারণায় সংসদের উভয় কক্ষ সরগরম থাকত; প্রজ্ঞা, বিষয়টির উপর জ্ঞানচর্চা, দূরদৃষ্টি, মূল্যবোধ সমৃদ্ধ আলোচনা সংসদকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যেত । সেই বিচারে সংসদের গুরুত্ব আজ প্রায় তলানিতে; অতি স্বল্পকালীন সময়ে সংসদ শুধুমাত্র বিল পাসের লক্ষ্যে যেন কনভেয়ার বেল্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে; শুরু হয় ব্যক্তি নামের জয়ধ্বনি দিয়ে, আর শেষ হয় শাসকের যুক্তির পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ধ্বনি ভোট দিয়ে; হাউসের সাফল্য মাপা হয় নতুন এক বিশেষণ দণ্ড দিয়ে :"উৎপাদনশীলতা" অর্থাৎ কটা বিল পাস হল তাই দিয়ে।
এবারের অধিবেশনে মণিপুর, অনাস্থা প্রস্তাব ইত্যাদি নিয়ে তুমুল লগজ্যামের মধ্যেও কেন্দ্রীয় সরকার একের পর এক বিতর্কিত বিল পাস করিয়ে নিয়েছে: তথ্য সুরক্ষা আইন, অরণ্য সংরক্ষণ ( সংশোধনী) আইন, দিল্লী নিয়ন্ত্রণ আইন ; সর্বোপরি, শেষ দিনে (১১ আগষ্ট), দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আগাম ইঙ্গিত পর্যন্ত না দিয়ে "কালো ম্যাজিকের" মত, সম্পূরক বিষয় হিসাবে, দেশে প্রচলিত মূল তিনটি ফৌজদারি আইনের বদলে (সংবিধানের ৩৪৮ অনুচ্ছেদকে আংশিক ভাবে নস্যাৎ করে) হিন্দি
( সংস্কৃত শিকড় সহ) নামকরণ দিয়ে তিনটি আইনের খসড়া পেশ করেন এবং বিস্ফোরক দাবি করেন , ১৮৬০ সাল থেকে ২০২৩ সালের (আগষ্ট পর্য্যন্ত ) চলিষ্ণু ব্রিটিশ আমলের ঔপনিবেশিক আইনগুলোর অবসান নাকি ঘটাল মোদী সরকার! দেশবাসীকে ঔপনিবেশিক দাসত্ব সুলভ মানসিকতা থেকে মুক্ত করল এই তিনটে বিল! তবে আপাতত শীতকাল পর্যন্ত আমাদের দাস ভাব নিয়েই থাকতে হবে; এর মাঝে বিলটি নাড়াচাড়া করবে স্বরাষ্ট্র বিষয়ক স্থায়ী ( স্ট্যান্ডিং) কমিটি, যে কমিটিতে আবার শাসক দলেরই প্রাধান্য বেশি, এবং এই মুহূর্তে চারজন বিরোধী সদস্য সাসপেন্ড হয়ে আছেন। তাই বিলগুলো শুধু কমিটির ও রাষ্ট্রপতির টিক মারার অপেক্ষায়।
বিলগুলো সত্যিই কি অতীত থেকে আলাদা?
ধারা সমূহ সংক্ষিপ্তকরণের নিরিখে, কিছু বর্জনের বিচারে, কিছু ভাষা , শব্দ বর্জন ও সংযুক্তির আলোকে, এবং নতুন সংজ্ঞার্থ, অপরাধ ও সাজার নতুন পরিসর বাড়ানোর মাপকাঠিতে এই তিনটি বিলের আপাত বাহ্যিক অভিনবত্ব আছে। কিন্তু খুঁটিয়ে দেখলে দেখা যাবে, প্রচলিত তিনটি ফৌজদারী আইনেরই ৮০ শতাংশের বেশি নতুন বিলে রীতিমত সুরক্ষিত। দ্বিতীয়ত, ফৌজদারী কার্য বিধিতে ১৯৭৩ সালে শুধু বিপুল পরিবর্তন হয়েছে তাই নয়,; তারপরেও এই বিধিতে রাজ্যগুলো বারবার নানা ধারার উপর সংশোধনী এনেছে, দণ্ড সংহিতায়, সাক্ষ্য আইনে সুপ্রীম কোর্টের নানা ব্যাখ্যা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের উপাদানগুলোকে বর্জন করেছে; রাণীর প্রতি প্রজার প্রশ্নহীন আনুগত্যের স্থলে নাগরিকের অধিকারের স্বীকৃতি, রক্ষা ও সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ১৯৫০ সালেই সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৩ সংবিধান বিরোধী অতীতের যাবতীয় আইন, শব্দ ব্যবহার ইত্যাদি বাতিল বলে গণ্য হবে বলে জানিয়ে দিয়েছিল; এবং নানা সময়ে, নানা আইনের সংশোধনীর মাধ্যমে বহু নির্দিষ্ট গণতান্ত্রিক পরিবর্তন সংসদই করেছিল; আবার, সময়ের দাবি মেনে নারীর, শিশুর বা সার্বিক মানবাধিকার নিয়ে নতুন একগুচ্ছ আইনও রচিত হয়েছে। সুতরাং, ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্য থেকে গেড়ে বসা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ফৌজদারি মানসিকতা এই তিনটি বিলের মধ্য দিয়ে সর্ব প্রথম ২০২৩ সালে বধ করা হল - সরকারের এই দাবি আদৌ ইতিহাস সম্মত নয়। বরং , নাৎসিদের ভাষার উপর বইয়ের লেখক ভিক্টর ক্লেমপেরের ( Klemperer).- র একটি মন্তব্য এখানে সুপ্রযোজ্য: 'যুক্তিভিত্তিক বাগ্মিতার' পরিবর্তে বাত্তেল্লাটাই সুপরিস্ফুট।
নতুন নতুন অপরাধের সংযোজন?- মিথ না সত্যি?
দাসত্ব থেকে মুক্তির নির্দশন হিসাবে যে আট - নয়টা নতুন অপরাধের সংযুক্তি ও তৎসংক্রান্ত সাজার কথা বলা হয়েছে তা নেহাতই সত্যের অপলাপ। কারণ, সেগুলো প্রচলিত আইনে কয়েক বছর ধরে রয়েছে; স্বল্প পরিসর হেতু মাত্র কয়েকটি দৃষ্টান্তের উল্লেখ করছি:
ক) ঘৃণা ভাষণ : বর্তমান দণ্ড সংহিতায় ২৯৫ক সহ অধ্যায় ১৫;
খ) জিরো এফ আই আর : ২০১৩ সালের ১৬ মে সরকারি আদেশ , ও সুপ্রিম কোর্টের দু দুটি রায় ;
গ) গণধর্ষণ: ২০১৩ সাল থেকে দণ্ড সংহিতায় ৩৭৬
ঘ) শিশুদের বিরুদ্ধে যৌন অপরাধ: ২০১২ সালের পকসো আইনে ধারা
ঙ) পকসো আইনে অভিযুক্ত ও আক্রান্ত উভয়েই লিঙ্গ নিরপেক্ষ ছিল; নতুন বিলে বালিকাই শুধু মাত্র আক্রান্ত ।
রাষ্ট্রদ্রোহ আইন বাতিল, রাষ্ট্রদ্রোহ আইন দীর্ঘজীবী হোক
সিডিশন ধারা বাতিলের ঘোষণাটি চমকপ্রদ হলেও নির্মম সত্য হল, বাতিল করা ছাড়া সরকারের গত্যন্তর ছিল না। সিডিশন বিরোধী বিপুল জনমত, কেদার নাথ (১৯৬২) রায়ের শর্ত এবং সুপ্রিম কোর্টের এই ''যুবরাজ" ধারাটির প্রয়োগের উপর ২০২২ সালের মে মাস থেকে অনির্দিষ্ট কাল স্থগিতাদেশ ধারাটিকে কার্যত অচল করে দিয়েছে। তাই বাতিলের আওয়াজের আড়ালে 'ন্যায় সংহিতায়' অন্য ধারায় (১৫০; তাও আবার ব্যাখ্যা অংশটি অসম্পূর্ণ) আরো ভয়ংকর রূপে দেশদ্রোহিতার ধারণাকে স্থান দিল, যা পড়লে লর্ড ম্যাকলে পর্যন্ত চমকে যেতেন এই ভেবে যে, দেশীয় শাসক নিজ দেশের স্বাধীন নাগরিকদের বিরুদ্ধেই সুরক্ষা দেওয়ার নামে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারে! ধারাটিতে অপরাধ হিসাবেএকাধিক শব্দবদ্ধ ব্যবহৃত হয়েছে (' অন্তর্ঘাতমূলক কাজ', জাতীয় ঐক্য ও সংহতি রক্ষা', 'বিচ্ছিন্নতাবাদী ধারণায় উস্কানি' ইত্যাদি) নতুন নতুন অপরাধের সংযোজন , যার কোনও আইনি ব্যাখ্যা, সংজ্ঞা, উদাহরণ অনুপস্থিত। স্মর্তব্য, ১৯৯৩ সালেই রাষ্ট্র সঙ্ঘ একটি প্রতিবেদনে স্পষ্ট বলেছিল, ফৌজদারী আইন দাবি করে নির্দিষ্ট সংজ্ঞার্থের ( precision); যত অস্বচ্ছ, ভাসা ভাসা শব্দ ব্যবহার হবে, তত এর প্রয়োগ স্বৈরাচারী হয়ে উঠবে। উপরন্তু, এই সমস্ত অস্বচ্ছ ধারা প্রয়োগের জন্য পুলিশের উপর ন্যস্ত করা হয়েছে অবাধ, দায়বদ্ধহীন ক্ষমতা। বর্তমান শাসকের অতি প্রিয় কিন্তু কল্পিত 'টুকরে টুকরে গ্যাং' ছকে তকমা দেওয়া হবে সব ধরনের বিরুদ্ধবাদীদের; অচিরেই দেশটি কংসের কারাগারে রূপান্তরিত হবে। বিচার ব্যবস্থার ইদানিং যে রহস্যময় রূপ দেখা যাচ্ছে, তাতে অমিত শাহ দের স্বপ্ন -- ৯০ শতাংশ সাজা পাওয়া -- হয়ত পূরণও হয়ে যাবে। উল্লেখ্য, সংসদে সরকার কোনও রিপোর্ট পেশ করে দেখলেন না, কেন দ্রুত বিচার সম্পন্ন করার লক্ষ্যে ২০০৫ সাল থেকে গঠিত ফাস্ট ট্র্যাক আদালত সাফল্য পেল না, পরিকাঠামো উন্নতি/ সংস্কার না করে কেন সেটা নিঃশব্দে বিসর্জন দিচ্ছে সরকার? সামারি বিচারও কি ঠিকঠাক চলছে?
সঙ্গত ভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, নতুন বিলগুলোর ৮০ শতাংশই যখন নতুন বোতলে পুরাতন মদ, তাহলে এত আপত্তির করার কোনও ন্যায্য কারণ থাকতে কি পারে? আমাদের উত্তর,হ্যাঁ , পারে। কারণ নতুন যে প্রায় ২০ শতাংশ নতুন বিলগুলোতে যোগ করা হয়েছে তা অতি মারাত্বক, ভয়ঙ্কর। কেন ভয়ঙ্কর তা আমরা পরের অংশে আলোচনা করেছি।
ন্যায় বিচার কাঠামোর রূপান্তর
দেশীয়, আন্তর্জাতিক সুষ্ঠু, ন্যায় বিচার কাঠামো অভিযুক্ত সুরক্ষা ভিত্তিক; তাই বিচার প্রক্রিয়া, তৎসংক্রান্ত নিয়ম কানুন সেই লক্ষ্য পূরণে রচিত। নতুন বিল তার আমূল রূপান্তর ঘটিয়ে বিরুদ্ধবাদী তথা অভিযুক্ত বিরোধী অনুসন্ধান ও বিচার প্রক্রিয়াকে (inquisitional) সিলমোহর দিতে চাইছে। যেমন, তদন্তকারী পুলিশ সুপার সহ অন্যান্য দের বিচারের সময় অভিযুক্তের পাল্টা জেরার অধিকার খর্ব করা হয়েছে ( নাগরিক সুরক্ষা সংহিতার ২৫৪,২৫৫,২৫৬(৩)); বিচারপতিকে ন্যায়বিচার, সুষ্ঠু বিচার প্রক্রিয়া বিরোধী ক্ষমতা অর্পণ করা হল। ফর্মুলা টা দাঁড়াবে এই রকম: ধৃত = দোষী ধরে নিয়ে বিচার= অসুষ্ঠু ভাবে দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া শেষ করেই সাজা প্রদান। সংশয়াতীত যুক্তিগ্রাহ্য প্রমাণের ধারণাই অপসৃত হল ; দ্রুত বিচারের নামে ন্যায় বিচারকেই বলি দেওয়া হল প্রস্তাবিত বিলে। নাগরিক ন্যায় তথা সুরক্ষা দেওয়ার নামে ফৌজদারি কাঠামোয় ইনকুইজিশন চোরাগোপ্তা ভাবে ঢুকিয়ে দিলো, ন্যায় বিচার প্রক্রিয়ায় মানবাধিকারের ধারণাকে শিকেয় তুলে দিল।
অপরাধ নিয়ন্ত্রণ মডেল রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের হাতিয়ার?
ন্যায্য, সুষ্ঠু বিচার প্রক্রিয়া হীন এই জাতীয় অপরাধ নিয়ন্ত্রণ মডেল অভিযুক্তের জামিন পাওয়া থেকে শুরু করে পুলিশের হেফাজত হিংসা উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে; প্রাথমিক সর্বমোট ১৫ দিনের পরেও পরবর্তী ৭৫ বা ৪৫ দিন পুলিশ হেফাজতে অভিযুক্তকে জেরার জন্য নিয়ে যাওয়ার নয়া বিধান (নাগরিক সুরক্ষা বিল, ১৮৭ ধারা) হেফাজত হিংসা, হত্যার দ্বার আবার অবাধে খুলে দেবে; সব ধরনের বন্দিকে হাতকড়া পরিয়ে জনসমক্ষে নিয়ে যাওয়ার নয়া বিধান (সুরক্ষা বিল, ৪৩(৩)) সুপ্রিম কোর্টের এই সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞাকে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে; অভিযুক্তের কাছে গ্রেপ্তার হওয়া থেকে গোটা বিচার প্রক্রিয়া পর্বটাই শাস্তি মূলক হয়ে উঠলো; মানব মর্যাদার রক্ষার স্থলে নেটিভ প্রজাদের প্রতি পরাধীন দেশগুলোর অমর্যাদাকর, অমানবিক শাসন বকলমে ফিরিয়ে আনা হল। দেশীয় আইনে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার অত্যাচার বিরোধী সনদ সহ নানা আইন, চুক্তি সনদে সব ধরনের শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার নিষিদ্ধ। নতুন বিলেও অত্যাচার কে আইনি সিদ্ধ বলে বিজেপি নামক দলটি , যারা "মডার্ন outlook with Indian ethos "-এ বিশ্বাসী, অন্তর্ভূক্ত করে নি; অর্থাৎ ব্যাহিক ভাবে মডার্ন outlook / আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ রেখেছে; কিন্তু সঙ্গে, বকলমে ইন্ডিয়ান এথস এর অনুসরণে অভিযুক্ত ধৃতকে থার্ড ডিগ্রি দেওয়ার জন্য পুলিশি হেফাজতে বার বার বন্দিকে নিয়ে যাওয়ার আইনি বন্দোবস্ত রেখেছে। প্রাচীন ভারতের আইনি নিয়ম কানুন সম্পর্কে স্মৃতি শাস্ত্র থেকে যেটুকু জানা যায় তা হলো, সেই সময়ে তিন ধরনের সাক্ষ্য আদালতে গ্রহণযোগ্য ছিল - ১. লিখিত দলিল ; ২. সাক্ষী দের মৌখিক বয়ান ; এবং ৩. অত্যাচার , যন্ত্রণা( 'ordeal') দিয়ে অভিযুক্তের কাছ থেকে বয়ান বা "স্বীকারোক্তি" আদায় [ দ্র L.Sternbach, Judicial studies in ancient Indian law (vol.2) , Delhi, 1967 ] । এই এথস্ কে নতুন বিলে কায়দা করে ঢুকিয়ে কার্যত আধুনিক যুগের অত্যাচার বিরোধী সর্বজনীন দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গিকে নাকচ করা হলো। তার স্থলে মনু সংহিতার ধারণাকে স্থান দেওয়া হল।
ব্যতিক্রমী, বিশেষ আইনকে সাধারণ বিচার কাঠামোয় অন্তর্ভুক্তি করণ
ন্যায় সংহিতার ১১১ ধারাতে "সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ" সম্পর্কিত সংজ্ঞার্থ, ব্যাখ্যা পুরোপুরি ভাবে বিশেষ আইন ইউ এ পি এ (UAPA) ,এর যাবতীয় দানবীয় ধারাগুলোর কপি ও পেস্ট। ফলে বিশেষ আইন লাগু করার ক্ষেত্রে যেটুকু বাধা ছিল - অনুমতির, বন্দির রিভিউ করার অধিকার ইত্যাদি - উঠিয়ে দেওয়া হলো। পাশাপাশি, "অপরাধ থেকে প্রাপ্ত" অভিযুক্তের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার জন্য বিশেষ আইনের( PMLA) ধারাও নাগরিক সুরক্ষা বিলে ১০৭ ধারায় যুক্ত করা হয়েছে।
কে "সন্ত্রাসবাদী" ? - এর ব্যাখ্যা ন্যায় সংহিতার ধারা ১১১ তে যা দেওয়া হয়েছে তা যদি পড়েন , তাহলে চমকে উঠবেন। কারণ, যে কোনও প্রতিবাদকে সন্ত্রাসবাদী তকমা দিয়ে দমন পীড়ন নামিয়ে আনার পথকে প্রশস্ত করেছে এই ধারা ও তার ব্যাখ্যা। দু তিনটে উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ধারায় রয়েছে, পাবলিক অর্ডারে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে যে বা যারা তারা সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে অভিযুক্ত হবে। ঠিক কি ধরনের পাবলিক অর্ডার বিঘ্ন বোঝাতে চেয়েছে ? একটি হলো, আবশ্যিক পরিষেবায় বাধা, বিঘ্ন ঘটালে; অর্থাৎ নিবর্তনমূলক আইন, এসমা তে বলা আছে কি কি আবশ্যিক পরিষেবা। সে সমস্ত সেক্টরে শ্রমিকরা ন্যায্য দাবি দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করলে , সরকার নিত্য প্রয়োজনীয় পরিষেবায় বাধা দিচ্ছে বলে , নতুন বিল অনুসারে, আন্দোলনকারীদের সন্ত্রাসবাদী ধারায় অভিযুক্ত করতে পারবে। অর্থাৎ পুরাতন কংগ্রেস আমলে তৈরি বিনা বিচারে আটক আইন দিয়ে আন্দোলনকারীদের আন্দোলন কে দমন করা নয়, একবারে গণ আন্দোলনকে সন্ত্রাসবাদী তকমা দিয়ে স্তন্ধ করে দেওয়া, ভয় ভীতি সঞ্চার করা নাগরিকের মধ্যে।
ক)
সন্ত্রাসবাদীর সবচেয়ে মারাত্মক কিন্তু অভাবনীয় একটি নতুন ধারণা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে এই ধারার ব্যাখ্যা অংশে : আগুন লাগলে, অথবা বন্যা হলে, সরকার একে সন্ত্রাসবাদীদের নাশকতা মূলক কাজ বলে কাউকে বা কয়েকজনকে এই সন্ত্রাসবাদী ধারায় যুক্ত করার ক্ষমতা ভোগ করবে। যেমন, করোমন্ডল এক্সপ্রেস এর ভাবাহ দুর্ঘটনাকে প্রথমে কেন্দ্রীয় শাসক দলের শ্যাডো বাহিনী সামাজিক মাধ্যমে কাগুয়া পত্তির কায়দায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নাশকতা মূলক কাজের পরিণতি বলে বলতে শুরু করেছিল, " রেল মন্ত্রী নিজেদের গাফিলতি ঢাকতে " এক্সটার্নাল interference" তত্ত্ব আমদানি করে সন্ত্রাসবাদী দের কাজ বলে বলতে শুরু করেছিলেন। সেটুকুও তথ্য পাই নি বলে কেন্দ্রীয় সরকার, সিবিআই বিষয়টা নিয়ে আর শোরগোল তুলছে না, চেপে যাচ্ছে।
খ)
এই ধরনের অস্বচ্ছ, ভাসা ভাসা শব্দবন্ধ আইনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলে রাষ্ট্রের পোয়াবারো -- না পছন্দ যাকে ইচ্ছে তকমা দিয়ে আইনি হয়রানি করতে পারবে বছরের পর বছর ধরে।
ন্যায় সংহিতা বিলে আরেকটি বিশেষ অপরাধের সংযোজন উদ্বেগজনক। এতদিন পর্যন্ত MCOCA জাতীয় বিশেষ আইন ছিল যার দানবীয় ধারাগুলো প্রয়োগ করতে গেলে অনুমতির প্রয়োজন ছিল। তার বদলে এই বিলে সেই জাতীয় সংগঠিত অপরাধ কে সাধারণ আইনের ধারা উপধারার অংশ করে দেওয়ার প্রস্তাবের অর্থ এবার থেকে অপরাধটি সত্যি অর্গানাইজড অপরাধ কিনা তা বিচারের ব্যাপার তুলে দেওয়া হলো; অনুমতি দেওয়ার ব্যাপারটি তুলে দেওয়া হলো। থানা সাব ইন্সপেক্টরই যে কারুর বিরুদ্ধে এই ধারায় (১১২) মামলা রুজু করতে পারবে । সদ্য ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার উল্লেখ এক্ষেত্রে আবশ্যিক। মহারাষ্ট্রের উপ মুখ্যমন্ত্রী ফডনবিসের দুর্নীতি সংক্রান্ত একটি খবর প্রকাশ করার "অপরাধে" মহারাষ্ট্রের কুখ্যাত সংগঠিত অপরাধ আইন, MCOCA- তে সাংবাদিক উকে র বিরুদ্ধে মামলা রুজু করেছে পুলিশ !
নতুন সাক্ষ্য বিলের ১১৫ ধারায় বলা হয়েছে, ন্যায় সংহিতার যে সমস্ত ধারায় (যেমন ধারা ১৪৫, ১৪৬, ১৪৭, ১৪৮) রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা, ফৌজদারী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে অথবা উপদ্রুত আইন যেখানে লাগু আছে, সেই সমস্ত ধারায় অভিযুক্ত দের প্রমাণ করতে হবে, তারা দোষী নন, নির্দোষ। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ঘোষণার অনুচ্ছেদ ১১ এবং আন্তর্জাতিক সুষ্ঠু ন্যায় বিচারের মৌল দর্শন --- যতক্ষণ না অপরাধ প্রমাণিত হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত অভিযুক্ত নির্দোষ -- র মূলে আঘাত করছে।
সাজার কঠোরতা
১৯৭৯ সালের এপ্রিল ৪ তারিখে ভারতের পক্ষে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি লিখিত ঘোষণার মাধ্যমে রাষ্ট্রসংঘে অঙ্গীকার করেছিলেন, নিজ দেশে ধীরে ধীরে মৃত্যুদণ্ড তুলে দেবে। আমরা বিপরীত মুখী পদক্ষেপ করা দেখেছি অতীতে; বর্তমানে নতুন বিলেও মৃত্যুদণ্ডের প্রাবল্য চোখে পড়ার মত।
এখানে আরেকটি বিষয়ের উল্লেখ বোধহয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ব্রিটিশ আমলে হত্যা সহ একাধিক অপরাধে মৃত্যুদণ্ড সর্বদা এক নম্বরে থাকত। যাবজ্জীবন দু নম্বরে বিকল্প শাস্তি হিসাবে ছিল। মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে, যদি কোনও বিচারক দণ্ডিতকে যাবজ্জীবন দিতেন, তাহলে কারণ উল্লেখ করতে হত; মৃত্যুদণ্ড দিলে কারণ উল্লেখ করতে হত না। ঔপনিবেশিক এই মানসিকতার পরিবর্তন ঘটে স্বাধীন ভারতে পঞ্চাশের দশকে; পরিবর্তন ঘটান ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক মানসিকতায় আচ্ছন্ন বলে যে দলকে বিজেপি আক্রমণ করে, সেই কংগ্রেস দল। পরে সুপ্রিম কোর্টও মৃত্যুদণ্ডের পরিধি ক্রমশঃ সঙ্কুচিত করে দিয়েছিলেন। আর, বিজেপি নামক ঔপনিবেশিক মানসিকতার প্রবল, কট্টর বিরোধী দাবিদার দল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের মানসিকতাকে ফিরিয়ে আনছে নানা ধরনের অপরাধে মৃত্যুদণ্ড কে এক নম্বরে স্থান দিয়ে। শুধু তাই নয়, মৃত্যুদণ্ড মকুব করার নানা সাংবিধানিক পদ্ধতিকে কাট ছাট করার প্রস্তাব রেখেছে নতুন ন্যায় সংহিতার বিলে। দ্রুত দোষী সাব্যস্ত করে দ্রুত চরম দণ্ড কার্যকর করার ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা পরিস্ফুট হচ্ছে এই তিন নতুন বিলে। ফলে, দেশ ক্রমশঃ এক আমনবিক মৃত্যু উপত্যকার রূপ নেবে।
আবার, সেসব ক্ষেত্রে নিজেরা বা তাদের শ্যাডো বাহিনী গণ পিটুনিতে যুক্ত থাকবে, সেখানে ৭ বছরের সাজার বন্দোবস্ত রাখা হয়েছে; 'লাভ জিহাদ' সরাসরি বলা না হলেও ঠকিয়ে বিয়ের ক্ষেত্রে সাজা ১০ বছর রাখা হয়েছে। আর, আমরা বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বাবরি মসজিদ ধ্বংস থেকে 'মব লিঞ্চিংয়ের' ঘটনাগুলোতে প্রমাণের অভাবে অভিযুক্তরা বেকসুর ছাড়া পেয়েছেন; বিলকিস বানুর ক্ষেত্রে ধর্ষকরা গুজরাট ও কেন্দ্রীয় সরকারের দৌলতে মুক্তি পেয়েছে। এক কথায়, নতুন বিলগুলোর অভিমুখ একটাই: সমস্ত বিরুদ্ধতা কে স্তব্ধ করা।
বিবিধ
বৈবাহিক ধর্ষণ নিয়ে কিছু বলা নেই। খাপ পঞ্চায়েতের বিচার ও শাস্তিদানের ক্ষমতা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের তীব্র নিন্দাসূচক রায় থাকলেও নতুন বিল এসম্পর্কে নীরব। আবার, নানা ধর্মে স্বীকৃত (যেমন শিখ ধর্মে) বিকল্প শাস্তি হিসাবে কমিউনিটি পরিষেবা নতুন বিলে যুক্ত হলেও, ঠিক কি ধরনের পরিষেবা দন্ডিত হবে, কারাই বা ঠিক করবেন তার কোনও ব্যাখ্যা নেই; ফলে স্বেচ্ছাচার ও নিষ্ঠুরতার প্রবল সম্ভাবনা রয়ে গেলো ।
শতাব্দীর পর শতাব্দী মনু সংহিতার দাসত্ব করার জন্য উপনিষদ আমাদের শিখিয়েছিল, 'নৈষা মতি: তর্কেনাপনীয়'। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন বাহুবল, পেশীশক্তির মাধ্যমে আমাদের পূর্বপুরুষদের দাবিয়ে রাখতে চেয়েছিল। উত্তর - সত্য ভারতের দেশীয় নামধারী রাষ্ট্রবাদী লর্ড ম্যাকলে এক ভয়ঙ্কর শক্তিশালী বিধি বিধান, নিষেধ হুঙ্কারের মধ্য দিয়ে সমাজ জীবনের স্বাভাবিক জীবন রস শুষে নিতে আজ উদ্যত। নাগরিকদের আনুগত্য সর্বস্ব কলের পুতুল বানানোর লক্ষ্যে এই তিনটে বিল।