আগামী কয়েক দশকে সারা দেশ জুড়ে যে প্রগতি বনাম রক্ষণশীলতার সংঘাত চলছে সেই পরিপ্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ দিশা নির্ধারক ঘটনা। আমরা দেখতে পাচ্ছি, দেশের ইতিহাস বদলে দেবার চেষ্টা হচ্ছে; আমরা দেখতে পাচ্ছি বিজ্ঞানকে অপসারিত করে তার স্থান নিচ্ছে একটা অদ্ভুত ধর্মীয় গোঁড়ামি। এইরকম একটা পরিস্থিতিতে এটা বোঝা যাচ্ছে আমাদের দেশ এমন একটা লক্ষণরেখার উপর দাঁড়িয়ে আছে যার একদিকে রয়েছে গণতন্ত্র ও বিজ্ঞানচেতনা অন্যদিকে রয়েছে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের কুশিক্ষা। এই ফ্যাসিবাদের কুশিক্ষা কেবলমাত্র গোমূত্র বা গোময় সেবনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। তা রিচুয়ালের গণ্ডি ছাড়িয়ে আসলে আমাদের সমাজ ব্যবস্থাটাকে ধ্বংস করেছে। সেখানে যে সৌহার্য এবং বন্ধুত্বের পরিবেশ, পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও সহযোগিতার পরিবেশ তাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
আমাদের এ কথা মনে রেখে শুরু করতে হবে যে ফ্যাসিবাদ একটি শক্তিশালী মতাদর্শ। অর্থাৎ দিনের শেষে আমাদেরও একটা মতাদর্শ জনগণের সামনে দাঁড় করাতে হবে যে মতাদর্শ ফ্যাসিবাদ মতাদর্শের ভ্রান্তিগুলোকে ও তার বিষময় ফলগুলোকে জনগণের সামনে তুলে ধরতে সমর্থ হয়। এই কাজটা একদিকে যেমন নিরন্তর প্রচারের মাধ্যমে অনলসভাবে করে যেতে হবে, অন্যদিকে আবার আমাদের কিছু সফল উদাহরণ তুলে ধরতে হবে। যেগুলির মাধ্যমে জনগণ বুঝতে পারে যে ফ্যাসিবাদী শক্তিকে মতাদর্শগতভাবে পরাস্ত করা সম্ভব। ওই একই সঙ্গে এই উদাহরণগুলি মতাদর্শগত সংঘাতের বিষয়টিকে জনগণের সামনে নিয়ে আসবে। আরো একটা জরুরী বিষয় রয়েছে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংঘর্ষে যারা লিপ্ত তাদের সামনেও কিছু সফল উদাহরণ থাকলে তারা মতাদর্শের প্রচার ও তার কৌশলের ক্ষেত্রে বাস্তব প্রক্রিয়াগুলির সঙ্গে বোঝাপড়া করতে সমর্থ হবে। জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নির্বাচনে সবকটি আসনে বামপন্থী প্রার্থীদের নিরঙ্কুশ জয় এবং আরএসএস-বিজেপি সমর্থিত অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের নিরন্ধ্র পরাজয় এইরকম একটি উদাহরণ আমাদের সামনে তুলে ধরল ২০২৪ সালের আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে।
অনেকে বলতে পারেন যে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের ছাত্র সংসদ নির্বাচন এবং সমগ্র দেশের লোকসভা নির্বাচনের মত একটা বিরাট ব্যাপারের মধ্যে কোন তুলনা চলে না। হ্যাঁ, তাঁরা ঠিকই বলবেন যে তুলনা চলে না। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে যে আমাদের দেশের কেন্দ্রের বর্তমান শাসক যারা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে দেশকে হিন্দুরাষ্ট্রের দিকে চালিত করছে তাদের কাছে জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিরোধকে ধূলিসাৎ করার একটা স্বপ্ন থেকে যায়। কারণ তারা জানে যেকোন ছোট পরিসরের কিন্তু উজ্জ্বল উদাহরণ তাদের পথের কাঁটা হতে পারে মতাদর্শগত দিক থেকে। এবং একথা আবার মনে রাখতে হবে যে ফ্যাসিবাদ মতাদর্শগতভাবে নিরঙ্কুশ প্রভাব বিস্তার করতে না পারলে চূড়ান্ত সাফল্যে পৌঁছয় না। ফলে প্রতিটি ছোট পরিসরে বাম প্রতিরোধকে নস্যাৎ করার একটা প্রাণপণ প্রচেষ্টা তাদের মধ্যে থাকবেই। তা ছিলও, তারা সব ধরনের অস্ত্র ও প্রভাবকে ব্যবহার করেছিল বাম ছাত্রদের পরাস্ত করতে। আসলে বলা যেতে পারে, জেএনইউ’তে জিততে পারলে শিক্ষাক্ষেত্রে শেষ বাম দূর্গকে তারা অধিকার করে নিতে পারত। অর্থাৎ উল্টো দিক থেকে দেখলে বলতে হয় যে এভিবিপিকে রুখে দেওয়া বাম ছাত্রদের দিক থেকে ফ্যাসিবাদের উপরে আপাতত একটা মতাদর্শগত জয়ের উদাহরণ স্থাপন করার সমতূল্য।
আমরা সকলেই জানি যে লড়াইটা দীর্ঘ। এক দিনে এর মীমাংসা হবে না। কিন্তু প্রত্যেকটা ছোট ছোট মতাদর্শগত লড়াই জেতা এখানে খুব জরুরী বিষয়, কারণ এই ছোট ছোট পরিসরে বিজয় হাসিল করতে পারলে তবেই ফ্যাসিবাদকে প্রতিরোধ করার অজস্র স্তম্ভ খাড়া করা যাবে। সেইরকমই একটা স্তম্ভ আপাতত আমাদের সামনে উদাহরণ স্বরূপ নির্মাণ করলেন জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সংযুক্ত বামপন্থী ছাত্ররা। তাদের এই জয় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে একটা ঐতিহাসিক মরাল বুস্টার হিসেবে দেশের সমস্ত প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক মানুষের কাছে আগামী দিনে প্রতিপন্ন হবে। এই ‘মরাল বুস্টার’ কথাটা আমি খুব সচেতন ভাবে গুরুত্ব দিয়ে ব্যবহার করতে চাই। কারণ চারপাশে তাকিয়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি মেইনস্ট্রিম মিডিয়া যেভাবে আটঘাট বেঁধে প্রচার করছে তাতে অনেকেই ধরে নিয়েছেন যে আগামী সাধারণ নির্বাচনে ফ্যাসিবাদী শক্তিটির জয় নিশ্চিত। অর্থাৎ আমরা যারা ফ্যাসিবাদের প্রতিপক্ষে দাঁড়িয়ে আছি তারা মানসিকভাবে বেশ কিছুটা পিছিয়ে গেছি এবং যেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও পরাজয় মেনে নিয়েছি। ৩৭০ সিট ৪০০ সিটের দাবিটাকে এমনভাবে গদি মিডিয়া ঢাক ঢোল পিটিয়ে প্রচার করে চলেছে এবং ২৪x৭ কানের কাছে মন্ত্রের মতো জপ করে চলেছে যে আমরা মানসিকভাবে অনেকখানি পিছিয়ে গেছি। জেএনইউ আমাদের বুঝিয়ে দেয় বুদ্ধিদীপ্ত প্রতিরোধে ও মতাদর্শগত সঠিক অবস্থানে থাকলে ফ্যাসিবাদী শক্তিকে পরাস্ত করা সম্ভব।
আসলে যদি একটু খেয়াল করা যায় তাহলে দেখা যাবে যে মোটামুটিভাবে আরএসএস-বিজেপি ও তাদের ছাত্র সংগঠনটি ধরেই নিয়েছিল যে জেএনইউ’র ছাত্র নির্বাচনে তারা বেশ ভালো ফল করবে। এটা ধরে নিয়েই তারা ঠিক দেশের সাধারণ নির্বাচনের মুখে ছাত্র সংসদের নির্বাচন ডাকে প্রায় চার বছর পরে। তারা কতটা মরিয়া তা বোঝা যায় তাদের বিভিন্ন চাল থেকে। ‘জাহাঙ্গীর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি’ নামের একটি কুৎসিত বলিউডি ছবিকে ঠিক ওই ছাত্র সংসদ নির্বাচনের আগে তারা প্রচারের আলোয় নিয়ে এল। সেই ছবি জুড়ে বলা হলো যে জেএনইউ’র প্রতিটা কোণে কোণে নাকি ‘জাতীয়তা-বিরোধী’ বামপন্থী মতাদর্শের চাষ হয়! এমনকি এইরকম প্ররোচনামূলক কথা বলা হলো যে এই বাম-ছাত্রদের পাবলিকলি লিঞ্জ করা উচিৎ। এই রকম এক ভয়ানক ঘৃণার পরিবেশ ছড়ানো হয়েছিল বাম ছাত্রদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এবং সারাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে। ফলে একটা ভয়ংকর চাপের মুখে দাঁড়িয়ে বাম ছাত্ররা এই নির্বাচনটা লড়লেন। যেখানে রাষ্ট্র ক্ষমতায় বলীয়ান তাদের প্রতিপক্ষ দাঁত নখ বের করে আক্রমণে উদ্যত এবং মরিয়া এই নির্বাচনকে জিততে। সেই রকম একটা পরিস্থিতিতে বুকে সাহস রেখে, মস্তিষ্ককে সচল রেখে একেবারে সফল হওয়া পর্যন্ত নিখুঁত ছন্দে ঠান্ডা মাথায় কাজ করে যাওয়া খুব সোজা কাজ ছিল না। কাজটা কঠিন জেনেও বাম ছাত্ররা তা নিখুঁতভাবে করে দেখালেন। এবং হাতেনাতে সাফল্য পেয়ে তারা যেসব লোকেরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে তাদের সামনে একটা উজ্জ্বল উদাহরণ স্থাপন করলেন। সংঘবদ্ধ লড়াইয়ের মাধ্যমে যে দক্ষিণপন্থীদের প্রতিরোধ করা যায় তার একটা বড় উদাহরণ এখানে স্থাপিত হল। বাস্তব পরিস্থিতি অনুমান করে, কিছু মতভেদ সত্বেও একটা বৃহত্তর এক্য তৈরি করার মধ্যে দিয়ে জেএনইউ’তে সাফল্য এসেছে। সঠিক ব্যক্তিকে প্রার্থী করা এবং ক্যাম্পেইনের নির্দিষ্ট অভিমুখ তৈরি করা সাফল্যের প্রধান কারণ হয়ে দেখা দিল। এটাও শিক্ষাণীয় কিভাবে ফ্যাসিবাদের প্রতিরোধে বৃহত্তর ফ্রন্ট গঠন করতে হয় এবং মতাদর্শগত ঐক্যের ভিত্তিতে গড়ে তোলা কৌশলের সঠিকভাবে প্রয়োগ করে সাফল্যে পৌঁছুতে হয়।
আসলে দক্ষিণপন্থীরা বরাবরই সারা পৃথিবী জুড়েই যে কোন ধরনের ক্রিটিকাল থিংকিং এবং লিবারেল পেডাগজির বিরোধী। তারা আধুনিক উদার জ্ঞানচর্চা বিরোধী, দর্শন চর্চার বিরোধী, তারা মনে করে দর্শন চর্চার বদলে শাস্ত্র চর্চা করা উচিত। তারা তত্ত্ব বা থিওরি বিরোধী, কারণ কোন এক আশ্চর্য ধারণা থেকে তাদের মনে হয় থিওরি চর্চা আসলে পাশ্চাত্য প্রভাব! জেএনইউ মোটামুটিভাবে বলা যেতে পারে আমাদের দেশে ক্রিটিকাল থিংকিং, দার্শনিক জ্ঞান চর্চা ও তাত্ত্বিক জ্ঞান চর্চার প্রধান আধুনিক কেন্দ্র। স্বভাবতই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ধরন-ধারণ দক্ষিণপন্থীদের দুচোখের বিষ। তারা মনেপ্রাণে চায় যে এই ধরনের চর্চার পতন হোক। সেই চেষ্টাটা তারা নতুন কারিকুলাম থেকে শুরু করে নতুন শিক্ষা নীতি এবং ইউজিসি তুলে দিয়ে হেপা এবং হেকি প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে সফল করার চেষ্টা করছে। যদি জেএনইউ’র এবারের নির্বাচনে বামপন্থী ছাত্রদের পতন ঘটতো তাহলে এদেশে ক্রিটিকাল থিংকিং এবং আধুনিক জ্ঞানচর্চারও সিম্বলিক পতন ঘটতো। কিন্তু বাস্তবে সেই পতন ঘটেনি। সে পতন রোধ করা গেছে এবং যারা সেই পতনের জন্য উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছিল তাদের হতাশ করে দেওয়া আপাতত কিছুক্ষণের জন্য হলেও সম্ভব হয়েছে। ফলে সারা ভারতেই বিদ্যাচর্চার প্রধান কেন্দ্রগুলির কাছে, বিশেষত যারা রাজনৈতিক দর্শন, ক্রিটিকাল থিংকিং ও আধুনিকতার বিবিধ চর্চা করে থাকেন তাদের কাছে একটা বিরাট আশার বার্তা পৌঁছুলো। এই সম্মিলিত প্রতিরোধের সাফল্য তাই খুব কম নয়।
সবচেয়ে বড় কথা সর্বশক্তি প্রয়োগ করেও সরকারি ব্যবস্থা ও তাদের পোষা মিডিয়ার সাহায্য নিয়েও আরএসএস-বিজেপি-এভিবিপি বামেদের হাতে পরাজিত হলো, এটা বুঝিয়ে দেয় মতাদর্শ ও কৌশলের সঠিক সমন্বয় করতে পারলে ওদের পরাজয় ঘটানো সম্ভব। আরো একটা কথা, নির্বাচনের ফল বেরোনোর দিন গণনা শুরু হওয়া থেকে বেশ কয়েক ঘন্টা গোদি মিডিয়া সারা ভারতবর্ষে আপডেট দিচ্ছিল যে জেএনইউ এবিভিপি’র করায়ত্ত হতে চলেছে।
এবং সেই প্রচারে যারা হতাশ হয়েছিলেন তারা সন্ধ্যে উত্তীর্ণ হয়ে রাত বাড়তেই বুঝলেন যে গদি মিডিয়া আসলে অসার ও চক্রান্তকারী। তারা এটাও বোধহয় বুঝলেন যে গোদি মিডিয়ার খবরে প্রভাবিত হয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে বসে থাকাটা এক ধরনের মূর্খামি। এই সব কিছুই ছাত্র সংসদের নির্বাচনে বাম ছাত্রদের জয় আমাদের সামনে এনে দিল। এই জয় প্রমাণ করল গদি মিডিয়ার দ্বারা প্রভাবিত হওয়া যদি আমরা বন্ধ করতে পারি তাহলে হতাশা কাটিয়ে উঠে অন্তত লড়াইয়ের ময়দানে সর্বশক্তি দিয়ে আমরা দাঁড়াতে পারবো। শেষ বাক্য বলব, গোদি মিডিয়া’য় নয়, জেএনইউ’তে বিশ্বাস রাখুন, মানুষের প্রজ্ঞা এবং অভিজ্ঞতার ওপর ভরসা রাখুন।