সকাল নটার উজ্জ্বল সুর্যালোকে হাভানার রিভেরা হোটেলের অলিন্দে বসে আমরা প্রাতরাশ করছিলাম। ঠিক সেই সময় একটা বিশাল ঢেউ সমুদ্র-বাঁধ বরাবর রাস্তা এবং ফুটপাতে রাখা কিছু গাড়িকে শূন্যে ছুঁড়ে দিল এবং একটাকে হোটেলের গায়ে পিষে দিল। সেটা ছিল যেন একটা ডিনামাইটের বিস্ফোরণ যা অট্টালিকাটার কুড়িটা তলায় আতঙ্ক বপন করল এবং প্রবেশমুখের অতিকায় জানলাটাকে ধূলিসাৎ করে দিল। বারান্দার অনেক পর্যটক আসবাবপত্র সমেত শূন্যে নিক্ষেপিত হল। কাচের শিলাবৃষ্টিতে কেউ কেউ আহত হল। ঢেউটা নিশ্চই দানবীয় হয়ে থাকবে কারণ সমুদ্র-বাঁধ এবং হোটেলের মধ্যেকার দুমুখো রাস্তা লঙ্ঘন করার পরও জানলাটা ধ্বংস করে দেওয়ার মতো যথেষ্ট শক্তি সেটার মধ্যে মজুত ছিল।
দমকলের সাহায্যে হাসিখুশী কিউবান স্বেচ্ছাসেবকরা ছয় ঘন্টার মধ্যে সমস্ত আবর্জনা পরিষ্কার করে সমুদ্রে যাওয়ার রাস্তাটা রুদ্ধ করে দিল এবং সেটার পরিবর্তে আরেকটা স্থাপন করল। সব কিছু আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল। সকালবেলার পিষে যাওয়া গাড়িটা নিয়ে কারো কোন মাথাব্যথা ছিল না কারণ সবাই ধরেই নিয়েছিল সেটা ফুটপাতে দাঁড় করান ছিল। কিন্তু ক্রেন দিয়ে সেটাকে যখন চাপবন্দি জায়গাটা থেকে ছাড়িয়ে আনা হল দেখা গেল স্টিয়ারিং এর পেছনে সিট বেল্ট দ্বারা সুরক্ষিত এক মহিলার দেহ। আঘাতটা এতই নৃশংস ছিল যে তার শরীরের একটা হাড়ও আস্ত ছিল না। তার মুখ থেঁতলে গেছে, বুট ফেটে চৌচির, জামাকাপড় ফালাফালা। তার আঙুলে সরিসৃপ আকৃতির একটা সোনার আংটি যাতে একটা পান্না ঝিলিক মারছে। পুলিশ প্রমাণ করল সে নতুন পর্তুগিজ রাষ্ট্রদূত এবং তাঁর স্ত্রীর গৃহ-তত্ত্বাবধায়ক। হাভানায় সে দু সপ্তাহ আগে এসেছে এবং সে দিন সকালে একটা নতুন গাড়ি নিয়ে বাজারে যাচ্ছিল। সংবাদপত্রে তার নাম পড়ে আমার কোন হেলদোল হয়নি, কিন্তু পান্না শোভিত সরিসৃপ আকৃতির আংটি আমার কৌতূহল উদ্রেক করল। যদিও আমি জানতে পারলাম না কোন আঙুলে সেটা পড়া ছিল।
এই তথ্যটা গূরুত্বপুর্ণ। কারণ আমার ভয় হয় সে এক অবিস্মরণীয় মহিলা যার নাম আমি কোন দিন জানতে পারিনি এবং যে ডান হাতের তর্জনীতে একই ধরণের আংটি পড়ত যা পুরনো দিনে আজকালের চেয়ে আরও বেশি বেমানান ছিল। চৌত্রিশ বছর আগে ভিয়েনায় তার সাথে আমার দেখা হয়েছিল। একটা শুড়িঁখানায় সে আলুসেদ্ধ দিয়ে সসেজ খাচ্ছিল এবং ফেনিল বিয়ার পান করছিল। সেটা ছিল লাতিন আমেরিকার ছাত্রদের একটা আড্ডাখানা। সেদিন সকালে আমি রোম থেকে এসেছি। তার সমৃদ্ধ, সপ্রানো বুক, কাঁটালতার মতো কোটের গলাবন্ধনী এবং সরিসৃপ আকৃতির মিশরীয় আংটি আমার মধ্যে যে উষ্ণতা সৃষ্টি করেছিল তা এখনো মনে আছে। একটা ধাতব উচ্চারণে, বিনা নিঃশ্বাসে সে একটা মামুলি স্তরের স্প্যানিশ ভাষা বলছিল। আর আমি কিনা ভেবেছিলাম ঐ লম্বা কাঠের টেবিলে সেই একমাত্র অস্ট্রিয়। কিন্তু না। তার জন্ম কলম্বিয়ায় এবং দুই যুদ্ধের মধ্যবর্ত্তী সময়ে সঙ্গীত ও বাচিক শিক্ষা নিতে সে অস্ট্রিয়ায় এসেছিল। তখন সে সবে বাল্যকাল পেরিয়েছে। এখন তার বয়স ত্রিশ, কিন্তু সময় তার শরীরে থাবা বসিয়েছে। কোন দিনও সুশ্রী ছিল না সে এবং সময়ের আগেই সে বুড়িয়ে গেছে। কিন্তু সে ছিল এক আকর্ষণীয় মানুষ আবার একই সাথে এক বিভীষিকা।
ভিয়েনা তখনও এক সাম্রাজ্য নগরী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উচ্ছিষ্ট দুটো আপসহীন দুনিয়ার মাঝামাঝি অবস্থান হওয়ার কারণে সেটা ছিল কালোবাজারি আর চরবৃত্তির স্বর্গভূমি। আমি আমার পলাতক স্বদেশবাসীর জন্য এর চেয়ে আরও মানানসই জায়গা কল্পনাই করতে পারতাম না। তার মুলুকের প্রতি আনুগত্যের কারণে সে ছাত্রদের শুঁড়িখানায় খানাপিনা করে কারণ তার টেবিলের বন্ধুদের চাহিদা মেটানর জন্য তার যথেষ্ট সংগতি ছিল। সে কখনো তার নিজের নাম বলেনি। ভিয়েনায় অবস্থিত আমরা লাতিন আমেরিকার ছাত্ররা আমাদের আবিষ্কৃত দাঁতভাঙা জার্মান সম্বোধন দিয়েই তাকে জানতাম---ফ্রাউ ফ্রিডা। আলাপ হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি উচ্ছসিত তাচ্ছিল্যের সাথে তাকে জিজ্ঞাসা করে ফেললাম কি করে সে কুইন্দির ঝড়ো শৃঙ্গ ছেড়ে এত দূর, স্বতন্ত্র একটা জগতে এসে পড়ল। সে বিধ্বংসী একটা উত্তর দিল। “আমি স্বপ্ন ফেরি করি।“
বাস্তবে সেটাই তার একমাত্র পেশা। কালদাসের এক বর্ধিষ্ণু দোকানদারের এগারোটা সন্তানের তৃতীয় সে। কথা বলতে পারার সাথে সাথেই সে তার পরিবারে প্রাতরাশের পূর্বে স্বপ্ন বিবৃত করার চমৎকার রীতি প্রচলন করে। এটাই মোক্ষম সময় যখন অমোঘ বাণীগুলো সবচেয়ে খাঁটি রূপে সংরক্ষিত থাকে। যখন তার বয়স সাত সে স্বপ্ন দেখে তার ভাই বন্যায় ভেসে যাচ্ছে। সাঁতার কাটা ছেলেটার বিশেষ শখ ছিল। কিন্তু ধর্মীয় কুসংস্কারের কারণে তার মা খাদের জলাশয়ে তার সাঁতার কাটা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু ফ্রাউ ফ্রিডার ভবিষ্যৎ বাণী করার নিজস্ব পদ্ধতি ছিল।
“স্বপ্নটার অর্থ এই নয় যে সে ডুবে যাবে,” সে বলে। “কিন্তু তার মিষ্টি খাওয়া উচিত নয়।“ তার এই ব্যখ্যা পাঁচ বছরের ছেলেটার কাছে প্রায় একটা অভিশাপের মতো কারণ রবিবারের সুস্বাদু ভালোমন্দ ছাড়া সে ভাবতেই পারত না। কন্যার অমোঘ প্রতিভা সম্পর্কে নিঃসংশয় তার মা কঠোর হাতে অনুরূপ আদেশ জারি করল। কিন্তু তার প্রথম অসতর্ক মুহুর্তে লুকিয়ে মিছরি খেতে গিয়ে ছেলেটার গলা আটকে গেল এবং কোনভাবেই তাকে বাঁচান গেল না।
এই প্রতিভা নিয়ে সে জীবিকা অর্জন করতে পারবে সেটা ফ্রাউ ফ্রিডা কোন দিনও ভাবেনি। কিন্তু ভিয়েনার নিষ্ঠুর ঠান্ডায় জীবন অতিবাহিত করা তার পক্ষে দুঃসহ হয়ে পড়ল। তারপর সে বসবাস করার জন্য প্রথম যে বাড়িটা পছন্দ হল সেখানে কাজের খোঁজ করল। যখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হল সে কি কাজ পারে সে নিপাট সত্যটাই বললঃ “আমি স্বপ্ন দেখি”। বাড়ির গৃহিণীকে তার শুধু একটা ছোটখাটো ব্যখ্যা দেওয়ার দরকার হল এবং তাকে এমন একটা বেতনে নিযুক্ত করা হল যাতে তার কোন রকমে দিন গুজরান হয়। কিন্তু সে একটা ছিমছাম ঘর পেল এবং দিনে তিনবার খাবার। অবশ্যই প্রাতরাশ যখন পরিবার একত্রে বসে প্রতিটি সদস্য তাদের আশু ভবিষ্যৎ জেনে নিত। পরিবারে বাবা একজন পরিশীলিত বিনিয়োগকারি, মা এক প্রফুল্ল নারী যে রোমান্টিক চেম্বার সংগীতে আসক্ত এবং তাদের এগারো ও নয় বছরের দুটি সন্তান। তারা প্রত্যেকে ধার্মিক এবং আদ্যিকালের কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। ফ্রাউ ফ্রিডাকে পেয়ে তারা আপ্লুত। তার একমাত্র দায় তার স্বপ্নের মাধ্যমে পরিবারের দৈনন্দিন নিয়তির রহস্যোদ্ধার করা।
দীর্ঘ সময় ধরে সে তার কাজ নিষ্ঠা সহকারে করে। বিশেষ করে যুদ্ধের বছরগুলোতে যখন বাস্তব দুঃস্বপ্নের চেয়েও হানিকর ছিল। প্রাতরাশে শুধুমাত্র সেই সিদ্ধান্ত নিত প্রত্যেকে সেই দিন কি কাজ করবে এবং কি ভাবে করবে। এই ভাবে বাড়িতে তার ভবিষ্যৎ বাণী সম্পুর্ণ নির্ণায়ক হয়ে গেল। পরিবারের ওপরে তার অবাধ কর্ত্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হল। এমন কি ক্ষীণতম শ্বাস ও নেওয়া হতো তারই নির্দেশে। আমি ভিয়েনায় থাকাকালীন বাড়ির কর্তার মৃত্যু হয়। মানুষটার এই কৃতজ্ঞতা ছিল যে সে সম্পত্তির একটা অংশ তার জন্য রেখে যায়। শর্ত্ত ছিল তাকে শুধু পরিবারের জন্য স্বপ্ন দেখে যেতে হবে যতদিন না তার ভান্ডার নিঃশেষিত হয়ে যায়।
আমি ভিয়েনায় এক মাসেরও বেশি ছিলাম। অন্য ছাত্রদের দুঃস্থ অবস্থার সঙ্গী ছিলাম এবং অর্থের জন্য অপেক্ষা করছিলাম যা কোনদিনই এসে পৌঁছায়নি। আমাদের দারিদ্র-পীড়িত অবস্থায় শুঁড়িখানায় ফ্রাউ ফ্রিডার অপ্রত্যাশিত আগমনগুলো এবং তার বদান্যতা উৎসবের মতো ছিল। এক রাতে বিয়ারের প্রবল ঘোরে সে প্রত্যয়ের সাথে আমার কানে ফিসফিস করল যাতে আমার দম ফেলার ফুরসুত রইল না।
“আমি এলাম শুধুমাত্র তোমাকে বলার জন্য যে কাল রাতে আমি তোমাকে স্বপ্নে দেখেছি,” সে জানাল। “তুমি অবিলম্বে ভিয়েনা ছেড়ে চলে যাও এবং পাঁচ বছরের আগে আর এসো না”।
তার কথায় এতটাই প্রত্যয় ছিল যে আমি সেই রাতেই রোমের শেষ ট্রেন ধরলাম। আমার নিজের ক্ষেত্রে বলতে পারি যে আমি তার কথাতে প্রবল ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলাম। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে আমি এমন একটা বিপর্যয় থেকে বেঁচে গেছি যে রকমটা জীবনে কোনদিন প্রত্যক্ষ করিনি। আমি আজ অবধি ভিয়েনায় ফিরে যাইনি।
হাভানার দুর্ঘটনার আগে বার্সেলোনায় ফ্রাউ ফ্রিডার সাথে এত অপ্রত্যাশিত ও আকস্মিক ভাবে আমার দেখা হয়েছিল যে সেটা প্রায় একটা রহস্যের মতো মনে হয়েছিল। এটা হয়েছিল যে দিন পাবলো নেরুদা গৃহযুদ্ধের পর প্রথম স্পেনের মাটিতে পদার্পণ করেছিলেন। ভালপারাইসো যেতে লম্বা সমুদ্র সফরে সেটা একটা সাময়িক বিরাম ছিল। বড় সওদার খোঁজে তিনি সারা সকালটা পুরনো বইয়ের দোকানে শিকার করে বেড়ালেন। অবশেষে পোর্তারে ছেঁড়া বাঁধাইয়ের এক পুরনো ঝুরঝুরে পুঁথি কিনলেন যেটার দাম রেঙ্গুনের দূতাবাসে তাঁর দু মাসের বেতনের সমান। তিনি একটা পঙ্গু হস্তীর মতো জনতার মাঝে বিচরণ করলেন। যেটাই দেখলেন সেটার আভ্যন্তরীণ কারিগরী সম্পর্কে শিশুসুলভ কৌতূহল তাঁর। পৃথিবীটা যেন তাঁর কাছে একটা বিশাল দম দেওয়া খেলনা যেটার সহায়তায় জীবন নিজেকে আবিষ্কার করছে।
রেনেসাঁ পোপের সাথে নুন্যতম সাদৃশ্য আছে এরকম কাউকে আগে আমি কখনও দেখিনি। তিনি ছিলেন ভোজনবিলাসী এবং পরিশীলিত। অনির্বায ভাবে খাওয়ার টেবিলে তিনিই কর্তৃত্ত্ব করতেন। স্ত্রী মাতিলদে তাঁর গলায় একটা লালাপোষ ঝুলিয়ে দিতেন যেটা খাওয়ার টেবিলের চেয়ে সেলুনের সাথে বেশি মানানসই। এটাই একমাত্র উপায় ছিল যাতে তিনি সসে অবগাহন না করেন। কারভাল্রাসে সেই দিনটা স্মরণীয়। তিনি শল্যচিকিৎসকের সূক্ষ্মতায় তিনটে পুরো গলদা চিংড়ি কাটাঁছেঁড়া করলেন। একই সাথে তিনি প্রত্যেকের প্লেট চোখ দিয়ে গলাধঃকরণ করলেন এবং এত স্ফূর্তি নিয়ে সবার থেকে একটু করে আস্বাদন করলেন যে খাওয়ার ইচ্ছাটাই সংক্রামক হয়ে গেল--------গ্যালিশিয়ার শামুক, কান্তাব্রিয়ার ঝিনুক, আলিকান্তের চিংড়ি, কস্তা ব্রাভার সি কিউকাম্বার। একই সাথে ফরাসীদের মতো অন্যান্য ঘরানার সুস্বাদু খাবার নিয়ে বকবক করে গেলেন। বিশেষ করে চিলির প্রাগৈতিহাসিক শেলফিস যেটা তিনি নিজের হৃদয়ে বহন করেন। হঠাৎ তিনি থমকে গেলেন। গলদা চিংড়ির শুঁড়টা ঠিকঠাক করলেন এবং চাপা স্বরে আমায় বললেনঃ “আমার পেছনে কেউ আছে যে আমার দিকে সারা ক্ষণ তাকিয়ে আছে।“
সত্যিই তো, আমি ওনার কাঁধের ওপর দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম। তিনটে টেবিল ছাড়িয়ে সেকেলে পশমের টুপী এবং বেগুনী স্কার্ফ পরিহিতা এক বেপরোয়া মহিলা বসে। তার খাওয়ার কোন তাড়া নেই এবং সে স্থির দৃষ্টিতে ওনার দিকে তাকিয়ে। আমি তৎক্ষণাৎ তাকে চিনে গেছি। তার বয়স হয়েছে, মোটা হয়ে গেছে। কিন্তু সে ফ্রাউ ফ্রিডা, তার তর্জনিতে সর্পাকৃতি আংটি।
নেরুদা এবং তাঁর স্ত্রীর সাথে একই জাহাজে সে নেপলস থেকে যাত্রা করেছে কিন্তু পরস্পরের সাথে দেখা হয়নি। আমরা তাকে আমাদের টেবিলে কফি খেতে আমন্ত্রণ জানালাম। কবিকে বিস্মিত করার জন্য আমি তাকে তার স্বপ্ন নিয়ে কথা বলতে উৎসাহ দিলাম। তিনি কোন আমলই দিলেন না। শুরুতেই তিনি বলে দিলেন যে তিনি কোন ভবিষ্যৎদর্শী স্বপ্নে বিশ্বাসই করেন না। “একমাত্র কবিতাই অতীন্দ্রিয়,” তিনি ঘোষণা করলেন।
মধ্যাহ্নভোজের পর রাম্বলার চারিপাশে অনির্বায পায়চারীর সময় আমি ফ্রাউ ফ্রিডার পিছু নিলাম যাতে অন্য কারও অগোচরে আমি তার সাথে আমাদের স্মৃতিগুলো ঝালিয়ে নিতে পারি। সে আমায় বলল যে অস্ট্রিয়ার সম্পত্তি বেচে দিয়ে পর্ত্তুগালের ওপোর্তুতে সে এখন অবসর জীবন যাপন করছে। সেখানে সে একটা বাড়িতে থাকে যেটাকে সে টিলার ওপরে একটা নকল দুর্গের সাথে তুলনা করল। সেই উচ্চতা থেকে দিগন্তবিস্তৃত মহাসাগরের ওপারে আমেরিকা দেখা যায়। সে আমাকে খুলে কিছু বলেনি। কিন্তু তার কথাবার্তায় এটা পরিষ্কার যে একটার পর একটা স্বপ্নের মায়াজাল বুনে তার অসন্দিগ্ধ পৃষ্টপোষকদের ভিয়েনার সমস্ত সম্পত্তি সে দখল করে নিয়েছিল। সেটা আমাকে অবাক করে না। কারণ আমার সব সময় মনে হয়েছে তার স্বপ্নগুলো শুধুমাত্র বেঁচে থাকার একটা ফন্দি। আমি সেটা বললামও তাকে।
বাঁধনছাড়া হাসিতে ফেটে পড়ল সে। “তুমি একই রকম নির্লজ্জ,” সে বলল। ব্যস ঐ টুকুই। কারণ বাকিরা তখন নেরুদার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে পড়েছিল। তিনি তখন রাম্বলা দ্য লস পাহারসে টিয়াদের সাথে চিলির গালাগালিতে কথা বলছিলেন। যখন আমরা নিজেদের কথায় ফিরে এলাম, ফ্রাউ ফ্রিডা বিষয়টা থেকে সরে গেল।
“যাই হোক তুমি এখন ভিয়েনায় ফিরে যেতে পার,” সে জানাল।
তখন আমার খেয়াল হল তার সাথে দেখা হওয়ার পর তেরোটা বছর কেটে গেছে।
“যদি তোমার স্বপ্নটা মিথ্যাও হয়, আমি আর ফিরে যাব না,” আমি বলে দিলাম। “বলা তো যায় না।“
তিনটের সময় আমরা তাকে বিদায় জানিয়ে নেরুদাকে তাঁর দ্বিপ্রাহরিক নিদ্রায় সঙ্গ দিতে চলে গেলাম। প্রথমে বাড়িতে একটা গুরুগম্ভীর প্রস্তুতি নিতে হল। এটা একটা জাপানিজ চা অনুষ্ঠানের সমগোত্রীয়। কিছু জানলা খোলা হল এবং অন্যান্য বন্ধ যাতে সঠিক উষ্ণতা অর্জন করা যায়। আর একটা বিশেষ দিক থেকে বিশেষ আলো আর সম্পুর্ণ নিঃস্তব্ধতা। নেরুদা অবিলম্বে ঘুমিয়ে পড়লেন। আবার যখন আমরা আশাই করিনি, ঠিক দশ মিনিট বাদে উঠে পড়লেন যেরকম ঠিক শিশুরা করে। বসার ঘরে এলেন একদম তরতাজা। তাঁর গালে বালিশের ওয়াড়ের মনোগ্রামের ছাপ।
“আমি যে মহিলা স্বপ্ন দেখে তাকে স্বপ্নে দেখলাম,” উনি বললেন।
মাতিলদে স্বপ্নটা জানতে চাইল।
“আমি স্বপ্ন দেখলাম সে আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছে।“
“এটা তো পুরো বোর্হেস,” আমি বলে উঠলাম।
হতাশ হয়ে তিনি আমার দিকে তাকালেন।
“উনি কি ইতিমধ্যেই এটা লিখে ফেলেছেন?”
“যদি না লিখেও থাকেন তাহলে কোন এক সময় লিখবেন। তাঁর কোন একটা ভুলভুলাইয়ার মধ্যে এটা হবে একটা।“
সন্ধ্যা ছটার সময় জাহাজে উঠেই নেরুদা আমাদের বিদায় জানালেন। ওনার বই উৎসর্গের জন্য উনি যে সবুজ কালি দিয়ে ফুল, মাছ, পাখি আঁকেন, সেই একই কালি দিয়ে একটা বিচ্ছিন্ন টেবিলে বসে ঝর্ণার মতো কাব্য রচনা শুরু করলেন। প্রথম ‘অল আশোর’ ঘোষণার সাথে সাথে আমরা ফ্রাউ ফ্রিডার খোঁজ করলাম। ঠিক যখন আমরা প্রায় বিদায় না জানিয়ে চলে যাচ্ছিলাম, তাকে আমরা পর্যটকদের ডেকে পেয়ে গেলাম। সেও দূপুরে ঘুমিয়েছিল।
“আমি কবিকে স্বপ্নে দেখলাম,” সে জানাল।
হতভম্ব হয়ে আমি তার স্বপ্নটা জানতে চাইলাম।
“আমি স্বপ্নে দেখলাম উনি আমায় স্বপ্নে দেখছেন,” সে বলল এবং আমার বিস্মিত চাহনি তাকে বিব্রত করল। “কী আশা করেছিলে তুমি? সমস্ত স্বপ্নের মধ্যে চুপিসাড়ে একটা গলে যায় বাস্তবের সাথে যেটার কোন সম্পর্ক নেই।“
আর কখনও তার সাথে দেখা হয়নি আমার। কখনও ভাবিনি তার সম্পর্কে যতদিন না হাভানা রিভেরা দূর্ঘটনায় মৃত মহিলার আঙুলে সর্পাকৃতি আংটির কথা শুনলাম। কয়েক মাস বাদে দূতাবাসের অর্ভথ্যনায় পর্তুগিজ রাষ্ট্রদূতের সাথে যখন দেখা হয়ে গেল তখন জিজ্ঞাসা করার লোভ সামলাতে পারলাম না। রাষ্ট্রদূত দারুণ উৎসাহিত হলেন এবং প্রচুর প্রশংসা করলেন তার সম্পর্কে। “আপনি ভাবতে পারবেন না সে কি অসাধারণ ছিল,” এবং যোগ করলেন, “আপনার কর্ত্তব্য ওনাকে নিয়ে একটা গল্প লেখা”। একই মুগ্ধতায় অবাক করা সব খুঁটিনাটি তিনি বলে যেতে লাগলেন। কিন্তু সেই অব্যর্থ প্রমাণটা ছাড়া যেটা আমাকে চূড়ান্ত সমাপনে পৌছাতে সাহায্য করবে।
“মোদ্দা কথা,” শেষমেষ আমি জিজ্ঞাসাই করে ফেললাম, “সে ঠিক কি করতো”।
“কিছুই না,” নিশ্চিত নির্লিপ্ততার সাথে তিনি বললেন।
“সে স্বপ্ন দেখত”।