হুতোম অনেকদিন ঘাপটি মেরে আচেন। বাবু বিবিরো ফি দিন এত রঙ্গ কচ্ছেন, কোনটি ছেড়ে কোনটি নিয়ে নকশা হবে মনস্থ করা শক্ত হয়ে পড়েচে। তবে সম্পাদককে ফাঁকি দেয়া বেশিদিন সম্ভবে না। গার্লফ্রেন্ডের জন্যে মিসেস হতে, আর নেতার জন্যে পাব্লিক হতে বারে বারে গা ঢাকা দিয়ে ও কাজে সে এম্নি দড় হয়েচে যে হুতোম পাতালে গেলেও পৌঁছে যাচ্চে, সিঙ্ঘু বা কতদূর?
সাড়ে তিন ডিগ্রী রাতের বেলায় চাষারা আগুন ঘিরে বসে দিব্য গান গাইচে, আপনাদের হুতোম মাথা দোলাচ্চেন আর উরুতে তাল ঠুকচেন। সম্পাদকের বলিহারি চোক। তারি মদ্যে ঠিক দেকতে পেলে। বল্লে সরে আসতে, ইম্পর্ট্যান্ট কতা আচে। চাষাদের সুমুখে সে কতা বলবে না। বলে, মারবেন নাকি? হাতে পায় ধরে এ চত্বরে ঢুকতে হয়েচে। দালাল বলে ফেরত পাঠিয়ে দিচ্চিল। কী বলচি শুনে ফের চটে গেলে? আমার চৌদ্দ পুরুষে কেউ চাষাভুষোর পায় ধরেনি, আপনার জন্যে এটিও কত্তে হল। পিঠ চাপড়ে বল্লেম, বেশ করেচ, পুণ্যি হবে। চা ওয়ালা প্রাইম মিনিস্টারের চরণে দিনরাত নৈবেদ্য দিচ্চ, চাষার পায় ধত্তে পারবে না এ বা কি কতা? সে যা হোক, একন ঝটপট কতাটি বলে ফ্যালো। দিব্য গানটি শুনছিলেম, রসভঙ্গ কল্লে।
তার নিবেদনটি জরুরী তলব দেয়ার মতন মোটেই নয়। নকশা চাইতে এসেচে। তা লিকতে কি আমার অসাধ? বল্লেম, এই তো, চাষাদের মুভমেন্ট নিয়ে লিকে দিচ্চি। এ ভারী আমোদের কাল। চাষারা পিৎজা খাচ্চে দেকে সরকার বাহাদুরের পক্ষ বলচেন, এইয়ো, এরা মোটে গরীব চাষা নয়। খামোকা গোল কত্তে এসেচে। আমরা গরীব চাষার জন্যে ল ফর্ম করেচি, তাই এদের গা পিত্তি জ্বলচে। এদিকে পথে বসে উনুনে রুটি বানিয়ে খাচ্চে যে চাষারা তাদের দেকতে পাচ্চেন না। দেকতে পেলে ফের নতুন এক্সপ্লানেশন খুঁজতে হবে। খালিস্তানি দিয়ে ম্যানেজ করার চেষ্টা হয়েচিল, শুনে ভদ্দরলোক পঞ্জাবি অবধি ক্ষেপে উঠচেন দেকে চুপ মেরে গ্যাচেন। তারপর দ্যাকো, গোড়ায় সরকার বাহাদুরের খাবার চাষারা খাচ্চিল না, একন মিনিস্টার আর বড়বাবুরাও খাচ্চেন না। তেনারাও চাষাদের খাবার খাচ্চেন। চাষারা দুই বাবুর সওদা বয়কট কত্তে বলেচে, একন আবার কারা য্যানো তেনাদের টিকি ধরে টানাটানি কত্তে লেগেচে। শুনচি কিচু টিকি কাটাও হয়েচে। আহা, সে ভণ্ড বামুনগুলোর ৫১ টিকির কতা মনে পড়ে বেজায় নস্ট্যালজিক হয়ে পড়চি হে! তা এসব নিয়েই লিকে দি?
সম্পাদক আমল দিলে না। বল্লে এসব ইস্যু পাব্লিক খাবে না।
তবে কী খাবে?
রবীন্দ্রনাথ খাবে।
আঃ! পোপ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর দি ফার্স্টের বেস্ট পোয়ের পাছে তোমরা ফের লেগেচ? তিনি নয় পোটকা সাধু ছিলেন, রবি ঠাকুর কী দোষ কল্ল? তোমাদের ভাষাটি মডার্ন করে দিয়েচে। বিদ্যাসাগরমশায়ের থেকে তো কিচ্চুটি শেখোনি। ইশকুলের একখানা ইঁট গাঁথতে দশ জনে ঝগড়া কর। আর রবি ঠাকুর আস্ত ইউনিভার্সিটি বানিয়ে গ্যাচে। যেসব গান কোবতে নিয়ে তোমরা দুলে দুলে আদিখ্যেতা কর সেগুলির কতা আর বল্লেম না। একন আবার তার থেকে কী চাও হে? শ্মশান যাবার পথে যে কটি চুল দাড়ি ওপড়ানো হয়েচিল তাতে মন ওঠেনি? আরো কটি চাই নাকি?
সম্পাদক বল্লে, আপনি দেকচি দিল্লী এসে বাংলার খবর কিচু রাখচেন না। কলকেতায় রবি ঠাকুরকে নিয়ে মেলা গোলমাল। গাঁটকাটাবাবু রবি ঠাকুরের ইউনিভার্সিটি গেলেন,স্টুডেন্টরো বল্লে রবি ঠাকুর নর্থ পোল হলে ইনি সাউথ পোল। যদি গাঁটকাটাবাবুর সুমুখেই বলে বসে, তাই কজনকে নাকি তালা দিয়ে রাখা হয়েচিল। ওদিকে উপাচায্যি মশায় কতা নেই বাত্তা নেই, দুম করে বলচেন অমর্ত্য সেনের বাড়ীটি নাকি ইল্লিগাল জমিতে। তাই বাঙালী বেজায় চটেচে। বলচে এসব আমাদের কালচারের উপরে বোমাবাজি। বাঙালীর দিদি রবি ঠাকুরের ফটো নিয়ে পথে নেমে পড়েচেন। রবি ঠাকুর একন বাংলার ভোটে সবচে বড় ফ্যাক্টর। মেজ ফ্যাক্টর অমর্ত্য সেন। তেনার বাড়ী, তেনার বিবাহ। তালে বুঝচেন তো? ইস্যু হল কালচার। ওইটে নিয়ে নকশা কল্লে হ্যাংলা রিপোর্টারে যেম্নি হামলে পড়ে নেতার উচ্ছিষ্ট পপুলারিটি খায়, পাব্লিক তেম্নি আপনার নকশা খাবে।
শুনে হুতোম হেসে বাঁচেন না। চাষাদের মোবাইলে কদিন প্রধান সেবকের মুখ দেকে আশা জেগেছিল তিনি দাড়ি লম্বা কচ্ছেন কাঁটাতারের বদলে দাড়ি বেঁঁধে চীন দেশের হাত হতে দেশের বর্ডার রক্ষে কত্তে। এইবার পেত্যয় হল তেনার রবি ঠাকুরের ইনকার্নেশন হবার সাধ হয়েচে। বাবুর সাধ্য কী জানিনে, সাধের অভাব নেই। তা না হবে কেন? তিনি কি রবি ঠাকুরের চে কম যান? সে ইউনিভার্সিটি বানিয়েচিল, ইনি ইউনিভার্সিটির নূতন সাবজেক্ট বানিয়েচেন। এন্টায়ার পোলিটিকাল সায়েন্স। রবি ঠাকুর চুল না পাকতে বিপত্নীক হয়েচিল, ইনি গোঁপ না গজাতে ডিভোর্সি হয়েচেন। এ বেলা চাট্টি বেসুরো গান, এক ডজন ছন্দের পিণ্ডি চটকানো কোবতে লিকলেই সাক্ষাৎ রবি।
তবে কিনা বাঙালীর কালচারে বোমাবাজির নালিশ শুনে বেশি আমোদ পেলেম। কালচার কাল ছিল, আজ খালি। বাঙালী হল গিয়ে সুইসাইড বোম্বার। ত্রিশ-চল্লিশ সন যাবৎ এম্নি মুঠো মুঠো বোম ফেলেচে যে রবি ঠাকুর কেবলি ছবি হয়ে গ্যাচে। স্বর্গে থাকতে দেখতেম সে মদ্যে মদ্যে সায়টিকার বেদনায় বুড়ো হাবড়ায় যেমন কাতরায় তেম্নি কাতরাত। একদিন শুধোলেম, কী হে ছোকরা! শরীর গেল বেদনা গেল না? বেচারি ব্যাজার মুখে বল্লে, এ বেদনা শরীরের নয় হুতোমবাবু, আত্মার। আমার আত্মাটি তো আমার গানে। মেগাসিরিয়ালে কতায় না কতায় হিন্দি সিনেমার গানের ঘাড়ে ঘাড়েই আমার গান বাজাচ্চে। ভরদুপুরে সিগনালে ‘আজ জ্যোৎস্নারাতে’, রাতের বেলা ‘তুমি ডাক দিয়েছ কোন সকালে’। উফ! বড় কষ্ট! আবার কে এক গায়ক হয়েচে, সে নাকি আমার গানে নিত্যি নূতন কতা বসিয়ে গায়। লেকাপড়া করা লোকে বলচে সে নাকি তার রাইট। অন্যের লেকায় কলম চালানোর কবে রাইট হল, হুতোমবাবু? কোন খবর আচে?
ওসব কেলেঙ্কারির সময় কারো কালচারের কতা মনে পড়েনি, এইবার কালচার বেরিয়েচে। বাবুরো অ্যাদ্দিন র্যালায় আমার কালচার আমি পায় কাটি কি মাতায় কাটি কচ্ছিলেন। হিজিবিজিকে কাব্যি বলে ডিলিট দেয়া হচ্চিল, গাঁটকাটাদের নেত্যকে শূদ্র জাগরণ ডিগ্রী দিচ্চিলেন, ফুটো নায়ককে মহানায়ক আর টোকা মুখুজ্জেকে সত্যজিৎ রায় উপাধি দেয়া চলছিল। একন শিয়রে শমন, ছোটলোকেদের হাত আচে তো কাজ নেই, কাজ আচে তো হাত নেই, হাত আচে তো ভাত নেই। বাবু বিবিদের সব আচে, তাই কালচার নে কান্নাকাটি কচ্ছেন আর রবি ঠাকুরের কাচে বিপদে মোরে রক্ষে কর, এই প্রার্থনা। ইনকার্নেশনবাবুর চ্যালারা অমর্ত্য সেনের গিন্নীসুমারি কচ্ছেন আর কালচারবাবু-বিবিরো ভাবচেন বাঙালী তেনার অপমানের মুখের মতন জবাব দেবে একন। আম বাঙালী মাতা চুলকে ভাবচে বুড়োটা কে রে? গৌরী সেনের নাতি হলে গরীব গুরবোর কাজে দিত, ভ্যান হিউসেনের রিলেশন হলে বাবু বিবিদের।
পাঠক ভাবচেন হুতোম ভারী নিন্দুক। হিন্দি ইম্পিরিয়ালিস্টও হলেও বা কে জানবে? বিশ্বেস নেই। কিন্তু ভেবে দেকুন, যে বাঙালী অভিজিৎ বাঁড়ুজ্জের নোবেল প্রাইজ আর ঝিঁঝি বোর্ডের প্রেসিডেন্টের চেয়ারটিকে সমান ভেবে কলকেতা জুড়ে হোর্ডিং ঝুলিয়েচে, তার কাচে অমর্ত্য সেন কল্কে পাবেন কী উপায়? বাঙালীর একন কালীদাসী কালচার।