কয়েক বছর আগে আমেরিকার হলোকষ্ট মেমোরিয়াল মিউজিয়ামের একটি উপহার সামগ্রীর দোকানে একটি পোস্টার বিক্রি হচ্ছিল যেখানে ফ্যাসিজমের আত্মপ্রকাশের ১৪টি প্রাক-চিহ্ন তালিকাবদ্ধ ছিল। আসলে ২০০৩ সালে লরেন্স ব্রিট নামে একজন ‘না- অনন্যসাধারণ’ ঐতিহাসিক ‘ফ্রি ইঙ্কুয়ারি ম্যাগাজিনে’ এই তালিকাকে প্রকাশ করেছিলেন। পোস্টারটি খুব বেশি বিক্রি না হলেও পরবর্ত্তীতে পোস্টারের বিষয়টি সামাজিক মাধ্যমে অনেক মানুষকে আকৃষ্ট করে। কি ছিল ঐ ১৪ টি পয়েন্টে?
ফ্যাসিবাদের প্রাক-চিহ্ন সম্বন্ধে সতর্কতাসূচক বিজ্ঞপ্তি
১)পরাক্রমশালী এবং নিয়ত গতিশীল জাতীয়তাবাদ।
২) মানবাধিকারের প্রতি চরম অবজ্ঞা ও ঘৃণা
৩) ঐক্যবদ্ধতার কারণ দেখিয়ে শত্রুদের চিহ্নিতকরণ।
৪) সৈন্য বাহিনীর আধিপত্য।
৫)সমাজে ব্যাপক পুরুষ প্রাধান্য।
৬) নিয়ন্ত্রিত সংবাদ মাধ্যম।
৭) জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে অতিমাত্রিক সংবেদনা।
৮) ধর্ম এবং সরকার একইসাথে বিজড়িত।
৯) কর্পোরেট ক্ষমতার সুরক্ষা।
১০) শ্রমশক্তির অবদমন।
১১) বুদ্ধিজীবী এবং শিল্পকলার প্রতি চরম অবজ্ঞা।
১২) ‘অপরাধ এবং শাস্তি’ নিয়ে ঘোরতর সংস্কারাচ্ছন্ন দৃষ্টিভঙ্গী।
১৩) ব্যাপক দুর্নীতি আর সঙ্গতিকরণ।
১৪) প্রতারণামূলক নির্বাচন।
এই ১৪ টি পয়েন্টকে কি এখন ভারতের বুকে অপরিচিত এবং অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়? যথাযথ উত্তর হবে “অবশ্যই নয়”।
এই মূহুর্তে ভারতের বুকে ফ্যাসিবাদ আর নতুন কথা নয়। আটের দশক থেকে ভারতে সংখ্যাগুরু হিন্দুত্বর যে ধারাবাহিক আস্ফালন আমরা প্রত্যক্ষ করেছি তা আজ ভারতীয় সমাজের গভীরে চাড়িয়ে গিয়ে রাষ্ট্র-কাঠামোর সমস্ত দিক অর্থাৎ সামাজিক, আইনি এবং সংসদীয় সমস্ত কাঠামোগুলিকে ভিতর থেকে দখল নিয়ে নিয়েছে। তারই স্পষ্ট চিহ্ন আমরা প্রত্যক্ষ করছি ৭৫ বছরের ‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসবের’ প্রাক্কালে মোদির বিজেপি পরিকল্পিত নয়া সংসদ ভবনের উপরে স্বাধীনতার পর নন্দলাল বসুর করা সারনাথের অশোক স্তম্ভর ক্ষমাসুন্দর ও বীর্যবান বৌদ্ধ প্রতিরূপকে প্রতিস্থাপিত করে, শ্বদন্ত সহ এক হিংস্র ‘নৃসিংহ-অবতার’সম এক আক্রমণাত্মক মূর্তিকে আমাদের প্রিয় ভারতের জাতীয় প্রতীক রূপে সামনে নিয়ে আসা। ভারতীয় সমাজের সার্বিক গেরুয়া করণের,মোদী-অমিত শাহ-মোহন ভাগবতের আর,এস,এস-বিজেপির চিহ্ন প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম চলছে। অতি সাম্প্রতিক হিমাংশুকুমার পরিঘটনা এবং সংসদে মোদী সাহেবের নাপসন্দ‘নির্ভেজাল সরকারের সমালোচনামূলক বাক্যবন্ধ’র উপর অসংসদীয় ছাপ মেরে দেয়া; যথাক্রমে বিচার ব্যবস্থা ও সংসদীয় কার্যক্রমের গেরুয়া ফ্যাসিবাদী তারিকাকে স্পষ্ট দেখিয়ে দেয়।যাই হোক, উপরে উদ্ধৃত ১৪ টি পয়েন্টই ভারত রাষ্ট্রর ক্ষেত্রে ভীষণ ভীষণ প্রাসঙ্গিক।এর প্রতিটি পয়েন্ট ধরে বিদগ্ধজন পাতার পর পাতা লিখতে পারেন। কি করেনি এরা?মোদী-অমিত শাহ-মোহন ভাগবতের আর,এস,এস-বিজেপি বিমুদ্রাকরণ; জি,এস,টি;কলমের এক খোঁচায় কাশ্মীরের৩৭০ ধারার অবলুপ্তি;উচ্চতম ন্যায়ালয়কে কাজে লাগিয়ে রামমন্দির নির্মাণ; দাভোলকর,পানশারে, কালবুর্গী,গৌরীয় লঙ্কেশ হত্যা; ভীম কোরগাঁও মামলা; গো-রক্ষক বাহিনী; জয় শ্রীরামের নামে মব লিঞ্চিং; ‘আরবান নকশাল’ নাম দিয়ে বিরোধী কন্ঠস্বরকে দমন, দলিত হত্যা; ধর্ষণ সংস্কৃতি; শিক্ষা-ইতিহাস-বিজ্ঞান সাধনার গৈরিকিকরণ, তাৎক্ষণিক তিনতালাক আইন; লাভজিহাদ আইন, করোনা কালে অপরিকল্পিত লকডাউন; পরিযায়ী শ্রমিকদের সাথে অমানবিক আচরণ;ব্যাঙ্কে জনগণের সম্পত্তি লুট হতে দেওয়া; বিলগ্নীকরণের নামে জলের দরে দেশের সম্পত্তি মুনাফালোভী পুঁজিপতিদের হাতে বেঁচে দেওয়া; কৃষকদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে নির্বিচারে দমনপীড়ন; এন,পি,আর-সি,এ,এ-এন,আর,সি; হেফাজতে আদিবাসী আন্দোলনের পুরোধা স্ট্যান স্বামী প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা, দিল্লি দাঙ্গা সংঘটিত করা, নয়া তারিকার বুলডোজার রাজ ইত্যাদি ইত্যাদি চরম নেতিবাচক যা কিছু আজকের এই ব্রাহ্মন্যবাদী ফ্যাসিস্ট ভারতে কার্যকর হচ্ছে সবই করছে এই সরকারের প্রতিনিধিরা। তাই ১৪ পয়েন্টের এই ফ্যাসিবাদ চিহ্নিত করণ আমাদের ভারতে খুবই প্রাসঙ্গিক। আমরা শুধু আলোচনা করব (২) নম্বর এবং (১১) নম্বর পয়েন্টটি, অর্থাৎ“মানবাধিকারের প্রতি চরম অবজ্ঞা ও ঘৃণা” ও “বুদ্ধিজীবী এবং শিল্পকলার প্রতি চরম অবজ্ঞা” এই দুই সূত্রটিকে। এখান থেকেই আমরা চিহ্নিত করতে পারব – মোদী জমানার আশু টার্গেট এবং কর্ম-প্রকরণ যজ্ঞ।
এই মূহুর্তে মোদী জমানার আশু টার্গেট কারা? দাভোলকর,পানসারে, কালবুর্গী,গৌরি লঙ্কেশ, ষ্ট্যা্নস্বামী পরিঘটনা থেকে একথা পরিষ্কার বোঝা যায়-একশ্রেণীর ব্যাক্তি মুক্তচিন্তক মানুষদেরই ওরা টার্গেট করেছে। কাফিল খান, সিদ্দিক কাপ্পান, বিশেষ করে ভুল বা জাল খবর প্রচারিত করে রাজনৈতিক ফয়দা ওঠানোর গদি-মিডিয়া-কৃত চক্রান্ত্রর বিরুদ্ধে শাসক শ্রেনির ফ্যাসিবাদের মুখোষ উন্মোচনের স্বার্থে নিয়োজিত নিরলস কর্মী অলট নিউজের সাংবাদিক মহঃ জুবেইরের ওপর রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ আমাদের জানা। ভীম কোরগাঁও মামলায় সুধীর ধাওলে, সুরেন্দ্র গ্যাডগিল,মহেশ রাউত,সোমা সেন, আনন্দ তেলতুম্বে, গৌতম নওলখা, সুধাভরদ্বাজ, অশীতিপর কবি ভারভারা রাও, অরুন ফেরেরা, ভারনন গঞ্জালভেস, জি এন সাইবাবা, হানি বাবুইত্যাদিদের অনৈতিক মিথ্যা কারণে গ্রেপ্তার- তার প্রকৃষ্ঠ প্রমান।চরম রাষ্ট্রীয় নিপীড়নকে প্রশ্ন করার অপরাধে উচ্চ ন্যায়ালয়কে দিয়ে পরম গান্ধীবাদী সমাজকর্মী হিমাংশু কুমারের শাস্তি এবং তিস্তা সিতলবাদ পরিঘটনা একই মুদ্রার দুটি পিঠ। নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনের নেত্রী মেধা পাটেকরের বিরুদ্ধে বিজেপির ছাত্র সংগঠনকে দিয়ে কৃত মামলা- এওশাসক চক্রান্তের দৃষ্টান্ত মূলক উদাহরণ। একই কারণে দিল্লির জহরলাল নেহেরু উইনিভার্সিটিও ওদের কেন্দ্রীয় আক্রমণের বিষয়বস্তু। বিজেপি-আর,এস,এস মূলত ভাঙতে চায় ভারতীয় সমাজের আপসহীন, সত্যি অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিবাদেরকেন্দ্রটিকে। এই কেন্দ্র হোল ‘নকশালবাদ’। এর উপর আক্রমণ শানানর আগে ওরা কেন্দ্রর পরিধির পরিবেশকে বিস্ত্রস্ত করে তুলছে। সাধারণভাবে ভারতের বামপন্থী রাজনীতির টানাপড়েন থেকে উদ্ভূত ‘উদার গণতান্ত্রিক ধর্মনিরেপেক্ষ’ কিন্তু ঐতিহ্যানুযায়ী বাম আন্দোলনের বাইরের অবস্থানকে নীতিগতভাবে ধরে রাখা এই শক্তিই হোল আজকের বিজেপি-আর,এস,এস-এর ‘নরম লক্ষবস্তু’। বিজেপি-আর,এস,এস এদের নাম দিয়েছে ‘শহুরে নকশাল’। নাম দেয়ার এই ধরণ দেখেই শাসকের উদ্দেশ্য-বিধেয়কে স্পষ্ট বোঝা যায়। আমরা এই ইতিবাচক শক্তিটিকে নির্দিষ্টভাবে বলতে পারি ‘কালচারাল কম্যুনিস্ট’। “কালচারাল কমিউনিজম” বা “কালচারাল কমিউনিষ্ট” পরিভাষা শুনলেই প্রথমেই মনে আসে “ফ্রাঙ্কফ্রুট স্কুল” এর কথাটা। খুব সংক্ষেপে বললে- এটি আধুনিকতার এক নয়া দার্শনিক উবাচ যা একইসাথে সোভিয়েত মডেলের এবং অধুনা ধনতান্ত্রিক কাঠামোর নিরন্তর বিরোধিতা করে। বৃহত্তর অর্থে সাম্যবাদের অবিচল সমর্থক, মার্ক্সবাদের পথানুসারী, লেনিনবাদের প্রতি সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গী সহ, স্তালিনপন্থা ও কমিউনিষ্ট দলতন্ত্রর ঘোড়তর বিরোধী, মাল্টি কালচারাল ও বহুত্ববাদের পুজারী। এটুকু বললে “ফ্রাঙ্কফ্রুট স্কুল” সম্পর্কে সব বলা হয় না। কিন্তু আমাদের নির্দিষ্ট আলোচনার জন্য মনে হয় এটুকু অপ্রাসঙ্গিক হবে না। সার্বিকভাবে সমস্ত স্তরে বামপন্থার বিরুদ্ধে আক্রমণে নামার আগে ভারতে এই শক্তিটির বিরুদ্ধেই প্রথমে আক্রমণে নেমেছে মোদী-অমিত শাহর বিজেপি-আর,এস,এস। সে কারণে আজকের ফ্যসিবাদের বিরুদ্ধে আপোষহীন শক্তিদের সার্বিক নির্ভরতার ভরকেন্দ্রকেও এই মূহুর্তে পাল্টে নেয়া প্রয়োজন বলে মনে হয়। ভারতের উচ্চকিত সর্বহারা শ্রেণী মূলত বিজেপি-আর,এস,এসের সাংস্কৃতিক শক্তি, তাদের অন্তরে তীব্র বাহ্মন্যবাদী অবশেষ। সেই কারণেই ঐ পরিসরে গতানুগতিক আন্দোলন চলুক কিন্তু এক্ষণে ঐ দিক থেকে মাত্রাতিরিক্ত দৃষ্টি সরিয়ে মধ্যবিত্ত উদারনীতিবাদী সাংস্কৃতিক শ্রেণীটিকে বিশেষভাবে সংগঠিত করা দরকার। স্বাধীনতার সময়ে গড়ে ওঠা বাংলার বৃটিশ বিরোধী অগ্নিযুগের আন্দোলনকে একসময় বামপন্থীরা ‘পেটি বুর্জোয়া বিপ্লববাদ’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন। যতই অতীতে সমালোচনা করি না কেন;আজ আমাদের সেই ধাঁচায় আন্দোলন ও সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। অতীত অভিজ্ঞতা নেই এমন তো নয়। ৭০ খুব এখনও পুরাকালের কথা হয়ে যায় নি। ৭০ও ছিল বিষয়গত দিকটি একটু অন্য হলেও, রুপের দিক দিয়ে অগ্নিযুগের উত্তরাধিকার।ভারতের বুকে ঘনায়মান ফ্যসিবাদকে রুখবার জন্যই সাংগঠনিক উদ্যোগে ঐ উত্তরাধিকারকে আজ ফিরিয়ে আনা জরুরী। প্রতিবেদনটিএকটু বিতর্কিত হয়ে গেল। বিতর্ক হোক, এই মূহুর্তে আমাদের দেখা দরকার ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এবং প্রগতির পক্ষে ইতিবাচক এই শক্তিটা কারা? বাংলায় মূলতঃ এই শক্তিটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মানবাধিকার-গণতান্ত্রিক অধিকার সংক্রান্ত সংগঠনে,পরিবেশ-বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সংগঠনে ও নানা ধরণের সাংস্কৃতিক সংগঠনে। আজকের ফ্যাসিস্ট বাতাবরণ সংক্ষুব্ধ বাংলায়, চরম ব্রাহ্মন্যবাদী বিজেপি-আর,এস,এস অভিযাত্রাকে রোখার জন্যই ঐক্যবদ্ধ হতেই হবে। বাংলা তো দিল্লী-মহারাষ্ট্র নয়। বাংলার আছে এক গর্ব করার মতো অতীত। সেই ইতিবাচক অতীতের দিকে তাকিয়ে আওয়াজ তোলা যাক- “সময় হয়েছে নিকট, এখন বাঁধন ছিঁড়িতে হবে”।