পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

আমাদের কাল যেভাবে কেটে যায়

  • 07 May, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 1361 view(s)
  • লিখেছেন : নীহারুল ইসলাম
আমাদের কথার বলার স্বাধীনতা ঠিক ওই বাবুটির বাতাস টেপার মতো। স্বাদহীন কথা বলে আমরাও আমাদের স্বাধীনতাকে পুষিয়ে নিচ্ছি। স্থান-কাল যাই হোক- রাজনৈতিক মঞ্চ হোক কিংবা ধর্মীয় জালসা, টিভির টক-শো হোক কিংবা খবরের কাগজ, রক হোক কিংবা চায়ের দোকান, বাস কিংবা ট্রেণ, তার ওপর আজকাল হয়েছে ফেস্‌বুক, ট্যুইটার। অবশ্য এতে আমাদের লাভ না হলেও এই করোনাকালে ক্ষতি কিছু হচ্ছে না! দিব্যি কাল কেটে যাচ্ছে ...

কথার স্বাধীনতা না কথার স্বাদ-হীনতা? সে যাইহোক, এর জন্যই দুনিয়ায় যত লড়াই! সে আমরা আল্লার বান্দা হই বা ভগবানের ভক্ত কিংবা ঈশ্বরের ঈশা-মুশা, আমরা সবাই প্রাণপণ লড়ে যাচ্ছি। আসলে লড়ে যাচ্ছি নিজের সঙ্গেই, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত। সেই সঙ্গে কাজকর্মে না হলেও, অন্তত মুখে বাঘ মারছি। সে রাজনৈতিক মঞ্চ হোক কিংবা ধর্মীয় জালসা! টিভির টক-শো হোক কিংবা খবরের কাগজ! রক হোক কিংবা চায়ের দোকান! বাস কিংবা ট্রেণ! কিন্তু করোনার কারণে এসব এখন লকডাউনে। অগত্যা টক-শো, ফেস্‌বুক, ট্যুইটারই ভরসা। নিজেরাই দেখছি। নিজেরাই লিখছি। নিজেরাই পড়ছি। নিজেরাই বকছি। নিজেরাই শুনছি। এই সবে প্রতিনিয়ত আমরা কত যে অকথা-কুকথার জন্ম দিচ্ছি, তার ইয়ত্তা নেই। যদিও আমাদের কারও কোনওরকম বিরক্তি নেই। বুঝে না বুঝে ‘Like’ দিচ্ছি। নানারকম ‘Coment’ করছি। আমরা যেন সব এক একটা সবজান্তা গামছাওয়ালা। আমাদের ভাবটা এমন- লাভ না হোক, ক্ষতি তো কিছু হচ্ছে না! নিজেকে বুদ্ধিমান প্রমাণ করে দিব্যি কাল কাটিয়ে যাচ্ছি। সেই কাল করোনার হোক কিংবা মরোনার। আহা বেঁচে থাকার এমন স্বাধীনতায় আমাদের আর কী চাই?

কিন্তু এই ‘আমাদের’ বাইরেও এমন অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা এসব ব্যাপার একেবারেই কিছু জানেন না। জানবার চেষ্টাও করেন না। অবশ্য জীবন-যুদ্ধে তাঁদের সময় কোথায় যে তাঁরা জানবেন বা জানবার চেষ্টা করবেন? তাঁরা নিজের মতো থাকেন। নিজের মতো করে ভাবেন। নিজের মতো করে নিজের কাজকর্ম করেন। জীবনের সঙ্গে কোনও রকম ছলনা করেন না।

এঁরা একেবারে মাটির মানুষ। শুঁকলে এঁদের গা থেকে মাটির গন্ধ পাওয়া যায়। ইদানিং আমাদের মতো সবজান্তা গামছাওয়ালাদের নিয়ে এঁদের হয়েছে মহাবিপদ! আমাদের কর্মকাণ্ডে এঁরা রীতিমতো তিতিবিরক্ত। আমরা সেভাবে এঁদের খোঁজ রাখি না। অথচ এঁদের নিয়ে কখনও কখনও এমন আচরণ করি, ওপর পড়া হয়ে এমন সব জ্ঞান দিই, যে-আচরণ যে-জ্ঞানে এঁদের বেঁচে থাকা ওষ্ঠাগত হয়। যা এঁরা কখনোই ভালো চোখে দেখেন না।

সেরকম একজন মানুষ আমাদের কাসেমভাই। আমি যখন কৈশরে ধোঁয়াপান করতে শিখি, বড়দের কাছে গন্ধ লুকনোর অপচেষ্টায় প্রথম প্রথম সিগারেট টানতাম। তা দেখে সে বিড়ি টানতে টানতে বলেছিল, ‘সিকরেট মারাইছো? এমুন সুমায় আসবে টানবার লেইগ্যা বিড়ির পুঙ্গা ধুঁড়ে বেড়াইবা!’

কাসেমভায়ের কথা বিফলে যায়নি। করোনাকালে পদে পদে টের পাচ্ছি। ছ’টাকার সিগারেট দশটাকায় বিক্রি হচ্ছে।

তারপর সেই দাঁড়িওয়ালা জাগালদার চাচা। মাঠ জুগিয়ে বেড়ানো যাঁর কাজ। বাড়িতে সুন্দরী ফর্সা বউ। দু-তিনটে ফুটফুটে সন্তান। অথচ লোকটা এই মাঝ বয়সে এসে প্রেমে পড়েছে ভাতারের ভাত না পাওয়া এক কালোনী সুন্দরীর। সে নিয়ে তাঁর বউ খুব অশান্তিতে আছে। অশান্তি বলতে স্বামীকে তো সে কিছু বলতে পারে না। বললেই স্বামী লাঠি-পেটা করবে। অগত্যা সে একে তাকে ব্যাপারটা বলে বেড়ায়। আমিও বাদ পড়ি না। আমাকেও বলে। শুনে কে কী করেছে জানি না, তবে আমি সবজান্তা গামছাওয়ালা হয়ে একদিন জাগালদার চাচাকে বলি, ‘চাচা- কাজটা কি ঠিক করছেন?’

জাগালদার চাচা উত্তর করেন, ‘ঠিক বেঠিক জানি না বাপ্‌। সাদা তরমুজ আর কালো তরমুজের ফারাক বুঝো কি? না বুঝলে শুনো- সাদা তরমুজের ভিতরটা ফ্যাকসা। আর কালো তরমুজের ভিতরটা টুকটুকা লাল! তা লাল তরমুজ ছেড়ে ফ্যাকসা তরমুজ কেহু খায় না কাহুকে খেতে দ্যায় বাপ? কহ তো দেখি!’

কী কহিব? জাগালদার চাচাকে কিছুই ‘কহিতে’ পারিনি। এই করোনাকালে এমন অনেক ঘটনা চোখে পড়ছে, কানেও আসছে।

তারপর আমাদের গুরুপদদা। গ্রাম থেকে এসে একটা চায়ের দোকান চালায় আমাদের ক্লাবের পাশেই। গুরুপদদার একটাই মেয়ে। মেয়েটার বয়স তখন বছর দশেক হবে। গুরুপদদা হঠাৎ তার বিয়ে জুড়ে বসল। সেই বিয়েতে গুরুপদদা আমাদের নেমন্তন্য করল। তইখন সদ্য কলেজ বেরনো আমরা তো অবাক। ওইটুকু মেয়ের বিয়ে! তা কী করে সম্ভব? আমরা গুরুপদদাকে অনেক করে বোঝালাম ওইটুকু মেয়ের বিয়ে না দেওয়ার জন্য। সব শোনার পর গুরুপদদা বলল, ‘ভাল কথা বলছো দাদা তোমরা। কিন্তু আমার কথাটাও শোনো একবার- আমি সেই কোন সকালে চলে আসি দোকানে। তোমাদের বউদি পরের বাড়িতে ঝি খাটতে চলে যায়। মেয়েটা বাড়িতে একা থাকে। ওই ফাঁকে সে যদি কারও সঙ্গে কিছু ঘটিয়ে বসে! তখন আমি কী করবো?’ কোনও জবাব দিতে পারিনি। গুরুপদদার মেয়ের বিয়ের নেমন্তন্য খেয়ে এসেছিলাম। এমন বিয়ের নেমন্তন্য এই করোনাকালেও আমাদের খেতে যেতে হয় লকডাউন অমান্য করে। সামাজিক জীব হয়ে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলি কী করে?

মনে পড়ছে আমার সইদুল্লা মামাকে। ধার্মিক পরিবারে জন্মেও ঘোর নাস্তিক ছিলেন। হজ দূরের কথা, তিনি নামাজ-রোজার ধার ধারতেন না। কেউ নামাজ-রোজার কথা বললে বিরূপ মন্তব্য করতেন। তাই শুনে এক মৌলানাসাহেব তাঁকে বলেছিলেন, ‘ভাই- হাজীর বেটা আপনি। আপনাকে জ্ঞান দিবার কিছু নাই। খালি একটা কথা শোধাইছি, মরলে মাটি পাবেন তো?’

সইদুল্লা মামাকে বলতে শুনেছিলাম, ‘মাটি না পাওয়ার কী আছে? আপনিই আমাকে মাটি দিয়ে আসবেন। না হলে পচে-গলে দুর্গন্ধ ছড়াবো যে! তখন টিকতে পারবেন তো?’

সইদুল্লা মামার কথা মিথ্যা হয়নি। সেই মৌলানাসাহেব সইদুল্লা মামাকে মাটি দেননি শুধু- সইদুল্লা মামার জানাজাও পড়িয়েছিলেন। মৃত্যুর পর চার দিনের কাজ, চল্লিশ দিনের কাজ উঠিয়েছিলেন দায়িত্ব নিয়ে। আমি দেখছিলাম।

আজকের পৃথিবী ধর্ম আর শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে মানুষকে সজাগ রাখতে মহা ব্যস্ত। টিভি খুললে অনেক পিরবাবা, অনেক যোগীবাবাদের পাওয়া যায়। খবরের কাগজ খুললে পাওয়া যায় স্বাস্থ্য নিয়ে আলাদা বিভাগ। যারা প্রতিনিয়ত আমাদের সজাগ করে চলেছে। আমরাও তাদের কথামতো কী করলে, কী খেলে, কী পরলে ইহকাল-পরকালে সুস্থ থাকব, সেই চেষ্টা করে যাচ্ছি।

সেই মতো আমিও নিয়মিত প্রাতঃভ্রমণ করি। তো সেদিন প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে কলকলির পাড়ে একটা দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়াই। একটা লোক, আমার অপরিচিত, হয়ত চাকরীসূত্রে আগত, জলশূণ্য কলকলির দিকে মুখ করে স্থির দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর হাত দু’টি সামনের দিকে বাড়ানো। শুধু ওই দুই হাতের দশটা আঙুল একবার মুষ্ঠিবদ্ধ করছে, একবার খুলছে। টিভিতে বাবাদের দেখানো শরীরচর্চায় এরকম কিছু আমি আগে কখনও দেখিনি। বা কোথাও পড়িনি। স্বভাবতই অবাক হই। তবে অবাক হয়ে বেশীক্ষণ সেখানে দাঁড়াই না। আবার হাঁটতে শুরু করি। পথে পবিত্র কাকার সঙ্গে দেখা। তাঁকে বলি ব্যাপারটা। পবিত্র কাকা আমাকে বলেন, ‘হাঁটছিস হাঁট। ওসব দেখে তোর কী লাভ?’ আমি কিন্তু নাছোড় বান্দা। শেষপর্যন্ত পবিত্র কাকা আমাকে বলেন, ‘ওটাকে গোদা বাংলায় ঢ্যামনামি বলে। বউ বুক টিপতে দেয় না বুকের সেপ খারাপ হয়ে যাবে বলে। এদিকে মনের ইচ্ছে অবদমিত করতে করতে রাত ভোর হয়। তখন বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসে কলকলির পাড়ে। তারপর ওভাবে বাতাস টিপে ইচ্ছেটাকে পুষিয়ে নেয়।‘

আমাদের কথার বলার স্বাধীনতা ঠিক ওই বাবুটির বাতাস টেপার মতো। স্বাদহীন কথা বলে আমরাও আমাদের স্বাধীনতাকে পুষিয়ে নিচ্ছি। স্থান-কাল যাই হোক- রাজনৈতিক মঞ্চ হোক কিংবা ধর্মীয় জালসা, টিভির টক-শো হোক কিংবা খবরের কাগজ, রক হোক কিংবা চায়ের দোকান, বাস কিংবা ট্রেণ, তার ওপর আজকাল হয়েছে ফেস্‌বুক, ট্যুইটার।

অবশ্য এতে আমাদের লাভ না হলেও এই করোনাকালে ক্ষতি কিছু হচ্ছে না! দিব্যি কাল কেটে যাচ্ছে ...

0 Comments

Post Comment