পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

সে আসছে

  • 02 January, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 1058 view(s)
  • লিখেছেন : সাত্যকি হালদার
তারাপদ না! তারাপদ! সে এখন কোত্থেকে আসবে! সে তো চলে গেছে বহু কাল। কিন্তু হাঁটাটা দ্যাখো, অবিকল তারই। ধুর, তারাপদ এমন বেঁকে হাঁটত নাকি!

ভাঁটার সময় জল সরে গেছে আধমাইল। সমস্ত চর জুড়ে জল নেমে যাওয়া চাকার মতো দাগ। পলির ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছে বেশ কয়েকটা বক। জল সরে যাওয়ায় নৌকোর ঘাটও সরে গেছে অনেকখানি! এ দিকের ঘাটে উপুড় করা বেশ কয়টি নৌকো, বাঁশে শুকোতে দেওয়া জাল, এক পাশে দরমার বেড়ায় ঘেরা বাবু মিঞার চায়ের দোকান। দোকানের বাইরে বাঁশের চটায় তৈরি এবড়োখেবড়ো বেঞ্চ, সেখানে ছিটিয়ে-থাকা মুনসিচরের সকালবেলার আড্ডা। সেখান থেকে আধমাইল দূরে জলের শেষ মাথায় নামতে দেখা গেল লোকটাকে।

তাকে নামিয়ে দিয়েই নৌকোটা আবার নদীর ভিতর দিকে চলে গেল।

চরের মাথায় দাঁড়িয়ে লোকটা চাদর ঠিক করল। ধুতিটা তুলে নিল খানিক। পা থেকে খুলে চটি জোড়া ব্যাগের ভিতর। ব্যাগে রাখার সময় উঁকি মেরে ভিতরটা দেখে নিল এক বার।

তাকে নামানোর পর নৌকো তখন আড়াআড়িভাবে নদীর মাঝখানে। সেদিকটা দেখে সে পলি ভেঙে হাঁটতে শুরু করল খেয়াঘাটে দিকে।

সোজাসুজি পলিতে পায়ের ছাপ পড়তে থাকে তার। বাতাসে উড়তে থাকে মাথার চুল, গায়ের চাদর। কয়েকটা বক সামান্য উড়ে দূরে গিয়ে বসে। এক ভাবে সে হেঁটে আসতে থাকে মুনসিচরের দিকে। জল নেমে যাওয়া বিস্তীর্ণ চরে সকালবেলায় সে একা। তার নাম শুনে বাবু মিঞার দোকানের ভিতর বসে থাকা কয়েকজন বাইরে এসে দাঁড়ায়। রোদ খুব জোরালো নয় তবু চোখ কুঁচকে দেখতে থাকে তাকে। চায়ের কাপের তলানিটুকু মাটিতে ঢেলে উবু হয়ে বেঞ্চে বসা ইসমাইল বলে, হ্যাঁ হ্যাঁ তারাপদই। দেখছ না কেমন ঘাড় তুলে হাঁটছে। এভাবেই তো চরের মাথায় হেঁটে বেড়াত সে।

জনার্দন নামের লোকটাও দোকান থেকে বেরিয়ে এসেছিল বাইরে। মুখ ঘুরিয়ে আবার ভিতরে যেতে যেতে বলল, বললেই হল! তারাপদ এমন ঢ্যাঙাপানা ছিল নাকি! আমি লিখে দিচ্ছি, গোকুলের ছোট জামাই ছাড়া ও লোক আর কেউ না।

চামচের খটাখট শব্দে ছোট গ্লাসে চিনি মেশাচ্ছিল বাবু মিঞা। মুখ না তুলে সে বলল, যাওয়ার দিনও এই ঘাট দিয়েই গিয়েছে। সেটাও ছিল এমনই সকাল। তবে ভাঁটা নয় গাঙে তখন ভরা জোয়ার। কয় বছর হবে ইসমাইল ভাই, বছর তিন না!

এ বার আর কোনও উত্তর করল না ইসমাইল। চায়ের কাপ পাশে নামিয়ে এক মনে দেখতে থাকল লোকটাকে।

নদীর ধার ছেড়ে কিছুটা পথ সে তখন এগিয়ে এসেছে। হাঁটায় একটা গতি এসে গেছে। মাঝে মুখ তুলে সে মূল খেয়াঘাটের দিকটা দেখছিল। হয়তো সামনের পথটা আন্দাজ করছিল মনে মনে। মাথার ওপর আকাশটা রোদ আর সাদা মেঘে একাকার। দু-একটা গাঙচিল পাক মারছিল সেখানে। মাঝে তাও দেখছিল লোকটা। বাবু মিঞার দোকানের আখড়া তখন আরও সরব তার পরিচয় নিয়ে। দু-একজন ছাড়া প্রায় সবাই দোকানের বাইরে।

আমারে তারাপদ হাঁপানির তাবিজ এনে দেবে বলেছিল। বামনগাছির ফকির-বাড়ির তাবিজ। এ দিকে কারে আর বলব, তারাপদরেই জানিয়ে রেখেছিলাম কথাটা।

শুধু তোমার তাবিজ! আমারে সে বলে গেল কোনও চিন্তা নেই কাকা, তোমার ছোট মেয়ের সম্বন্ধ একটা হবেই। শুধু কটা দিন সময় দ্যাও।

জনার্দন ধমকে ওঠে এবার। ...লোকটা কে ঠিক নেই, এ দিকে মেয়ের বিয়ে আর তাবিজের গল্প। আরে বাবা আগে তারে আসতে দ্যাও, তারপর দ্যাখো কার কথা খাটে। আমরা এতগুলো চেনা লোক এখানে, তারাপদ হলে কি হাত তুলে ইশারা করত না!

জনার্দনের কথায় কজন একটু দমে যায়। এ-ও মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। নিচু গলায় ইসমাইল বলে, আমরা কি ইশারা করেছি যে সে সাড়া দেবে। তা ছাড়া কাদা দেখে দেখে পা ফেলতে হচ্ছে, হাত নাড়ানাড়ি করে এটুলি কাদায় হুমড়ি খাবে নাকি! তোমাদের যদি গলার জোর থাকে তালে বরং নাম ধরে ডাক দ্যাও।

ইসমাইলের কথাটা মনে ধরে যায়। জনার্দন বলে, অ্যাই নেপাল, নে ডাক দে তো গলা ছেড়ে। ঠাকুর ভাসানোর সময় তো চরে ডাকাত পড়ার মতো চ্যাঁচাস। এ বার তারাপদ বলে হাঁকড়ে দে দেখি।

নেপাল ছেলেটা জটলা থেকে দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। জনার্দনের কথায় আলগাভাবে বলল, ঠ্যাকা থাকলে তোমরা ডেকে দেখ। কে চরের মাথায় নামল তা নিয়ে আমি কি তক্ক করতে গেছি। তোমরা বরং গলার জোরের একটা পাল্লা দিয়ে নাও।

ইসমাইল বলল, তোদের ভারি বাজে বকার স্বভাব। একটা লোক তিন বছর পরে ফিরছে। আমাদের তো তার জন্যে এগিয়ে যাওয়া উচিত। তা নয় নিজেদের ভিতর ঝগড়া বাঁধিয়ে বসে আছি।

ঘাটে আসার আধাআধি পথ পার হয়ে গিয়েছিল লোকটা। রোদ বাঁচাতে কাঁধের ঝোলাটা দু হাতে মাথার ওপর ধরা! এই সময় সে দাঁড়িয়ে পড়েছিল এক বার। ঘুরে ঘুরে এ-ধার ও-ধার দেখছিল। তার পিছন দিকে জল আর জল, বড় গাঙে মোহনা, নদী কোথায় সমুদ্দুর হয়েছে বোঝার উপায় নেই। তার সমানে ভাঙা, মুনসিচর, বাবু মিঞার দোকানে ঘাটের হইচই। এইখানে দাঁড়িয়ে সে চারপাশটা ভালো করে দেখল। আকাশের দিকে মুখ তুলল ক বার। তার কাছাকাছি যে বকগুলো পা টিপে চলেছে তাদেরও দেখল। তার পর মাথার ওপর ঝোলা ধরে এগিয়ে আসতে থাকল মূল ঘাটের দিকে।

জনার্দন বলল, এতেই বোঝা যায় তারাপদ না। আধ মাইল হাঁটতে তার বিশ্রাম লাগত নাকি! ইসমাইল বলল, এটা বিশ্রাম তা কে বলল তোমারে। চলতে-ফিরতে আমরা জিরোই না নাকি!

বহুদিনের হাঁপানিতে ফেলু শেখের বুকের মাঝখানটা উঁচু মতো! সামান্য কাশতে কাশতে সে বলল, যতই তক্ক কর আমি জানি এ তারাপদ। এই ঘাটেই তার ফিরে আসার কথা। আমার তাবিজটাও সঙ্গে আনছে।

সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে হরিচরণ। এবার সে ফেলু শেখের কাছ ঘেঁষে এল। নিজের মনে বলার মতো বলল, কোন গ্রামের সম্বন্ধ আনে দেখি! বড় মেয়েরে তো উত্তরে দিলাম, ভালো ছেলে পেলে ছোটটারেও ও দিকেই দেব। শেষে বুড়ো-বুড়ি রয়ে যাব এই নোনা পানির চরে।

লোকটার চলায় ততক্ষণে আবার ছন্দ এসে গেছে। আরও তাড়াতাড়ি এগোচ্ছে মুনসিচরের দিকে। তাকে নিয়ে তর্ক বেড়ে উঠল আরও কয়েক ধাপ। কথা কাটাকাটি শুরু হয়ে গেল জনার্দন আর ইসমাইলের। চায়ের দোকান ছেড়ে বাবু মিঞাও বাইরের রোদে। হরিচরণ চুপচাপ ছিল। সে জানত ছোট মেয়ের গতি হচ্ছে এত দিনে। ফেলু মিঞা বুঝল রাতে-রাতে বুক চেপে বসে থাকাও এইবার শেষ।

আর মাত্র কয় পা। তারপর স্পষ্ট হয়ে উঠবে চোখমুখ। জানা যাবে তার আসল পরিচয়। সেটুকু জানার জন্য মুনসিচরের লোকেরা সকালের রোদে অপেক্ষা করে থাকল।

0 Comments

Post Comment