আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। আমাদের দেশজুড়েও নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পালিত হচ্ছে এই বিশেষ দিনটা। আমরা স্মরণ করছি মানব সভ্যতার বিকাশে নারীদের অমূল্য যোগদান, আলোচনা করছি, নারীদের সম মর্যাদা ও ক্ষমতায়ন নিয়ে। আমরা দাবি করছি নারী স্বাধীনতা, সুরক্ষা ও সমানাধিকারের। আর এই দিনেও দেশ জুড়ে অব্যহত রয়েছে নারীদের প্রতি আক্রমণ ও বৈষম্যের রোজনামচা। এ দেশে প্রতি ১৬ মিনিটে একজন মহিলা ধর্ষিতা হন, আর প্রতি ৪ মিনিটে একজন মহিলা সহিংসতার শিকার হন, এমনটাই স্পষ্ট হয় এনসিআরবি র ২০২০ সালের প্রতিবেদন থেকে। ঐ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ধর্ষণের ঘটনার নিরিখে উত্তরপ্রদেশ ও রাজস্থানের স্থান দেশের মধ্যে সবার আগে।
মূল লেখায় আসার আগে উপরের তথ্যগুলি উল্লেখ করা দরকার, কারণ এটা বোঝা দরকার উত্তর প্রদেশের হাথরাস জেলায় যে নৃশংস ঘটনাটি ২০২০ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর ঘটেছিল, সেটি নিছক এক বিছিন্ন ঘটনা নয়। আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক তথা রাজনৈতিক কাঠামো এমন এক শাসন ব্যবস্থাকে জিইয়ে রেখেছে; যেখানে মহিলাদের সুরক্ষা, সম্মান ও সমানাধিকারের প্রশ্নগুলি অনেক সময় অবান্তর হয়ে যায়। কাজেই হাথরাসের মতন ঘটনা বন্ধ করতে হলে মৌলিক প্রশ্নগুলি তোলা একান্তই দরকার, কিন্তু তাঁর জন্য যে সচেতনতা, সংগঠন ও রাজনৈ্তিক সদিচ্ছার দরকার আজ চারপাশে সেটার বড় অভাব। তাই হাথরাস নিয়ে আমাদের আলোচনায় হাহাকারই ধ্বনিত হয় বেশি, প্রতিবাদের ঝড় হয় ক্ষণস্থায়ী।
হাথরাসের মূল ঘটনা যা পুলিশের প্রতিবেদন তথা সংবাদমাধ্যম মারফত আমাদের সামনে এসেছিল, তা হলো, চার উচ্চবর্ণের পুরুষের দ্বারা এক ২০ বছরের দলিত তরুণীর উপর গণধর্ষণ ও খুনের অভিযোগ। নারকীয় ধর্ষণের ও শারীরিক আঘাতের শিকার হওয়ার পরে প্রায় দুই সপ্তাহ মৃত্যুর সাথে লড়াই চালিয়েও শেষ পর্যন্ত,দিল্লিতে চিকিৎসাধীন অবস্থায়, এই তরুণীর মৃত্যু হয়। সংবাদমাধ্যমে উঠে আসে নির্যাতিতার ভয়ানক পরিনতির খুঁটিনাটি। আক্রান্ত তরুণীর মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হয় ও আহত অবস্থায় তাঁর গলায় ওড়না জড়িয়ে টেনে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণ করা হয়েছিল সে কথা সামনে আসে। এছাড়া তাঁর দেহের নানান জায়গায় গুরুতর আঘাত ও তাঁকে শ্বাসরোধের চেষ্টাও করা হয়েছে, এমনই ধরা পরে ডাক্তারী পরীক্ষায়। অভিযোগের আঙুল ওঠে চারজন ঠাকুর সম্প্রদায়ের লোকের বিরুদ্ধে, যারা স্থানীয় প্রভাবশালী। পরিবারের বয়ান অনুসারে পুলিশ প্রাথমিক ভাবে অভিযুক্ত পরিবারকেই লাঞ্ছিত করে ও অভিযোগ নিতে অস্বীকার করে। পরে ২০ সেপ্টেম্বর পুলিশ অভিযোগটি নথিভুক্ত করে ও তারপরে নির্যাতিতার বয়ান ইত্যাদি নেওয়ার কাজ শুরু করে।
তরুণীর মৃত্যুর পরে, পুলিশী নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ তুলে তরুণীর পরিবারের সদস্যরা, মৃতদেহ দাহ করতে অস্বীকার করলে, রাতের অন্ধকারে পুলিশ পরিবারের সম্মতি ছাড়াই জোর করে দেহ সৎকারের ব্যবস্থা করে বলেও অভিযোগ ওঠে। পরিবারে পক্ষে অভিযোগ করা হয় সরকার তথা প্রশাসন এই ঘটনায় যুক্ত থাকা উচ্চবর্ণের অপরাধীদের আড়াল করতে চাইছে। নির্যাতিতার গ্রামে সংবাদমাধ্যমের প্রবেশকেও এই সময় কার্যত নিষিদ্ধ করে স্থানীয় প্রশাসন। এই ঘটনার জেড়ে সে সময় রাজ্য তথা দেশের রাজনৈতিক মহলে বিশেষ আলড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। নান রাজনৈতিক দল, মহিলা সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন, নাগরিক সমাজের একাংশ পথে নামে হাথরাসের নির্যাতিতার সুবিচারের দাবি নিয়ে। রাজ্যসরকার চাপের মুখে পড়ে স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টীম বা সিট গঠন করে ও এরপরে তদন্তের ভার নেয় রাজ্য গোয়েন্দা সংস্থা।
এসব সত্ত্বেও আজ দুবছর পরে, উত্তরপ্রেদেশের ন্যায়ালয় চার অভিযুক্তের মধ্যে সেই তিনজনকেই বেকসুর খালাস করেছে, যাদের বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ ছিল গুরুতর। দোষী সব্যস্ত হওয়া আসামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলনায় কম, ধর্ষণ বা খুনের ঘটনায় তাঁর নাম ছিল না বলে সংবাদে প্রকাশ।
Like our Facebook Page
অর্থাৎ হাথরাসের ঘটনায় কাউকেই দোষী সব্যস্ত করতে পারল না পুলিশ প্রশাসন। আদালত চলে প্রমাণের ভিত্তিতে, এই রায় থেকে স্পষ্ট যে পুলিশ- প্রশাসন তাদের কেসটি নিশ্ছিদ্র করে আদালতে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ । স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন হঠে তাহলে হাথরাস গণধর্ষণ ঘটল কি ভাবে? আর এই অনুষঙ্গেই মনে প্রশ্ন জাগে, মহিলাদের সুরক্ষার যে ঢিলে-ঢোলা বলয়টুকু দেশে আছে, প্রান্তিক, দরিদ্র্য, দলিত সংখ্যালঘু মহিলাদের জন্য তার কি আদৌ কোন তাৎপর্য আছে? নাকি রাজনীতির রঙে, জাতিবাদী সমাজের চোখ রাঙানিতে ও পিতৃতান্ত্রিকতার দুঃসহ জাঁতাকলে আর সব দুষ্কর্মের রঙ চটজলদি ঢাকা পরে যায়। অপরাধের বিরুদ্ধে প্রশ্ন করাই তখন হয়ে দাঁড়ায় অপরাধ! এই যদি চিত্র হয়, তাহলে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরে অমৃতকালে, দেশের অর্ধেক আকাশ, অর্থাৎ ভারতীয় নারীদের অর্জন ঠিক কি?
আন্তর্জাতিক নারী দিবসে দাঁড়িয়ে তখন মনে পরে যায় নির্ভয়া কাণ্ডের পরেও এ দেশে ঘটে যায় কাঠুয়া থেকে হাথরাস। এ দেশেই ধর্ষকদের সমর্থনে জাতীয় পতাকা নিয়ে মিছিল বের করার দুঃসাহস দেখাতে পারে এক বিশেষ চিন্তাধারার মানুষজন। এ দেশেই গুজরাত দাঙ্গার সময় গণধর্ষণের শিকার বিলকিস বানুর অপরাধীদের সাজা মকুব করা হয় অমৃতকালের অজুহাতে, আর সেই ধর্ষকদের মালা পরিয়ে মিষ্টিমুখ করিয়ে সমাজে বরণ করে নেওয়ার লোকেরও অভাব হয় না। সংবাদমাধ্যমে সেই খবর যখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে, তখন সারা দেশের নারীদের কাছে তা কি বার্তা বহন করে? আর কতটা নিরাপদ বোধ করেন দলিত, ধর্মীয় সংখ্যালঘু বা প্রান্তিক দরিদ্র পরিবারের মহিলারা?
মহিলাদের সুরক্ষার অভাবের বিষয়টি দেশে নতুন নয়, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে অনেকেই প্রতিনিয়ত আক্রান্ত হচ্ছেন। আক্রান্ত মহিলাদের খুব ছোট অংশই পুলিশের কাছে এসে অভিযোগ লেখান, বাকীরা পারিবারিক- সামাজিক নিন্দা ইত্যাদির ভয়ে অন্ধকারেই থেকে যান। ভারতের মতন গণতান্ত্রিক দেশে মহিলা কমিশন রয়েছে। অথচ মহিলাদের সাথে ঘটে যাওয়া নানা গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা নেহাতই গতানুগতিক মন্তব্য করার মধ্যেই অধিকাংশ সময় সীমিত থাকে। কাঠুয়া থেকে হাথরাস বা বিলিকিস বানুর অপরাধীদের সাজা মকুব প্রসঙ্গে আমরা দেশের মহিলা কমিশনকেও বার বার নীরব না নিষ্ক্রিয় থাকতে দেখছি। অথচ সামাজিক মাধ্যমের দৌলতে নাগরিক সমাজের সেই সব মহিলারা, যারা নারীদের অধিকার নিয়ে সরব, তাদের উপর জঘন্য আক্রমণের ঘটনা ক্রমশই বেড়েই চলেছে, এর সাথে যুক্ত হয়েছে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। মাত্র কয়েক বছর আগে বুল্লি বাই ও সুল্লি ডিলসের নামে ধর্মীয় সংখ্যালঘু মহিলাদের একাংশকে যে ভাবে আক্রমন করা হয়েছিল, স্বাধীন ভারতে তা নজিরবিহীন, কিন্তু আক্রান্ত মহিলারা ন্যায়বিচার পেলেন কিনা সে খবর আর আমরা রাখি না। আর কিছুকাল পরে হাথরাসের ঘটনাও আমরা ভুলে যাব; ততদিন পর্যন্ত যতদিন না বিপদ আমাদের নিজেদের দরজায় কড়া নাড়ছে। আর সেরকম কোন বিপদের দিনে এই ক্ষয়িষ্ণু সামাজিক, রাজনৈতিক পরিবেশে আমাদের অসহায়তাও হয়ত সেদিন ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য বিলাপ করবে।
কিন্তু তাতে কি এসে যায়, আন্তর্জাতিক নারী দিবস তো আরেকটি বাণিজ্যিক দিন। আসুন আমরা কেনাকাটায় ছাড় ইত্যাদি নিয়ে ও নানা প্রতীকি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে মহিলাদের সমানাধিকার ও ক্ষমতায়নের কথা বলি, কারণ বাকী ৩৬৪ দিন আমরা আবার মেতে থাকব সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক রাজিনীতিতে, জড়িয়ে থাকব পুরুষতান্ত্রিক শাসনের বেড়াজালে; আমাদের অধিকারের লড়াই অন্য কেউ লড়ে দেবে এই মহৎ প্রত্যাশায়।
0 Comments
Post Comment