২০২৪ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি, উত্তরাখণ্ডের বানভুলপুরায় সরকারি জমিতে বেআইনি নির্মাণের অভিযোগে একটি মাদ্রাসা ও একটি মসজিদ হলদ্বানি পুর কর্তৃপক্ষ বুলডোজার চালিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। ঘটনায় স্থানীয় মুসলিমদের ব্যাপক বিক্ষোভ সমাবেশে পুলিশের গুলি চললে পাঁচজন প্রাণ হারিয়েছে, আহত শতাধিক।
কোথাও কোথাও রাস্তা সম্প্রসারণ বা পাবলিক পারপাসে সরকারি জমি খালি করতে মন্দির, মসজিদ বা অন্য ধর্মস্থান ভাঙা পড়েছে। কোন কোন জায়গায় অসন্তোষ দেখা গেলেও বাঁধভাঙা বিক্ষোভ হয়নি, যেমনটা হল হলদ্বানির বানভুলপুরায়। মনে হতে পারে, মুসলিমরা প্রতিবাদে সংযম দেখালে ভাল হত; তা হলে হয়তো এই ক্ষয়ক্ষতি এড়েনো যেত। এই প্রশ্নও ওঠা অস্বাভাবিক নয় যে, সেখানকার মুসলিমদের ধর্মপ্রাণতাই কি তাদের সালেরকম অশান্তির মধ্যে ঠেলে দিল?
মাদ্রাসা ও মসজিদে হাত দেওয়া, এ নিশ্চয় ধর্মীয় দিক থেকে আক্রমণ। কিন্তু মহল্লার মুসলিমদের মধ্যে ধর্মপ্রাণতা কতটা উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল, তা বোঝা মুশকিল। কেননা পিছনে আরও ঘটনা আছে, যার ফলে শুধু ধর্মস্থান নয়, তাদের অস্তিত্বই এক আবর্তের মধ্যে পড়েছে।
২০২২সালের ২০শে ডিসেম্বর, উত্তরাখণ্ড উচ্চ আদালত এই বানভুলপুরাতেই রেলের জমিতে বেআইনীভাবে বসবাসের অভিযোগে বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করার জন্য ২০২৩সালের ৭ই জানুয়ারি পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিল ভারতীয় রেল কর্তৃপক্ষকে। বাসিন্দাদের তরফে শীর্ষ আদালতে গেলে ২০২৩সালের ৫ই জানুয়ারি শীর্ষ আদালত উচ্ছেদের নির্দেশের উপর স্থগিতাদেশ জারি করে। শীর্ষ আদালত বলেছিল, এটি একটি মানবিক বিষয়। যারা নিয়মসম্মতভাবে ওখানে বসবাস করছে, তাদের জন্য বাস্তবসম্মত সমাধান খুঁজতে হবে রেল কর্তৃপক্ষকে, এমনকি যাদের জমির উপর আইনী অধিকার নেই, তাদের জন্যও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
বাস্তবসম্মত সমাধান খোঁজার দরকার ছিল আগেই, আদালতের বিচার প্রক্রিয়ার মধ্যে না ঢুকে। কারণ উচ্ছেদের দানবীয়তা থেকে রেহাই পাওয়া বানভুলপুরার পঞ্চাশ হাজার বাসিন্দার সিংহভাগ জীবন-জীবিকার দিক থেকে প্রান্তিক বর্গের। সুতরাং প্রশ্ন মানবাধিকারের। দ্বিতীয়ত, ষাট বছরের বেশি সময় ধরে তারা সেখানে বসবাস করছে। সেখানে গড়ে উঠেছে একটি কমিউনিটি হেল্থ সেন্টার, চারটি সরকারি স্কুল ও দশটি বেসরকারি স্কুল, একটি ব্যাঙ্ক, চারটি মন্দির, একটি কবরস্থান ও দুটি মাজার, এবং দশটি মসজিদের মধ্যে নয়টি এখনও রয়ে গেছে। কিন্তু সব প্রসঙ্গই লোপাট হয়ে গিয়েছিল উচ্চ আদালতের একতরফা (Ex-parte) রায়ে। কোভিড পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে এলাকার বাসিন্দাদের শুনানির সুযোগ দেওয়া হয়নি। উত্তরাখণ্ড সরকার এই উচ্ছেদ প্রক্রিয়ায় ‘অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের’ ভূমিকা নিয়েছিল-- প্রশাসনিক সহযোগিতার ‘আইনী’ পদক্ষেপ ছাড়া সরকার নাকি কোনভাবে ব্যাপারটায় জড়িত ছিল না।
কিন্তু ন্যায়ত উত্তরাখণ্ড সরকারের দায় সবচেয়ে বেশি। বাসিন্দাদের অনেকের কাছে আছে নজুল (nazul) জমি হিসেবে সরকারি লীজের নথি। আবার ১৯৪৭ সালে ‘শত্রু জমি’ (enemy property) হিসেবে ‘ইউনিয়ন মিনিস্ট্রি অফ রিহ্যাবিলিটেশন’সালের তত্ত্বাবধানে নিলাম-বিক্রয়ের (auction-sale)সালের শংসাপত্র (evidence of title) আছে বেশ কিছুজনের। বাকি বাসিন্দাদের আছে স্থানীয় সরকারি কর্তৃপক্ষের দেওয়া জমি পাট্টার কাগজ। ২০০৯ সালে উত্তরাখণ্ড সরকার নতুন নজুল পলিসি আনে-- এই ধরনের সব জমিগুলিকে ফ্রীহোল্ড ল্যাণ্ডে পরিবর্তিত করে। তখন থেকে বানভুলপুরার বহু জমির অধিকারী সেল ডীডসালের কাগজ পেয়েছে।
রেল কর্তৃপক্ষ যেখানে ২০০৭ সাল থেকে দাবি করে আসছে ২৯ একরের মালিকানা, সেখানে পিলার পুঁতে রেখেছিল ৭৮ একর পরিসরে। অদ্ভুতভাবে ২০২২ সাল থেকে বলছে, তারা ৭৮ একরের মালিক। ইতিমধ্যে রেল দপ্তর ঐ ৭৮ একর জায়গার ম্যাপও বানিয়ে নিয়েছে, এবং আর কোন বৈধ কাগজপত্র নয়, এই ম্যাপ দেখিয়েই কিস্তিমাত করতে চাইছে। তখন তো রাজ্য সরকারকে জমির অধিকারীদের পাশে দাঁড়াতেই হয়। এখন দাঁড়ায়নি, ২০১৬ সালে দাঁড়িয়েছিল। এখন আছে বি.জে.পির সরকার, তখন ছিল কংগ্রেসের। উচ্ছেদের মামলাটি এখনকার নয়। ২০১৬ সালে উত্তরাখণ্ড উচ্চ আদালত জনৈক ব্যক্তির জনস্বার্থ সংক্রান্ত মামলার পরিপ্রেক্ষিতে এই এলাকায় উচ্ছেদের নির্দেশ দিয়েছিল। তখন উত্তরাখণ্ড সরকার উচ্চ আদালতে রায় পুনর্বিবেচনা করার জন্য আপীল করেছিল। সরকারের বক্তব্যের মূল প্রতিপাদ্য ছিল এলাকার বাসিন্দাদের বৈধ দখলিস্বত্ত্বের বিষয়টি। তখনকার মতো উচ্ছেদ প্রসঙ্গ ধামাচাপা পড়ে যায়।
প্রশ্ন হল, কেন উচ্ছেদ? আর কেনইবা উত্তরাখণ্ড সরকারের উচ্ছেদ নিয়ে এই নীরবতা, যা কার্যত উচ্ছেদের পক্ষেই গেছে? দুটি প্রশ্নের উত্তর একটিই— বানভুলপুরায় ৯০ শতাংশ বাসিন্দা মুসলমান। এবং মুসলিমদের মধ্যে বি.জে.পির গ্রহণযোগ্যতা নেই। ফলে নৈনিতাল জেলায় একমাত্র হলদ্বানি বিধানসভা কেন্দ্র থেকে কখনও সালেরনির্বাচনে জিতে যেতে পারে না। মুসলিমদের এলাকা থেকে বিতাড়িত করতে পারলে সোনায় সহাগা হবে। আর বাকি ১০ শতাংশের বেলায়, যারা ধর্মবিশ্বাসে হিন্দু? সংখ্যালঘু দমন-যজ্ঞে সংখ্যাগুরুর কিছু মানুষকে দধীচির ভূমিকা নিতে হবে যে!
অদ্ভুত ব্যাপার এই যে, যে জায়গা নিজেদের দাবি করে রেল কর্তৃপক্ষ স্থানীয় মানুষদের উচ্ছেদে এগিয়ে ব্যর্থ হল, সেই জায়গাতেই পুর কর্তৃপক্ষ নিজেদের আইনী অধিকারের কথা বলে মাদ্রাসা ও মসজিদ ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিল। ক্ষমতার ঔদ্ধত্য স্বৈরাচারের কোন উচ্চতায় উঠতে পারে, এই ঘটনা তার স্পষ্ট দৃষ্টান্ত। ধ্বংসপ্রাপ্ত মাদ্রাসা ও মসজিদের অবস্থান বানভুলপুরার নজুল ল্যাণ্ডেই, যা ১৯৩৭ সালে জনৈক মোহাম্মদ ইয়াসিন ব্রিটিশ সরকারের থেকে লীজে নিয়েছিলেন। হাত-ফেরের মধ্য দিয়ে ১৯৯৪ সালে আব্দুল হামিদ খান এই জমির সত্ত্বাধিকারী হন। ২০০৬ সালে লীজের মেয়াদ শেষের প্রাক্কালে তিনি জেলা প্রশাসনের কাছে জমিটিকে ফ্রীহোল্ড ল্যাণ্ডে রূপান্তরিত করার জন্য আবেদন করেন। সেখানে সাড়া না পেয়ে ২০০৭ এ উচ্চ আদালতে আবেদন করলে বিচারক জেলা শাসককে নির্দেশ দেন বিষয়টির আইনী নিষ্পত্তির জন্য। তথাপি আজ পর্যন্ত বিষয়টি ঝুলে আছে। ২০২৪সালের ৩০শে জানুয়ারি হলদ্বানি পুর কর্তৃপক্ষের উচ্ছেদ নোটিশ পাওয়ার পর আব্দুল হামিদের পুত্র বর্তমান সত্ত্বাধিকারী আব্দুল মালিকের তরফে উচ্চ আদালতে গেলে বিষয়টির শুনানির জন্য ২০২৪ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করে উচ্চ আদালত। কিন্তু তার আগেই পুর কর্তৃপক্ষ কাঠামো ধ্বংসে পদক্ষেপ করল। আবার উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী দাবি করলেন, এই উচ্ছেদ অভিযান আদালত দ্বারা অনুমোদিত। এমনকি, পুর কমিশনার যে আইনসম্মত নোটিশের সাফাই দিয়েছিল, যা ‘পাবলিক প্রেমিসেস (এভিকশন অফ আনঅথোরাইজড অক্যুপ্যান্টস) অ্যাক্ট ১৯৭১’সালের অধীনে ইস্যু করা হয়েছিল, তাতে বলা আছে, প্রাথমিকভাবে জমির দখলদারকে শো-কজ নোটিশ ইস্যু করতে হবে অন্তত ১০ দিন সময় দিয়ে। আরও বলা আছে, জমির দখলদারকে উচ্ছেদের নোটিশের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতে আপীল করার সুযোগ দিতে হবে।
এই পরিপ্রেক্ষিত এটি স্পষ্ট করে যে, বানভুলপুরায় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ভাঙা নিয়ে সেখানকার মুসলিমদের জান-কবুল প্রতিরোধ খাড়া করা—এ ধর্মীয় নিছক আবেগের বিষয় নয়। এই ঘটনা তাদের কাছে তাদের অস্তিত্বের সামনে সম্ভাব্য বিপদের সঙ্কেত হয়েই উপস্থিত হয়েছিল। ভানভুলপুরায় উচ্ছেদ নিয়ে রেল কর্তৃপক্ষ ও হলদ্বানি পুর কর্তৃপক্ষ যে বৈরিতার দৃষ্টান্ত রেখেছে, তাতে এই আশঙ্কা হওয়াই স্বাভাবিক।
হলদ্বানিতে উচ্ছেদ ছিল পুরোপুরি রাজনৈতিক বিষয়। এবং তা সংখ্যাগুরু আধিপত্যকামী রাজনীতি হওয়ায় উচ্ছেদে বিফল হয়ে ধর্মীয়ভাবে আঘাত করল। সালের কিছু আশু উদ্দেশ্য আছে। ধর্মস্থানে আঘাত-ধর্মীয় পরিচিতির দিক থেকে বিরোধিতা-হিন্দু ভাবাবেগে সুড়সুড়ি দেওয়া— একটি উদ্দেশ্য হতে পারে। অবশ্য এইটুকুতে তার খিদে মিটবার নয়। সামনে লোকসভা নির্বাচন। সন্দেহ হয়, বানভুলপুরার ভোটাররা ঠিকমতো ভোট দিতে পারবে কিনা। সেজন্য শক্ত কোন বিরোধের সম্ভাবনাকে আগেভাগে বানচাল করতে মাদ্রাসা-মসজিদ ভাঙার অভিযানকে হাতিয়ার করার ফন্দি বলে মনে হয়।
বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে শাসনের এক দানবীয়তার নাম দাঁড়িয়েছে ‘বুলডোজার রাজ’। সরকারী জমিতে বেআইনীভাবে বসবাস ও জীবিকার্জনের ব্যবস্থাপনার অজুহাতে মুসলিমদের উচ্ছেদ করতে বুলডোজার নিয়ে হানা দেওয়া-- সালেরশাসিত রাজ্যগুলোতে মুসলমান বিরোধী কর্মকাণ্ডে এক বিশেষ ধরনে পরিণত হয়েছে। এখানে কোন আইন বা পুনর্বাসন পলিসি বা মানবাধিকার কোন কিছুর তোয়াক্কা করার দায় নেই। আবার দেখা গেছে, কোন হিন্দু ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়ানো, তারপর মুসলিমদের দিক থেকে হিংসা ছড়ানোর মিথ্যা অভিযোগ তুলে সংশ্লিষ্ট এলাকায় বসবাসরত মুসলিমদের বাসগৃহ বা সম্পত্তি বেআইনী নির্মাণের ধুয়ো তুলে সরকারি প্রশাসনের তরফে বুলডোজার চালিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া— উত্তর ভারতে এমন ঘটনা হামেশাই ঘটেছে।
আরও উদ্বেগের বিষয় যে, আইন অমান্যের অভিযোগ হোক অথবা স্রেফ বৈরিতাবশে, মুসলিমদের বিরুদ্ধে অভিযোগের নিষ্পত্তি আইন-বহির্ভূতভাবে সরকারী প্রশাসন বা সমাজের মাথাদের মর্জিমাফিক করার প্রবণতা দেশের আইন ও বিচারব্যবস্থার প্রতি অবজ্ঞা ও অস্বীকৃতিকে প্রকট করে। এটি দেশের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে সাংবিধানিক প্রজ্ঞা ও বিধি-বিধানের বিরুদ্ধে যায়। সংখ্যালঘুদের এভাবে উচ্ছেদ অথবা গণতন্ত্রের বৃহৎ অঙ্গন থেকে প্রত্যাখ্যান করার অপপ্রয়াস— সংখ্যাগুরু আধিপত্য কায়েম করার একমাত্র পন্থা নয়; কোন এক পর্যায়ে সংখ্যাগুরু মানুষেরাও সংখ্যাগুরু আধিপত্যকামী রাজনীতির লক্ষ্যবস্তু হয়ে দাঁড়াবে। কেননা আধিপত্যকামী রাজনীতির কেন্দ্রে আছে কর্তৃত্ববাদ আর গণতন্ত্রের আছে কর্তৃত্ববাদের বিপরীত সংকল্প, এবং গণতন্ত্রের কোন সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু বিচারধারা নেই। ফলে কর্তত্ববাদের নিশানা শুধু সংখ্যালঘুরাই নয়, কোথাও-না-কোথাও কোন-না-কোন সময়ে সংখ্যাগুরুদের উপরেও কর্তৃত্ববাদের খড়্গ নেমে আসবে। এ ব্যাপারে আমরা দিল্লির তুঘলকাবাদের ঘটনা স্মরণ করতে পারি।
তুঘলকাবাদে দুই লক্ষাধিক মানুষের বাস। তার পাশেই আছে সুলতান গিয়াসুদ্দিন তুঘলক নির্মিত দুর্গ। এই দুর্গের জায়গা দখল করে বসবাস করছে, এই অভিযোগে এ.এস.আই (আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইণ্ডিয়া) ২০২৩-সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে কয়েক হাজার পরিবারকে উচ্ছেদে উদ্যত হয়। এখানে অধিকাংশ হিন্দুর বাস এবং তাদের বড় অংশ বি.জে.পির চিরাচরিত ভোটার। কিন্তু ২০২২সালের দিল্লি মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন নির্বাচনে সালেরএই ওয়ার্ডে হেরে যায়। সামগ্রিক নির্বাচনী ফলাফলে দিল্লি কর্পোরেশনও বি.জে.পির হাত ছাড়া হয়, যা ১৫ বছর একটানা তাদের হাতে ছিল। অতঃপর উচ্ছেদের তৎপরতায় এলাকার অনেকেরই এই বিশ্বাস হয়েছিল যে, হারের প্রতিশোধ নিতেই এই উচ্ছেদ অভিযান।