এ কেমন স্বাধীন দেশে আমরা বসবাস করি? যেখানে অনির্বাচিত রাজ্যপালের বিরুদ্ধে মামলা গ্রহণ করতে সর্বোচ্চ আদালতকে নানা প্যাঁচ কষতে হয়, আর নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী কে একজন কনস্টেবল গ্রেপ্তার করে নিতে পারে? ২০২৪ সালের লোকসভা ভোট এমনই বহু প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।
গত দুই বছর যাবৎ ভারতে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পক্ষে যত জোরালো আওয়াজ উঠেছে তত জোড়ালো আওয়াজ বিগত ১২৫ বছরে ওঠেনি। এবারের লোকসভা ভোটের অক্ষ ছিল সবল রাজ্য বনাম সবল কেন্দ্র। বলাই বাহুল্য, সবল রাজ্যের দাবী, স্বশাসিত রাজ্যের দাবী যত জোরালো হবে ততই রাজ্যপাল পদের অবসানের দাবিও শক্তিশালী হবে। বিরোধী পক্ষ এই আশংকায় ছিল যে এবার মোদী স্বমহিমায় ফিরলে সব কটা রাজ্যকেই কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে বদলে দেবে। ফলে গত একশো বছরে সরকার বিরোধী দলগুলির যে রূপ জনগণ দেখেনি সেটা এবার দেখলো। বিরোধী দলগুলোর অনুপ্রেরণায় জনতাও এই নতুন লড়াইয়ের গুরুত্ব বুঝেছেন। আর বিরোধী দলগুলো নিশ্চয়ই বুঝেছে যে একবার যখন জনগণ এই স্লোগানের স্বাদ পেয়েছে তখন আর তারা থামবেন না।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অক্ষ ছিল হিন্দু মুসলিম সম্পর্ক, যার আবার রাজনৈতিক বহিঃপ্রকাশ ছিল স্বাধীন ভারতে কেন্দ্রীয় সরকার তুলনায় শক্তিশালী হবে নাকি রাজ্য (আঞ্চলিক) সরকার। হিন্দু মহাসভা, আরএসএস চিরকাল ছিল কেন্দ্রীভূত শাসনের পক্ষের শক্তি। তারা ছিল রাজনৈতিক সংরক্ষণের চূড়ান্ত বিরোধী। পৃথক নির্বাচক মন্ডলীর প্রস্তাব কংগ্রেস মেনে নিলেও তারা সার্বিক বিরোধিতা করে গেছে। Montford সংস্কারের বিরোধী, খিলাফত ঐক্যের বিরোধী, আবার তার পর প্রথম নির্বাচনে মুসলিম লীগকে ভোটে লড়ে সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার পক্ষে ছিল তারা। কংগ্রেস দলকে ভেঙে মুক্তমনাদের সাথে মিলে মিশে নতুন দল করে হিন্দু এলিটদের ভোট অংশ নেওয়া যদিও তারা সুনিশ্চিত করেছিল। অন্যদিকে সাইমন কমিশন সকলে বয়কট করলেও অস্পৃশ্যদের সংরক্ষণের দাবিতে আম্বেদকর করেননি। গোটা পর্যায় জুড়ে আরএসএস হিন্দু মহাসভা উদারমনা জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বকে টেনে রেখেছিল পিছনে। রাজনৈতিক সংরক্ষণের দাবি থেকে সরে গিয়ে মুসলিম লীগ যেদিন চোদ্দ দফা দাবি পেশ করল, তার পাল্টা যে রিপোর্ট পেশ করা হল সেখানেও আরএসএস নেতাদের প্রভাব স্পষ্ট। শেষ দিন পর্যন্ত দেশ ভাগ করার সমস্ত কলকাঠি নেড়ে তারা কেন্দ্রীভূত শাসনের পক্ষে দাঁড়িয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে কেন্দ্র করে যে ইংরেজ কমিশনগুলো দশ বছর অন্তর ভারতে পৌঁছত সেগুলোর সম্পর্কে ভারতের দলগুলো কি অবস্থান গ্রহণ করবে সেই নিয়ে ছিল বিতর্ক। ভবিষ্যত ভারতের যে সংবিধান ভারতীয় দলগুলো পৃথকভাবে পেশ করলো সেখানে মূল পার্থক্য হল রাজ্য তুলনায় শক্তিশালী হবে নাকি কেন্দ্র? হিন্দু মুসলিম সম্পর্ক আর রাজ্য কেন্দ্র সম্পর্ক মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছিল। দেশভাগ হবে এই আশংকা যদিও ১৯০৬ সালে, ১৯০৯ সালে, ১৯২৭ সালে, ছিল না। কিন্তু যারা ঐক্য চেয়েছিলেন আন্তরিকভাবে তাদের কাছে এটা আশা করা কি অন্যায় যে সেই পর্যায়ে জুড়েই হিন্দু মুসলিম সম্পর্ক এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে যদি সংযুক্ত ভাবে দেখা যেত তবে ১৯৪০ সাল পরবর্তী স্পষ্ট বিভাজন আর হয় না। আজকের আলোচনা এই নিয়ে নয়। কিন্তু এই পর্যায়ে যদি লুস কনফেডারেশনের (loose confederation) পথে যাত্রা শুরু করতো ভারত তবে ১৯৪৭ সালে প্রাক সংবিধানসভা, বা ১৯৫০ সালে সংবিধান সভা রাজ্যপালের পদটি কিছুতেই মেনে নিত না। শ্রী আম্বেদকারকেও এটা বলতে হতো না যে আমেরিকার মতন আমাদের দেশ বিভিন্ন স্বশাসিত রাজ্যের জোট নয়। প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবীরা দাবী করেন যে দেশভাগের অমন বিপদের মুখে দাঁড়িয়েই নাকি রাজ্যপাল পদ তুলে দিয়ে কেন্দ্রকে দুর্বল করার কথা কেউ ভাবতে পারেননি। কথাটা ঠিক বিপরীত। আগেই বলেছি কেন্দ্রীভূত শাসনের প্রতি নেতাদের অনুরাগ দেশভাগের ফল নয়, আসলে ছিল দেশভাগের কারণ।
সংবিধান সভায় কি তা হলে রাজ্যপাল নিয়ে কোনো বিতর্ক হয়নি? হয়েছে অবশ্যই। রাজ্যপালের নিয়োগের প্রক্রিয়া নিয়ে হয়েছে, রাজ্যপালকে সরিয়ে দেওয়ার প্রকরণ নিয়ে হয়েছে, রাজ্যপালের হাতে দেওয়া ৩৫৬ ধারার মতন বিশেষ ক্ষমতা নিয়ে হয়েছে। কিন্তু রাজ্যপালের পদের অবলুপ্তি নিয়ে হয়নি। এমনকি K T Shah, Kamath, T Krishmachari, Shibban Lal Saxena alladi krishnaswamy দের মুখেও রাজ্যপাল পদের অবসান নিয়ে কোনো বক্তব্য অন্তত খুঁজে পাওয়া যায়নি। সংবিধান সভার একটা বড় অংশ, অনেক দিকপাল সহ, রাজ্যপালকে অমিত শক্তিধর করতে চেয়েছিলেন। কারণ তারা সমগ্র স্বাধীনতা সংগ্রাম জুড়ে ছিলেন সবল কেন্দ্রের পক্ষের লোক। তারা চাননি যে রাজ্যগুলি বেয়াদপি করুক। বিপরীতে ছিলেন এমন অনেকে, দিকপাল সহ, যারা চেয়েছিলেন রাজ্যপাল হবেন একটি আলংকারিক প্রধান। রাজ্যগুলির ক্ষমতা যাতে বিন্দুমাত্র খর্ব না হয় সেই ব্যাপারেই তারা বেশী আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু সবটাই রাজ্যপাল পদ বহাল রেখে!! ঠিক যেমন ক্যাবিনেট মিশন প্রস্তাব বাতিল করেও তারা ভেবেছিলেন দেশের ঐক্য বজায় থাকবে। অথবা মুসলিম লীগের ১৯২৭ সালের ১৪ দফা দাবী সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে নেহরু রিপোর্ট পেশ করলেও বোধহয় ঐক্য ভাঙবে না। স্বশাসিত রাজ্যের যে প্রস্তাব দাবী ভারতে ভিন্ন মহল থেকে নানা কারণে উঠেছিল, সেগুলোকে সংকীর্ণ স্বার্থে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করলে যে দেশ ভাঙবে সেদিনও নেতারা বোঝেননি, বা না বোঝার ভাণ করেছেন। আর তাই দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও তারা ভাবতেও পারেননি রাজ্যপালের পদ তুলে দিয়ে স্বশাসিত রাজ্য বানাবেন তারা।
আম্বেদকার ছিলেন কট্টর কেন্দ্রীভূত শাসনপন্থী সংবিধানসভার ভারী অংশ আর সংখ্যালঘু ফেডেরাল কাঠামোপন্থী (স্বশাসিত নয়) অংশের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা মানুষ। বাস্তবেও কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাব কমিটির মাথা উনি না থাকলেও তিনি ছিলেন খসড়া কমিটির প্রধান। তবে সেইদিন এই ভারসাম্য রক্ষা করার দরকারও ছিল। না হলে প্রভাবশালীরাই ছড়ি ঘুরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দফা রফা করে ছেড়ে দিতো। সংবিধান সভার আসল কাজ করেছিল সাব কমিটিগুলো। আঞ্চলিক বা রাজ্য সরকারের দায় দায়িত্ব, unitary সরকারের সাথে এই আঞ্চলিক বা রাজ্য সরকারের সম্পর্ক কি হবে সেই সাব কমিটির মাথায় থাকলেন প্যাটেল, যিনি নিজে ছিলেন শক্তিশালী কেন্দ্র সরকার পন্থী মানুষ। ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী ভারতের হওয়ার কথা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো। কিন্তু এই সাব কমিটি কোনো সিদ্ধান্তেই পৌঁছতে পারল না। বিতর্ক হল বড় পরিমাণে। রাজ্যপাল নিয়ে আলোচনা মানেই ঘুরে ফিরে সেই একই প্রশ্ন, দেশের যুক্তরাষ্ট্রে কেন্দ্র কত শক্তিশালী হবে, রাজ্যগুলো কতটা শক্তিশালী হবে। রাজ্যগুলো স্বশাসিত হবে, নাকি কেন্দ্র নামক অভিভাবকের সংসারে জুনিয়র পার্টনার হবে? শক্তিশালী কেন্দ্র পন্থীদের পক্ষ থেকে রাজ্যপাল পদটাকে শক্তিশালী করার জন্য দুই তিনরকম প্রস্তাব এলো। রাজ্যপালকে সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত করার প্রস্তাব যেগুলোর মধ্যে ছিল অগ্রগণ্য। রাজ্যপাল নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে পারেনি এই সাব কমিটি। ঠিক হল, রাজ্যপাল বিষয়টা কেন্দ্রীয় সরকার সাব কমিটিরও অন্তর্ভুক্ত। যে কমিটির মাথা নেহরু। যুগ্ম কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হল, কেন্দ্রের প্রতিনিধি রাজ্যপাল কেন্দ্রের দ্বারা নয়, বরং রাজ্যের জনগণের সার্বজনীন ভোটাধিকারের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত হবেন। কিন্তু এটা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর সম্পূর্ন বিপরীত অবস্থান হয়ে গেছে সেটা বুঝে কমিটি শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে রাজ্যের বিধায়করা নির্বাচিত করবেন চার জন প্রার্থীকে। এবং সেই চারজনের মধ্যে থেকে একজনকে বেছে নিয়ে রাজ্যপাল মনোনীত করবেন রাষ্ট্রপতি। অর্থাৎ রাজ্যের বিধায়কদের দ্বারা নির্বাচিত রাজ্যপাল। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের মত প্রক্রিয়া প্রস্তাব করলো ওই যুগ্ম কমিটি। কিন্তু দুই বছর পর যখন সংবিধান সভা বসলো তখন সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ বদলে গেল। শক্তিশালী কেন্দ্র পন্থী এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো পন্থীরা একটা জায়গায় এসে মিলিত হলেন, আম্বেদকরের সাহয্যে। রাষ্ট্রপতি মনোনীত করলে তার ক্ষমতা কমবে নির্বাচিত হওয়ার তুলনায়, আম্বেদকারের এই যুক্তি শেষ পর্যন্ত টিকে গেল। কে কে মুন্সী, কৃষ্ণস্বামী আল্লাদিদের আর আপত্তি তুললেন না। নির্বাচিত হওয়া মানেই রাজ্যপাল হয় প্রধানমন্ত্রীর মতই শক্তিধর হবেন অথবা মুখ্যমন্ত্রীর মতই সবল হবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাজ্যপালকে রাষ্ট্রপতি দ্বারা মনোনীত করবেন ঠিক হল। রাজ্যের দ্বারা ভোট তো হলই না, এমনকি মনোনয়নও হল না। ফলে এই দিক থেকে সবল কেন্দ্র পন্থীরাই জিতে গেলেন। উপরন্তু আর একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কথা এলো। রাজ্যপাল যাতে রাজ্যের পছন্দসই হয়, তাই রাজ্যের মন্ত্রিসভার আলোচনার নিরিখেই মনোনীত করা হবেন রাজ্যপাল। সুতরাং রাজ্যপাল এবার সরাসরি কেন্দ্রের লোক।
রাজ্যপালকে সরানোর প্রক্রিয়া নিয়েও যথেষ্ট বিতর্ক হল। প্রথম প্রস্তাব এলো যুক্তরাষ্ট্রীয় পন্থীদের তরফ থেকে যে জজদের যেভাবে সরানোর সুযোগ থাকছে, ঠিক সেই প্রক্রিয়াতেই রাজ্যপালকেও বরখাস্ত করার আইন থাকা উচিত। কিন্তু সেটাও মানা হল না। একমাত্র রাষ্ট্রপতি, বা রাষ্ট্রপতি যার পরামর্শে চলবেন যে কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেটের উপরেই রাজ্যপালের যাওয়া নির্ভর করলো। রাজ্যপাল যখন থাকলই স্বশাসিত রাজ্যের ন্যূণতম সম্ভাবনাকে বাতিল করে, ফলে তার হাতে থেকে গেল বিশেষ ক্ষমতা। এই সিদ্ধান্তের পর ৩৫৬ ধারা নিয়ে যা যা তর্ক বিতর্ক হয়েছিল সেটা অর্থহীন। আসলে কেন্দ্র বনাম রাজ্য বিতর্কে জিতে গেল কেন্দ্র। আর আজ, ২০২৪ সালে এসে দেখা যাচ্ছে, স্বৈরাচার থাবা বসিয়েছে আরও অনেকটা। তাই আজ জনপ্রতিনিধিদের গুরুত্ব, জনপ্রতিনিধিত্বমুলক সংস্থার গুরুত্ব আরও নীচে নেমে গেছে। এখন আদালত বনাম রাজ্যপালের দ্বৈরথে জনগণকে নির্ভর করতে হচ্ছে। দুটো অনির্বাচিত সংস্থা আজ দেশের ভবিষ্যত নির্ধারণ করছে। স্বাধীন ভারতে এখন গণতন্ত্রের রক্ষা কর্তা আদালত--- এই লজ্জা আমরা লোকাই কোথায়!! যদিও লজ্জা শুধু আমাদের নয়, দায় এবং লজ্জা সংবিধান সভার সেই ৩৮৯ জনেরও। রাজ্যপালের রক্ষাকবচ এমনই যে সে দাগী অপরাধীও হয়ে উঠতে পারে, দেশের স্বার্থে। আর সেই রক্ষাকবচকে নিজেদের মত করে ব্যাখ্যা করে যদি আদালত রাজ্যপালের বিরুদ্ধে মামলা গ্রহণ করে তবেই আদালতই হয়ে উঠছে গণতন্ত্রের ভাগ্যবিধাতা!! চারিদিকে আদালতের জয়জয়কার ধ্বনি উঠছে। ১৯৯৪ সালের বোম্মাই রায় হল। ৩৬৫ ধারা নিয়ে রাজ্যপালের হাতে পায়ে বেড়ি পড়ানোর পরেও রাজ্যপাল নিজেদের কার্যসিদ্ধি করতে সাংবিধানিক ফাঁক ঠিকই বের করে নিয়েছেন। ১৬৩, ১৬৭ এবং ২০০ নম্বর ধারাকে ব্যবহার করে, প্রতিটা বিল দেখতে চেয়ে এবং রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর আছিলায় আটকে রেখে রাজ্যপালরা অবিজেপি রাজ্যের মানুষকে হেনস্থা করে চলেছে। যার বিরুদ্ধে তামিল নাডু, পাঞ্জাব আর কেরালা সরকার ২০২৩ সালের নভেম্বরে আদালতে গেছিল। আদালত ধমকও দিয়েছে রাজ্যপালকে। কিন্তু অস্পষ্ট রায় দিয়েছে। আদালত বললো রাজ্যপালগুলি অন্যায় করছে। বললো যে তারা সংবিধান বিরোধী ভূমিকা নিচ্ছে। অথচ দেখা গেল রায় হিসেবে বলা হল যত শীঘ্র সম্ভব টাকাগুলো দিয়ে দেওয়া হোক। যত শীঘ্র সম্ভব, এ আবার কেমন রায়!! আদালত এমন ভাবেই রায় দিচ্ছে যাতে আইনের শাসন কায়েম হয়ে স্বৈরাচার বন্ধ হওয়ার বদলে যাতে জনতাকে বার বার আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়।
বোম্মাই মামলারও আগে সারকারিয়া কমিশন বসলো, কেন্দ্র রাজ্য সম্পর্ককে ভারসাম্যযুক্ত করার জন্য। সারকারিয়া কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী hung assembly-র ক্ষেত্রে রাজ্যপালের কি করণীয়? রাজ্যপাল কোন ক্রমে ডাকবে সরকার গঠনের জন্য, সেটা বোঝানো হল। প্রথমে তাদের ডাকতে হবে যাদের ভোটের আগে থেকেই জোট ছিল। তার পর সেই দলকে যে সবচেয়ে বেশী আসন পেয়েছে, তাকে বাইরে থেকে সমর্থন দিচ্ছে অন্যান্য দল বা নির্দল প্রার্থী। তার পর ডাকতে হবে ভোট পরবর্তী জোটকে , যদি সেই জোটের সব শরিক সরকারে ঢুকতে রাজি হয়। তার পর সুযোগ পাবে ভোট পরবর্তী কোনো জোট, যার কিছু শরিক সরকারে ঢুকবে, কিছু বাইরে থেকে সমর্থন করবে। কিন্তু বাস্তবে এই মাত্র তিন বছর আগেও মহারাষ্ট্রে নাটকীয় পটপরিবির্তনে কোশিয়ারি বাবু কোনো সারকারিয়া কমিশনের ভ্রুক্ষেপ করলো না। করার কথাও নয়। ওই যে রাজ্যপালকে সংবিধান সভা কিছু বিশেষ ক্ষমতা (discretionary power) দিয়ে রেখেছে। নির্বাচন কমিশন যে ঝাড়খন্ডের মুখ্যমন্ত্রী সোরেনকে নির্দোষ বলেছে, সেই তথ্য রাজ্যপাল গোপন করার সুযোগ পেয়েছে কারণ নির্বাচন কমিশোন রাজ্য জনপ্রতিনিধিদের না জানিয়ে রাজ্যপালকে জানিয়েছে। কেরালার রাজ্যপাল আরিফ মহম্মদ খানের আস্পর্ধা তো গগনচুম্বী। পশ্চিমবঙ্গে বোস এরাজ্যের হাজার হাজার মেহনতী মানুষের হকের পাওনা আটকে রেখেছেন তিনি। 2007 সালে পুঞ্চি কমিশন বসিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টা হয়েছিল নাকি রাজ্যপালকে রাজ্য সরকার ইম্পিচ করতে পারবে এই প্রস্তাব দিয়ে রাজ্যের ক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টা হয়েছিল সেটা এখনোও ধাঁধা।
রাষ্ট্রপতি শাসন এদেশে লাগু হয়েছিল ১৩০ বারের বেশী। সবচেয়ে বেশী ইন্দিরার দুই আমলে। এক, ৫০ম বার ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৭, ১৯৮০ থেকে ১৯৮৪। আর জনতা পার্টির আমলে ২০ বার, ১৯৭৭ থেকে ১৯৮০। নেহরু সরকার ১৯৫৮ সালে কেরালার নাম্বুদরিপাদ সরকারকে ফেলে দেয় রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করে। আমরা গত সাত দশক ধরে রাজ্যপালের পদ নিয়ে স্বৈরাচারে অত্যন্ত বিরক্ত। কিন্তু আজ মোদীদের দল শুধু কয়েক মাসের জন্য জরুরি অবস্থা নয়, রাজ্যগুলিকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বদলে দিতে চাইছে।
ব্রিটিশ শাসকরা ভারতকে দেশভাগের দাঙ্গার মধ্যে ফেলে পালিয়েছিল। ন্যূনতম প্রশাসনিক ভূমিকাটুকুও তারা নেয়নি। দুর্দান্ত ক্যাবিনেটে মিশন রিপোর্ট মেনেও মানেনি ভারতীয় দলগুলি। সুতরাং দাঙ্গা হবেই। অথচ মাউন্টব্যাটেন মিলিটারি ব্যারাকে তখন বাজছে ঈশ্বরের গান বাজছিল। দাঙ্গা করে হিন্দু মুসলিম জনসংখ্যাকে ভৌগোলিক ভাবে পৃথক করে ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগকে বাস্তব রূপ দেওয়া হল। গান্ধীজি নোয়াখালীর দাঙ্গায় বসে মুসলিমদের এপাড়ে থাকার ডাক দিলেন, দাঙ্গা থামলো, আরএসএস মানতে পারল না। গান্ধী হত্যা করে আবার দাঙ্গা বাঁধিয়ে এপাশে থেকে যাওয়া মুসলিমদের খেদানোর পরিকল্পনা ছিল সাভারকারদের। কিন্তু গান্ধী হত্যা দেশ কে অশান্ত করার বদলে শান্ত, স্তব্ধ করেছিল।
আজ নতুন অধ্যায়ে আমরা প্রবেশ করেছি। বিগত লোকসভার লড়াই স্রেফ আর পাঁচটা ভোটের মত ছিল না। দেশকে নতুন করে গড়ার লড়াই ছিল সেটা। আজ তাই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর দাবি লোকের মুখে মুখে। স্বশাসিত রাজ্যের দাবি, রাজ্যপাল পদ বিলোপের দাবি জনতার দরবারে। প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, যোগাযোগ আর মুদ্রা ছাড়া বাকি সব রাজ্যের হাতে তুলে দেওয়ার নামই হল রাজ্যের স্বশাসন। যা আদায় ছাড়া ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই সফল হবে না, ফ্যাসিবাদ কে ঝাড় বংশে উৎখাত করা যাবে না।