বিশ্বসাহিত্যের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাকার দস্তয়েভস্কির (১৮২১ - ২০২১) ২০০ বছর পূর্ণ হল। যাঁরা সাহিত্য পড়তে ভালোবাসেন, ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, রাজনীতিতে যাদের আগ্রহ আছে, তাঁরা অনেকেই নিয়মিতভাবে দস্তয়েভস্কির রচনাবলীতে অবগাহন করেন। প্রতিটি পাঠে খুঁজে পান চিন্তার নতুন নতুন দিক।
দস্তয়েভস্কির বিখ্যাত উপন্যাসগুলি - যার মধ্যে আছে নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড (১৮৬৪), ইডিয়ট (১৮৬৯), ডেভিলস (১৮৭২), ব্রাদার্স কারমাজোভ (১৮৮০) ইত্যাদি - সারা বিশ্বজুড়ে একইসঙ্গে সাধারণ পাঠক আর নোবেলজয়ী কথাকারবর্গ - সবাইকে গত দেড়শ বছর ধরে মাতিয়ে রেখেছে। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্টকে (১৮৬৬) অনেক সাহিত্য সমালোচকই পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশেষ্ঠ উপন্যাসের মর্যাদা দিয়ে থাকেন।
১৮৪৮ এর ইউরোপ জোড়া বিপ্লবের ঢেউ যখন রাশিয়ায় এসে পৌঁছেছিল, তখন অন্যান্য অনেকের মতো তা স্পর্শ করেছিল সাতাশ বছরের তরুণ দস্তয়েভস্কিকেও। এর তিন বছর আগে, মাত্র চবিশেই দস্তয়েভস্কির প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘পুওর পিপল’ প্রকাশের পরেই সাড়া ফেলেছে। সেই সময়কার বিখ্যাত সমালোচক বেলিনস্কি, তরুণ প্রগতিশীল ও পশ্চিমী মনোভাবাপন্ন লোকেদের মধ্যে যার খ্যাতি তখন তুঙ্গস্পর্শী – দস্তয়েভস্কির এই উপন্যাসটির ভূয়সী প্রশংসা করেন। এই উপন্যাসটির সূত্র ধরেই তরুণ দস্তয়েভস্কির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। দস্তয়েভস্কি ১৮৪৮ এর আলোড়ন তোলা সময়ে রুশ বিপ্লবী মিখাইল পেট্রাশেভস্কি চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন ও পেট্রাশেভস্কিকে ঘিরে বিপ্লবীদের যে আলোচনাচক্র বসত সেখানে নিয়মিত যাতায়াত শুরু করেন। সেখানে আলোচনা হত ভূমিদাসপ্রথার অবসান বা রুশ সেন্সরশিপের কঠোরতা থেকে মুক্তির প্রয়োজনীয়তা ও পদ্ধতির ওপর। সমকালীন ইউরোপীয় বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে জার প্রথম নিকোলাস রুশ তরুণদের এইসব প্রগতিশীল উদ্যোগকে শুরুতেই ধ্বংস করার চেষ্টা করেন। আরো অনেকের সঙ্গে গ্রেপ্তার হন দস্তয়েভস্কিও। প্রথমে তাঁর প্রাণদণ্ডেরই আদেশ হয়েছিল, পরে শাস্তি খানিকটা লঘু করে তাঁকে পাঠানো হয় সাইবেরিয়ায় সশ্রম কারাদণ্ডে। এই কারাজীবন দস্তয়েভস্কির দর্শন ও চিন্তায় মৌলিক বদল আনে। সামাজিক প্রগতিচিন্তার চেয়েও তিনি ব্যক্তির স্বাধীনতাকে বেশি গুরুত্ব দিতে আরম্ভ করেন। এই ভাবনা ক্রমশ ব্যাপ্ত ও গভীর হয়। দস্তয়েভস্কি সোসালিজম, নিহিলিজম ইত্যাদি ধারণাকে ব্যক্তি স্বাধীনতার পরিপন্থী বলে মনে করতে থাকেন এবং এগুলিকে রুশী ঐতিহ্যে ঢুকে পড়া পশ্চিম ইউরোপের প্রভাব বলে মনে করেন। চল্লিশের দশকের বেলিনস্কি ও পেট্রাশেভস্কি চক্রের চিন্তার উত্তরসূরী বলা যায় ষাটের দশকের চেরনিশেভস্কিদের। কিন্তু পেট্রাশেভস্কি চক্রের উৎসাহী তরুণ থেকে বদলে যাওয়া মধ্যবয়স্ক দস্তয়েভস্কি চেরনিশেভস্কির চিন্তা ও দর্শনকে মানতে তো পারলেইনই না, তাকে ব্যঙ্গে সমালোচনায় বিঁধতে চাইলেন ‘নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড’ নামের নভেলেট এ। চেরনিশেভস্কির ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান’ এবং তার পরের বছর প্রকাশিত দস্তয়েভস্কির ‘নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড’কে পাশাপাশি রেখে পড়লে স্পষ্ট বোঝা যায় কীভাবে দস্তয়েভস্কি সরাসরি চেরনিশেভস্কির দর্শন ও চিন্তার বিরুদ্ধ অবস্থান নিয়েছেন। চেরনিশেভস্কি মনে করেছিলেন যে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই যুক্তিবাদী এবং অধ্যয়ন ও প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার মধ্যে দিয়ে এই যুক্তিবাদকে ছড়িয়ে দিতে পারলে সামাজিক মুক্তি সম্ভব। বিজ্ঞানচিন্তাই প্রগতিচিন্তার সারাৎসার – এটাই ছিল চেরনিশেভস্কি সহ নিহিলিস্ট বা সোশালিস্টদের মত। উপযোগিতাবাদ, যুক্তিবাদ ও সমাজবাদের দর্শনটিকে দস্তয়েভস্কি নির্ধারনবাদ বলে মনে করলেন এবং ‘নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড’ থেকে তাকে খারিজ করা শুরু করলেন। মনে রাখতে হবে দস্তয়েভস্কির সমালোচনা ইংরেজ উপযোগিতাবাদী চিন্তাবিদ জেমস স্টুয়ার্ট মিল ও তাঁর গুরু জেরেমি বেন্থামের দর্শনের দিকেও ধাবিত হয়, কারণ চেরনিশেভস্কি যে সব চিন্তাধারা তাঁর লেখায় হাজির করেছিলেন তার অনেকগুলিরই উৎস রয়েছে মিল, বেন্থামের রচনায়।
১৮৬০ এর রাশিয়ায় বিপ্লবী আদর্শ হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এক নতুন ধরনের চিন্তাধারা – নিহিলিজম। এই মতবাদের পক্ষে বিপক্ষে কলম ধরেন তুর্গেনিভ, চেরনিশেভস্কি, দস্তয়েভস্কির মত সেকালের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য প্রতিভারা। পরপর তিন বছরে প্রকাশিত তিনটি ক্লাসিকে নিহিলিজমকে তিনটি আলাদা আলাদা দৃষ্টিকোণে দেখা হয়। ১৮৬২ তে তুর্গেনিভের ‘পিতা-পুত্র’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। ১৮৬৩ তে তার জবাব হিসেবে চেরনিশেভস্কি লেখেন ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান’ এবং পরের বছর, ১৮৬৪ সালে তার প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায় দস্তয়েভস্কির বিখ্যাত উপন্যাস ‘নোটস ফ্রম দ্য আন্ডারগ্রাউন্ড’ এর মধ্যে। আখ্যানের বাইরে সাহিত্য সমালোচনার জগতেও বিষয়টিকে কেন্দ্র করে বিতর্কর ঝড় বইতে থাকে।
‘নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড’ এ যে অনামা ‘আন্ডারগ্রাউন্ড ম্যান’কে দস্তয়েভস্কি হাজির করলেন, তিনি প্রথম তারুণ্যে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদকেই মুক্তির পথ ভেবেছিলেন, কিন্তু চল্লিশে পৌঁছে এর সীমাবদ্ধতাগুলি তার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি সামাজিক ইউটোপিয়াবাদকে খারিজ করেন এবং দেখান যে মানুষ মোটেই মূলগতভাবে যুক্তিবাদী নয়, যুক্তির বাঁধনে মানুষের জীবন, চিন্তা ও কাজ বাঁধা থাকে না, সে যুক্তি ও অযুক্তির মিশ্রণে স্বাধীনভাবে নিজের ইচ্ছানুযায়ী পথ চলতে চায়। দস্তয়েভস্কির এই ‘আন্ডারগ্রাউন্ড ম্যান’ এর কাছে জীবনের স্বাধীনতাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এবং যুক্তিবাদ, সমাজবাদ প্রভৃতি তার মতে স্বাধীনতার জন্য প্রতিবন্ধক। তার মতে যুক্তিবাদ মানুষকে যান্ত্রিক করে দিতে বাধ্য।
নিরাপত্তা ও সুখই যে মানুষের জীবনের জন্য যথেষ্ট নয়, বরং ক্ষেত্রবিশেষে তা তার স্বাধীনতার হন্তারক – এই ধারণাকে দস্তয়েভস্কি ফিরিয়ে আনেন তাঁর শেষ উপন্যাস ‘দ্য ব্রাদার্স কারমাজোভ’ এ। দ্য গ্রান্ড ইনকুইজিটর এর মধ্যে দিয়ে তিনি দেখান নিরাপত্তা ও সুখ শেষপর্যন্ত কীভাবে মানুষের মহত্তম আকাঙ্ক্ষা স্বাধীনতার প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ এর মূল কথা একজন মানুষের তীব্র মনস্তাত্ত্বিক লড়াই, সেখানে সে মূলত নিজের সঙ্গে লড়ে। লড়ে নিজের এই অতীত বিশ্বাসের সঙ্গে যে ভাবত একজন সুপারম্যান সমাজের বৃহত্তর প্রয়োজনে একজন ঘৃণিত নিকৃষ্ট মানুষকে খুনও করতে পারে। তাতে সমস্যার কিছুই নেই, বরং তা প্রয়োজনবাদী দিক থেকে যুক্তিগ্রাহ্যই। কিন্তু বাস্তবে এরকম একজনকে খুন করে ফেলার পর ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ এর নায়ক রাসকলনিকভ তীব্র মানসিক সমস্যার মুখোমুখি হয়। একসময়ে সে যে ভেবেছিল এই খুন করার আইনী ন্যায্যতা থাকুক বা নাই থাকুক, নৈতিক ন্যায্যতা আছে – সেই ভাবনা সৌধটির ধূলিস্যাৎ হয়ে যাবার কথাই ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট এ দস্তয়েভস্কি সবিস্তারে বলেছেন।
সামাজিক দার্শনিক মতবাদের প্রগতি প্রতিক্রিয়ার ছকে দস্তয়েভস্কির মহত্ত্বকে যে বিচার করা যায় না, বিখ্যাত মার্কসবাদী নন্দনতাত্ত্বিক ও উপন্যাসব্যাখ্যাতা গেয়র্গ লুকাচ আমাদের তা মনে করিয়ে দিয়েছেন। দস্তয়েভস্কি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে লুকাচ আমাদের মনে করিয়ে দেন চেকভের একটি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যসূত্র। চেকভ বলেছিলেন একজন শিল্পী সাহিত্যিকের কাজ সঠিক প্রশ্ন তোলা, সেই প্রশ্নের সঠিক উত্তর তিনি দিতে পারলেন কিনা, সেটা আদৌ ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। চেকভ এই প্রসঙ্গে পুশকিনের ‘ইউজিন ওনেজিন’ আর তলস্তয়ের ‘আনা কারেনিনা’র কথা তুলেছিলেন। পুশকিন বা তলস্তয় এখানে কোনও সমস্যারই নিরসন করতে পারেন নি, কিন্তু সঠিক সমস্যাকে তাঁরা অসামান্যভাবে হাজির করেছিলেন বলেই এগুলি কালজয়ী সাহিত্য হিসেবে গণ্য হয়েছে। দস্তয়েভস্কির সাহিত্য বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে লুকাচ এই সূত্রটিকেই অনুসরণ করেছেন। তাঁর মতে দস্তয়েভস্কি সমস্যার যে সমাধানগুলি দেখান সেগুলি যে শুধু পরবর্তীকালের নিরিখেই শুধু ভ্রান্ত ঠেকবে তা নয়, সেকালেও এগুলি ছিল যথেষ্ট প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রের। কিন্তু তাতে দস্তয়েভস্কির অসামান্যতা বাতিল হয়ে যায় না। তিনি বিশিষ্টতার আসনে বসে আছেন সমস্যাগুলিকে সঠিকভাবে হাজির করতে পারার জন্য, সঠিক প্রশ্নগুলিকে অসামান্যভাবে সামনে নিয়ে আসতে পারার জন্য।
দস্তয়েভস্কির সাহিত্যের অনন্যতা কোথায় তা ধরিয়ে দেবার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন রুশ উপন্যাসতাত্ত্বিক মিখাইল বাখতিন। তাঁর প্রবলেমস অব দস্তয়েভস্কিস পোয়েটিক্স বইটির কাছে বারবার আমাদের ফিরে যেতে হয় দস্তয়েভস্কিকে নিবিড়ভাবে বোঝার জন্য। বাখতিন দেখান উপন্যাস শিল্পের মৌলিক বিষয় যে বহুস্বরিকতা, পলিফনি - সেই বহুস্বরকে দস্তয়েভস্কি কীভাবে ধারণ করেন। এক সর্বগ ও সর্বজ্ঞ অথর কর্তৃত্ত্ব করেন না দস্তয়েভস্কির উপন্যাসে - বরং চরিত্ররা নিজস্ব চিন্তা ও কাজের সূত্রে স্বাধীনভাবে বিকশিত হয়। বিভিন্ন চরিত্রের সংলাপ একটি প্রসঙ্গকে নানাভাবে তুলে ধরে। উদাহরণ হিসেবে ধরা যায় অপরাধ ও শাস্তি উপন্যাসে অপরাধ সংগঠনের সীমা নৈতিকতা নিয়ে রাসকেলনিকভ, তার বন্ধু রাজুমিখিন আর গোয়েন্দা পরফিরি কথাবার্তা বলে, বিতর্ক করে। দস্তয়েভস্কি নিজস্ব দর্শন বিশ্বাসে কোথাও বেশি কম জোর দেন না। সমস্ত দৃষ্টিকোণগুলি পাশাপাশি রাখেন। এখান থেকেই শুরু হতে পারে উপন্যাসের ও জীবনের এক খোলা পাঠ।
দস্তয়েভস্কি জীবনের এই খোলা পাঠে সব সময়েই নান্দনিক বিচরণের পরিসর তৈরি করে রাখেন সব দেশকালের পাঠকের জন্য। এখানেই তাঁর অনন্যতা।