কৃষক আন্দোলনের ভিত্তিভূমি ছিল পাঞ্জাব এবং হরিয়ানা। ২৫শে সেপ্টেম্বর, ২০২০, রাষ্ট্রপতি তিনটি কৃষি আইনে সম্মতি দেওয়ার পর, ‘সারা ভারত কিসান সংঘর্ষ কো-অর্ডিনেশন কমিটি’ কিছু বিক্ষোভ আন্দোলন করে, কিন্তু ঐ দুটি রাজ্যের কৃষকরাই প্রথম একটা মরণপণ লড়াইয়ে নেমে পড়ার উদ্যোগ নেন। ২৫শে নভেম্বর তাঁরা ‘দিল্লি চলো’ ডাক দেন। ডিসেম্বর মাস নাগাদ ‘ভারতীয় কিসান ইউনিয়ান’ তিনটি আইনের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে। এরপর থেকে পশ্চিম উত্তর প্রদেশের কৃষকরা আন্দোলনে যুক্ত হতে থাকেন ও রাকেশ টিকায়েত নেতৃত্বে উঠে আসেন। এঁরা একটু পরে যোগদান করেছেন বলে এঁদের অবদানকে খাটো করা হচ্ছে এমনটা নয়।
১৯৪২ এর ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন ছাড়া ভারতবর্ষের কোনও আন্দোলনই দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েনি, এমনকি ১৮৫৭র বিদ্রোহও নয়। কৃষক আন্দোলন ঐতিহাসিক, জোটবদ্ধতায় এক অনবদ্য নজির সৃষ্টি করেছে, কিন্তু সেটা কিছু অঞ্চল, এবং কৃষিসমাজের একটা অংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এটা বলা দরকার কারণ এমন একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল যে শুধুমাত্র কৃষক আন্দোলনের জোরেই বিজেপিকে রাজ্যে রাজ্যে নির্বাচনে ধরাশায়ী করা যাবে। পাঞ্জাবে যেখানে আন্দোলন সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল সেখানে বিজেপি ছবি হয়ে গেছে। আপ সহ কংগ্রেস এবং আকালি সবাই তিনটি আইনের বিরোধি তা করতে বাধ্য হয়েছে। আপ দিল্লি সীমান্তে গড়ে ওঠা ধরনাস্থলগুলিতে দীর্ঘ তেরো মাস ধরে জল ও বিদ্যুৎ নিয়মিত সরবরাহ করে কৃষকদের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছে। মানুষ তাদের উপুড় করে ভোট দিয়েছে। এই আন্দোলন যদি না থাকতো তাহলে গোষ্ঠীদ্বন্দে জীর্ণ কংগ্রেস পাঞ্জাব থেকে মুছে যেতো, লাভবান হতো বিজেপি-আকালি। আপ ভালো সংখ্যক আসন পেতো কিন্তু ক্ষমতায় আসত কিনা সন্দেহ আছে।
উপরোক্ত দুটি রাজ্য বাদ দিয়ে আন্দোলন ছড়িয়েছে পশ্চিম উত্তর প্রদেশ এবং কিছুটা প্রভাব পড়েছে রাজস্থান, উত্তরাখন্ড এবং মধ্য প্রদেশে। ‘বিজেপিকে সবক শেখাও’, এই আওয়াজ দিয়েছিলেন কিষাণ নেতারা। নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন; এই ব্যর্থতার কিছু পরিষ্কার, বোধগম্য কারণ আছে, যেগুলো আমরা জেনেও না জানার ভান করেছি; আবার এটাও ঘটনা এই ব্যর্থতার আড়ালে কিছু রুপোলি রেখাও আছে। পশ্চিম উত্তর প্রদেশ একটা বিশাল এলাকা, ২২টা জেলা আছে, জাট ছাড়াও অন্যান্য বহু জাত আছে। আমরা ইতিমধ্যেই জানি আন্দোলন মূলত শক্তিশালী ছিল চারটি জেলাতে----মুজাফরনগর, শামলি, বাগপত এবং কিছুটা মিরাটে। এখানে উনিশটি আসনের মধ্যে বিজেপি মোটে ছটি জিতেছে, যার মধ্যে তিনটি শহরের সিট। ২০১৩ সালে মুজাফরনগরে দাঙ্গা করে জাট-অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে বিজেপি নিজেদের আধিপত্য কায়েম করে; এরপরে প্রতিটি নির্বাচনে তারা জাটদের বিপুল, প্রায় ৯০% ভোট পায়।
এই বিষাক্ত পরিবেশে কৃষক আন্দোলন এখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ফুল ফোটায়। গত ৫ই সেপ্টেম্বর ‘সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা’ মুজাফরপুরে বিশাল মহাপঞ্চায়েত করে এবং অভুতপূর্ব হিন্দু-মুসলিম ঐক্য স্থাপন করে। ভারতবর্ষে যা কদাচিৎ ঘটে সেটাই মুজাফরপুরে হয়েছিলঃ হিন্দু ও মুসলমানরা একত্রে শ্লোগান তুলেছিল, আল্লাহ হো আকবর, হর হর মহাদেব। দাঙ্গার ফলে জাট মুসলিমদের সাথে সম্পর্কে ফাটল ধরে গিয়েছিলো, মহেন্দ্র সিং টিকায়েতের গড়া ‘ভারত কিষাণ ইউনিয়ান’ পর্যন্ত আড়াআড়ি ভাগ হয়ে গেছিলো। সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার নেতৃত্বে সেই সম্পর্ক জোড়া লাগে। সিএসডিএসের সমীক্ষা অনুযায়ী এই নির্বাচনে জাটদের মধ্যে বিজেপির ভোট ৫৪% এ নেমে এসেছে। সঙ্গীত সোম, সুরেশ রানা, উমেশ মালিকের মতো দাঙ্গার পান্ডারা পরাজিত হয়েছেন। ঐ একই সমীক্ষা অনুযায়ী কৃষকদের মধ্যে বিজেপির প্রাপ্য প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। এতে বিজেপির আসন সংখ্যা কমেছে, কিন্তু সেটাও যথেষ্ট হয়নি।
কিন্তু ঐ টুকুই। মূলত আখ চাষের এলাকার বাইরে আন্দোলন ছড়ানোর চেষ্টা হয়নি। আগ্রা, আলিগড় ইত্যাদি জেলার আলু চাষিদের মধ্যে আন্দোলনের কোনও প্রভাব পড়েনি। জাটদের বাইরে অন্যান্য সম্প্রদায়কে প্রভাবিত করার কোনও উল্লেখযোগ্য চেষ্টাও হয়নি। পূর্ব উত্তর প্রদেশে আন্দোলনের প্রায় কোন প্রভাবই পড়েনি। যে কারণে লখিমপুর খেরিতে অতোবড় ঘটনার পরেও বিজেপি সেখানে সবকটি আসনেই জিতেছে। কিষাণ নেতারা এটা বুঝতে পেরে ঐ অঞ্চলে মহাপঞ্চায়েত করা শুরু করেছিলেন। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে; নির্বাচনের মাত্র দু মাস আগে প্রধানমন্ত্রী আইন বাতিল করে দেওয়ার ফলে ঐ উদ্যোগ বন্ধ হয়ে যায়। অনেকে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী মোক্ষম সময়ে আইন বাতিল করে আন্দোলনের পক্ষে যে হাওয়া ছিল তা ঘুরিয়ে দিয়েছেন। সময়টা দু চার মাস আগে হলে ফলাফলের খুব বেশি হেরফের হতো না। আগেই বলা হয়েছে আন্দোলনের নিজস্ব কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল; দ্বিতীয়ত শুধুমাত্র আন্দোলনের জোরেই কি প্রবল প্রতিপক্ষকে হারানো যায়, আন্দোলনকারীরা নিজেরাই ক্ষমতায় আসতে পারে?
আন্দোলনের অন্যতম প্রধান দূর্বলতা হচ্ছে এতে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের যোগদান সীমিত। এই সত্যিটা যোগেন্দ্র যাদবের মতো নেতারা প্রকাশ্যে আনতে দ্বিধা বোধ করেন। তিনটি আইন লাগু হলে ছোট চাষিও একই ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কৃষিক্ষেত্র যদি কর্পোরেটের লীলাক্ষেত্র হয়ে যায় তাহলে জমির মালিক ও ক্ষেতমজুরের পরম্পরাগত সম্পর্ক (যে সম্পর্কের মধ্যে শোষণ বদান্যতার রূপ নিয়ে থাকে) ছিন্ন হয়ে যাবে। কর্পোরেট ছোট চাষির ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকবে, তার সাথে তিনি কোনদিনও দরাদরি করে উঠতে পারবেন না। ফসলের এমএসপি বাড়লে তাঁরও মজুরি বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে। একই ভাবে বিদ্যুতের খরচা মকুব হলে মালিকের আয় বাড়বে, সেটা চুইঁয়ে তাঁর কাছেও পৌঁছাবে। সুতরাং তিনটি আইন বিলোপ হলে তাঁদেরও লাভ।
কিন্তু তাঁর আয় নিতান্তই কম, যার ফলে মাসের পর মাস তাঁর পক্ষে টিকরি বর্ডার বা গাজিপুরে বসে থাকা সম্ভব নয়। ২০২১ এর NSSO র (ন্যাশানাল স্যাম্পেল সার্ভে অফিস) সমীক্ষা অনুযায়ী প্রান্তিক চাষির মাসিক আয় ৯০৯৯ টাকা, যেখানে মধ্য চাষির ২৮২৯২ টাকা, বড় চাষির ৬০৭৫৮ টাকা। তাই উচ্চবিত্তরা পরিবারের হাতে চাষের ভার সমর্পণ করে দু মাস ধরনাস্থলে ঘুরে আসতে পারেন, যেটা ছোট চাষির পক্ষে সম্ভব নয়। সমীক্ষা অনুযায়ী দেশের কৃষি অবস্থা অত্যন্ত করুণ। ভূমিহীন চাষির সংখ্যা ২০১২-১৩তে ছিল ৩৪.৫%, সেটা ২০১৮-১৯য়ে বেড়ে হয়েছে ৪২%। কৃষকের গড় আয় মাত্র ১০১২৮ টাকা যার মধ্যে কৃষি উৎপাদন থেকে আসে ৪০৬৩ টাকা। এটা কিন্তু নিজের এবং পরিবারের শ্রম এবং জমির ভাড়া ব্যাতিত, যেগুলো হিসাবে ধরলে চাষ থেকে প্রকৃত আয় দাঁড়াবে যৎসামান্য। বাকি আয় আসে ক্ষেতমজুরি থেকে, এনরেগার মতো বিভিন্ন সরকারি স্কিম থেকে, ছোট ব্যবসা, ইটভাটা, খনন কাজ ইত্যাদি থেকে। এর জন্য নিম্ন শ্রেণীর চাষিদের সর্বক্ষণ কাজের সন্ধানে থাকতে হয়। আবার উত্তরপ্রদেশের চাষির যা আয় (৮০৬১/), তার থেকে পাঞ্জাবের চাষির আয় তিন গুণের বেশি (২৬৭০১/)। পরম্পরাগত ভাবে পাঞ্জাবের চাষি বিত্তশালী। স্বাভাবিক ভাবেই ঐ রাজ্য থেকে নিম্নশ্রেণীর চাষির যোগদান যত ব্যাপক হয়েছে উত্তরপ্রদেশে হয়নি। এটা গভীর সমস্যা। বিশেষ করে ছোট চাষিদের ক্ষেত্রে চাষ লাভজনক হচ্ছে না, চাষি আর চাষি থাকছে না, তাঁকে অন্যত্র জীবিকা সন্ধান করতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে তাঁকে কী ভাবে আন্দোলনে যুক্ত করা যায় তা ভাবতে হবে।
অদলীয় আন্দোলন থেকে ক্ষমতার অলিন্দে যাওয়ার উদাহরণ অতি সম্প্রতি ঘটেছে। ২০১১য় আন্না হাজারের দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলন স্মরণ করুন। টানা প্রায় দেড় বছর আন্দোলন চলার পর অরবিন্দ কেজরিওয়াল হাজারে ও অন্যান্যদের বিরোধীতা করে ‘আম আদমি পার্টি’ গঠন করেন ও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। কেজরিওয়াল যুক্তি দেন সরকার ও অন্যান্য বিরোধী দল যখন তাঁদের মূল দাবী (লোকপাল বিলকে আইনে প্রণয়ন করা) মানছে না, তখন নিজেদের দল গঠন করা উচিত। বাকিটা তো ইতিহাস। পার্থক্য হচ্ছে তখন সরকার আন্দোলনকারীদের দাবী মানেনি, এক্ষেত্রে কৃষকদের আইন বাতিল করার দাবী বিজেপি সরকার মেনে নিয়েছিল। কিছু কৃষক সংগঠন মোর্চা তৈরি করে পাঞ্জাবের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে কিন্তু শোচনীয় ভাবে পরাজিত হয়। তাহলে কি দুর্নীতি-দমন সমাজের ব্যাপক অংশের দাবী, তিনটি কালা কৃষক আইন বাতিল করা শুধুমাত্র কৃষকদের দাবী? যতই আমরা তাঁদের অন্নদাতা বলি, দাবীগুলো খালি কৃষিজীবীদেরই ছিল? এটা আংশিক সত্য। দিল্লির মতো একটা নগর-রাজ্যে বাজিমাত করা আর বিপুল বৈচিত্র্যময় উত্তরপ্রদেশে বিজেপির বিরুদ্ধে জেতা এক নয়। কৃষক আন্দোলন অনেকটা জমি প্রস্তুত করে দিয়েছিল, রাজনৈতিক দলগুলি সেটার কিছুটা ফয়দা তুলতে পেরেছে। পাঁচ বছর ধরে রাজ্যে বিভিন্ন সংকটের সময় সমাজবাদী দলের নেতৃত্বকে যদি মানুষের পাশে দেখা যেতো তাহলে হয়তো পাশা উল্টে যেতো। বিজেপির ‘বিপুল’ জয়ের আড়ালে আশার কিছু রুপোলী ঝলক অবশ্যই আছে যা ২০২৪ এর জন্য নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করতে সাহায্য করতে পারে।