বারোতলার উত্তর-পূর্ব কোনের ফ্ল্যাট অপরেশবাবুর। সূর্যাস্ত এখান থেকে দেখা যায় না। শুধু শেষ বিকেলের আলো কিভাবে আস্তে আস্তে কমে আসে চারপাশে - সেটাই অনুভব করা যায়। আলো কমে এলেই দেখতে পাওয়া যায়, আলো জ্বলে উঠেছে এই স্যাটেলাইট সিটি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার একমাত্র পথ - ঐ ফ্লাইওভারের মাথায় মাথায়। ঐ রাস্তা ধরে ঠিক সতেরো মিনিট এগোলেই - ব্যস্ত শহর, মাল্টিপ্লেক্স, শপিং মল আর হৈ-হুল্লোড়।
সে হিসেবে এই ফ্লাইওভারটাও শুধু মাত্র এই কমপ্লেক্সের মানুষদের ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য। এর শেষ প্রান্ত ঢুকে এসেছে কমপ্লেক্সের নিজস্ব এলাকার মধ্যে। এলাকাটা একেবারেই রুক্ষ পাহাড়ি টিলা দিয়ে ঘেরা। টিলাগুলোর এদিকে ওদিকে বাউন্ডারি ওয়াল যেন সরীসৃপের মতো ঢেউ খেলে খেলে চলে গেছে। নিচের জমি কঙ্করময়, গাছ বলতে কয়েকটা বাবলার ঝোঁপ ছাড়া আর কিছু-ই নেই। সভ্য সমাজের এতোটা কাছে থেকেও তাই এতোদিন অনাঘ্রাত ছিলো এই জায়গাটা।
এখন অবশ্য আর সেকথা ভাবাই যায় না। চারপাশের ছোটোখাটো টিলাগুলোর মাথা টপকে উঁচু হয়ে মাথা তুলছে এক-একটা বিল্ডিং। অপরেশের বিল্ডিং-এর ঠিক দক্ষিণে উঠছে আর একটা বহুতল। এটা হবে আঠারো তলা। যখন প্রথম এই সিটিতে পাকাপাকি ভাবে থাকতে এলেন, তখন এটা ছিলো ব্যালকনির অনেক নিচুতে। এখন আর সেটা নিচে নেই। এখন মাথা উঁচু করে দেখতে হয় - ওপরের ক্রেনগুলোকে। রাতে ওপরে জোরালো আলো জ্বলে। শিফটে কাজ হয়। রাতেও এর বৃদ্ধি থেমে থাকে না।
আজীবন শেয়ালদা লাইনের ট্রেনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ডেলি-প্যাসেঞ্জারি করেছেন অপরেশবাবু। গায়ের ওপর একগাদা লোক সবসময়ই যেন হামলে পড়ে আছে, শরীরের সঙ্গে ঠেকে রয়েছে আরো কয়েকজনের অবাঞ্ছিত স্পর্শ। তারপর যখন পরিচয় হয়ে গেলো তাদের কারো কারোর সঙ্গে, তখন আলাপ আলোচনার মধ্যে আরও যেন অন্যের জীবনের মধ্যে, তার একান্ত ব্যক্তিগত পরিসরে ঢুকে আসার সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা দুয়েক জনের মধ্যে লক্ষ্য করেছিলেন তিনি। স্বচ্ছল উপার্জনের সুবাদে পাড়ায় আর অফিসে সুযোগ পেলেই সাহায্য-প্রার্থীর হাত যেন এগিয়েই থাকতো তার দিকে। অথচ ঘটনা নিয়ন্ত্রণে কোনো ভূমিকাই পালন করতে পারতেন না তিনি।
পাড়ার মোড়ে যখন এক অপরিচিত যুবককে আটক করে প্রচণ্ড মারধর করা হলো, তিনি তো গেছিলেন আটকাতে, পেরেছিলেন কী? অফিস পাড়ায় সন্ধ্যের মুখে একটা মেয়ের সঙ্গে দুই যুবকের অশ্লীলতার প্রচেষ্টা - বাধা দিতে পেরেছিলেন কী? ঠিক করে নিয়েছিলেন তখনই - রিটায়ার করলে এসবের মধ্যে আর থাকবেন না। এতোটাই দূরে যেতে হবে এই চেনাজানা চৌহদ্দি ছাড়িয়ে - এইসব অন্যায় আর অস্বস্তিতে যেন আর না পড়তে হয়।
নমিতা কিন্তু বারেবারেই তাকে বারণ করেছিলো। চেনাজানা যে পরিবেশের মধ্যে জন্ম থেকে তার বেড়ে ওঠা, বিয়ের পর থেকে যে মানুষগুলোকেই তার কাছের বলে মেনে নেওয়া - তাদের সান্নিধ্যকে একেবারেই ঝেড়ে ফেলতে তার মন সায় দেয়নি। সেই সময় অপরেশবাবু নমিতাকে মনে করিয়ে দিয়েছেন - আত্মীয়-স্বজন ও চেনাজানা মহলের কতো কৌশলী আবদার মেটাতে গিয়ে, তিনি মানসিক ভাবে কতোটা ক্ষত-বিক্ষত হয়েছেন। অফিসে ও সমাজে নিজের জায়গা সুরক্ষিত রাখতে গিয়ে কতোবার কতো অনৈতিক কর্মকান্ড বুঝতে পেরেও - না বোঝার ভান করে তাকে চুপ করে থাকতে হয়েছে। জীবনের শেষ কয়েকটা দিন, তিনি কি এদের নখ-দাঁতের বাইরে নিজেকেএকটু সুরক্ষিত ভাবে রাখতে পারেন না?
চাকরি থেকে অবসরের আগে হঠাৎই একদিন অপরেশবাবুর চোখে পড়ে এই স্যাটেলাইট সিটির বিজ্ঞাপন। মনে হয়, এমনটাই তো খুঁজছিলেন তিনি, বেশ কিছু দিন ধরে। অফিসের ট্যুরের নাম করে প্রথমবারের মতো এসে সব কিছু দেখে গিয়েছিলেন তিনি। পরেরবার এসেছিলেন, সবাইকে জানিয়ে, নমিতাকে সঙ্গে নিয়েই। দু-একটা টিলা তখন সবেমাত্র ভাঙা হয়েছে, বহুতল উঠেছে মাত্র চারটে।
এক-একটা বহুতলে প্রতিটি তলায় ষোলোটা করে ফ্ল্যাট - 'এ' থেকে 'পি' পর্যন্ত। সত্যি কথা বলতে কি, এখনো পর্যন্ত এই তলার অন্য কোনো ফ্ল্যাটের মালিকের সঙ্গে তিনি পরিচয় রাখেননি। মুখ চেনা আছে, মাত্র কয়েক জনের সঙ্গে। হয়তো এই আবাসনেই আছেন কোনো অবসরপ্রাপ্ত মানুষ, হয়তো আছেন কোনো বাঙালিও। হতেই পারে যে, সেই বাঙালির ছোটবেলা কেটেছে সিউড়ি বা রামপুরহাটে - তার নিজের মতো।
কলকাতার কলেজে পড়তে এসে মেজোপিসিদের উল্টোডাঙার সরকারি আবাসনে যাওয়া-আসা ছিলো মাঝেমধ্যেই। সেখানে প্রথম দিন পৌঁছে সিড়িতে উঠতে গিয়ে একপাশে দেখেছিলেন সারি সারি মিটার বক্স। আর একপাশে সারি সারি লেটার বক্স। এখানে কোনো ফ্ল্যাটের তলাতেই লেটার বক্স দেখেননি তিনি। অথচ, পার্সেল ডেলিভারি করতে কতোজন যে আসে সারাদিন ধরে, তার ঠিক নেই। মাঝে মাঝেই ভাবেন তিনি, এখানকার লোকজন কি চিঠিটা লেখেই না, শুধুই মেল করে, আর মেসেজ করে? কিন্তু এই ভাবনাটা তিনি কারোর কাছেই প্রকাশ করেননি - নমিতার কাছেও নয়। কেননা, অন্যের খোঁজ রাখবেন না বলেই তো, এতো পরিকল্পনা করে এই স্যাটেলাইট সিটিতে উঠে আসা।
অন্যের খোঁজ রাখবেন না বলেই তো, এই ফ্ল্যাটে নানান উপকরণ রাখা থাকলেও টিভি বা রেডিও তিনি রাখেননি। কম্পিউটার বা স্মার্টফোন-ও নয়। নমিতার একটা স্মার্টফোন আছে বটে, সেটা তাদের একমাত্র ছেলের মা-কে দেওয়া একটা উপহার। কিন্তু অপরেশবাবু জানেন যে, তার সমস্ত অপারেশন নমিতার হাতের মুঠোয় নেই। তিনি নিজে ব্যবহার করেন একটা নতুন মডেলের বেসিক ফোন - যার সিমটাও নেওয়া হয়েছে স্থানীয় সূত্রেই। আসলে এই কমপ্লেক্সেই আছে একটা কমিউনিকেশন অফিস - সিমকার্ড, আধার, পাসপোর্ট থেকে শুরু করে গ্যা্যাস-বুকিং, টিকিট-বুকিং এমনকি টাকা-পয়সা লেনদেনের কাজটাও তারাই করে দেয়। এই ফোনে তাই তিনি মাত্র যে কয়েক জনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চান, তার বাইরে কোনো ফোন আসে না।
গতকাল ফোন এসেছিলো ঠিক দুবার - সকালে নমিতার, রাতে বুকাইয়ের। বুকাইয়ের সঙ্গে কথা বলার পর নমিতাও একবার ধরেছিলো। তার আগের দিন-ও তাই । নমিতার ছেলের কাছ থেকে ফিরতে এখনো তিন দিন বাকি। সারাদিনে কলিং বেল বাজে একবার - সকাল সাড়ে দশটায় - বাঈ এসে কাজকর্ম সব করে দিয়ে যায়। জিনিস-পত্র সব কিছু কেনা আছে, নাহলে সেসব পৌঁছে দিতে ডেলিভারি বয় হয়তো আসতো। আর হ্যাঁ, পরশু বাড়ির খাবার খেতে আর ইচ্ছে করছিলো না বলে, খাবার আনানো হয়েছিলো বাইরে থেকে, ব্যাস।
ব্যালকনিটা বেশ পছন্দের জায়গা অপরেশবাবুর । এখানে বসে বসেই অনেক কিছু দেখা যায়। নিচের দিকে তাকালে তবেই চোখে পড়ে মানুষজন - ছোটো ছোটো, পোকামাকড়ের মতো। বেতের সোফায় বসলে সেটুকুও দেখা যায় না। আদিগন্ত শুধু ঢেউ খেলানো ক্ষয়ে যাওয়া মালভূমি।
আবার এখানে বসে বসেই মনে মনে সুদূর অতীতেও ঘুরে আসেন কখনও কখনও। ছোটোবেলার সেই মাটির দোতলা বাড়ি। ওপরের ঘরের চালাটা নেমে এসেছে দোতলার দেওয়ালের মাথা থেকে জানলার সামনে পর্যন্ত। যেটাই চালা, সেটাই সানসেড। আর এই বিশাল সানসেডের চাপে পড়ে জানলাগুলোও ছোটোখাটো। সেই ছোটো ছোটো জানলার চারপাশে আবার আলকাতরা দেওয়া। গবাক্ষ শব্দের আক্ষরিক মানে আর প্রচলিত মানের মধ্যে যে কোনো অসঙ্গতি আছে, ছোটোবেলায় অন্তত সেটা একবারের জন্যও মনে হয়নি।
জ্ঞান হবার পর থেকেই দেখে এসেছেন অপরেশ - বাড়িতে একগাদা লোকজন। বাবা, কাকা, জ্যাঠা মিলে তিনভাই - সব মিলিয়ে আটজন ভাইবোন। পুজোর সময় এক ধরনের জামাপ্যান্টের ছিট কিনে তৈরি হতো নতুন পোশাক। সেটা পরেই কী আনন্দ সবার!
সকালে বা সন্ধ্যায় জলখাবার দেওয়া হতো অনেক সময় একটা বা দুটো বড়ো কোনো পাত্রে। সবাই সেখান থেকেই যে যার মতো তুলে তুলে খেতো। ভালো ভালো জিনিস পত্র যাতে প্রথম দিকেই হাতের মুঠোয় উঠে না যায় - বড়োদের সেদিকে ছিলো শ্যে্যেনদৃষ্টি। আবার রাতের খাবার সময় লোডশেডিং হলে - আশেপাশের ভাইবোনেদের থেকে সতর্ক থাকার খুবই দরকার ছিলো। বিশেষ করে, আলো জ্বালিয়ে নিয়ে আসার মধ্যে কারোর পাতের ডিম হাপিস হয়ে গেলে - ওটা ফেরত পাওয়ার আর উপায় ছিলো না। বড়োদের কাছে নালিশ করলে, সে ছিলো আরও ঝুঁকির, ফল যে কী হবে, কেউ জানে না। কাজেই নিজের মনেই অপেক্ষা করতে হতো, নিজের সুযোগের অপেক্ষায়। কতোদিন অন্ধকার হয়ে যাবার পর, একজনের সঙ্গে অন্যজনের হাত ঠেকে গেছে - কিন্তু কেউ কোনো শব্দ-ও উচ্চারণ করেনি কখনও হয়তো আলো আসার পর দেখা গেছে, কেউ কেউ হাসি চাপার চেষ্টা করছে!
এখানে বাকি পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগের একটাই রাস্তা - ঐ ফ্লাইওভার। না, আর একটা রাস্তা-ও আছে।সেটা রাখতে হয়েছে খানিকটা বাধ্য হয়েই। ব্যালকনির দক্ষিণ দিকে অনেকটা হাটলে নাকি দেখতে পাওয়া যায় একটা আদিবাসী গ্রাম। ঐ গ্রামের বাসিন্দা কয়েকজন মেয়ে-বউ সরু কাকড় বিছানো রাস্তা ধরে চলে আসে রিসেপশন অফিসের ডানদিকে। তারপর সন্তর্পনে কাউ-ক্যাচার পেরিয়ে খাতায় টিপছাপ দিয়ে ভেতরে আসার অনুমতি পায়। দুপুরের পর ওরা আবার ঐ পথ দিয়েই ফিরে যায় নিজেদের গ্রামের দিকে।
ভাবতেই মনে মনে একটু আনন্দ অনুভব করেন অপরেশ, তাকে ঢোকার সময় খাতায় নাম লিখতে হয় না। উপরন্তু, গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দারোয়ান প্রত্যেকবার স্যালুট জানায়। অবশ্য এই স্যালুটটুকু পেতে খরচ করতে হয়েছে, জীবনের সঞ্চয়ের সিংহভাগ। তা হোক, তার জন্য পরোয়া করেন না অপরেশবাবু। এমনটাই তিনি ভেবে এসেছিলেন আজীবন। একমাত্র ছেলের কোনোদিন দরকার-ও পড়বে না, তাঁর উপার্জিত অর্থের। অনেকেই অনেক কিছু কেনে, তিনি আজীবনের খাটনির বিনিময়ে অর্জিত অর্থ ব্যয় করে কিনতে চেয়েছেন নিজের স্বস্তি, নিজের মতো করে থাকবার স্বাধীনতা।
নমিতা সঙ্গে থাকলে সপ্তাহে একবার হলেও বাইরে যেতে হয় তাঁকে - নমিতাকে সঙ্গে নিয়েই। এখান থেকে বাইরে যাবার একমাত্র উপায় নিজের গাড়ি। যাদের সেটা নেই, তাদের জন্য কমপ্লেক্সের নিজস্ব বাহন আছে, সেটা ছাড়ে আবাসিকদের প্রয়োজনে সকাল থেকে সন্ধ্যায় আধঘণ্টা অন্তর। এতে আবাসিকদের কোনো ভাড়া দিতে হয় না। এছাড়াও ফোনে ডেকে নেওয়া যায় অনলাইন ট্যাক্সি - সব বড়ো বড়ো শহরের মতোই।
দুপুরে খেয়েদেয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে একটা বই পড়ার চেষ্টা করছিলেন অপরেশবাবু। হঠাৎই ফোনটা বেজে উঠলো। প্রথম দিকে স্বাভাবিক কথাবার্তা - দুপুরের খাবার খেয়ে নিয়েছো? রান্না ঠিক মতো হয়েছিলো তো? ওষুধপত্র খেয়েছো ঠিক মতো? এদিকে তো একটা সমস্যা হয়েছে। আমাদের কিছু নয় কিন্তু এলাকায় কী যেন একটা হয়েছে। আমি ঐদিনের টিকিটে আসতে পারবো কি না, কে জানে! নমিতা বলেই চলে - আমি অবশ্য আসার সামান্য সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়বো - বুকাইয়ের সঙ্গে-ও আমার সেই রকমই কথা হয়েছে। তাও তোমাকে আগেই জানিয়ে রাখলাম। তুমি তো বাইরের খবর শুনতে চাও না, তাই সবকিছু ভেঙে আর বললাম না। ওপারে নমিতার গলায় কি একটু বেশি উদ্বেগের সুর?
ইচ্ছে করছিলো একবার জেনে নিতে, কিন্তু মনে মনে নিজেকেই বোঝালেন অপরেশবাবু - মা আছে ছেলের কাছে - যদি কয়েক দিন থেকেই আসে, তা আসুক না। মুখে সেটা বলেও দিলেন - ঝামেলা কিছু হয়ে থাকলে বাড়তি ঝুঁকি নেবার কোনো দরকার নেই। তুমি বরং কয়েক দিন পরেই এসো। আমি তো একলা মানুষ , কোনো দায়িত্ব-ই নেই। ব্যালকনির সোফায় বসে বসে শুধু ভাবতে ভাবতেই কয়েকটা দিন কাটিয়ে দেবো - ও নিয়ে তুমি চিন্তা কোরোনা। তারপর নিজেই লাল বোতাম টিপে ফোনকলটা কেটে দিলেন।
বিকেলে রোদ একটু পড়ে এলে, নিজের পছন্দের সোফায় আবার এসে বসলেন তিনি। এখানে এসে বসলেই মনটা ভালো হয়ে যায়। মনে হয়, এই যে বারোতলার ফ্ল্যাট - আমিই নিজের চেষ্টায় এটা কিনতে পেরেছি, এটা আমার অর্জন। একসময় সন্ধ্যা হয়ে আসে। এতোটা ওপরে মশা-মাছি পৌঁছনোর কোনো সম্ভাবনা নেই। এইসময় থেকেই এমন একটা হাওয়া বইতে শুরু করে যে, ঘরের জানলা বন্ধ করে রাখতে হয়, নাহলে জিনিস পত্র পড়তে থাকে সেই হাওয়ার ধাক্কায়।
যখন ছোটো ছিলেন, দেখেছেন - খবর দিয়ে বা না দিয়েই অনেক সময় বাড়িতে কাছাকাছি বা দূরসম্পর্কের আত্মীয় স্বজন চলে আসতেন। হয়তো দুপুরের খাবারের পাট শেষ করে, সবে মাত্র বাসনপত্র নিচে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে - ঠিক সেই সময় হয়তো হাসিহাসি মুখে বাড়িতে এসে হাজির হলো তিন-চার জন মানুষ। তাদের মুখে অপ্রতিভতার লেশমাত্র নেই, বরং কেমন চমকে দিয়েছি তোমাদের - তাদের মুখের ভাবে এমনটাই প্রকাশ পাচ্ছে। মা-কাকিমার তখন আবার কাজ পড়তো - এদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করা খাবার তৈরি করে খেতে দেওয়া - এইসব। পরে অফিসে কাজ করতে এসে একটা শব্দের সঙ্গে খুবই পরিচিত হয়েছিলেন - সারপ্রাইজ ভিজিট!
এই স্যাটেলাইট সিটিতে এইরকম কারো ভিজিট করার কোনো সম্ভাবনাই নেই। সামনের সিকিউরিটির কাছে চেকআপ না করে একটা মাছি গলে যাবার-ও কোনো উপায় নেই। তাও হঠাৎ করে কেউ চলে এলে , রিসেপশন থেকেই সরাসরি ভিডিও কল চলে আসবে ফ্ল্যাটের মালিকের কাছে। তারপর তিনি চিহ্নিত করে অনুমতি দিলে, তবেই আগন্তুক আসতে পারবেন ফ্ল্যাটের দরজায়। সামান্য অজুহাতে সাহায্য চাইতে আসার পথ এখানে পুরোপুরি বন্ধ-ই করে দেওয়া হয়েছে।
পরদিন সকালে ফোন করলো বুকাই। এই ঝামেলাটা নাকি ছড়িয়েছে অনেক দূর, তাই নমিতার ফিরতে এখন নাকি অনেক দেরি হবে। বুকাই বুঝিয়ে বলতে যাচ্ছিলো - আসলে কী হয়েছে ঘটনাটা। অপরেশ সঙ্গে সঙ্গে তাকে থামিয়ে দিলেন - আমি কি তোর কোনো কথায় অবিশ্বাস করেছি? কেন তাহলে অদরকারি একটা তথ্য মাথায় নিয়ে মাথাটাকে ভারি করবো? এইসব ছাড়া তোর যা কিছু বলার আছে, বল না।
বুকাই ফোনটা নমিতার হাতে দিলো - নমিতার গলা কান্নায় ভাঙা ভাঙা। সে শুধু বললো - কমিউনিকেশন অফিসে গিয়ে কয়েক দিনের খাবার কেনার অর্ডার দিয়ে এসো, পরে যদি পেতে দেরি হয়! উল্টে তাকে সামলাতে থাকলেন অপরেশবাবুই - এইসব করার কোনো মানে হয়? এখন তো সবাই ভয়ের চোটে এইরকম করতে গিয়ে, খামোখা ভিড় বাড়াবে। আমি বরং দেখি, কীভাবে যা আছে, তাই দিয়েই আরও বেশি দিন চালিয়ে নেওয়া যায়। সে সব আমি পারবো,তুমি চিন্তা কোরোনা। বুকাই আবার নিয়ে নিলো ফোনটা। তারপর অবাক হয়ে জানতে চাইলো - বাবা, তুমি কি সত্যিই জানতে চাও না - এখন কী হয়েছে? নাকি, এরমধ্যে জেনেই গেছো? ফোনে মেসেজ পাঠিয়েও তো অনেক কিছু জানানো হচ্ছে - সেগুলো নিশ্চয়ই তুমি পড়েছো?
উত্তর দিতে গিয়ে একটু থামলেন অপরেশ । তারপর বললেন - আমি পরশু দিনের পর আর ফ্ল্যাট থেকে বাইরে যাইনি। আর এরমধ্যে অনেক মেসেজ ফোনে এসেছে ঠিকই, কিন্তু আমি তো এখন চশমাটা খুঁজে পাচ্ছি না, তাই না পড়েই সেগুলো ডিলিট করে দিয়েছি। চিন্তা করিস না, একদিন তো সবকিছুই চলতে শুরু করবে। সেদিন তোর মাকে নিয়ে সাবধানে চলে আসিস। এখন তোরা নিজেদের দিকে নজর দে। আমি তো ঝামেলার এলাকা থেকে অনেক বাইরেও আছি।
এইদিন থেকেই বাঈ আর কাজ করতে এলো না। অপরেশবাবু ভাবলেন, ভালোই হলো। এবার আরও নিজের মতো থাকা যাবে। আর এই নিজের মতো থাকাটাও কতোটা অন্যরকম, সেটা প্রকাশ করার কোনো সাক্ষীও থাকলো না।
বয়সকালে অপরেশবাবুর জেঠুর মাথায় গন্ডগোল ধরা পড়েছিলো। তিনি তখন যা যা বলতেন, সেগুলোর কোনো অর্থ কেউ করতে পারতো না। কিন্তু সেই সময় থেকেই অপরেশ খুঁজে বের করতে চাইতেন - সত্যিই কি এই কথাটার কোনো অর্থ আছে? যেমন জেঠু বলতেন - এই চালা নিচুতে নেমে গেছে, পুকুর পাড়ের মাটি আস্তে আস্তে ওপরে উঠে এসেছে। কখনও বা বলতেন - বিপদের কথা বলে কী লাভ?
দুপুরে একটু ছাতুগুলে খেয়ে নিলেন অপরেশ। ভাবলেন - এতোটাও খিদে পায়নি, যে ভাত রান্না করে আবার খেতে হবে। বিকেলে ভালো করে স্নান করে এসে বসলেন ব্যালকনির সোফায়। ঠিক ডানদিকেই সেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা আঠারো তলা। ওর ঠিক পেছনেই একটা গোল মাথার টিলা ছিলো। এখন আর সেটা এখান থেকে দেখা যায় না। কিন্তু এখন ক্রেনগুলোকে আর নড়াচড়া করতে দেখা যাচ্ছে না। তার মানে, ওটা এখন আর বাড়ছে না। তিনি ভাবলেন, এটাই সুযোগ। এই সুযোগে যদি টিলাটা একটু মাথা তুলতে পারে, তাহলে আবার ওটাকে দেখা যেতে পারে। ভূমিকম্প, প্লেট মুভমেন্ট নিয়ে অনেকক্ষণ ভাবলেন তিনি। হঠাৎই তার মাথায় এলো অন্য একটা ভাবনা - হয়তো বারোতলার থেকে ওর চূড়াটা দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু যদি তিনি উঠতে পারতেন আঠারো তলার সমান উচ্চতায় - একমাত্র তাহলেই তিনি বলতে পারতেন - এখনও পর্যন্ত কোনটার মাথা সবচাইতে উঁচু। ওপাশের ফ্লাইওভারটার দিকে তাকিয়ে থাকলেন এবার কিছুটা সময়। ওপরের দুই সারি আলো ঠিক সেরকম ভাবেই জ্বলে আছে, কিন্তু অবাক হয়ে দেখলেন - একটাও গাড়ি যাচ্ছে বা আসছে না।
রাতে নমিতার ফোন এলে তিনি জানালেন - দুবেলাই তিনি সেদ্ধ-ভাত করে খেয়েছেন। বললেন যে, তিনি খুবই ভালো আছেন। বললেন - এখানে লোকজন বোধহয় খুব বেশি নেই। কেননা, নিচের দিকে ঝুঁকে পড়ে তিনি দেখেননি বটে, তবুও এটা তিনি দেখতে পাচ্ছেন যে - ফ্লাইওভারটা একদমই ফাঁকা।
এরপর বুকাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আর একটা কথাও বলবো কি বলবো না করে তিনি বলেই ফেললেন - যেটা ছোটো বলে মনে হচ্ছে - মানে এটা আজকেই তিনি ভেবে দেখেছেন যে - যেটাকে ছোটো বলে আমরা ভাবছি, সেটা আসলে ছোটো নাও হতে পারে। স্পষ্ট শুনতে পেলেন অপরেশবাবু - বুকাই একটা শব্দ করে শ্বাস ফেললো। অপরেশবাবু ভাবছিলেন - এটা না বললেই হয়তো হতো। হয়তো ছেলেটা ভাববে যে আর কোনো উপায় নেই - তার বাবা শেষমেশ তার বাবার জেঠুর মতোই কথা বলতে শুরু করে দিয়েছে। বুকাই কিন্তু এসব কথার ধার দিয়েই গেলো না। বরং আরও একটু সময় নিয়ে বললো - তাহলে তো তুমি সব কিছু জেনেই গেছো! ফোনটা বুকাই অফ করে দিলো।
অপরেশবাবুর হঠাৎই খুব আনন্দ হলো এই ভেবে যে, বুকাই তার না বলা কথাটাও বুঝতে পেরেছে! বুকাইয়ের সঙ্গে তার ভাবনার কোনো অমিল নেই! এই আনন্দ উপভোগ করার জন্য আজকে প্রথমবার গ্যাস জ্বালিয়ে বানিয়ে নিলেন বড়ো এক মাগ কফি। সঙ্গে নিয়ে নিলেন চারখানা বিস্কুট। মনে মনে ভাবলেন - রাতের খাওয়াটা বড়ো মন্দ হলো না। আরও ভাবলেন - এভাবে চললে কিছুদিন দোকান-বাজার বন্ধ থাকলেও তার চলে যাবে!
পরদিন সকালে উঠে অপরেশবাবু আবার এসে দাঁড়ালেন ঐ ব্যালকনিতে। দূরের পাহাড় বা আরও দূরের পোড়ো জমি - সেখানেও নিশ্চিতরূপে আছে তাদের নিজস্ব জীববৈচিত্র্য - মানুষের ডাকা বন্ধ বা হরতালের কোনো প্রভাব সেখানে সামান্যতম প্রভাব-ও ফেলে না।
পাখির ডাক শোনা যায় না এই উচ্চতায়। তাই একেবারেই স্তব্ধ হয়ে আছে চরাচর। ডানদিকে শুধু নিষ্প্রাণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা বহুতল। এছাড়া আর সবদিকেই ঢেউ খেলানো টিলা। আর এই দুয়ের মাঝে ঐ ফ্লাইওভার। কোথাও কোনো সাড়া নেই, কিছুই নড়ছে না। এই নিশ্চল চারপাশের দিকে তাকিয়ে তার মনে হলো প্রকৃতির টিলা আর মানুষের তৈরি সুউচ্চ নির্মাণ - এর মধ্যে যেন কোনো পার্থক্য-ই নেই। দুটোই যেন প্রাণের স্পর্শ ছাড়া আপাতদৃষ্টিতে তাৎপর্যপূর্ণ অথবা একেবারেই তাৎপর্যহীন।
চড়া রোদ জোরদার গরম ছড়িয়ে দিচ্ছে পুরো এলাকায়। ভালো করে চারপাশ দেখে নিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে এলেন অপরেশ। মনের ক্যামেরায় প্যানোরামিক মোডে সমস্ত ছবিটা তুলে নিয়েছেন তিনি। মনে মনে একটু হাসলেন এবার - পুরোপুরি নিখুঁতভাবে মুখস্থ করে নিয়েছেন তিনি। এবার আর বারবার বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। চোখ বুজলেই দেখতে পাচ্ছেন এই স্হিরচিত্র।
মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে প্রকৃতির গতিবিধিকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছে আদিকাল থেকেই। এর মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাদের সভ্য্যতা। এই সভ্যতার অগ্রগতি কখনও কখনও পৃথিবীর নিজস্ব ছন্দকেও বিঘ্নিত করেছে। মানুষেরা এখন বোধহয় নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করছে আরও একদল মানুষের গতিবিধি। সেও হয়তো তাদের নিজেদের স্বার্থেই। যদিও পৃথিবীর এতে কিন্তু কোনো হেলদোল হচ্ছে না, পৃথিবী ঘুরতে থাকছে সেই গতিতেই, যে গতিতে সে ঘুরে এসেছে এতোদিন - যাকে বলে আবহমানকাল।