অনেক দিন পর এখানে এসে অন্য রকম লাগে। নদীর জলে পা ডোবালে কেমন নির্ভার। পাহাড়ের সবুজে অদৃশ্য হাতছানি। এবার এদিকে আসার কথা ছিল না। তাছাড়া বছরের এমন একটা সময় যখন এদিকে খুব কেউ আসে না। ঘোর বর্ষা, জুলাইয়ের মাঝখানে। কখনও এক দিন বা এক বেলা একটু আলোর ঝলক। তেমনই একটা বিকেলে আমরা পুরানো জায়গাটায় ফিরে আসি। শীলতোর্সা নদীর কাছাকাছি।
পথে আসতে শেষ অংশটুকুতে চা বাগান। এত বছরে বাগানটা সামান্য বদলেছে। একটু যেন রুক্ষ, পরিচর্যাহীন। অথচ এই বাগানের সুবাদেই আমাদের এই জায়গাটাকে চেনা। বাগান ঘুরতে এসেই এই ছোট্ট অখ্যাত নদী-ঘেরা জনপদটুকু আবিষ্কার। আমাদের এক পুরনো বন্ধু অর্পিতার বাবা তখন এখানের ম্যানেজার। সেবারের আসায় অর্পিতাও ছিল আমাদের সঙ্গে। আমরা প্রথম ক-দিন চা বাগানের ভেতরে ওর বাবার কোয়ার্টারে ছিলাম।
সে এক আশ্চর্য ব্যবস্থা। সন্ধের পরই নির্জন হয়ে যেত চারপাশ। ঝিঁঝিঁ ডাকত। বাগানের কুলি-মদেশিয়দের বনবস্তি থেকে ভেসে আসত মেয়ে-পুরুষের গলা মেলানো টানা সুরের গান। গানের কোনও কথা বোঝা যেত না। কখনও গানের মাঝে জড়ানো গলায় বিচ্ছিন্ন হল্লা। এর সঙ্গে মিশে ছিল নুড়ি-পাথর নিয়ে শীলতোর্সার অবিশ্রাম চলা। তার জলের শব্দ। তিন-চার দিনে আমরা একবার শুনেছিলাম গলা তুলে হাতির ডেকে ওঠা। চট করে চিনতে পারিনি। অর্পিতার বাবার তিরিশ বছরের চাকরি। তিনি আমাদের চিনিয়ে দিয়েছিলেন।
তের-চোদ্দ বছরে সেই জায়গাটার অনেকটাই বদল হয়ে গেছে।
আমাদের সেই পুরানো চারজনের দল থেকে অর্পিতা যেমন নেই সমরদাও তেমনি নেই। অর্পিতা বিবাহিত দূরে। সমরদা আরও দূরে, সীমার বাইরে। বনগাঁ থেকে শিস পত্রিকা করত সমরদা। সেবার ফিরে গিয়ে ডুয়ার্স নিয়ে অদ্ভুত এক লেখা লিখেছিল। সে লেখায় মিশেছিল নদী, সে লেখায় মিশে ছিল জ্যোৎস্নায় দূর পাহাড়ের ছায়া, সমরদার নিজস্ব মনখারাপ। ডুয়ার্স যেন বদলে যাচ্ছে। ডুয়ার্স যেন হারিয়ে যাবে একদিন। নদী কাউকে মনে রাখে না, সমরদা লিখেছিল, নদীকেও হয়ত মনে রাখবে না কেউ।
এবার আমাদের অন্য কাজে ছোট এক দলের সঙ্গে আসা। তবে এদিন আমরা আলাদা। আমি আর অমৃতাংশু। অমৃতাংশু তখনও ছিল আমাদের দলে।
ওর সেবার নতুন ক্যামেরা। উঠতি ফটোগ্রাফারের হাত আর মন। নতুন ক্যামেরায় অজস্র ছবি তুলেছিল চারপাশের। যা দেখছিল তাই। এবারেও ওর সঙ্গে ক্যামেরা। তবে এতগুলো বছরে অনেকটাই পরিণত ছবিকার। ইংরিজি ভ্রমণ পত্রিকায় ছবি বেরিয়েছে দুবার। প্রদর্শনীর প্রস্তাব দিয়েছে কেউকেউ। এখন আর যা পায় তাই তোলে না। শেষ বিকেলে নদীর কাছাকাছি পৌঁছে ও বলল, জায়গাটা তুই চিনতে পারছিস বিভু! আমার তো মনে হচ্ছে একেবারেই অন্য কোথাও...।
অন্য কোথাওই তো। অমৃতাংশুর ক্যামেরায় যে ছবিগুলো তোলা ছিল তাতে শান্ত সবুজ পাহাড়ের এক পাশ থেকে নেমে আসা নদী। পাথর ছড়ানো বিস্তীর্ণ প্রান্তর। কোনও ছবিতে মাথায় বোঝা বা পুঁটুলি নিয়ে জল পার হয়ে ওপারের পাহাড়ি গ্রামে যাওয়া এক-দুটি লোক। তের-চোদ্দ বছর আগের ছবি এখন আর নেড়েচেড়ে দেখা হয় না। তবু স্মৃতিতে রয়ে যাওয়া দু-একটি দাগ।
নদীর এপারে যেখানে আমরা সকাল বা বিকেলে বাগান থেকে হেঁটে এসে দাঁড়াতাম সেটা ছিল নির্জন, বসতিহীন। সকালবেলা শহর থেকে একটি বাস আসত। ঘন্টাখানেক থেকে ফিরে চলে যেত। বিকেলে আরেকটি। পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ বলতে এই। বনবস্তি বা পাহাড়ি গ্রামের কিছু লোক যাতায়াত করত সেই বাসে।
এর বাইরে এদিকে একটি চায়ের দোকান। চায়ের সঙ্গে পাঁউরুটি, বাইরে বাঁশের নড়বড়ে বেঞ্চ। এই ক’টি ছবির বাইরে আর কোনো ছবি নেই।
অথচ এখন জায়গাটি সত্যিই অচেনা। যেন অন্য কোথাও। পাহাড় আছে। নদীটিও। কিন্তু এপারে কয়েকটি হোটেল, ট্যুরিস্ট লজ। এই জুলাইতে তেমন লোক আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু পুরানো জায়গাটি আর নেই। খানিক দূরে এক পাশে পাঁচিল ঘেরা বক্সাইট কারখানা। এদিকে তার বোর্ড। পাথর ভেঙে দামি খনিজ বার করা হয় সেখানে। এই নির্জনতার ভেতরে একটি চলমান ও ভাসমান শব্দ। ঘড়ঘড়। এই শব্দই এখন নদী পাড়ের আবহ।
অমৃতাংশু বলল, অর্পিতাদের বাংলোয় যখন থেকেছি তখন একটি মেয়ে আসত মনে আছে তোর? দুধিয়া না কী নাম। বাগানের কুলিদের ঘরের মেয়ে। অথচ সারা দিন ওদের বাংলোয়।
দুধিয়ার কথা অস্পষ্ট মনে আছে। চা বাগানের কুলিদের ঘরের সদ্য কিশোরী। অর্পিতাদের বাংলোয় কাটাত সারা দিন। ওর মা বাগানে কাজ করত। পাতা তোলার কাজ। বিকেলবেলা পিঠে ঝুড়ি, মাথা নামিয়ে হেঁটে যেত বাগান থেকে কারখানায়, পাতা জমা দিতে। ওর বাবা বাংলোর মজুর। ছোট্ট লনটুকুতে ঘাস বাছত, জল দিত গাছে। ওদের মেয়ে সারা দিন বাংলোয়। ঘুরঘুর। অর্পিতার মায়ের সঙ্গে। আমরা গেলে আমাদের পাশে। অমৃতাংশুর সাদা-কালো ক্যামেরায় দুধিয়ার দেহাতি মুখের ক’টা ছবি নেওয়া হয়েছিল। রোগা, কালচে। স্পষ্ট গোল চাহনি।
অমৃতাংশু বলল, অর্পিতা সঙ্গে নেই। ওর বাবা রিটায়ারের পর বাগান ছেড়ে দিয়েছেন। ফলে যেখানে আমরা রাজত্ব করে গেছি তা প্রায় অচেনা।
অমৃতাংশুকে কিছু বলি না। ও ঘুরেঘুরে সেই বদলের ছবি খুঁজে বেড়ায়। বক্সাইট কারখানার ওপাশের ছবি। সেখানে নদীর অস্পষ্ট একটা বাঁক। দূরে পাথর আর নুড়ি ভরা প্রান্তরের ওদিকে মিশে গেছে নদী।
ছবি তোলা হলে আমরা একটু বসি। তারপর এলোমেল হাঁটা। হাঁটতেই থাকি। আমাদের হাতে বিকেলের খানিকটা সময়। গোটা একটা দলের সঙ্গে ডুয়ার্সে এসেছি। দলের বেশিরভাগের প্রথমবার এদিকে আসা। এদিন বিকেলে তাদের অন্যত্র সিডিউল।
অনেক বদলের মাঝেও সেই চায়ের দোকানটি পাওয়া যায়। হঠাৎ খুঁজে পাওয়ার পক্ষে একটু আড়ালে। আগে যেন বাস-রাস্তার আরও কাছাকাছি ছিল। এখন সামনে দাঁড়ানো একটা সুমো গাড়ি, হয়ত ট্যুরিস্ট নিয়ে এসেছে। অমৃতাংশু আবারও ছবির জন্য ঘোরে, আমি ফাঁকা বেঞ্চে এসে বসি। এই দোকানের পেছন থেকে শুরু হয়ে যেত জঙ্গল। ঠাসাঠাসি গাছপালা। সারা দিন পাখিডাক। এখন তা অনেকটাই হালকা। গাছের ফাঁক দিয়ে ওদিকে এখন নদী দেখা যায়।
এই শীলতোর্সা ধরে একদিন আমরা বাংলো ছেড়ে কাছাকাছি ভুটান পাহাড়ের দিকে হেঁটেছিলাম। অর্পিতা তার আগেও একবার গেছে। ও বলেছিল ওদিকটা নাকি রাতে হাতিদের জল খেতে আসার জায়গা। সন্ধের পর বা অনেক রাতে তারা দল বেঁধে আসে। নদীর চরে জ্যোৎস্নায় চরে বেড়ায়। একে অপরকে আরও কাছে আসার জন্য ডাকে। সেই ডাক শোনা যায় দূর থেকে।
চোদ্দ পনের বছরের কিশোরী মেয়েটি সেদিন ছিল আমাদের সঙ্গে। দুধিয়া। ওর মা না করেছিল। অর্পিতা শোনেনি। খানিকটা জোর করেই নিল ওকে। দুধিয়ার চোখে ভয়। তবু আমাদের সঙ্গে হেঁটেছিল পাহাড়ের কাছ পর্যন্ত। নদীর ধারে পাহাড়ের গোড়ায় অর্পিতার সঙ্গে দাঁড়ানো দুধিয়ার একটা ছবি নিয়েছিল অমৃতাংশু। চোদ্দ বছর আগের ছবি। এখনও সে ছবি আছে কিনা কে জানে!
যথেষ্ট বয়স হয়ে যাওয়া চা দোকানের লোকটিকেই চেনা লাগে শেষ পর্যন্ত। তখন একাই সামলাত দোকান। এখন একটি ছেলে রেখে দিয়েছে। এবং এত পাল্টানোর মধ্যেও দোকানটি খুব বদলায়নি। বাইরে নড়বড়ে বেঞ্চ। প্রায় খালি বোয়ামে অল্প কটা বিস্কুট। এবং লোকটিরও রোগা চেহারা, ময়লাটে ধুতি। অর্পিতার বাবার কথা মনে করানোয় চিনতে পারে আমাদের। অর্পিতাকে এখনও মনে আছে তার।
চায়ে চিনি নাড়তে নাড়তে লোকটি বলে, ম্যানিজার বাবুর সময় লজ হয় নাই, কারখানা হয় নাই, তবে হাট হত। রবিবার। বাগানে হপ্তা মিলত আগের দিন। ওই হাটে কুলিদের হপ্তা খতম।
আর এখন? অমৃতাংশু ক্যামেরা দু হাতে কোলের কাছে নিয়ে ফোকাস ঠিক করতে থাকে। ও হয়ত এখনের একটি ছবি নিয়ে ফেলতে চায়। লোকটি চা বাড়াতে বাড়াতে বলে, এখন আর কী! তিন বছর হল বাগান বন্ধ। হাট উঠে গেছে। যে যার মতো দেশ ছাড়া।
এই দোকানের বেঞ্চ থেকে নদীর শব্দ শোনা যেত। এখনও যায়। তবে তার সঙ্গে মিশে আছে দূরে কারখানায় পাথর ভাঙার শব্দ। যেন ধীর গতিতে কোনও মেশিন ঘুরে চলেছে। আগে এখানে বসে দিনেরাতে শোনা যেত জংলি ঝিঁঝিঁর ডাক। কখনও কাছে কখনও দূরে। দিক ঠাওর করা যেত না। বাংলোর বারান্দায় বসেও দুপুর বা রাতে আমরা সেই ডাক শুনতে পেতাম।
নিজের জায়গায় ফিরে গিয়ে লোকটি বলল, ম্যানিজার সাব এখন কোথায়? রিটায়ার করে তো শুনি আসামের দিকে গেলেন।
অর্পিতারা আসলে জোড়হাটের লোক। ওখান থেকে ওর বাবা চাকরি করতে এসেছিলেন। চাকরি সূত্রে উত্তরবঙ্গে থাকা হয় অনেক দিন। উত্তরবাংলা থেকে অর্পিতা কলকাতায় পড়তে চলে আসে। এসে আমাদের বন্ধু। ওর সূত্রে শুরু হয়েছিল আমাদের ডুয়ার্সে যাতায়াত।
রিটায়ারমেন্টের পর ওর বাবা মা জোড়হাটে ফিরে গেছেন। অমলেশের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর অর্পিতা পাকাপাকিভাবে কলকাতায়।
আমাদের ফেরার সময় হয়ে আসছিল। জঙ্গলে পাহাড়ে সন্ধে খানিকটা আগে নামে। গাছের আড়ালে আলো মরে আসতে থাকে। আমাদের ফেরার ব্যবস্থা বলতে চেয়ে আনা বাইক। অমৃতাংশু শেষ বিকেলের ছবি নিল কয়েকটি। গাছের মাথায় আবছা আলো-আঁধার। নদী পার হয়ে চলে যাওয়া মানুষ। মাথায় পুঁটুলি, গোটানো কাপড়। মিলিয়ে যাচ্ছে দূরে। তারপর ক্যামেরা ভাঁজ করে বলল, দুধিয়ার কথাটা কি জানতে চাইব একবার?
বয়স হয়ে যাওয়া দোকানদার প্রথমে চিনতে পারেনি। চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর আরেক বার নামটি শুনে চনমনে হয়ে উঠল। বলল, দুধ্যাকে এদিকে তো এখন সবাই চিনে। বাগানের পুরানো বস্তিতেই থাকে ও। কাগজে ওর কথা পড়েন নাই?
কাগজে দুধিয়া! কোন কাগজে! কেন! আমাদের মনে তো চোদ্দ বছরের কিশোরী। রোগাটে হাত পা। স্পষ্ট কালো চোখ। অর্পিতাদের বাড়ি থেকে দেওয়া নীলচে একটা ফ্রক পরে থাকত। যেদিন ভুটান পাহাড়ের দিকে যাওয়া হল, অর্পিতা ওর হাত ধরে পা ডোবানো জলে হেঁটেছিল। ভয় পাচ্ছিল দুধিয়া।
আর এখন!
পুরানো ঘোলাটে চশমাটি খুলে ফেলল বুড়ো। আবার পড়ে নিল। জঙ্গলের গোড়ার দিকে অন্ধকার। বুড়ো বলল, কাগজে দ্যাখেন নাই বাগান বন্ধের পর কতগুলা লোক না খেয়ে মরল। মাস দুই আগে মরল ডেনিস ওরাঁও, ওর বর। কাগজের লোকেরা আসার পরও কিছু ক্ষণ বেঁচে ছিল। তারপর সবার চোখের সামনে শেষ।
আমাদের দেখা কিশোরী এখন তাহলে চা বাগানের শ্রমিকের বিধবা? প্রায় তের-চোদ্দ বছর পর আমাদের এদিকে আসা। তার মানে দুধিয়া এখন আঠাশ ঊনতিরিশ। বর মারা যাওয়ার পর কী করছে কে জানে! ছেলেমেয়েই বা কী! পুরানো ছবির তাহলে অনেকটাই আর নেই!
আসার পথে রুক্ষ বাগান দেখেছি আমরা। যেন যত্নহীন। এরকম কোনো বন্ধ বাগানের কুলি লাইনেই হয়ত দুধিয়ারা রয়েছে।
বুড়ো আবছাভাবে বলল, বর মরাটা বড় খবর নয় এখানে। চা বাগানে অনেকের বরই আগেভাগে মরে। দুধিয়া খবর অন্য কারণে। ...এই মাসের গোড়ায় ও দুই মেয়ের ছোটটাকে বেচে দিচ্ছিল বিহারি ফড়ের কাছে। তখন হাতেনাতে ধরা পড়ে গেছে...।
ফেরার পথে অমৃতাংশু বাইক চালাচ্ছিল। আমি পেছনে। চার পাশের গাছপালা অন্ধকার হয়ে আসছে। বুনো ঝিঁঝিঁর ডাক দূরে কোথাও। শেষ হয়ে আসছিল একটা দিন, আর একটা দিন।
অমৃতাংশু খানিকটা আস্তেই চালাচ্ছিল। আমাদের দু-পাশে ছড়িয়ে যাচ্ছে সন্ধের চা বাগান।