প্রথম 'স্বাধীন' ভারতের পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল মণিপুরে। ১৪ এপ্রিল ১৯৪৪। ইম্ফল থেকে মাত্র ৪৫ কিলোমিটার দূরে মইরাং-এ। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জাতীয়তাবাদী মুক্তিবাহিনীর দ্বারা। অগ্রসরমান নেতাজির সেই বাহিনী সেদিন পতাকা তুলেছিলেছি। আর সেই সুবাদে এটি তখন দিল্লির গেটওয়ে বা প্রবেশদ্বার ছিল। ইতিহাসের কী ট্রাজেডি, প্রায় ৮০ বছর পর, এখন সেই মণিপুর দিল্লির দিকে তাকিয়ে আছে আরও ভালভাবে ও সহানুভূতির সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতিটি বোঝার জন্য।
মণিপুরে কি রাষ্টপতি শাসন জারি করতে হবে? ডাবল ইঞ্জিনের সরকার তো কিছুতেই পরিস্থিতি সামলে দিতে পারছে না। মোদী সরকারের সেকেন্ড ইন কমান্ড অমিত শাহ চারদিন উত্তরপূর্বের এই রাজ্যে আস্তানা গেড়ে, ছোট বড় মিলিয়ে থান চল্লিশেক বৈঠক করেও তেমন কোনও সমাধানের রাস্তা বের করতে পারলেন না। রাজ্য পুলিশের ডিজি পি ডাঙ্গেলকে সরিয়ে ত্রিপুরা ক্যাডারের আইপিএস রাজীব সিংকে বসানো হয়েছে। শাহর এই বিশ্বস্ত পুলিশ কর্তা কতটা করতে পারে সেটাই এখন দেখার। পাঠক এটা বিবেচনা করে দেখবেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে তাঁর এই চারবছরের মধ্যে এটি দীর্ঘতম সময় যে অমিত শাহ একটা রাজ্যে কাটালেন। শুধু অমিত শাহ নন, কোনো কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর একটি অশান্ত রাজ্যের রাজধানীতে টানা চারদিন প্রায় শিবির করে থাকার নজির নেই। সম্ভবত এটিই সবচেয়ে দীর্ঘ সময়। এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে উত্তরপূর্বের এই রাজ্য নিয়ে কী অস্থির অবস্থায় কাটাচ্ছে বিজেপি।
রাজ্য এখন সেনা নিয়ন্ত্রণে। নির্বাচিত সরকারের প্রধান মুখ্যমন্ত্রী নংথামবাম বীরেন সিং এই মুহূর্তে কাঠের পুতুল। বেচারির কিছুই করার নেই। এদিকে শাহ থাকতেই হামলা চলছে। মুখ্যমন্ত্রী এন বিরেন সিং অভিযোগ করেছেন যে, এবারে ইম্ফল উপত্যকায় যে ধরনের হামলা জঙ্গিরা ঘটিয়েছে, তা দেখে মনে করা হচ্ছে যে গোটাটাই পূর্ব পরিকল্পিত। সাধারণ মানুষদের ওপর এধরনের হামলা অত্যন্ত নিন্দনীয়। শান্ত রাজ্য হিসেবে পরিচিত মণিপুরকে স্বাভাবিক রাখা এখন চ্যালেঞ্জ। কারফিউ জারি করে, ইন্টারনেট পরিষেবা বাতিল করেও তেমন কোনও ফল পাওয়া যাচ্ছে না। ৩ মে থেকে শুরু হওয়া হিংসায় মৃত্যু হয়েছে শতাধিক। মৃতের পরিবারগুলোকে আর্থিক সাহায্যের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। বহু মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে কিন্তু এসবই অস্থায়ী ব্যাপার। মূল সমস্যাকে এখনও অ্যাড্রেস করা যায়নি।
জম্মু ও কাশ্মীর নিয়ে যে কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্বেগের শেষ নেই, পশ্চিমবঙ্গে কোন গলিতে কার রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে দেখে কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দল চলে আসে, এমনকী, বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জগৎপ্রকাশ নাড্ড দলীয় প্রতিনিধি টিম পাঠিয়ে দেন, সেই তারা অদ্ভুতভাবে নীরবতা পালন করছে মণিপুরের ক্ষেত্রে। স্পিকটি নট। যেন ওখানে যা ঘটছে, তা সীমান্তর ওপারে! প্রায় একমাস ধরে উত্তর-পূর্বের এই ছোট্ট রাজ্যটিতে যে ধরনের জাতি-দাঙ্গা চলছে, তা সাম্প্রতিককালে দেশের অন্য কোথাও দেখা যায়নি। প্রকাশ্যে একে ৪৭-এর মতো অস্ত্র নিয়ে দাঙ্গাকারীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। সরকারি হিসাবেই প্রায় ৯৮ জনের প্রাণ গিয়েছে। নিহতদের তালিকায় আধাসেনার কমান্ডো থেকে জাতীয় স্তরের খেলোয়াড়, সরকারি আধিকারিক প্রমুখ রয়েছেন। আক্রান্ত হয়েছেন শাসকদলের একজন বিধায়কও। হাজার হাজার মানুষ ঘরছাড়া। তবুও দেখা গিয়েছে কর্নাটক বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহসহ নানা সাইজের কেন্দ্রীয়মন্ত্রীরা। তাঁরা কেউ মুখ খোলেননি মণিপুর নিয়ে। অথচ, মণিপুরে জ্বলছে মোদীর বড় সাধের ডাবল ইঞ্জিন সরকার। মণিপুর যখন জ্বলছে মোদী-শাহরা তখন ভীষণ ব্যস্ত সেন্ট্রাল ভিস্তা নিয়ে, নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধন করে রাজদণ্ড সেঙ্গল প্রতিষ্ঠায়। এই যে ঘটনা অগ্নিগর্ভ হলেও নীরব থাকা, এটা নরেন্দ্র মোদীর একটি বড় প্রিয় স্বভাব। দিল্রিতে প্রতিবাদরত কুস্তিগিরদের ক্ষেত্রেও এই নীতি নিয়ে চলছেন প্রধানমন্ত্রী। এদিকে এই হিংসার মাঝেই মুখ্যমন্ত্রী বদল নিয়ে জল্পনাও তৈরি হয়। মে মাসের মাঝামাঝি ভাবাই হচ্ছিল বীরেন সিং সরছেন। মণিপুরের হিংসার আগের থেকেই এন বীরেন সিংকে গদিচ্যুত করার দাবি করে আসছিলেন বিজেপির একাংশ। তবে বীরেন সিং মেইতেই সম্প্রদায়ের মানুষ। রাজ্যের অন্যতম বড় মেইতেই নেতা। পাশাপাশি তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতা পরীক্ষিত। এই আবহে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তাঁকে সরাবার পদক্ষেপ করার ঝুঁকি নিতে চাইছে না। সেনা নামিয়ে ঠান্ডা করতে চাইছে। সব বুঝেশুনে গত সোমবার সন্ধেয় মণিপুরে ল্যান্ড করেছেন অমিত শাহ।
জনসংখ্যার নিরিখে মণিপুর একটি অত্যন্ত ছোট রাজ্য। মেরেকেটে এই রাজ্যে অধিবাসীর সংখ্যা ৩৫ লক্ষের বেশি নয়। বৈচিত্র্য হচ্ছে, এই ৩৫ লক্ষের মধ্যে ছোট বড় মিলিয়ে রয়েছে প্রায় ৩৫টি জনজাতি সম্প্রদায়। এদের মধ্যে মেইতেইরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। মোট রাজ্যবাসীর ৫৩%। রাজ্যে বাস করেন একাধিক ধর্মের মানুষও। হিন্দু ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা প্রায় সমান-সমান। সাড়ে ৮ শতাংশ মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষও রয়েছে। প্রায় ১০ শতাংশ এমন একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছে, যাদেরকে হিন্দু-পূর্ববর্তী ধর্ম সম্প্রদায় বলা হয়ে থাকে। অল্প জনসংখ্যা, কিন্তু অসম্ভব বৈচিত্রময় এই রাজ্যের একটা দীর্ঘ ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও রয়েছে। যাকে ঘেঁটে দেওয়ার পরিকল্পনাও সক্রিয় রয়েছে বেশ কিছুদিন ধরে। অথচ আমরা তো জানি, এই সেদিনও থাংজাম মনোরমার জন্য ন্যায় ও আফস্পার বিরুদ্ধে মণিপুরের এককাট্টা প্রতিবাদ হয়েছিল! ২০০৪ সালের ১৫ জুলাই ইম্ফলে অসম রাইফেলসের সদর দফতরের সামনে ব্যানার হাতে দেখা যায় ১২ জন বিবস্ত্র মহিলাকে। সেখানে লেখা ছিল ‘রেপ আস ইন্ডিয়ান আর্মি’। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল সেই ছবি। ধিক্কার উঠেছিল নানা ভাষায়। বিভিন্ন জনজাতি পারস্পরিক বিরোধকে দুরে ঠেলে মনোরমার জন্য ন্যায় ও আফস্পার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল। সে ছিল মণিপুরের এককাট্টা প্রতিবাদ।
কিন্তু ২০০৪ থেকে ২০২৩। মাত্র দু’দশকের মধ্যে এমন কী ঘটল যে 'চিত্রাঙ্গদার' পাহাড়ি রাজ্যটি আজ গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত? তবে কি এক ভারত, এক ধর্ম, এক ভাষা চালু করার রাজনৈতিক তৎপরতা মণিপুরকে অশান্ত করে তুলেছে? মণিপুরে উপজাতি বা আদিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে লড়াই নতুন কিছু নয়। ব্রিটিশ এদেশে আসার আগে থেকেই তা চলছে। তবে এবার তা ভিন্ন মাত্রা ধারণ করেছে। মনে হচ্ছে অনেক বেশি পরিকল্পিত। তৎপর হয়েছে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো। মৌনব্রত ভেঙে অমিত শাহ হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, কোনভাবেই মনিপুরকে খণ্ডিত করতে দেওয়া যাবে না। এমনকী, এই মুহূর্তে যদি জঙ্গিরা আস্ত্র ত্যাগ না করে তাদের ভয়াবহ ফল ভুগতে হবে। এ তো গেল দাপের রাজনীতির কথা। কিন্তু? এটা ঠিক এখন সারা দেশে ওবিসি আন্দোলন নিয়ে নানা বিতর্ক না স্তরে জায়মান, ভারতের জনসংখ্যায় ‘ওবিসি’ বা তফসিলি নিম্নবর্গ আসলে কত তা প্রকাশ করার জন্য বিরোধীদের অনেকেই দাবি করছেন। সেরকম জনগণনার কথাও উঠছে। এইরকম একটা পরিস্থিতিতে মণিপুরে বিজেপির মতো সর্বভারতীয় দল ক্ষমতাসীন। সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই জনসমাজের সমর্থনও বিজেপির দিকে। মেইতেইরা বিজেপির ভোটব্যাঙ্ক ছিল। নাগা-কুকিরা মূলত পাহাড়বাসী খ্রিস্টান সংখ্যালঘু। পাহাড় ও জঙ্গলে বাস করার কারণে এই উপজাতিরা সংখ্যায় মেইতেইদের চেয়ে কম হলেও রাজ্যের ৯০ শতাংশ জমির মালিক। কারণ, রাজ্যের আয়তনের মাত্র ১০ শতাংশ জমি ইম্ফল উপত্যকায়। আর উপত্যকাই মেইতেইদের মূল বাসভূমি। শাসক সম্প্রদায় হওয়া সত্ত্বেও মাত্র ১০ শতাংশ জমির ওপর স্বত্বাধিকার মেইতেইদের পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ কিন্তু উপত্যকাতে এসেও জমি কিনতে পারে। অন্যদিক, উপজাতি এলাকার জমি কেনার অধিকার নেই মেইতেইদের। এই প্রেক্ষাপটেই মণিপুর হাই কোর্টের নির্দেশ আগুনের ফুলকি হিসাবে কাজ করেছে। হাই কোর্ট এই দাবি সমর্থন করায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে গিয়েছে। মেইতেই বনাম নাগা-কুকি, সংখ্যাগরিষ্ঠ বনাম সংখ্যালঘু, হিন্দু বনাম খ্রিস্টান, দেশীয় এবং বহিরাগত-সংঘাত নানা স্তরে বিপজ্জনক রূপ নিয়েছে। মেইতেই জনসমাজের প্রতিনিধি মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণেও চূড়ান্ত ব্যর্থ। মুখে বহুত্ববাদী কথা বলা মোদী-শাহর বিজেপি নিজেও বুঝতে পারছে না বীরত্ব দিয়ে কতটা সামলাবে। ১৯৪৭ সালে মণিপুর স্বাধীন রাজ্য হিসাবে আত্মপ্রকাশের ইচ্ছা প্রকাশ করে। পাশে বর্মার (এখনকার মায়ানমার) আগ্রাসী মনোভাবে ১৯৪৯ সালে রাজা বোধচন্দ্র সিং ভারত অন্তর্ভুক্তির সম্মতিপত্রে সই করেন। ১৯৫৬ সালে এটি কেন্দ্রশাসিত রাজ্য হয়। পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা পায়।
১৯৭২ সালে। উত্তরপূর্বের এই অঞ্চলের পুনর্গঠন এবং নতুন রাজ্যগুলি, গত শতাব্দীর ছয়, সাত ও আট দশকে তৈরি হওয়ার পর থেকে বিশেষ করে মণিপুরে বিগত পাঁচ দশকে, একটি রাজনৈতিক ফেব্রিক বা প্যাটার্ন তৈরি হয়েছে, যা আজও চলছে। প্যাটার্নটি হল, কেন্দ্রে যে রঙের সরকার থাক, তারা সাধারণত রাজ্যের শাসনক্ষমতা মালিকানা, অধিগ্রহণ, কোঅপ্ট বা বিকৃত করতে সক্ষম হয়। আর সেটা করে হয় নিজ দলের সরকার গঠন করে বা অনুগতদের বসাতে কিম্বা স্থানীয় ক্ষমতার অভিজাতদের স্থলাভিষিক্ত করে। কংগ্রেসের আমলে কংগ্রেস এটা করেছে, জনতা পার্টি সামান্য সময় কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকতেও করেছে আর বিজেপি তো করছেই।
এবার শাহ দীর্ঘ সময় কাটিয়ে, নানা স্তরে কথা বলেও একধাপ এগিয়েছে বলে মনে হচ্ছে না।
প্রায় এক মাস আগের পরিস্থিতির দিকে ফিরে তাকালে বোঝা যাবে, মণিপুর পুনরুদ্ধারের পথে রয়েছে, মানে শান্ত হচ্ছে এমন সিদ্ধান্তে পৌছবার কোনও চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না।