দক্ষিণায়ণ শুরু হতেই বাংলার বাতাসের গন্ধটা যায় বদলে। শরতে দিন-রাত্রি সমান সমান হবার আগেই ফোটে কাশ। পদ্মা তীরবর্তী গরমতম জেলা শহর ঘিরে তখন যে হাওয়াটা বইতে থাকে, সেই শৈশব থেকেই জানি, সেটা পুজোর ঘ্রাণ। অকারণ স্ফূর্তিতে বন্ধুদের কাছে খবর নেবার শুরু, কবে পাড়ায় পাড়ায় বসবে পুজো মণ্ডপ।
বড়ো পুজো অর্থাৎ কিনা দুর্গোৎসব এর বেশ আগেই, আষাঢ় মাসে রথ-যাত্রা; সমস্ত শহরটা জুড়ে সাড়া পড়ে যেতো। রথের মেলার জন্য, মা- খালাদের বছর জুড়ে প্রতীক্ষা- কখন কিনবে তাদের কাজের আর শখের জিনিসপত্র। ছানা-পোনা থেকে বুড়ো, সবার জন্যই মেলায় নানা জিনিসের আমদানি। শিশুদের খেলনা। বাড়ির তৈজস থেকে আসবাব। রকমারি খাবার। সে মেলায় যায় সকলে। বরাবরই সে রথের রশি টেনে, রথ উদ্বোধন করেছে জেলা প্রশাসক বা নগরপিতা। বর্ষার বৃষ্টি, বাঁশির আওয়াজ ভোঁ, জিলিপি কি পাঁপড়ভাজার মৌ মৌ সুবাস, দামাদামি সবমিলে দারুণ এক সার্বজনীন উৎসব। সেই ঐতিহ্যবাহী রথ এবং রথের মেলা আজও একই ভাবে রাজশাহী শহরটিকে আনন্দ দান করে চলেছে।
সরস্বতী পুজোতে ঘুরে ঘুরে কলেজগুলোতে প্রসাদ খেয়েছি হাত পেতে, পাত পেতে। দুই একটা স্কুলে আগেও পুজো হতো, এখনও হয়। বাড়ি বাড়ি তো রয়েছেই। সরস্বতী পুজো ঘিরে সমস্ত দেশজুড়ে বিদ্যার্থীদের মধ্যে যে বিপুল সাড়া পড়ে, তা শুধু সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেই সবসময় সীমাবদ্ধ থাকে না। বীণাপাণিকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করতে কাউকে শুনিনি। উস্কানিমূলক মন্তব্য তো নয়ই।
দশভুজা শব্দটি নারীর জন্য অলংকার স্বরূপ। সুপ্রাচীন কাল থেকেই নারী তার কর্মযজ্ঞ দিয়ে পূজিত। কাজই আনন্দ, কাজই কল্যাণ, কাজই বেঁচে থাকার প্রেরণা। তাই প্রাচীন যূথবদ্ধ সমাজের অনেকটা জুড়েই ছিলো মাতৃতান্ত্রিক সমাজ। মাকেই তাই পুজো করা হয়েছে। মা দেবী। মা নারী। দুর্গা বা দশভুজাও বাংলায় নানা শক্তির আধার রূপে পূজিত। অকালবোধনে দেবীর আবাহনে সর্বত্র বিরাজিত দেবী সকল অমঙ্গল দূর করেন, শঙ্কাহরণ করেন। বন্ধুদের কাছে শৈশবে এসব ভাসা ভাসা শোনা। সকল উৎসব আয়োজনের পেছনের যে গল্পটি তা শৈশবে সকলেরই খুব ভালো জানা থাকে না। সামনে যেটুকু দৃশ্যমান, সেটুকুই উৎসব।
বাংলায় বারো মাসে তেরো পার্বণ। তারমধ্যে শারদীয় দুর্গোৎসব অন্যতম। নদীর জল বর্ষার সময়ের চেয়ে কমতে থাকে। আকাশে মেঘ আর নিচে কাশফুলের মিতালি। শিউলির ঘ্রাণ। এর সাথে ঢাকের বাদ্য-বাজনা; এসব মিলে ভাগ হওয়া পূর্ববঙ্গের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাকে ভীষণ সেক্যুলার দেখেছি।
আশির দশকে বাড়িতে পত্রিকা যেটি আসতো, প্রতিটি খবর খুঁটিয়ে পড়তেন যিনি, তিনি আমার দাদা (বাবার বাবা)। রেডিওর প্রতিটি খবর শোনা চাই তাঁর। কোলকাতায় দু'বছর পড়াশোনা করার সুবাদে, তাঁর কাছে সেকাল অর্থাৎ কিনা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমসাময়িক পুজো আর আশির দশকের পুজোর বেশ তুলনামূলক আলোচনা শোনা যেতো। একজন পরহেজগার মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও তাঁর মধ্যে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি ভ্রার্তৃত্বমূলক আচরণই দেখেছি। পুরো পরিবারের মধ্যেও তেমনি পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। চার-পাঁচ দিনব্যাপি দুর্গোৎসব ঘিরে তাই আমাদেরও কৌতুহলের শেষ ছিলো না। কতোকিছু করার আছে, দেখার আছে।
মহিষাসুরমর্দিনী সুর কি আশ্চর্য দ্যোতনার সৃষ্টি করতো, রেডিও টিভিতে শোনার জন্য বসে থাকা হতো, ভোর হতো। শহরের অনেক অংশ জুড়ে আলোর মেলা! আলোকসজ্জা দেখার জন্যও একটি সন্ধ্যা রাখতেই হতো। মণ্ডপে আসা প্রত্যেকজনকে কি উজ্জ্বলই না দেখাতো! চেহারার কষ্টের ভাঁজ, দুঃখের রেখা সেই বর্ণিল অলোতে মুছে যেতে দেখেছি। দেখেছি ঢাকের তালে সকলকে নেচে উঠতে। বাঁধভাঙা আনন্দের জোয়ারে ভেসে যেতে। ধূপসুগন্ধি ধোঁয়া নিকিয়ে নিয়েছে গুড়ি গুড়ি বিষন্নতার বৃষ্টিকে। কতো রকমারি মণ্ডপ! মণ্ডপ ঘুরে ঘুরে নিজেদের মতো মনে মনে প্রথম দ্বিতীয় নির্বাচন করে ফেলার সুখ। শৈশবে প্রায় সব পুজো মণ্ডপে প্রতিমার গড়ন একই হতো। হঠাৎ কোথাও আলাদা নকশার প্রতিমা দেখলে সেটাই হয়ে যেতো প্রথম। আজকাল মায়ের কতো গড়ন, কতো ধরণ, নানা থিম। তবু মন কেমন করে সেই পুরাতনী মায়ের জন্যই!
সারাদেশের সকল উৎসব উদযাপনের খবর সংবাদপত্র আর বেতারে মিলতো, সে ছিলো সাদা-কালোর যুগ। টিভিও প্রথম সাদা-কালো। ধীরে ধীরে রঙিন হয়ে উঠলো বটে, কিন্তু শৈশবের সাদা-কালো যে কতোটা রঙিন ছিলো সে আজ বুঝি! বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্রই সার্বজনীন বারোয়ারি পুজো। ইতিহাস এও বলে, পূর্ববাংলার তাহেরপুরের রাজা কংস নারায়ণ সর্বপ্রথম বাংলায় সার্বজনীন দুর্গোৎসবের আয়োজন করেন। ক্রমে এই পুজোর ধরণটি প্রচলিত হয়ে যায়।
ধনী পাড়ায় বড়ো পুজো মণ্ডপ। দরিদ্র পাড়ায় ছোটো মণ্ডপে দেবী অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু সকল পাড়ায় সকলের অবাধ যাতায়াত। সরকার এবং স্থানীয় সরকার পুজোর জন্য প্রতিবছর যে অনুদান দিয়ে থাকেন তার সাথে নিজেদের সারাবছর জমিয়ে রাখা অর্থে যে পুজো, সেখানে দেবীর যে আরাধনা; ধনী-দরিদ্রে মানসিকতায় কোনো ব্যবধান নেই। ভেতরে ভেতরে থাকলেও উৎসব আনন্দে সেটা টের পাওয়া যায়না। দেখিনি অন্য ধর্মের কাউকে পুজোর সময় পুজোর আয়োজনে বিরোধিতা করতে। যার যার নিজ ধর্ম, ধর্মীয় উৎসব নিজের মতো পালনের প্রত্যেকেরই রয়েছে সমান অধিকার। বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা যা পুজো বা প্রতিমার ক্ষতি করে এমন কোথাও কালেভদ্রে ঘটলেও, তাৎক্ষণিকভাবে প্রশাসন সেটির সমাধান করে। নিরাপত্তার অভাব বোধের কথা শুনিনি বন্ধুদের কাছে।
চাঁদ সাড়ে ঊনত্রিশ দিনে একবার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে, সেই দিন ঘিরেই আসে ধর্মীয় উৎসব। যদিও উৎসব শুরু হলে তাতে ধর্মের বাতাবরণ থাকে না, বা যতটা থাকে সেটুকু সেরে নেওয়া যায় স্বল্প সময়েই। বাকিটা উচ্ছ্বাস। যেহেতু বিষয়টি চাঁদের সাথে সম্পর্কিত সেহেতু বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের অনুষ্ঠান একই দিনে পড়ে যায়। কুরবানির ঈদ, দুর্গোৎসব। আশুরার সাথে দুর্গোৎসব। প্রবারণা পূর্ণিমা, ঈদ-ই-মিলাদুন্নবি, লক্ষ্মীপুজোও হয়ে যায় একই সময়ে, ভালোবাসা আছে বলে, যার যার উৎসব আগিয়ে পিছিয়ে আমরা ঠিক আনন্দের সাথে উদযাপন করি। আনন্দ বা শোক ঠিকই যার যার জায়গায় রেখেই বয়ে যায় যে যার মতো। শুনিনি কেউ উচ্চরব তুলেছে অন্যের বিরুদ্ধে।
স্কুলে পড়াকালীন বন্ধুদের বাড়ি পুজোর দাওয়াতে না যেতে পারলেও, টিফিনে দিব্যি মোয়া,নাড়ু সাবাড় করেছি। একটু বেড়ে উঠতেই বন্ধুদের বাড়ির লুচি-লাবড়া-পায়েসের যে ভোগ খেয়েছি, সে অমৃত! সে সময় পুজোর কাছাকাছি সময়ে নতুন জামা তুলে রাখতাম পুজোয় পরবো বলে। এখন অবধি সেই একই! সূর্যাস্তে আজান ফুরোতেই, দেখা দেয় সন্ধ্যা তারা, বেজে ওঠে শঙ্খ। পুজোর সময় সন্ধ্যা আরতির ঢাকের শব্দ মিশে যায় মানুষের আনন্দ কোলাহলে।
আমাদের এই বাংলায় রাষ্ট্র থেকেই প্রচার হয়, ধর্ম যার যার, উৎসব সবার; তাই বাঙালির এখন আর বারো মাসে তেরো নয় বহু পার্বণ যুক্ত হয়েছে। যুক্ত হয়েছে সকলে সকলের সঙ্গে। হয়তো ছোটো-ছোটো সাংঘর্ষিক কিছু বিষয় রয়েছে, সেটি সহমর্মিতায় এড়িয়ে গেলে আমাদের বন্ধন সুদৃঢ় হবে উৎসবে,আনন্দে।
ছবি - কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত