হাথরসের রঙ নিয়ে কেউ কথা বলছে না। তার মানে কি এই যে সবাই জেনে গেছে হাথরসের রঙ কী? সত্যি, কী সেই রঙ যা বর্ষার মধ্যেও ঠিক আটকে ছিল আগুনে বা হিন্দুস্থানের সেরা শহরে, সেই দিল্লীর রঙবাজিতে আলাদা হয়ে ফুটেছিল। হ্যাঁ, ফুটেছিল বলেই না সব সেরা নওজোয়ান , সব সেরা হিম্মতদার - হিন্দুস্থানের নওজোয়ানো কা শান ভাই চন্দ্রশেখর আজাদ রাবণ এনআইএয়ের চোপা থামিয়ে দিয়ে বলল,“ পি এমকে উত্তর দিতে হবে আমাদের বোনেদের গায়ে হাত দেওয়া হয় কেন!” ভাই চন্দ্রশেখর রাবণ কিছু বললে ড্রিম ড্রিম আওয়াজ হয় আর গোলির কুত্তার মতো মিডিল ক্লাস ঘুমকে ছুটে পালাতে দেখা গেল। সে কোথায় পালাচ্ছিল মিডিল ক্লাস ঘুম, দেখতে বারান্দায় যেই ঝুঁকেছি বুঝলাম তলায় যেন আলোচনা হয় হাথরসের কাহানি নিয়ে। কেমন সে সব কাহানি যা নজর আন্দাজ করতে আবার কি ছুটতে হবে ভাই চন্দ্রশেখর রাবণের কাছে?
মিডিল ক্লাস ঘুম তখনও পুরোপুরি ভাঙেনি আর সেই ঘুমের পাতলা চাদর সরিয়ে যেন দেখা যাচ্ছে বাবা সাহেবের গাঢ় নীল ঝাণ্ডা যা দিল্লীর শুখা বাতাসে পতপত করে উড়ছে। এখন এই ঘোর বারিশের উচ্ছাসের মধ্যে যখন সব বাড়তি সেন্টুরা কাদার মধ্যে মুখ গুঁজে পড়ে থাকতে দেখা যায় সে সময় বারান্দার বাতাসে দিল্লী থেকে ভেসে আসা জয় ভীম, লোহিয়াজির নারা, জগদীশবাবুর ইনকিলাব আর ছোটানাগপুরের উলগুলান চাঙ্গা করে তুলছে হাথরসের কাহানিমালা। শুনলাম রঙ নিয়ে আলোচনা চলছে—
—— হাথরস হাথরস - এক অদ্ভুত ব্যাপার আছে না !
—— হ্যাঁ, খুবই সোনোরাস।
—— শুনতে বড় ভালো।
—— আচ্ছা ওটা কি জায়গার নাম?
—— কোথায় সে গলি?
—— গলি হতে যাবে কেন।
—— তবে কী?
—— ওটা কি সিনেমার নাম?
—— ওটা সিনেমা হলে কেমন সে সিনেমা?
—— ওটা কি ছবির নাম?
——ওটা ছবি হলে কেমন সে ছবি?
—— কে আঁকলো ছবিটা?
—— ওটা কি গল্প ?
—— ওটা কি গল্পের নাম?
—— ওটা গল্প হলে কে লিখল গল্প?
—— ওটা কি নাটকের নাম?
—— ওটা নাটক হলে কত বড়ই বা সে নাটক?
—— সারা রাত চলতে পারে এমন নাটক কি হাথরস?
—— হাথরস নাটক হতে যাবে কেন।
—— আমি হাথরস নামের এক নাটকের কথা বলছি।
—— তার চেয়ে বড় কথা হাথরসের রঙ।
—— হ্যাঁ, সিনেমা নাটক গল্প ছবি বা গলির খোঁজ সব তো বানানো তাই রঙটা গুরুত্বপূর্ণ — রঙ।
—— কী রঙে আঁকা হবে হাথরসকে?
হিন্দুস্থানের কাহানিমালা বড় আজিব। নানান ফর্মে আর তার চক্করে পড়ে তার নানা চেহারা হাজির। বারান্দা দিয়ে সে সব আন্দাজ পাওয়া খুব মুশকিল হয়ে ওঠে। তবে নানা দিক থেকে নানান রকমের হয়ে তা যে আসে এ এক আজিব দস্তানই বটে। মান্টো সাব নানান তরিবৎ আর তারিকায় তার একটা লিস্ট বানিয়ে গেছেন। সে সব সীমান্তের কথা - দেশভাগ। একটা খণ্ড থেকে দুটো খণ্ড হওয়ার বাইনারি। হ্যাঁ, মাত্র দুটো খণ্ড হাত দিয়ে পরখ করতে করতেই মান্টো সাব জানাজায় চড়ে ছিলেন। তাঁর সেই মহৎ জানাজা দুই খণ্ডের মধ্যে দুলতে দুলতে চলছে আজও পূর্ণিমার রাতে দেখা যায়। সে সব স্পষ্ট আমি তো দেখতে হররোজ যাই জঙ্গলের একদম মধ্যিখানে। যেখানে একটা নদীর আওয়াজ শোনা যায়, যেখানে একটা নদীর আওয়াজ শোনা যায় আর দূর হতে দেখা যায় সান্নাটা যা শোনার কথা সেই সান্নাটা যখন দেখা যেতে থাকে, যখন বুনো মোষেরা শান্ত পাথরের মতো দূরে বিশ্রাম নেয় আর বাঘ দূর হতে ভুটান পাহাড়ের খাঁজে লুকিয়ে তাকিয়ে তার চেয়ে অনেক ভয়ংকর শ্বাপদ - আদমি ও আওরতের প্রেম লক্ষ্য করে তখন মান্টো সাবের জানাজা দুলতে দুলতে দেখি আমি হর রোজ হর জঙ্গল । আর ভাবছিলাম হাথরসের রঙের কথা- শুধুমাত্র দু টুকরার বাইনারি নয় এক হাজার টুকরার মধ্যে দেশ বাঁটতে বাঁটতে যে ছবিটা বেরিয়ে আসছিল তা হিন্দুস্থানের মতো আকার নেওয়া এক আওরতের উরুর মধ্যিখান থেকে খিঁচে নেওয়া রক্তের ডেলা। সেই ডেলা থেকে রঙ চুঁইয়ে চুঁইয়ে নামছে আর হাথরসের গলি থেকে, হাথরসের সিনেমা-নাটক-গল্প বা ছবিমালাকে রঙ দিয়ে ভরিয়ে ভরিয়ে দিচ্ছে— সে সব মিডিল ক্লাস ঘুমের মধ্যে আমার তো রক্তের মতোই লাগছিল আরকি। একটা বড় ক্যানভাস তার ওপর হাতের পাঞ্জার ছাপ ছাপ ছাপ ছাপ ছাপ।
সুদীপ বলল,“ গল্প দারূণ লিখেছো। তোমার হাতের পাঞ্জার ছাপ আছে।” জানি না তার সাথে হাথরসের সম্পর্ক কী হবে। তবে আমি এসব করতেও চাইছি না। কেনই বা নিজের হাতের পাঞ্জার ছাপ দিয়ে দিয়ে ছবি আঁকতে যাব। বারান্দায় দাঁড়িয়ে মিডিল ক্লাস ঘুম কেটে পাঞ্জার কথা ভাবছিলাম আর আতঙ্কে শিউরে উঠে দেখেছি আমারই কাটা পাঞ্জার ছাপ দিয়ে দিয়ে ওই রক্তের ছোপ মারা হাথরসের ছবি আঁকা চলছে তো চলছেই।
ভাই চন্দ্রশেখর আজাদ রাবণের তাতে কিছু এসে যায় না। গোঁফে তা দিয়ে,গাঢ় নীল উড়নিটা গলায় পেঁচিয়ে সে বলেছে,“ পি এমকে জবাব দিতেই হবে।” ভাই চন্দ্রশেখর রাবণ আবার তার ক্ল্যাসিক ৩৫০ রয়্যাল এনফিল্ডে স্টার্ট দিতে যায়, ইঞ্জিনের আওয়াজ উঠল- ড্রিম ড্রিম ড্রিম ড্রিম ড্রিম ড্রিম। আমি আবার মান্টো সাবের জানাজা দুলতে দুলতে যেতে দেখলাম- হর রোজ হর জঙ্গল।