এনকাউন্টারের খবর কলকাতার পার্টি দপ্তরে চলে গেলেও সেখান থেকে কোনো একশন স্কোয়াড চুঁচুড়ায় মুনিকেশদার বাসায় বা অকুস্থলের দিকে রওনা হল না। কলকাতা দপ্তরের কিছু প্রাচীন বাঘা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মন্তব্য করল, সত্তর সাল হলে এতখণে স্কোয়াড ত্রিশ কিলোমিটার এগিয়ে যেত।
এসব ঘি শোঁকাশুঁকির মধ্যে মুনিকেশদার বডি পোষ্টমর্টেম হয়ে গেল ইমামবাড়া হসপিটালে। পোষ্টমর্টেম রিপোর্টে লেখা হল ধাক্কাধাক্কিতে পড়ে গিয়ে মুনিকেশদার বুকের পেসমেকার যন্ত্রটি ডিসপ্লেস হয়েই যত বিপত্তি।
এলাকার প্রবীণ নকশালদের শোক উথলে উঠল। হতভম্ব হয়ে গেল তারা। বসল গোপন মিটিং – একী কান্ড ! মুনিকেশদার বাড়ীতে কোনো বুলেট পাওয়া গেল না ! অন্তত নেপালার কোপ বা বোমের স্প্রিন্টাল ? আমরা যে “শহীদ কমরেড লাল সেলাম“ দিয়ে দিলাম ! “শহীদের রক্ত হবে নাকো ব্যর্থ” বলে দিলাম ! তার কি হবে এবার ? কলকাতা দপ্তরের প্রবীণ বাঘারা নির্দেশ দিল,চেপে যা। জল দিয়ে গিলে লে।
কলকাতা চ্যাপ্টার ক্লোজ হলেও স্থানীয় কমিটি এতদিন পর ধুপের আগুনকে ফার্নেস বানানোর চেষ্টা ছাড়তে নারাজ। তারা এক কমরেডের ছেলের এসিওয়ালা বসার ঘরে বসে সিদ্ধান্ত করল, এর শেষ দেখে ছাড়বে। গভীর চক্রান্ত অবশ্যই এখানে আছে। এরকম একজন এক্টিভিস্টের মৃত্যুকে ফুকে দেওয়া যায়না। এখন মৃত্যু বহুমুখী। ময়দানে নিয়ে গুলি করার দিন চলে গেছে। এমন বিজ্ঞান সম্মত পরিকল্পিত ধাক্কা মুনিকেশদাকে কে এবং কেন দিল যাতে তার বুকের পেসমেকার নিখুত ভাবে ডিসপ্লেস হল !
মুনিকেশদার চুঁচুড়া শহরের মধ্যস্থলে ছিল বিশাল জমি। যার প্রায় সবটাই গ্যারেজ, চায়ের দোকান, দর্জি, ফুলের দোকান, স্টোভ কুকার রিপেয়ারিং, সাইকেল বাইক সারাইয়ের দোকান নামমাত্র ভাড়ায় চলে। মুনিকেশদা যখন সশস্ত্র সংগ্রামে গ্রামমুখী, তখন এসব পুর্ববাঙ্গলার রিফিউজিদের চুঁচুড়া শহরে খাদ্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেন। তার এমত ঐতিহাসিক ভুল তার পরিবারবর্গ বা অন্যান্য অংশীদারগণ মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু তখন সময়টা অন্যরকম, তাই কিছু বলতে পারেনি। জমানা যত বদলেছে,উন্নয়ন যত রাজপথগামী হয়েছে, শহরের মধ্যস্থলের এই জমির উপর নজরদারি তত বেড়েছে। আর নজরদারি যত বেড়েছে মুনিকেশদার গোটা পরিবার এমনকী তার একমাত্র ভাইপোও তাকে গালমন্দ করা বাড়িয়েছে। মুনিকেশদা তার টিনের স্টুডিয়োতে বসে শুধু ছবি এঁকে গেছে আর মাঝে মাঝে প্রাগৈতিহাসিক বিপ্লববাদকে উত্তোরিত করার চেষ্টা করে গেছে। এদিকে জমি ছাড়ার জন্য তার উপর চাপ বেড়ে চলে। নানারকম বাহারি গাড়ি গভীর রাতে মুনিকেশদার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াতে থাকে। ঘুম থেকে তুলে তারা কাগজপত্র মুখের সামনে এগিয়ে দেয় সই করার জন্য। আর বিনিময়ে সই করা ফাঁকা চেক তার হাতে গুঁজে দিতে চায়। মুনিকেশদার একটাই কথা, সমস্ত দোকানদারের পূণর্বাসন ছাড়া কোনো কাগজে সই দেব না। পালটা হুমকি এসেছে। বন্ধুজনেরা সাবধান করেছে। মুনিকেশদা বলেছে,” আরে আমি ঞ্জোতদার মেরে জেল খেটেছি। বাঁকুড়ার জঙ্গলে পুলিশের সাথে লড়াই করেছি। এসব কুঁচো রংবাজ আমার কি করবে ! এখনো একটা খবর করলে একশন স্কোয়াড চলে আসবে। জানবি, আমার মৃত্যু বন্দুকের গুলিতেই হবে, সুগার কোলেস্টরেলে নয়…”
মুনিকেশদা নিজের এই টিনের স্টুডিওকে বলত ঘাঁটি। আর গোটা জমিটা, যেটায় এইসব ভাড়াটিয়ারা ছিল তাকে বলত মুক্তাঞ্চল। এই মুক্তাঞ্চলে মুনিকেশদা তার পঁয়ত্রিশ কেজি ফিগার নিয়ে শিনা ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াতো। আর বলত, এই ডেরাতে কোনো শ্রেণীশত্রুর ঢোকা নিষেধ।
কিন্তু শ্রেণীশত্রু কে ? সেটা কি মুনিকেশদা চিহ্নিত করতে পেরেছিল শেষ অবধি ? চিহ্নিত করতে পারলে তো মারা যেত না ! অথবা মুনিকেশদার মৃত্যু কি আদৌ কোনো শ্রেণীশত্রু করেছিল ? না কি তার মৃত্যু আসলে একজন শ্রেণীমিত্রের হাতেই সংঘটিত হয়েছিল ? এসবের রিপোর্ট পোষ্টমর্টেম রিপোর্টে থাকে না। তবে পুলিশ রিপোর্টে থাকে। ছিলও।
মুনিকেশদার ভাইপো বাপি, সিজোফ্রেনিয়া রোগে আক্রান্ত। অর দিদি বিধবা হয়ে বাড়ীতে থাকে। ওদের অনেক টাকার দরকার। কিন্তু টাকা কোথায় পাবে ! রামকৃষ্ণ বলেছেন, টাকা মাটি, মাটি টাকা, এই জমিটা বেচলে অনেক টাকা…
গভীর রাতের বাহারি গাড়ির মালিকরা বাপিকে চিনে ফেলে। এসি গাড়িতে করে কোথায় ঘুরতে নিয়ে যায়? দু”চার ঘন্টা পর ছেড়ে দেয় বাড়ির সামনে। বাপি গাড়ি থেকে নেমে আসে। হাতে দুটো বিরিয়ানির প্যাকেট আর কোকোকোলার বড় বোতল। সে বিড়বিড় করতে থাকে,” টাকা মাটি মাটি টাকা, বিরিয়ানি যার জমি তার, জমি তার ? জমি কার? বিরিয়ানি যার…
মুনিকেশদা তার মুক্তাঞ্চল পাহারা দেয় গোপন রাইফেল হাতে। ফরাসি বিপ্লবের পেইন্টিংটা করতে গিয়ে সে চল্লিশ বছরের পুরনো রাইফেলটা আবার খুঁজে পায়। ছবি থেকে ও রাইফেলটা উপড়ে নিয়ে আসে। গভীর রাতে মুনিকেশদা খালি গায়ে পাজামা পরে রাইফেল হাতে নিয়ে ঘাটিতে বসে ইন্টারন্যাশনাল গায়। নিশুতি চুঁচুড়ার বুকে লক্ষী পেঁচা উড়ে যায়। মুনিকেশদার মনে পড়ে বাঁকুড়ার জঙ্গলে তিন রাত গাছের ডালে কাটানোর স্মৃতি। পুরো জঙ্গল ঘিরে রেখেছিল সিআরপিএফ। গাছ থেকে নামেনি মুনিকেশদা ! খায়ও নি ! হাগামোতা গাছের উপর থেকেই করেছিল।
মুনিকেশদার ভাইপো সিজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত বাপি হুমকি দেয়, এ জমিতে আমারও ভাগ আছে, সই করে এখান থেকে চলে যাও, টাকা মাটি মাটি টাকা, কাগজ যার জমি তার…
মুনিকেশদা বলে, সই দেবনা যা ভাগ, এতগুলো মানুষের কথা ভাবলি না তুই !
বাপি বলে, এত ভাবলে আমার মাথা ধরে, এই জমি কার? আমার তোমার, তোমার আমার, আর কারো নয়। আমার টাকা চাই, আমার অনেক ওষুধ লাগে, দিদির কিডনী খারাপ,অনেক টাকা লাগবে। টাকা চাই, টাকা নাই। জমি আছে, টাকা মাটি, মাটি টাকা।
মুক্তাঞ্চলের ভাড়াটে দোকানী-হকাররা হাত জোড় করে বলে, কাকা তুমিই আমাদের মা-বাপ, দোকান গেলে আমরা পথে বসবো। ওরা বাপিকে ফুঁসলাচ্ছে কাকা, বাপির দিদিকেও ফুঁসলাচ্ছে।
মুনিকেশদা বলে, আরে আমি আছি তো ! এত ভাবছিস কেন? আমার রাইফেলটা দেখেছিস তো ? আমি নকশাল করা লোক। বন্দুকের নল ক্ষমতার উৎস।
দোকানী-হকাররা টিনের ঘরে উঁকি মেরে রাইফেল খোঁজে।
চুঁচুড়া শহর নাকি পর্তুগীজদের হাতে তৈরি। সেসব তো কতদিন আগেকার কথা। পর্তুগীজরা চলে গেছে সেই কবে ! কিন্তু ছেড়ে গেছে তাদের বেওয়ারিশ ভ্রূণগুলো। পর্তুগীজরা জাহাজে চেপে এসেছিল লুটপাট চালাতে। আর ওদের বেওয়ারিশ ছেলেপুলেগুলো বাহারি গাড়ি করে ঘুরফির করে শহরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। লুটপাট আজো চলে। জমি লুঠ,মাটি লুঠ,নদীর বালি লুঠ,আরো কত লুটপাট।
এরকমই এক বেজম্মার সাথে বাপি রোজ রাতে ঘুরতে বেরোয় যখন মুনিকেশদা ঘাঁটি পাহারা দেয়! এসি গাড়িতে চেপে বাপি হু হু করে এগিয়ে চলে হাইওয়ে দিয়ে। সুন্দর বাধানো কালো পিচ রাস্তার দুদিকে শুধু জমি আর জমি !
বাপির মনে হয় ওর কাকা ওকে ভুল পথে চালিত করছে। যেগুলো ও করতে চায়না সেগুলো ওকে দিয়ে করিয়ে নিচ্ছে। সব জমি কাকা বিলিয়ে দিচ্ছে ভিখিরির বাচ্ছাগুলোকে ! বাপি এসব চায়না। ও বাঁচতে চায়। বাঁচার জন্য অনেক টাকার দরকার। জমি বিক্রি হলে ও সাউথে যাবে চিকিৎসা করাতে। আরো ভাল ভাল দামি ওষুধ খাবে ও । আর সেরে উঠবে। কিন্তু কাকা ওকে সেটা করতে দিচ্ছে না।
বাপি বিরিয়ানি নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। বিড়বিড় করে, টাকা মাটি, মাটি টাকা, টাকা যার জমি তার, জমি কার, বিরিয়ানি যার…
বাপি ছিটকে ঢুকে পড়ে মুনিকেশদার ঘাটিতে। “সই দিবা কি না বলো, এসপার ওসপার।“
মুনিকেশদা বলে,”দেবো না, যা ভাগ, আমাকে ভয় দেখাবি না…”
বাপির মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে। টাকা মাটি মাটি টাকা… সে দু হাতে গায়ের সম্পুর্ণ জোর দিয়ে ধাক্কা মারে মুনিকেশদাকে ! মুনিকেশদা কাটা কলা গাছের মতো লুটিয়ে পড়ে মুক্তাঞ্চলের জমিতে। সব ভাড়াটে দোকানি-হকাররা রৈ রৈ করে ছুটে আসে। দু বার হাত পা ছুড়ে মুনিকেশদা স্থির !
বাপির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কয়েকজন। বাকিরা মুনিকেশদাকে ধরাধরি করে শুইয়ে দেয় ওর বিছানায়।
পুলিশ এসে বাপিকে এরেস্ট করে নিয়ে যায়। আর লোকজন মুনিকেশদাকে নিয়ে সোজা ইমামবড়া হাসপাতালে। পেসমেকার ডিসপ্লেস হয়ে মারা গেল মুনিকেশদা ! হঠাৎ ধাক্কায় পেসমেকার ডিসপ্লেস। অনিচ্ছাকৃত খুনের মামলা দায়ের করল পুলিশ বাপির নামে !
মুনিকেশদা শহীদ হল
মুনিকেশদার শহীদ হওয়া হল না
মুনিকেশদা শ্রেণীশত্রুদের চিহ্নিত করতে পেরেছিল
মুনিকেশদা শ্রেনীশত্রুদের চিহ্নিত করতে পারল না শেষ অবধি…
মুনিকেশদার শ্রেণীশত্রু কারা??
বাপি? নাকি পর্তুগীজদের বেজম্মা বংশকীটের দল ? নাকি কলকাতার পার্টির সদর দপ্তর ?