ফলজ গাছের ফলমূলের কোন দাবীদার নেই। বেশিটা পাখিতে খায়, নষ্ট করে। বাকিটা শ্মশান পালক পেড়ে নেয়। কিছু নিজে রেখে অন্যদের বিলি করে দেয়। অনুরোধে পড়ে কখনও তালসুপুরি হরিতকি বিক্রি করে টাকাগুলো জমা রাখে। গেছো খাটাশ আর বনবিড়াল যত নারকেল খায় তারচে বেশি ফেলেছেড়ে তলা ভরে রাখে। মাঝে মাঝে সাহসি টুকানীরা দল বেঁধে ঢুকে পড়ে। কুড়িয়ে নেয় সেগুলো নইলে আপনাআপনি আবার গাছ হয়ে মাথা তুলে দাঁড়ায়। উন্নাসিক এক নৈঃশব্দ তুমুল উদাসীনতায় ঘিরে থাকে এই শ্মশানভূমি।
নীচে শ্মশান ছুঁয়ে বয়ে গেছে নদী মধুমতি। সেখানে খেজুরগাছ বাঁধানো নতুন ঘাট দেখা যাচ্ছে । প্রতি বছর বর্ষা বাদল বন্যায় এসব ঘাট ভেসে যায় কিম্বা রোদে জ্বলে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে পচে ভেঙ্গে পড়ে। আবার নতুন ঘাট বানানো হয়। তবে অই তাল খেজুরের গাছেরই ঘাট হয়। পাকা ঘাট ? আর কখনও নয়।
ইচ্ছে করলে এ অঞ্চলের হিন্দু ব্যবসায়ীরা নদীর কূল জুড়ে দশ কুড়িটারও বেশী শান বাঁধানো বিশাল পাকা ঘাট বানিয়ে নিতে পারে। তাদের রোজকার যাপিত জীবনে, জন্ম মৃত্যু এবং ধর্মীয় সংস্কৃতির সঙ্গে নদী এবং বহতা জলের সম্পর্ক অনেক গভীর এবং নিবিড়। তাছাড়া মধুমতির জল পবিত্র ও পূণ্যময় বলে খ্যাত। এক সময় বাংলাদেশে মা গঙ্গার প্রবাহিতা প্রধাণ ধারাকন্যা ছিল স্রোতস্বিনী গৌরী এবং এই মধুমতি।
কিন্তু কি হবে এসব ঘাট বানিয়ে ! কাদের জন্যেই বা বানাবে ! এদেশ থেকে হিন্দুরা ক্রমাগত বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ! এখনও যে কয় ঘর টিকে আছে তারাও খুঁটি গেঁড়ে রেখেছে ভারতের এখানে সেখানে। গোরুখোর মোছলমানদের সাথে আর কতদিন একসাথে থাকা যায় !
সত্যি বলতে কী, এদেশে থাকতে দয়ালের মনও মানে না।
আনন্দ ফুর্তিতে পুজো পাঠ করা যায় না। মন খুলে হরিনাম সংকীর্তন করা যায় না। উৎসব আনন্দযজ্ঞে ভজন কীর্তনের আসর বসানো যায় না। বৈষ্ণবদের আখড়া গেছে ভেঙ্গে। পুজো পার্বণে আজকাল মেলা হয় না। হলেও যাত্রাপালা বন্ধ। বাঙ্গালী বলে গর্ব করে অথচ পয়লা বৈশাখ, পয়লা ফাল্গুন ছাড়া অন্য কোন মাসের আদর কদর পালন সংস্কৃতির বালাই নেই মাথা মোটাদের মধ্যে। তাছাড়া আজকাল পুজোর সময় প্রতিমা ভাঙ্গা যেন মোছলমানদের সওয়াবের কাজ হয়ে গেছে। আর আছে জবরদখল। হয়ত কোনদিন দেখা যাবে এই শ্মশানও দখল হয়ে যাবে। যেমন গুজরাটে হিন্দুদের মন্দির হয়ে গেছিল বাবরি মসজিদ ! দয়াল মনে মনে অনেক আনন্দ পায়, বাবরি মসজিদ ফের হিন্দুরা দখল করতে পেরেছে এই ভেবে।
তাছাড়া এদেশে আছেটা কি ! দেশ জুড়ে আছে শুধু ওয়াজ আর ওয়াজ। এই হুজুর তো সেই হুজুর ! বাইট্টা, কাউঠা, বাচ্চা, লুইচ্চা হুজুরে ভরে গেছে । গ্রামের মাঠে দশ বারোটা মাইক বসিয়ে সারা বছর ওয়াজ হয়। সব হুজুরের এক চোপা, নারী তুই অন্দর যা ! আর আছে বিধর্মীদের দুর্ণাম।
রাগের চোটে মুখ বেঁকে যায় দয়ালের। সে কী আর শুধু শুধু হিন্দুরাষ্ট্র চায় !
২
হাতমুখ ধুতে ও নদীতে চলে আসে। এ নদীর আত্মা মরে গেছে। ভাটার সময় স্খলিত বসনের মত জল নেমে গেলে শুধুস্তনবৃন্তের মত জেগে ওঠে অনেকগুলো ডুবোচরের মাথা। ওপারের তীর এপারের অনেক কাছে সরে এসেছে। তাতে ওপারের শন-শটি, হোগলা ঝোপের সাথে কোথাও আকন্দ আর শেয়ালকাঁটার জঙ্গল একেবারে সুস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এরপর শুরু হয়েছে চষা ক্ষেতের বিস্তার। ক্ষেতের আইলে ধৈঞ্চাগাছের সীমানা। যদ্দুর চোখ যায় কেবল বাদাম আলুর ক্ষেত আর উচ্ছে করলা শসা মাচাং।
হঠাত চমকে ওঠে দয়াল। নদীর জল লালরঙে রেঙে যাচ্ছে। আকাশ দেখে তাজ্জব হয়ে যায় ও । কি আশ্চর্য ! আগুন হয়ে ফুটছে আকাশ। গ্যালন গ্যালন পেট্রল ঢালা আগুনরঙের মেঘ ঢেকে ফেলেছে আকাশের পশ্চিম দিক । লেলিহান শিখার মত পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে জ্বলন্ত লাল ঢেউ। মেঘ পুড়ে নীলাভ ভস্মচ্ছটা পাগলপারা হয়েছুটে যাচ্ছে উত্তর দক্ষিণ আকাশে।কখনওবা মোচড় খেয়ে ধমধমিয়ে ফুলে ফেঁপে উঠছে। কয়েক টুকরো হলুদ মেঘ কাঁপতে কাঁপতে ঝাঁপিয়ে পড়ল জ্বলন্ত লাল মেঘের অগ্নি গহ্বরে। সেই সঙ্গে মুহুর্মুহু বদলে যাচ্ছে নদীর রঙ। বিস্ফারিত আবেগে ফুলে ফেঁপে উন্মুখ হয়ে উঠেছে জলরাশির স্তম্ভ। রক্তাক্ত আকাশের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছে এতদিন পরে গতি পাওয়া রুদ্ধ বদ্ধ নিস্তেজ জলস্তম্ভের পাহাড়। সে জলস্তম্ভের গায়ে ভেসে উঠছে আগুন মেঘের অপরূপ রূপকচ্ছটা। সে চ্ছটায় কল্পতরু হয়ে উঠেছে ওপারের বৃক্ষরাজি। চষাক্ষেতের চৌকো অধিকারে ভেসে উঠছে ভয়তাড়িত কাকদের উদ্বিগ্ন উড়ালের অলৌকিক ছায়াপাত।
ওপারে জ্বলছে কী ? চিতা নাকি ! শালার আগুন। এত আগুন আসল কোত্থেকে !
মুখ মুছে বিস্ময় কাটাতে মাথা ঝাঁকিয়ে ঘুরে দাঁড়ায় দয়াল। একটু আগে যে পথ বেয়ে ও ঘাটে এসেছিল সে পথটা যেন কোন যুদ্ধশেষের অপ্রাকৃত নীরব নির্জন প্রান্তরেখা। গাছগুলো স্থির, পাখিরা নির্বাক। রোদ্দুর ঘষে গেছে। লতাপাতা পাখিদল অচঞ্চল নিশ্চুপ।
ওর এক কালের জীবিকা সঙ্গী আশফাক আর রফিক এরকম আকাশ দেখলে মাছ ধরা বন্ধ করে দিত। ওরা বলত, ওদের নবীজির আদরের দুই নাতি হাসান হোসেনের রক্ত ভেসে উঠেছে আকাশে। কারাবালার প্রান্তরে এজিদের সেনাপতি সিমারের হাতে - –
চুদিরভাই। সারা দুনিয়াডা মোছলমানে ভরি গেছে। এহন আকাশডারও দখল নিতি চাতিছে শুয়োরের বাচ্চারা। মনে মনে ধুমায় গালি দিত দয়াল। তারপর ভিজে লুঙ্গি ছেড়ে বিড়ি ধরিয়ে ওদের পাল্টি জবাব দিত সে, জানিস ত কচুর বাড়া। কুরুক্ষেত্তের যুদ্ধি যারা মরি গেছে এগুলান হতিসে তাগের রক্ত। শুনিস নাই ভীম অজ্জুন যুদিষ্টিরগের নাম ! বিশ্বেস না হলি টেলিভিশনে দেখি নিস। ছাক্কা প্রমাণ। তোগের আছে ?
৩
ঘাট থেকে ফিরে পেট চেপে বসে পড়ে দয়াল। ক্ষুধার আগুনে ধিকোচ্ছে ওর আহত শরীর। আজ নিয়ে তিনদিন ও ভাত ছাড়া।
দ্বিজুদাদুর সমাধিতে এসে আশ্রয় নিয়েছে পাঁচ মে। রাত্তিরে। দাদুরবেশ কায়দার সমাধি। ইচ্ছে করলে একজন মানুষ জীবনভর এখানে থাকতে পারে। চাল ডাল সাথে থাকলে বাইরে না বেরুলেও চলে যাবে কয়েক মাস ! শ্মশানে ত আগুনের অভাব নাই ! যদিও এদেশে হিন্দুর সংখ্যা কম তাই মরার রেটও কম। রেগুলার একটা কি দুটো লাশ আসে। কোন দিন হয়ত আসে না। চিতার আগুনে বিড়ি সিগারেট ধরিয়ে খাওয়ার টেষ্ট একদম অন্য রকমের। ধনী লোকদের ঘি চন্দন আর গরিবদের কেরোসিন পোড়া গন্ধে বিড়ি সিগ্রেটের ঘ্রাণ পালটে অন্য ধরণের স্বাদ পাওয়া যায়।
সত্যি ত ভুল হয়ে গেছে । কিছু চাল ডাল আলু---- কিন্তু তখন ত জান বাঁচানো ফরজ ছিল ! রাতারাতি গা ঢাকা না দিলে ছাতু হয়ে যেত দয়াল। সাজানো কড়ি যে এমন উলটে যাবে কে পেরেছিল ভাবতে !
তাছাড়া ও ভাল করেই জানত বাংলাদেশে ওর কখনও ভাতের অভাব হবে না।
যদিও বছর দশেক আগে এক কেস খেয়েছিল। সে কারণে এদেশে এলেও এখনও পালিয়ে থাকে। তবে অই কেস এখন হালকা হয়ে গেছে। যে দিয়েছিল সেই দাপুটে নেতা দুর্নীতির দায়ে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ায় সেই কেসফেসের আর তেমন নড়াচড়া নেই। ধম্মের কল মাঝে মধ্যে ফুড়ুৎফাড়ুৎ ঠিকঠাক লড়েচড়ে !
দশ বছর আগে দুর্গাপুজোর সময় সেই নেতার খাতিরযত্ন তেমন হয়নি বলে সাগরেদদের পাঠিয়ে দিয়েছিল হিন্দুদের শিক্ষা দিতে। তারা মণ্ডপ ভাঙচুর না করতে পেরে মুতে গেছিল ! অশ্লীল গালিগালাজের সাথে মেয়েদের গায়ে হাত দিয়ে মালুর আলু বলে জ্বালাচ্ছিল অই শালারা।
দয়াল আর সহ্য করতে পারেনি। রাগের মাথায় ধুনুচি নাচের হাঁড়ি ভেঙ্গে একজনের পেটের নাড়িভুঁড়ি বের করে দিয়েছিল। মরলে তো মরবই। তয় আগে দ্যাখ শুয়োরের বাচ্চারা কেমন লাগে।
কেস হবে তাতো জানতই। হিন্দুপাড়া ভাঙচুর লুটতরাজ করে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতেও পারে। কিন্তু ঘটনা ত ঘটে গেছে। এবার পালাতে হবে। হাতে ছিল মাত্র একরাত। পুলিশ আসার ঘন্টা খানেক আগে শহর ছেড়ে সীমান্তের পথে বেরিয়ে পড়েছিল দয়াল। বন্ধু পলাশ বাগেরহাট পেরিয়ে খুলনা পর্যন্ত ওকে দিয়ে গেছিল। কিন্তু বুদ্ধি করে চেনা সীমান্ত ছেড়ে অন্য পথ ধরেছিল দয়াল। পরদিন দুপুরে ভারতের মাটিতে পা দিয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিল, ও যতদিন বাঁচবে মোছলমানদের নিকেশ করাই হবে ওর কাজ।
দয়াল পরে জানতে পেরেছে, অই ঘটনার পর ওদের শহর আর আর আশেপাশের গ্রামের প্রায় কুড়িজন হিন্দু ছাত্র ভারতে এসে এখানকার ইশকুলে ভর্তি হয়েছিল। হিন্দু পরিবারের কেউ তাদের উঠতি কিশোর তরুণ ছেলেদের ওখানে রাখতে নিরাপদ বোধ করেনি। কিন্তু দয়াল ত পড়াশুনা ছেড়েছে সেই কবে। বয়েসও ওদের চেয়ে অনেক বড়। মধ্যপাড়ার বাজারে নিজের ধরা মাছ বিক্রি করত বাবা জ্যাঠা কাকাদের সাথে। এদেশে এসেও তাই শুরু করেছিল।
তারপর ইচ্ছে করেই ঢুকে গেছিল রাজনীতির চক্রে।
সারাক্ষণ বাংলাদেশের ক্যাংলা শুনতে কাঁহাতক ভাল লাগে ! দিনরাত ভয়। কে জানে কখন গলাধাক্কা দিয়ে পার করে দেয় বাংলাদেশে ! ওরা শুনেছে, পত্রপত্রিকা, টিভিতেও দেখেছে কি এক ক্যাম্প বানিয়েছে। পুলিশ পাঠিয়ে বাংলাদেশের ক্যাংলাদের সেই খোঁয়াড়ে ভরার জন্যে।
৪
গামছার ব্যান্ডেজ সরিয়ে ডান পাশের পেট দেখে দয়াল। অনেকখানি চিরে গেছে। থেকে থেকে রক্ত বেরুচ্ছে। মাটি চেঁচে পার হতে গিয়ে অকামটা ঘটে গেছে। কে জানত মাটির ভেতর সেঁধিয়ে আছে তারকাঁটা। ওষুধ না দিয়ে এভাবে থাকলে নির্ঘাত ও মরে যাবে। তখন শ্মশানের শিয়াল কুকুর চিল শকুন ছিঁড়ে খাবে ওর শরীর। তাছাড়া শ্মশানের পশ্চিম দিকে নরম মাটির নিচে আছে লাশখেকো কাছিমের দল। অনেক মাংস পাওয়া যায় বলে এরা দল বেঁধে মোছলমানদের গোরস্তানের মাটির নিচে ঘাঁটি গেঁড়ে থাকে। অনেক সময় শ্মশানে আধপোড়া লাশের টুকরো, হাড়গোঁড় পড়ে থাকে। শিশুদের লাশ পুঁতে দেওয়া হয়। শালারা ভোম ভোম করে লাশ খায় আর মানুষিক গলায় চেঁচিয়ে ভয়ার্ত করে তোলে গোরস্তান আর শ্মশানের পরিবেশ।
এভাবে মরার চেয়ে রিস্ক ওকে নিতেই হবে ! বাঁচতে হবে। অনেক কাজ। মরলে ত চলবে না।
বাংলাদেশের সিম মোবাইলে ভরে এসএমএস করে, পলুরে স্তেপানরে নিয়ি তাড়াতাড়ি দ্বিজদাদুর সমাধিতে আয়। খিদেয় মরি যাতিছি রে ভাডি।
এখন কী আসতে পারবে পলাশ ! একে করোনা তায় রমজান মাস। ঘন্টাদুয়েক পরেই ইফতার। শুনেছে পলাশ আজকাল কাঠমোল্লা হুজুরদের সাথে চলে ফিরে। স্বপ্ন দেখে দেশটাকে ইসলামি রাষ্ট্র বানানোর। এই পলাশই প্রথমে দয়াল এরপর ওদের পুরো পাড়াটাকে ভারতের সুন্দরবন অঞ্চলে পালাতে সাহায্য করেছিল। জানতে পেরে সেই নেতা পুলিশ লেলিয়ে দুই দুটো বছর খুব ঝামেলা করেছিল পলাশকে। শর্ট টাইমের জেল বাসও হয়েছিল পলাশের।
বাল্যবন্ধুর জন্যে ওর কি সেই মন এখনও আছে !
দ্বিজদাদুর সমাধি ছুঁয়ে উঠে গেছে একটা ঝাপালো বেলগাছ। সেদিকে তাকিয়ে শীত লাগতে শুরু করে দয়ালের। জ্বর আসবে নাকি ! কিসের জ্বর ? তবে কি !
ইচ্ছে করে গলা খেঁকিয়ে কাশি দেয়। হাতের নাগালের বুনোগাছপালা ছিঁড়ে গন্ধ শোঁকে। আমরুলপাতা চিবিয়ে খায়। নাহ স্বাদগন্ধ সব পাচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গের ইলেকশনে যেভাবে দাপিয়ে বেড়িয়েছে তাতে যে কোন সময় করোনা হয়ে যেতে পারে। ক্ষুধাতৃষ্ণা ব্যথা আর দুশ্চিন্তায় দয়াল কিছুতেই ঝিমিয়ে পড়তে চায় না। ওর চোখে ভাসে হিন্দুরাষ্ট্র ভারত প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। বিরুদ্ধবাদীদের ঘরবাড়িতে জাল ফেলার মত কাঁচা পেট্রল ছিটিয়ে আগুন দেওয়ার ছন্ছনাছন্ শিহরণ।
আগুন আগুন। কারা যেন ওর নাম ধরে গালি দেয়।
তারপরেই নির্দেশ আসে, পালা। পালিয়ে যা। খেলা হবে। হবেই। একবার ক্ষমতা পেলে সব শালা মোছলমানগো কচু কাটা করবে দয়াল। আগুনে পোড়াবে। জেতা জ্যান্ত পুড়িয়ে মারবে গুজরাট ইস্টাইলে। একটাকেও পালাতে দেবে না।
দয়াল পালাচ্ছে। আগুন তাপ ঝাঁঝালো গন্ধ, চীৎকার, কান্না, ধাওয়া পেরিয়ে ছুটছে—আবার সেই ঘৃণার দেশে ! কার যেন কাঁদন ছুটে আসে, আমাগের দ্যাশে রাখে আয় দয়াল – রাখে আয় --- তোর ভগমানের কিরা লাগে – এ দ্যাশ আমার লয় রে দয়া--- কে কাঁদে ? ঠাকমা ? ও দেশে গিয়ে দিনরাত খালি কানত। শালার বুড়ি মরি যায়িও দ্যাশ ফলাতিছে ! দ্যাশ কি আর তোর আছে রে ঠাকমা ! জেতা থাকতি তুই তো বুঝলি না রে বুড়ি তোর দেশ এই ভারত। ওডা গরুখোর মোছলমাগো দেশ। ইয়াক থুঃ --
দয়া, এ দয়াল, শালা জাউলার পো তুই কোহানে ?
শ্মশান মশান হাতের তালুর মত চেনা পলাশের। কতবার মড়া পোড়াতে জুতে গেছে শব মিছিলে। বল হরি, হরি বোল--- তখন কিসের হিন্দু কিসের মুসলমান ! বন্ধুদের জন্যে জান কুরবান। অস্ফুট আওয়াজ শুনে দয়ালকে ও খুঁজে পায়, এ কী রে ! তুই কী মরতি আসিছিস ইখানে !
চুপ কর শালা- ভাত আনিছিস, ভাত ? দে, তাড়াতাড়ি দে। দিয়ে সরে যা— তফাতে গিয়ে বসগে—যা যা--
খাবার শেষ করে হাতমুখ না ধুয়ে শুয়ে পড়ে দয়াল। পড়েই থাকে। পলাশ সিগারেট ছুঁড়ে দেয়, কেস কি ইবার ? খুন ?
নাহ, পেট্রলবোমা। তাও শালা জিততে পারলাম না।
খ্যাচখ্যাচ করে হাসে পলাশ, তয় সিট কিন্তুক আগেরচে বেশি পাইছিস।
জেতাটাই আসল রে !
তা ঠিক। আমাগের দ্যাখ। এখনও একাত্তরের রাজাকার কয়ি ঘেন্না করে বাঙলাদেশ।
এবার দয়াল হাসে খুচখুচ, তোরা ত রাজাকারই। দেশডারে পাকিস্তান বানাতি চাতিছিস। বাঙালি বুঝনদার আছে বুঝলি।
সমাধির চাতালে শুয়ে পড়ে পলাশ, আর তোরা ? তোগের বাঙালিরাও এবার বুঝনদার হয়িছে বুজেছিস।আচ্ছা দয়া তুই কি জানিস জিন্না আর তোর নেতা একদেশের মানুষ। শালারা কেউ বাঙালি না ! বাঙ্গালীগো পুছেও না।
ইডা কিডা কয়িছে তোরে ? এস্তেপান ?
হুম। আমিও জানছি। গুগলে দেখছি। কথাডা মিথ্যে না। ভাবতিছি ওরা যখন বাঙালি না, তয় ক্যান আমরা ওগের কথায় নাচি ? জীবনডা দিয়ে দেই ?
তোর কি হয়িছে রে পলু ? গভীর উৎকণ্ঠার সাথে জানতে চায় দয়াল।
ওর বুদ্ধি খুলতিছে --- ক্রিং ক্রিং করে বেল বাজে।ভয় তরাসে পিপিই পরা স্তেপানকে চিনতে না পেরে উঠে বসতে চায় দয়াল। হাত তুলে ওকে শুয়ে থাকতে বলে হাসে স্তেপান। ততোক্ষণে ধড়াম ধড়াম বুক কেঁপে গেছে দয়ালের। মুখ খারাপ করতে গিয়ে থেমে যায়। ঘাড় ঘুরিয়ে স্তেপানকে একবার দেখে ‘আজান পড়লি ডাকি দিস’ বলে নিশ্চিন্তে শুয়ে থাকে পলাশ।
ওষুধের বাক্সটা মাটিতে রেখে স্তেপান ছড়ানো ইঁট টেনে বসে পড়ে, তোর মুখচোখ ত ভালো ঠেকতিছে না। জ্বর কাশি----
দয়াল বিস্তারিত বলতে মুখ খুলতেই কি ভেবে থামিয়ে দেয় স্তেপান, আমি পলিটিক্সের ডাক্তার না। দেখি গামছা সরা—আর এই নে মাস্ক। হ, দুডেই পর শুয়োর।
৫
পলাশের আনা ইফতার খেতে খেতে দয়ালকে হাসপাতালে নেওয়ার কথা আলোচনা করে ওরা। চৌদ্দ দিনের না হলেও দশদিনের কোয়ারেন্টাইনে থাকা দরকার। দয়াল আপত্তি করে, মরি গেলিও যাবো নানে। কি চাস তোরা, পুলিশ আসুক আর বান্ধে নিয়ে যাক আমারে !
তালি আমার সাথি চল।
না, আমি এহানেই থাকপো। খাবার দাবার ওষুধ রাখি যা। দেখিছিস এডাও কোরেন্টাইনের কেমন ফাসটো কেলাস জায়গা। দুডে বোতলও দিস। ওয়া খালি করোনা হয় না তা জানিস !
কিন্তু জ্বর আসলি কি করবিনি ? কাটা জায়গার রক্ত পচি গন্ধ ছড়াতিছে। ইনফেকশন হয়ে গেলি ---
যা শালা তাইলে তুই কিসের ডাক্তার। কড়া ওষুধ দে- এখনই ভাল হয়ি যাবানি। কাজ আছে বুঝিছিস—মেলা কাজ।
দু বন্ধু কিছুতেই দয়ালের সাথে পারে না। ঠিক হয় আরও একদিন দেখে ওকে নিয়ে আসবে হাসপাতাল। এ শহরের কেউ চিনতে পারলেও শয়তানি করবে না। নিত্যদিন এমন কতজন বাংলাদেশ ভারত করছে। ইন্ডিয়ায় করোনা ভয়ঙ্কর হতে অনেকেই চলে এসেছে বাংলাদেশে। তাছাড়া কত জন ত সারা বছর আসা যাওয়ার ভেতরে থাকে। এ অঞ্চলে এসব ওপেন সিক্রেট ব্যাপার স্যাপার। ওসব বিজিবি বিএসএফ পাহারা ফাহারা, কাঁটাতার ফার সব নস্যি। হাতের মুঠোর মত ছোট্ট বাংলাদেশের তিনদিকে বিশাল রাষ্ট্র ভারত । পাহারায় আর কত কুলায় ! যত পাহারা তত ফাঁকফোকর।
প্রাথমিক যা করার সবকিছু করে, ওষুধ খাবারদাবার পানি গুছিয়ে দিয়ে ওরা বেরিয়ে আসে শ্মশান ছেড়ে। টর্চ জ্বেলে ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে দয়াল। অন্ধকারে আধখানা ঢেকে গেছে পলাশ। দুবার হাত নেড়েছে পেছন ফিরে।বলে গেছে সেহরি খেয়েই মাঝরাতে চলে আসবে। ততক্ষণ বাঁচে থাকিস শুয়োরেরবাচ্চা।
স্তেপানকে মানুষ বলে মনে হচ্ছে না। কারা যেন একবার ওদের ঘরবাড়িতে আগুন দিয়েছিল। ওদের বসার ঘরে সাজানো থাকে নটরাজের মূর্তি। দেওয়ালে সুরা চার কুলের পেতলরং ক্যালিওগ্রাফি আর একজন কোট পরা ভীষণ টাকপড়া ভদ্রলোকের ছবি। স্তেপানের মা বিকেলে পাড়ার পোলাপানদের গান শেখায়।
একবার খুব ধরেছিল স্তেপানের আব্বা, দয়াল তবলাটা শিখে নে। স্তেপান না থাকলে তুই তো পারবি ---
সাইকেলের ঘুরন্ত চাকার সাথে একটি শুকনো পাতা মাটি থেকে উঠে এসে আবার ঝরে পড়ে। এবার অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে ওরা। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। ঘন অন্ধকারে ঢাকা চারদিক। দয়াল এদিক সেদিক টর্চ ফেলে। কঙ্কালের মত দেখা যাচ্ছে গাছের ডালগুলোকে। সমাধির চারপাশে আলো ফেলে। বেলগাছটা যেন অনেকখানি ঝুঁকে এসেছে সমাধির দিকে। পাতাগুলো এত লকলক করছে কেন? বেলকাঁটা কি এত খাড়া আর সূঁচালো হয় ? কিঁচকিঁচ করে ছুটছে ইঁদুর। সমাধি ঘিরে এত গাছ ছিল না ত আগে ! গাছরা কি হাঁটতে পারে ! কেমন শিকড় টানার শব্দ হচ্ছে। নাক জ্বালানো ঝাঁঝালো গন্ধ আসছে। মাটি আর সবুজের তীব্র কাঁচা গন্ধ ।
গত দুই রাত এরকম ত লাগেনি কখনও ! তবে কি মানুষ এসেছিল বলে রাতের শ্মশান জেগে উঠছে ! দয়ালের ঘাম বেরিয়ে আসে ভয়ে । ওর ইচ্ছে করে ওদের পেছনে ছুটে যেতে। ডাক ছেড়ে কাঁদন আসে। ওরা তো এখনও বেশী দূর চলে যায়নি। ওর মনে হয় চেঁচিয়ে ডাক দেয়, এস্তেপান দাঁড়া। পলু রে আমারে নিয়ি যা ও ভাডি --- আমি যে মরে যাচ্ছি।
কিন্তু দয়াল ওদের ডাকে না। বরং দাঁত কামড়ে ভয় কাটাতে সমাধির পাশে শুকনো কাঠপাতার স্তুপে আগুন ধরিয়ে দেয়।
মড়াহীন চিতা জ্বলছে। জ্বলুক।