পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

নববর্ষ : মানুষের রঙে রাঙা হোক বর্ষবরণের উৎসব

  • 14 April, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 413 view(s)
  • লিখেছেন : অঞ্জুশ্রী দে
এপার বাংলার মানুষ যেমন নববর্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মেতে ওঠেন ঠিক তেমনি ওপার বাংলার বাঙালিরাও মেতে ওঠেন বর্ষবরণের উৎসবে। নববর্ষের দিন রমনার বটমূলে ছায়ানটের গানের অনুষ্ঠান হয়। সূর্য উঠার সাথে সাথে নতুন বছরের মঙ্গল কামনায় রমনার বটমূল গানে গানে মুখরিত হয়ে উঠে। সকলে মিলে একই সুরে গেয়ে ওঠে-“এসো, হে বৈশাখ এসো এসো”। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ গ্রামীন সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দিয়ে বিভিন্ন মুখোশ ও মুর্তি বানায়, যা ঢাকার রাস্তায় বর্ষবরণের শোভাযাত্রায় ব্যবহার করা হয়। তার নাম মঙ্গল শোভাযাত্রা। এই শোভাযাত্রায় অংশ নেন সব ধর্মের মানুষ। এখানেই উৎসব হারিয়ে দেয় ধর্মকে।

“আয় না সবাই এক হয়ে যাই/ বৈশাখের এই দিনে/ হৃদয় দিয়ে সকল হৃদয়/ একে একে করিগো জয় / মন দিয়ে মন / নেইগো সবাই কিনে/ বৈশাখের এই দিনে।”

দেখতে দেখতে আবার একটা বাংলা নববর্ষ এসে পড়ল। এই দিন বিশ্বের যেখানে যত বাঙালি আছেন তাঁরা সকাল থেকে নানা অনুষ্ঠানে মেতে ওঠেন। আর সেই অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়েই বাঙালি বাংলা নতুন বছরকে বরণ করে নেন। এ বছরও তার অন্যথা হবে না। তবে আমাদের এখানে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবছরে বর্ষবরণের তাৎপর্য একটু আলাদা। কারণ, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারতে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় উৎসব ‘নির্বাচন’। ইতিমধ্যে নির্বাচনী নির্ঘণ্ট প্রকাশিত হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলি তাদের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেছে।   চলছে নির্বাচনী প্রচার সঙ্গে দেদার প্রতিশ্রুতি। আমি রাজনীতির মারপ্যাঁচ অত বুঝিনা তবুও সাধারন নাগরিক হিসেবে বাকিদের সঙ্গে গণতন্ত্রের উৎসবে মাতবো। ভোট দেবো, মনমত সরকার গড়তে সাহায্য করব। গণতন্ত্রের এই উৎসবের মধ্যেই এবছর বাঙালির বর্ষবরণের উৎসব । আর রাজনৈতিক দলগুলি  এই বর্ষবরণ উৎসবকে নিজেদের প্রচারের কাজে লাগাবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। স্বাভাবিক ভাবেই এবছর ‘নববর্ষ’  নতুন মাত্রা পেয়েছে।

আমাদের শাস্ত্রে দু'টো শব্দ আছে - পুজো এবং উৎসব। পুজো মানুষের একান্ত নিজস্ব। একটা নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে মানুষ তার ধর্ম পালন করেন, আরাধ্য দেবতাকে স্মরণ করেন। পুজো হল তাই-ই। সেজন্যই পুজোর গন্ডি সীমিত। আর সেই সীমিত গন্ডির বাইরেই উৎসবের বিশাল বিচরণ ক্ষেত্র। যেখানে মানুষ মানুষের সঙ্গে মিলে যায়, স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দে একে অপরকে বরণ করে নেয়। সেখানে বাউল এসে গান গাইবে, কবিয়াল এসে কবির লড়াই করবে, কীর্তনীয়া এসে কীর্তন ভাসিয়ে দেবে বাতাসে। গানে, আনন্দে মুখরিত হয়ে উঠবে আকাশ বাতাস। এসব এখনও উঠে যায়নি। নববর্ষ সেই রকমই একটা উৎসব। একে পূজো বললে ভুল হবে। একে বলা চলে বরণ উৎসব।

যতদিন আমাদের দেশে গ্রাম থাকবে, গ্রামীণ মানুষ থাকবে, চাষবাস থাকবে ততদিন আমাদের দেশে উৎসব যা - লোকউৎসব, তাও বেঁচে থাকবে। আমরা শহরের মানুষ,  দেশ বিদেশ থেকে নানা সংস্কৃতি ধরে আনি।  অন্যের সংস্কৃতিকে  অনুকরণ করি। সে অর্থে দেখতে গেলে শহরের মানুষ অনুকরণকারী।  সেই সংস্কৃতিতে অন্যের ছায়া থাকে। শহরে প্রকৃত/অকৃত্রিম সংস্কৃতি খুঁজে পাওয়া কঠিন। সেখানকার মানুষ,  সংস্কৃতি খোঁজে, বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের হাজারো অনুষ্ঠানে। তারাই ঠিক করে দেয় আমাদের সংস্কৃতি। যখন তারা বলে সব 'গেল, গেল, - তখন আমরা  শঙ্কিত হয়ে পড়ি। অথচ কলকাতা থেকে মাত্র কয়েক ঘন্টা দূরে যে মানুষ থাকে, তাঁদের জীবনে সবই তো আগের মত রয়েছে। সেখানকার মানুষ নিজের সংস্কৃতি ধরে রেখেছেন। সেরকমই এক অকৃত্রিম সংস্কৃতির মুখোমুখি হই গতবছর, নববর্ষের দিন।

বীরভূমের মুরারই থানার প্রত্যন্ত গ্রাম - ডালিম্বা। যার একদিকে পশ্চিমবঙ্গের  মুর্শিদাবাদ জেলা অন্যদিকে একটু এগোলেই বিহার। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বাঁশলই নদী। গ্রামে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও তা গ্রামকে পুরোপুরি গ্রাস করেনি। গত বছর নববর্ষের সময়, ওই গ্রামে থাকার সুযোগ হয়। বর্ষবরণের দিন সকালে রানি কাকিমা (যাঁদের বাড়িতে ছিলাম) আমাকে আর আমার মেয়ে আহেলিকে নিয়ে গ্রামের দক্ষিণে রাজবংশী পাড়ায় যান । গন্তব্য মংলাদের বাড়ি। মংলা রানি কাকিমাদের বাড়ির ফাইফরমাশ  খাটে। রাজবংশী পাড়ায় গিয়ে দেখি সব বাড়ির সামনে বড় বড় গরু বাঁধা। কেউ কেউ আবার পুকুরে গরুকে স্নান করাচ্ছেন। মংলার সঙ্গে আমরা ওদের বাড়ির ভিতরে গেলাম।  ঢুকে দেখলাম, সদ্য স্নান করানো ১ টা গাই গরু উঠোনে বাঁধা আছে। ওদের মেঠো ঘরের দাওয়ায় তখন একটা কলাপাতার উপর কয়েক গাছা দূর্বাঘাস, একটা বাটিতে সরিষার তেলে বাটা হলুদ গোলা, একটা পাত্রে অল্প সিঁদুর, একটা পাত্রে একটু চন্দন, কয়েকটা পাকা কাঁঠালি কলা, একটি তালপাতার পাখা ও একঘটি জল। মংলার  ছোটো বোন পার্বতী ততক্ষনে স্নান সেরে পরিপাটি করে সেজে  তৈরি। ছোটো পার্বতী ওর মায়ের সাহায্য নিয়ে প্রথমে  গরুর শিঙে  তেল মাখালো  তারপর কপালে হলুদ- সিঁদুর-চন্দনের টিপ দিল। এরপর দেখলাম, ঘুরে ঘুরে গরুর পা ধুইয়ে দিচ্ছে। পা ধোয়ানো শেষ করে, "গোকুল গোকুলে বাস/ গরুর মুখে দিয়ে ঘাস/ আমার যেন হয় স্বর্গে বাস" - বলতে বলতে দূর্বাঘাসের সঙ্গে পাকা কলাটা গরুকে খাইয়ে দিল।  এরপর  হাতপাখা দিয়ে গরুটিকে বাতাস করতে লাগলো আর সুর করে বলতে লাগলো  - "তোমারে পুজিয়া গাভী বাতাস করি পাখা/ আমার হাতে থাকে যেন সুবর্ণের শাঁখা ।" সবশেষে, গরুটির চার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল।  ওদের কাছে জেনেছিলাম সংসারের সমৃদ্ধি ও মঙ্গল কামনায় প্রতিবছর পয়লা বৈশাখ  সকালে ওরা এই আচার পালন করে।  রাজ্যের অনেক গ্রামেই এ দৃশ্য দেখা যায়। তবে, আমাদের কাছে এটা নতুন অভিজ্ঞতা। এই সংস্কৃতি অকৃত্রিম। গ্রামের নিজস্ব সংস্কৃতি যা দিয়ে আলাদা করা যায় শহরের মানুষ গ্রামের মানুষকে। পৃথিবীর সব দেশেই শহর এবং গ্রাম আছে। তবে, গ্রামের মানুষ প্রকৃতির মানুষ, মাটির মানুষ। তাদের উৎসব লোক-উৎসব। প্রকৃতির মানুষ সেই উৎসবে অংশগ্রহণ করেন।

এতো গেল উৎসব, সংস্কৃতি ! ফিরে আসি নববর্ষে। আমরা সবাই জানি, পয়লা বৈশাখে, নববর্ষের উৎসব পালিত হয়। বাংলা নববর্ষ পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের পাশাপাশি সারা বিশ্বের বাঙালিদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। পয়লা বৈশাখের একটা ইতিহাস আছে। বলা হয়, মুঘল আমলে সম্রাট আকবর  ফসল কাটার মরশুমে চাষিদের জন্য নতুন এক খাজনা চালু করেছিলেন। প্রজাদের চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সব খাজনা পরিশোধ করতে হত। খাজনা শোধ করার আনন্দে পরদিন  পয়লা বৈশাখে জমির মালিকরা নিজের প্রতিবেশীদের মিষ্টি বেলাতেন। তাকে ঘিরে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন হত। এই উৎসবটিই বর্তমানে এত বড় সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। পয়লা বৈশাখের সঙ্গেই শুরু হয় হালখাতা। বাংলা বছরের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনগদ করার প্রক্রিয়াই হালখাতা। গ্রাম, শহর, বাণিজ্যিক এলাকা সর্বত্রই পুরনো বছরের হিসাবের খাতা বন্ধ করে নতুন হিসাবের খাতা খোলা হয়। বাংলা নববর্ষের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে হালখাতা উদযাপন। হালখাতা বাঙালি ঐতিহ্য ও ইতিহাসের একটি অংশ।

এপার বাংলার মানুষ যেমন নববর্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মেতে ওঠেন ঠিক তেমনি ওপার বাংলার বাঙালিরাও মেতে ওঠেন বর্ষবরণের উৎসবে। নববর্ষের দিন রমনার বটমূলে ছায়ানটের গানের অনুষ্ঠান হয়। সূর্য উঠার সাথে সাথে নতুন বছরের মঙ্গল কামনায় রমনার বটমূল গানে গানে মুখরিত হয়ে উঠে। সকলে মিলে একই সুরে গেয়ে ওঠে-“এসো, হে বৈশাখ এসো এসো”। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ গ্রামীন সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দিয়ে বিভিন্ন মুখোশ ও মুর্তি বানায়, যা ঢাকার রাস্তায় বর্ষবরণের শোভাযাত্রায় ব্যবহার করা হয়। তার নাম মঙ্গল শোভাযাত্রা। এই শোভাযাত্রায় অংশ নেন সব ধর্মের মানুষ। এখানেই উৎসব হারিয়ে দেয় ধর্মকে।

ধর্ম যার যার নিজের কিন্তু উৎসব - আমাদের সবার। স্বাধীনতার এত বছর পরেও আমাদের দেশে সামাজিক, অর্থনৈতিক  বৈষম্য প্রকট। ধর্মীয় বিভাজন ও জাতপাত, মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করছে। প্রতিদিন চোখে পড়ছে মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে নির্বাচনের বছরে বাঙালিদের কাছে নববর্ষের তাৎপর্য অনেক বেশি। কারন, সাধারন নির্বাচন মানেই  দেশের নতুন সরকার গঠন।  তাকে ঘিরে নতুন করে স্বপ্ন দেখা। আশা জাগে গরিবের পেটে ভাত, বেকারের হাতে কাজ যেমন জুটবে তেমনি দেশবাসীর প্রত্যেকের মাথা গোঁজার ব্যবস্থা হবে। সর্বোপরি দেশের ধর্ম নিরপেক্ষ কাঠামো বজায় রেখে যে যার সংস্কৃতি নিয়ে একসঙ্গে বাস করবেন। কিন্তূ বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন জটিল মনে হয়। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা, যারা আমাদের স্বপ্ন দেখান। সেই স্বপ্নের ফেরিওয়ালারা, ধর্মের বেসাতি করছেন। মানুষের প্রাথমিক চাহিদা থেকে চোখ ঘোরাতে ধর্মকে রাজনীতির বোড়ে হিসেবে ব্যবহার করছেন। এখানেই নববর্ষের প্রাসঙ্গিকতা - যা পরস্পরকে কে বরণ করতে, মেনে নিতে শেখায়। সে তিনি যে ধর্মের, যে বর্ণের, যে দলেরই হোক না কেন। বর্ষবরণ উৎসবের নিজস্ব কোনোও রং নেই। মানুষের রঙই তার রঙ। তাই নববর্ষের দিনটিকে সত্যিকারের উৎসবের দিনে পরিণত করতে উদ্যোগী হতে হবে উৎসব মুখর বাঙালির সঙ্গে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদেরও। পথ  দেখাতে হবে হাতে হাত রেখে সকলে একসঙ্গে মিশে যাবার। প্রত্যেকের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে হবে ভ্রাতৃত্বের বোধ। তবেই সার্থকতা পাবে  নববর্ষের উৎসব।

0 Comments

Post Comment