নিষ্ঠুরতার কারণ দেখিয়ে যেভাবে নাগাল্যান্ডে কুকুরের মাংস বিক্রি (কাঁচা বা রান্না করা) এবং খাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে, একই যুক্তিতে আগামী দিনে ভারতে যে কোনও রকমের মাংস বা মাছ খাওয়া নিষিদ্ধ হতে পারে। বস্তুত কিছু নিরামিষাশী এবং তথাকথিত পশুপ্রেমী সংগঠনের আবদারে বিজেপি-র সমর্থনপুষ্ট নাগাল্যান্ড সরকার সে রাজ্যের মানুষের একটি প্রচীন প্রথার অবলুপ্তি ঘটালো। কুকুর নাগাল্যান্ডের কয়েকটি ট্রাইবের কাছে কেবল আহারযোগ্য মাংস নয়— তাদের চিরায়ত সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের সঙ্গে ওতপ্রোত হয়ে রয়েছে। নাগাদের ঘরে ঘরে সবাই কিন্তু কুকুরের মাংস খায় না, তবে যারা খায় তাদের কাছে সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং তা খাদ্যেরও অধিক। যেমন বাঙালির কাছে মাছ কিংবা ভারতের বহু জনগোষ্ঠীর কাছে শুয়োর। লাগাল্যান্ডে কুকুরের মাংস নিষিদ্ধ করার ঘোষণা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উপজাতি মানুষের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে— তার মধ্যে হিংসা, ঘৃণা এবং জাতপাত সবই রয়েছে।
খাদ্যের পছন্দ-অপছন্দ আজ আমাদের প্রতিদিনই জাতপাত, উগ্রহিন্দুত্ব কিংবা উগ্র জাতীয়তাবাদের দিকে ঠেলে নিয়ে চলেছে। যেমন গরুকে যারা রক্ষা করতে চায় তারা তা কার্যকর করার জন্য তারা চরম হিন্দু জাতীয়রাবাদকে অস্ত্র করেছে। কুকুরকেও সেই তালিকায় তুলে আনা হল। অনেক দিন থেকেই কুকুরের মাংস খাওয়ার বিষয়টাকে সভ্যতা, বিশুদ্ধতা এবং দেশপ্রেমের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। এখন কুকুরের মাংসের ওপর নিষেধাজ্ঞা একটা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হবে। কিন্তু কুকুরের মাংসকে যাঁরা তাঁদের খাদ্য সংস্কৃতির অংশ বলে মনে করেন তাঁরা নিশ্চয়ই লড়াইটা লড়বেন। স্বাধীনতার পর থেকেই লাগাল্যান্ড শসস্ত্র সংঘাত, মানবাধিকার লঙ্ঘন, আতঙ্ক এবং গভীর নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিয়ে চলেছে। কুকুরের মাংসে নিষেধাজ্ঞা এমন একটা সময় জারি করা হল যখন প্রায় একই সঙ্গে আর্মড ফোর্সেস পাওয়ার্স অ্যাক্ট (আফসপা)-র মতো মানবাধিকার বিরোধী কালা-আইনের কার্যতারিতা সে রাজ্যে বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে দিয়ে যে বার্তাটি নাগাদের কাছে পৌঁছলো তা হচ্ছে— ‘ভারত কুকুরদের রক্ষা করতে পারে কিন্তু নাগাদের রক্ষা কতরতে পারে না।’
তথাকথিত পশু অধিকার কর্মীদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফলে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানিয়েছে নাগাল্যান্ড সরকার। পশু অধিকার কর্মীদের বক্তব্য, কুকুরের ওপর নিষ্ঠুরতা বন্ধে এই সিদ্ধান্ত এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তবে সুশীল সমাজের কয়েকটি গোষ্ঠী এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে বলছেন, এই নিষেধাজ্ঞা রাজ্যের মানুষের খাদ্যরীতির ওপর হামলা। তবে এই নিষেধাজ্ঞা কিভাবে কার্যকর করা হবে, তার বিস্তারিত জানায়নি সরকার। কারও মতে প্রক্যশ্য নিষ্ঠুরতাই যদি কারণ হয় তাহলে তো কুকুরের মাংস নিষেধ না করে কুকুর নিধনের আধুনিক পদ্ধতি গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া যেত। তা করা হয়নি।
গণমাধ্যম বলছে, বস্তায় ভরে কয়েকটি কুকুর বিক্রি করার উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, এমন একটি ছবি সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে এই নিষেধাজ্ঞা এলো। ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান অ্যানিম্যাল প্রোটেকশন অর্গানাইজেশন (এফআইএপিও) জানিয়েছে, ‘কুকুরগুলোকে যেভাবে শোচনীয় অবস্থায়, বস্তার ভেতরে বাধা অবস্থায় কাঁচা বাজারে বিক্রির জন্য রাখা হয়েছে, যেখানে মাংস খাওয়ার উদ্দেশ্যে সেগুলোকে অবৈধভাবে কাটা হচ্ছে, ব্যবসা করা হচ্ছে, তা দেখে তারা অত্যন্ত দুঃখ পেয়েছে।’
কিছু দিন ধরেই সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ছবি ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল। ছবিতে দেখা যাচ্ছিল যে বস্তায় করে কুকুর নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে কুকুরগুলি নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে দাবি করেন একজন ট্যুইটার ব্যবহারকারী। এই খবর প্রকাশ্যে আসতে হস্তক্ষেপ করেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মানেকা গান্ধী। কুকুরের আমদানি-রফতানি বন্ধ করার জন্য নাগাল্যান্ড পুলিশের কাছে আবেদন করেন মানেকা। এই নিয়ে হইচই শুরু হতেই মাংসের ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারি হয় নাগাল্যান্ডে।
কিন্তু এই পশুপ্রামীরা কেন কেবল কুকুরের ওপর নির্যাতনই দেখতে পেল? তারা দেখেনি কীভাবে ছাল ছাড়ানো আস্ত ছাগল রাস্তার ধারে প্রকাশ্যে টাঙানো থাকে মাংস বিক্রির জন্য? কী আদিম পদ্ধতিতে প্রকাশ্যে ভরা বাজারের মধ্যে মুরগি কেটে বিক্রি করা হয়— তাঁরা দেখত পাননি?
নাকি ব্রিটিশ আমল থেকে নাগাদের ‘সভ্য’ করার যে যোজনা শুরু হয়েছিল কুকুরের মাংস খাওয়া বন্ধ করারটা সেই প্রকল্পেরই অংশ? উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষদের ‘ভারতীয়’ করে তোলার এই প্রকল্প আর কত দিন জারি থাকবে?
কুকুরের মাংস বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার জন্য নাগাল্যান্ড সরকারের প্রতি আহ্বান জানায় এফআইএপিও। নাগাল্যান্ডে কুকুরের মাংস বিক্রির বিরুদ্ধে অনেক দিন ধরেই আন্দোলন চালিয়ে আসছে বেশ কয়েকটি পশু রক্ষা সংগঠন। হিউম্যান সোসাইটি ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি সংস্থার ধারণা, নাগাল্যান্ডে বছরে অন্তত ৩০ হাজার কুকুর খাওয়া হয়। কাঁচাবাজারে জীবন্ত বিক্রির পর কাঠের লাঠি দিয়ে পিটিয়ে সেগুলোকে হত্যা করা হয়।
ব্যাপকভাবে না হলেও চীন, দক্ষিণ কোরিয়া এবং থাইল্যান্ডেও কুকুর খাওয়া হয়ে থাকে। মাংসের যোগানে টান পড়ায় সে দেশের সমস্ত পোষা কুকুর জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছেন উত্তর কোরিয়ার সর্বময় কর্তা কিম জং-উন। শুধুমাত্র মাংস খাওয়ার জন্য এশিয়া জুড়ে প্রতি বছর ৩ কোটি কুকুর ও ১০ কোটি বিড়াল হত্যা করা হয়। চিন, দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম এবং উত্তর পূর্ব ভারতের বেশিরভাগ অংশে কুকুর ও বিড়ালের মাংসের ব্যাপক চল রয়েছে। তবে, হংকং, ফিলিপিন্স, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুর কুকুরের মাংসের ব্যবসা ও ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে।