দু জন মানুষ হুমকি পেলেন।কারণ তাঁরা মেয়েদের নিকাব বা মুখমণ্ডল আবৃত করার বিরোধিতা করেছিলেন।দু জন মানুষই স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।প্রথম জন হলেন পিএ ফজল গফুর।কেরলে থাকেন।নামকরা শিক্ষাবিদ।পিএ ফজল গফুরের পিতা পিকে ফজল গফুর ছিলেন প্রখ্যাত চিকিৎসক ও শিক্ষাবিদ।কেরলের ম্যাপিলা মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ।অনুন্নত ওই সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেন মুসলিম এডুকেশনাল সোসাইটি।এই সংস্থার অধীনে আছে বহু বিদ্যালয় ও কলেজ।সংস্থাটি শুধু কেরলে নয়, তামিলনাড়ুর শিক্ষায়ও বিপ্লব এনেছে।পূর্ব ভারতের আল আমিন মিশনের মতো দক্ষিণ ভারতে মুসলিম এডুকেশনাল সোসাইটি বা এম ই এস-এর খ্যাতি।পিতা পিকে ফজল গফুরের প্রয়াণের পর সংস্থার হাল ধরেন পুত্র পিএ ফজল গফুর।সোসাইটির অধীনে রয়েছে ১৫২-টি প্রতিষ্ঠান, যার বেশির ভাগ কেরলে অবস্থিত আর কয়েকটি তামিলনাড়ুতে।সাধারণ বিদ্যালয় ছাড়াও রয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ম্যানেজমেন্ট স্কুল এবং স্পেশাল স্কুল।গত ১৭ এপ্রিল একটি সার্কুলার জারি করে ঘোষণা করা হয়, সংস্থার অধীনস্থ সব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষিকা ও ছাত্রীদের মুখ ঢাকার প্রথা বা নিকাব পরা নিষিদ্ধ করা হল।ছাত্রী ও শিক্ষিকাদের জন্য নতুন ড্রেস কোড চালু হল শালোয়ার-কামিজ ও ওড়না।এক্ষেত্রে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নতুন পোশাক-বিধি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের জিনস, লেগিংস, মিনি স্কার্ট, বোরখা প্রভৃতি পোশাকও নিষিদ্ধ হয়ে গেল।২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে এই নতুন নিয়ম বলবৎ হবে, যার শুরুর দিন আগামী ১ জুন।
এম ই এস-এর সভাপতি পিএ ফজল গফুরের এমন নির্দেশিকায় সমালোচনার ঝড় উঠেছে।‘সমস্ত কেরল জমিয়তউল উলেমা’ নামের এক সুন্নি ধর্মীয় গোষ্ঠী এই নির্দেশিকার তীব্র সমালোচনা করে।ফোনে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিরা তাঁকে প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছেন।নিষেধাজ্ঞা তুলে না নিলে পরিণতি ভয়ঙ্কর হবে বলে শাসিয়েছে হুমকিদাতারা।ফজল গফুর পুলিশে জানিয়েছেন সব কিছু।পাশাপাশি তাঁর বক্তব্য হল, মধ্যপ্রাচ্যের আমদানি করা ইসলামি সংস্কৃতি নয়, তাঁরা কেরলের ইসলামকে অনুসরণ করতে চান, যা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে।তাছাড়া ধর্মীয় পুস্তকে বা সুন্নতের অনুশাসনে মুখ ঢাকার এমন বিধান নেই বলে তিনি জানিয়েছেন।শালীন পোশাক পুরুষ-স্ত্রী নির্বিশেষে সকলে পরবেন, এমন কথাই ধর্মীয় অনুশাসনে লেখা আছে।নিকাব হল বিদেশি সংস্কৃতি, ইসলাম ধর্মের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই।কেরলের ইসলাম ধর্ম বয়সের বিচারে আরবের তুলনায় নবীন নয়।আর এমন সব কথাতে বেজায় চটেছে এক দল ধর্মান্ধ ব্যক্তি।
ইসলাম ধর্মে মুখ-পর্দা বা নিকাব নিয়ে কী নির্দেশ আছে বা আদৌ কোনও নির্দেশ আছে কিনা তা নিয়ে ব্যাখ্যাকারদের মধ্যে মতভেদ আছে।তবে মুসলিম এডুকেশনাল সোসাইটির এই নির্দেশিকার পিছনে আছে আইনি ভিত্তি।মহম্মদ সুনির নামের এক ব্যক্তির দুই কন্যা পড়তো কেরলের থিরুভল্লমের ক্রাইস্ট নগর সিনিয়র স্কুলে।বিদ্যালয়ে ‘ধর্মীয় পোশাক’ পরে যাওয়া যাবে না কেন, এই প্রশ্নে মহম্মদ সুনির আদালতে মামলা করেন।তাঁর মেয়েরা স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়।২০১৮ সালের ডিসেম্বরে কেরল হাইকোর্টে সিঙ্গল বেঞ্চের রায় বের হয়, যেখানে বিচারপতি এ মহম্মদ মুস্তাক জানিয়ে দেন—পোশাক বিধি নিয়ে একজন ব্যক্তির অধিকার প্রতিষ্ঠানের বৃহত্তর স্বার্থের উপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না।
স্বাভাবিকভাবে ইসলাম-ধর্মালম্বীদের প্রশ্ন উঠেছে, নিকাবকে নিষিদ্ধ করে কি সত্যি সত্যিই ধর্মকে উপেক্ষা করা হল? ইসলামের মধ্যে যে সমস্ত গোষ্ঠী বা মজহাব আছে, তাঁদের সিংহভাগ মুখ-পর্দাকে আবশ্যিক মনে করেন না।কোনও এক সময় সৌদি আরবের ‘নজদ্’ নামের এক জনপদের নারীরা মুখমণ্ডল আবৃত করে রাখতেন, সেখান থেকেই এই সংস্কৃতি এসেছে বলে অনেকে মনে করেন।প্রাক-ইসলামি যুগে ক্রীতদাসী ও গণিকা ছাড়া মুক্ত আরব নারীদের অনেকে নিকাব ব্যবহার করতেন প্রচণ্ড গরম থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য।ইসলামি যুগেও সেই প্রথা বহমান।প্রাক-ইসলামি যুগে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের বহু খ্রিস্টান নারী নিকাব পরতেন।ইহুদি ধর্মের হারেদি গোষ্ঠী বা সেফার্দি গোষ্ঠীর মহিলারাও ‘ফ্রুমকা’ নামের নিকাব ব্যবহার করতেন।মরুভূমিতে নারীদের মুখ ঢাকার প্রথা সুপ্রাচীন।অবশ্য প্রাচীন বলেই যে তা ভাল, এমন কথা বলা যাচ্ছে না যেখানে বিষয়টি দেশের ও দশের নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত।হাল আমলে একদল সন্ত্রাসী মুখ-পর্দার এই ধর্মীয় সুযোগ নিয়ে নাশকতামূলক কাজ করছেন বলে বিভিন্ন দেশে নিকাব ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে ও হচ্ছে।
পর্দা নিয়ে কোরানের বিভিন্ন আয়াতের মধ্যে প্রথমটি হল পুরুষদের উদ্দেশ্যে।সুরা নুরের ৩০ আয়াতে পুরুষের চোখের পর্দার কথা বলা হয়েছে।সেখানে পুরুষকে দৃষ্টি নত রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।ওই সুরার ৩১ আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ মুখমণ্ডলকে ঢেকে রাখার পরিবর্তে নারীদের নির্দেশ দিচ্ছেন যে তারা যেন ওড়না (খুমুর/খিমার) দিয়ে তাদের বুক (জাইব) ঢেকে রাখে।
ফলে ধর্মীয় এবং আইনি দিক থেকে ফজল গফুর ঠিক কাজ করেছেন।অভিনন্দন তাঁর প্রাপ্য।কিন্তু একটি প্রশ্ন থেকে যায়।তাঁর সংস্থার অধীনে ৮৫০০০ ছাত্রছাত্রী পড়াশুনা করেন।ছাত্রী ও শিক্ষিকাদের জন্য পোশাক-বিধি চালু করা হলেও ছাত্র ও শিক্ষদের জন্য ড্রেস কোড চালু হল না কেন? পুরুষ, মানে ছাত্র বা শিক্ষক যদি নিকাব বা ঘুঁঘট পরে আসে, কীভাবে আটকাবেন তাঁরা?
নিকাব বা ঘুঁঘট-এর বিরোধিতা করে আর একজন মানুষও হুমকি পেয়েছেন।তবে খুনের নয়।তাঁর চোখ তুলে নেওয়া হবে ও জিভ ছিঁড়ে নেওয়া হবে।কারণ তিনিও মেয়েদের নিকাব বা মুখমণ্ডল আবৃত করার বিরোধী।
জাভেদ আখতার।কবি, গীতিকার ও চিত্রনাট্যকার।শ্রীলঙ্কার গির্জায় ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর সে দেশে নিকাব-বোরখা নিষিদ্ধ হয়েছে।ভারতে এমন পোশাক নিষিদ্ধ করা দাবি তোলেন প্রজ্ঞা ঠাকুরের মতো সংঘ পরিবারের অনেকে।শিবসেনার মুখপত্র সামনা-য় এর পক্ষে সওয়াল করা হয়।জাভেদ আখতার বলেন, চিনতে পারা যায় না এমন পোশাক সার্বিক নিরাপত্তার খাতিরে নিষিদ্ধ করাই উচিত।তাই নিকাব-বোরখার পাশাপাশি ঘুঁঘটকেও স্থান দেওয়ার কথা বলেন।আর এতে বেজায় চটেছে রাজস্থানের শ্রীরাজপুত করণী সেনা।যোধা-আকবর, পদ্মাবতী চলচ্চিত্র নিষিদ্ধ করার লক্ষ্যে এরা একদা পথে নেমেছিল।করণী সেনার সভাপতি জীবন সিংহ সোলাঙ্কি বলেছেন, ঘোমটা নিষিদ্ধ করার কথা বলার জন্য জাভেদ আখতারকে ক্ষমা চাইতে হবে, নইলে তাঁর জিভ কেটে নেবে সেনা এবং চোখও উপড়ে নেবে।জাভেদের যুক্তি হল, তিনি মুখ ঢেকে রাখার বিপক্ষে, তা যে কোনও প্রকারেরই হোক।কারণ নিকাব ও ঘুঁঘট নিরাপত্তাজনিত প্রশ্ন তুলছে।নিকাব উঠে গেলে সন্ত্রাসবাদীরা রাজস্থানি ঘুঁঘটের সাহায্য নেবে বলা বাহুল্য।বহু অমুসলিম মানুষ বেআইনি কাজ করার জন্য নিকাবের আশ্রয় নিয়েছেন, এ কথা সংবাদ মাধ্যম থেকেই জানা যায়।
নারীরা কেমন পোশাক পরবেন, সেটা নিয়ে পুরুষের মাথা না ঘামালেও চলবে।নিকাব-ঘুঁঘট ইচ্ছে হলে নারীরা পরবেন অথবা পরবেন না— এমন কথা বলারও দিন ফুরিয়েছে।যে পিতৃতন্ত্র তাঁদের মুখের উপর পর্দার ফাঁস ঝুলিয়ে রেখেছে এত দিন, দ্রুত তার অবসান হোক।যে কোনও ভাবে, যে কোনও পন্থায়।
0 Comments
Post Comment