গত ২২-শে জুন পাটনাতে বিরোধী দলগুলির সভা থেকে ২০২৪-এর নির্বাচনে বিজেপির বিরুদ্ধে একযোগে লড়ার বার্তা দেওয়া হল। নিজেদের মধ্যে সতত সংগ্রামরত বিরোধী দলগুলির এক ছাতায় আসার উদ্যোগ নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। আমাদের দেশে এই মুহুর্তে রাজনৈতিক অবস্থা যা, তাতে করে ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইটাই যে প্রধান লড়াই তাতে সন্দেহ থাকা উচিত নয়। বিশেষ করে, ২০২৪ সালটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ২০২৫-এ আরএসএস প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ হতে যাচ্ছে। ২০২৪-এ যদি বিজেপি ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারে তাহলে ২০২৫-এ যে তারা ভারতকে পুরোপুরি ফ্যাসিকরণের রাস্তায় হাঁটবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সেক্ষেত্রে গায়ের জোরে সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটানো, সরাসরি অথবা সংবিধান থেকে "ধর্মনিরপেক্ষ" শব্দটি তুলে দিয়ে দেশকে কার্যত হিন্দুরাষ্ট্র বানানোর মত যে কোনো ঘটনা ঘটতে পারে। সংসদীয় রাজনীতির ওপর আরও বড় আঘাত নামিয়ে আনা, সংখ্যালঘুদের গণতান্ত্রিক অধিকার মায় নাগরিকত্ব পর্যন্ত হরণ করার যাবতীয় প্রচেষ্টাই তারা নেবে। রাজনৈতিক স্বাধীনতা যেটুকু ছিল সেটুকুকে তো তারা যথেষ্ট খর্ব করেইছে, তা আরও সংকুচিত হয়ে পড়বে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৃহৎ পুঁজির পক্ষে এবং মেহনতী মানুষের বিপক্ষে আরও বড় এবং মৌলিক পদক্ষেপ করাও খুবই স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। মূলধারার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি অবশ্য এত কিছু নিয়ে ভাবিত নয়। তারা শুধুমাত্র দেখছে তাদের রাজনৌতিক স্বাধীনতা তলানিতে গিয়ে ঠেকবে বা পুরোপুরি হরণ করার চেষ্টা হবে। ইতিমধ্যেই দেশের সমস্ত বিরোধী দলগুলির পেছনে সিবিআই, ইডি লাগিয়ে এবং লাগাতার গ্রেপ্তার করে তারা এই দলগুলির নাভিশ্বাস তুলে দিয়েছে। এমনিতেই ক্ষীণদৃষ্টি-সম্পন্ন এই দলগুলি যে এইটুকুও দেখতে পেরেছে এটাই একটা বড় ব্যাপার। এখন দেখার ব্যাপার এই যে, বিভিন্ন তাৎক্ষণিক এবং আঞ্চলিক স্বার্থকে অতিক্রম করে এই দলগুলি কতখানি নিজেদের ঐক্যকে ধরে রাখতে পারে এবং বিজেপির বিরুদ্ধে একযোগে লড়াই করার তাদের নীতিগত সিদ্ধান্তকে ময়দানী বাস্তবতায় প্রয়োগ করতে পারে! বিরোধী দলগুলির এই উদ্যোগকে বিভিন্নজন বিভিন্ন দৃষ্টিতে দেখছেন। আমরা যারা বামপন্থী বা কমিউনিষ্ট রাজনীতির চর্চা করি, তাদের কীভাবে বিষয়টি দেখা উচিত এবং কীভাবেই বা এই পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ করা উচিত? এই প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় এটাই।
ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামের সমস্যাবলী
ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রাম একটি জটিল সংগ্রাম। সমগ্র বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণির সংগ্রাম বা সামন্ত ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে কৃষকদের সংগ্রামের তুলনায় এই সংগ্রাম অনেক বেশি জটিল, বহুমাত্রিক এবং সূক্ষ্ম। ফলে এই সংগ্রামের সমস্যাগুলিকে আমাদের গভীর মনোযোগের সঙ্গে অনুধাবন করা দরকার। কিন্তু প্রথমে একটি কথা বলে নেওয়া ভালো। এই যে বললাম, এই সংগ্রামকে গভীরভাবে অনুধাবন করা দরকার, এই কাজটি তাঁরাই করবেন যাঁরা এটা মনে করছেন যে, বর্তমান ভারতবর্ষে একটি ফ্যাসিবাদী দল ক্ষমতায় এসেছে এবং বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে এই দল, বিজেপি, ২০১৯ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর তার রূপ দেখাতে শুরু করেছে এবং ফলত, ভারতের শ্রেণিসংগ্রাম গুণগতভাবে একটি ভিন্নস্তরে উন্নীত হয়েছে। আমরা জানি, অনেক কমিউনিষ্ট সংগঠন বা ব্যক্তি এভাবে বিষয়টিকে দেখেন না। তাঁরা মনে করেন না যে, ফ্যাসিবাদী শক্তি ক্ষমতায় আছে এবং ফলত শ্রেণি সংগ্রাম একটি ভিন্নস্তরে উঠে গেছে। অনেকে আবার এটাও মনে করেন যে সকল শাসকই ফ্যাসিবাদী। সুতরাং, গুণগতভাবে নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি হবার কিছু নেই। এই সকল মতানুসারীরা আগের হিসাবনিকাশ হাতে রেখেই এগোনোর পক্ষপাতী। এঁদের কথা আলাদা। কিন্তু যাঁরা মনে করছেন যে, বর্তমানে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামটিই ভারতের মুখ্য রাজনৈতিক সংগ্রাম তাঁদের অবশ্যই এই সংগ্রামের সমস্যাবলীকে বুঝতে হবে। আমি দুটি প্রধান সমস্যার কথা উল্লেখ করব। এক, শত্রুর মধ্যেকার দ্বন্দ্বকে কাজে লাগানোর প্রশ্ন এবং দুই, ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করার আসল অর্থ।
ফ্যাসিবাদ যেহেতু লগ্নিপুঁজির সর্বাপেক্ষা প্রতিক্রিয়াশীল অংশের শাসন তাই লগ্নিপুঁজির অন্য অংশটি ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামের দোদুল্যমান মিত্র, এটা একটি স্বতঃসিদ্ধ সিদ্ধান্ত। ফ্যাসিবাদ সংক্রান্ত দিমিত্রভীয় সংজ্ঞা স্বীকার করলে এর থেকে অন্যরকম কোনো সিদ্ধান্তে আসা চলে না। ট্রটস্কিবাদীরা (বর্তমান ভারতবর্ষে) ফ্যাসিবাদের ক্ষমতায় আসার বিষয়টা স্বীকার করেন বটে কিন্তু তাঁরা যেহেতু ফ্যাসিবাদের দিমিত্রভীয় সংজ্ঞা স্বীকার করেন না তাই তাঁদের রাজনৈতিক লাইন আলাদা। কিন্তু এছাড়াও এক ধরণের সংশয়বাদ আছে যা প্রায়শই এই ভেবে বিভ্রান্ত হয় যে, বিজেপি বিরোধী বুর্জোয়া দলগুলি কি সত্যিই ফ্যাসিবাদ বিরোধী? তারা তো নিজ নিজ ক্ষমতার জায়গায় প্রায় একই রকম নীতি নিয়ে চলে। যেমন ধরুন অনেকে বলেন যে, মমতা ব্যানার্জীও ফ্যাসিবাদী, কারণ তিনিও বিরোধীদের ওপর ফ্যাসিবাদী কায়দায় দমনপীড়ন চালাচ্ছেন ইত্যাদি। এই অভিযোগ বিজেপি বিরোধী সকল দলের বিরুদ্ধেই আছে। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে আরও বেশি করে আছে। কারণ তারাই কেন্দ্রের শাসনে দীর্ঘদিন বহাল ছিল।
আসলে ফ্যাসিবাদকে শুধুমাত্র দমনপীড়ন দিয়ে বোঝার চেষ্টা করলে তা অন্ধের হস্তিদর্শন হতে বাধ্য। বিরোধীদের দমনপীড়ন সবাই করে। এমনকি যখন কমিউনিষ্ট পার্টি ক্ষমতায় যায় তখন তাঁরাও করে। কিন্তু কমিউনিষ্টদের শত্রু-মিত্র নির্ধারিত হয় পার্টির বিচারে নয়, শ্রেণির বিচারে। তাই ক্ষমতাসীন কমিউনিষ্টরা বুর্জোয়াদের দমন করে। তত্ত্বে তো বলাই আছে, বুর্জোয়াদের ওপর একনায়কত্ব প্রযুক্ত হবে। প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্বের মূল কথাটা তো সেটাই। সুতরাং, দমন প্রতিটি শাসন ব্যবস্থার কেন্দ্রীয় বিষয়। যেদিন দমন করার মত কিছু থাকবে না সেদিন শাসন ব্যাপারটাও থাকবে না। তাই ফ্যাসিবাদকে শুধু দমন ব্যাপারটা দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়। আসলে ফ্যাসিবাদ হল, এক প্রতিক্রিয়াশীল গণ-আন্দোলন। ফ্যাসিবাদের এটি হল মৌলিক চরিত্র। সকল গণ-আন্দোলনের মত, একটি প্রতিক্রিয়াশীল গণ-আন্দোলন গড়ে তোলার পূর্বশর্ত হল একটি প্রতিক্রিশীল মতাদর্শের শক্তিশালী উপস্থিতি। ভারতে এই প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শের ওপর সমগ্র রাজনীতিকে স্থাপিত করার ক্ষমতা একমাত্র আরএসএস/বিজেপির আছে। অন্য কারুর নেই। অফ্যাসিবাদী বুর্জোয়ারা ফ্যাসিবাদী নয় কারণ ফ্যাসিবাদী হবার ক্ষমতা তাদের নেই। ক্ষমতা থাকলে তারাও ফ্যাসিবাদী হত। এই সোজাসাপটা ব্যাপারটা মাথায় রাখতে না পারলে ফ্যাসিবাদ বিরোধী রাজনীতি করা যাবে না। অনর্থক সংশয়ের পাঁকে ডুবে মরতে হবে। আবার যেহেতু, ফ্যাসিবাদীদের হাতে শুধু শ্রমিক কৃষকরাই আক্রান্ত হয় না, বুর্জোয়াদের অন্য অংশও হয়, তাই এই অফ্যাসিবাদী বুর্জোয়ারা নিজের পিঠের চামড়া বাঁচানোর জন্যেই ফ্যাসিবাদের বিরোধিতা করতে বাধ্য হয়। এটা মতাদর্শের প্রশ্ন নয়। অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্ন। এটিও একটি সোজাসাপটা ব্যাপার যা আমাদের মাথায় রাখা দরকার। কংগ্রস কিংবা তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে ফ্যাসিবাদ বিরোধী মতাদর্শ খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত হবার কোনো প্রয়োজন নেই।
এখন প্রশ্ন হল, বুর্জোয়াদের এই অন্তর্বিরোধকে আমরা, কমিউনিষ্টরা, ব্যবহার করব কিনা। এখানে প্রথম কথা হল, যে জনা শত্রুর মধ্যেকার দ্বন্দ্বকে কাজে লাগায় না, শত্রুর মধ্যেকার অন্তর্বিরোধকে কাজে লাগাবার চেষ্টা করে না তার পক্ষে যুদ্ধবিগ্রহে না নামাই ভালো। এমনকি সাইডলাইনে বসে পরামর্শ দেবার অধিকারও তাদের নেই। এ ধরণের যোদ্ধাদের অথবা পরামর্শদাতাদের সম্পূর্ণভাবে জনবিচ্ছিন্ন করতে না পারলে বিপদ আছে। তবুও তো যুদ্ধের ময়দানে এই ধরণের যোদ্ধাদের দেখা যায়। লেনিনকেও তাঁর সময়ে বারে বারে এই সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। এই ধরণের যোদ্ধারা কাদের প্রতিনিধিত্ব করেন? লেনিনের স্পষ্ট বক্তব্য ছিল, অভিজাতদের। অভিজাততান্ত্রিক যুদ্ধবাদের কাছে যুদ্ধের উদ্দেশ্য যত না যুদ্ধ জেতা তার থেকে অনেক বেশি যুদ্ধের গৌরব অর্জন করা। অভিজাতদের কাছে যুদ্ধের উদ্দেশ্য যুদ্ধই। এবং তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা গৌরব। কিন্তু শ্রমিক কৃষকের পার্টি যুদ্ধকে এভাবে দেখে না। তাঁদের কাছে যুদ্ধ লক্ষ্য নয়, লক্ষ্যে পৌঁছনোর উপায়মাত্র। তাই যুদ্ধে জেতাই হল যুদ্ধের লক্ষ্য। শত্রুকে পরাজিত করাই হল লক্ষ্য। তাই শত্রুর মধ্যেকার দ্বন্দ্বকে ব্যবহার করা কমিউনিষ্টদের কাছে বাধ্যতামূলক। সুতরাং, কমিউনিষ্টদের কাছে এটা প্রশ্ন নয় যে, শত্রুর মধ্যেকার দ্বন্দ্বকে আমরা ব্যবহার করব কিনা! প্রশ্ন এটাই যে, শত্রুর মধ্যেকার দ্বন্দ্বকে আমরা ব্যবহার করতে পারব কিনা!
কমিউনিষ্টরা শত্রুর মধ্যেকার দ্বন্দ্বকে ব্যবহার করতে পারবে কিনা তা দুটি শর্তের উপর নির্ভরশীল। এক, কমিউনিষ্টদের নিজেদের শক্তি আর দুই, কমিউনিষ্টদের সঠিক রাজনৈতিক লাইন। যে কমিউনিষ্টরা নিজেদের স্বাধীন শক্তিকে বিকশিত করার কাজকে অবজ্ঞা করে শুধু 'ফ্যাসিবিরোধী জোট, ফ্যাসিবিরোধী জোট' বলে লাফালাফি করে তাঁদের পক্ষে ফ্যাসিবিরোধী লড়াইয়ে চাইলেও শত্রুর মধ্যেকার দ্বন্দ্বকে ব্যবহার করা সম্ভব হয়না। আর, রাজনৈতিক লাইনের প্রশ্ন কেন গুরুত্বপূর্ণ? গুরুত্বপূর্ণ, কারণ প্রায়শই দেখা যায়, বুর্জোয়াদের একটি অংশের সঙ্গে জোট বাঁধতে গিয়ে কমিউনিষ্টদের কোনো কোনো অংশ তাদের কৌশলগত মিত্র হিসাবে না দেখে অনেক সময়ে নীতিগত মিত্র হিসাবে দেখে ফেলে। ফলে এই অংশের গুণগান করা, তাদের গণতান্ত্রিক শক্তি হিসাবে দেখা এবং তাদের নেতৃত্বের পায়ে নিজেদের স্বাধীন উদ্যোগ ও হস্তক্ষেপকে সমর্পন করার মত ঘটনা ঘটে। কমিউনিষ্টদের যথেষ্ট শক্তি থাকলেও এই ধরণের ভুল রাজনৈতিক লাইনকে পরিহার করতে না পারলে ফ্যাসিবিরোধী সংগ্রামে সঠিক ভূমিকা পালন করা যায়না।
ফ্যাসিবিরোধী সংগ্রামের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হল, ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করা এবং নির্মূল করা আর ঠেকিয়ে রাখার পার্থক্যটি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানের অভাব। কমিউনিষ্ট বা বামপন্থী মনোভাবাপন্ন অনেক ব্যক্তি মাঝে মাঝেই প্রশ্ন করেন, বিজেপিকে নির্বাচনে হারিয়ে দিলেই কি ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করা হবে? না, হবে না। কারণ ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করার আদত অর্থ হল একটি বিকল্প ব্যবস্থাকে জনমানসে হাজির করা এবং প্রতিষ্ঠা করা, এবং সংগ্রামের ধারায় সেই ব্যবস্থাকে বাস্তবে প্রয়োগ করা। বিকল্প কর্মসূচিহীন সংগ্রাম কখনই ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করতে, নির্মূল করতে সমর্থ হয় না। গত শতকের ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করা গেছিল কেন? অনেকেরই ছেলেভুলোনো ধারণা হল, স্তালিন এমনই এক লৌহকঠোর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যে ফ্যাসিবাদকে পুটুস করে হারিয়ে দেওয়া গেছিল। প্রকৃত বিষয়টি তো তা নয়! ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করতে পারাটি শুধু সামরিক সাফল্যের বিষয় নয়। অনেক বেশি করে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সাফল্যের বিষয়।
আমাদের এটা ভুললে চলবে না যে, ফ্যাসিবাদ যেহেতু পুঁজিবাদী অর্থনীতির সার্বিক সংকট থেকে উদ্ভুত তাই ফ্যাসিবাদ হল পুঁজিবাদী সংকটের একটা জবাব। কিন্তু এই জবাব ডেকে আনে সমাজের বৃহত্তর অংশের সর্বনাশ। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ধ্বংসসাধন। উৎপাদিকা শক্তির একটা বড় অংশের ধ্বংস। সমাজের দুর্বলতর অংশগুলির সামুহিক নিশ্চিহ্নকরণ। পুঁজিবাদী সংকটের ফ্যাসিবাদী জবাবের এগুলি হল অনুসঙ্গ। এর বিপরীতে ফ্যাসিবাদ বিরোধী শক্তির অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক জবাব কী? গত শতকের ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামের দুই শক্তি, কমিউনিষ্ট পার্টি এবং অফ্যাসিবাদী বুর্জোয়া, উভয়ের কাছেই সেই জবাব প্রস্তুত ছিল। এবং সেটিই ছিল ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামের বিজয়ের মূল ভিত্তি। কমিউনিষ্টদের জবাব ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৩০-এর যে মহামন্দার অভিঘাতে তৎকালীন ফ্যাসিবাদের উৎপত্তি তা গোটা ইউরোপ এবং আমেরিকাকে তছনছ করে দিলেও সোভিয়েত অর্থনীতিতে আঁচড়ও কাটতে পারেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তীকালে চিন সহ এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার একটা বড় অংশ এবং পূর্ব ইউরোপ এই ব্যবস্থার অনুসারী হয়। আর অন্যদিকে, অফ্যাসিবাদী বুর্জোয়ারা সংকট থেকে শিক্ষা নিয়ে গড়ে তোলে কেইন্সীয় ব্যবস্থা, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তীকালের তিনটি দশক রাজত্ব করেছে এবং এই সময়ই পুঁজিবাদের স্বর্ণযুগ বলে চিহ্নিত হয়েছে। ফ্যাসিবাদ বিরোধী শক্তির এই বিকল্প জবাবগুলি না থাকলে হাজারো লৌহদৃঢ় নেতৃত্ব থাকলেও ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করা, নির্মূল করা সম্ভব হত না।
এই শতাব্দীর ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামের অন্যতম প্রধান দুর্বলতা হল, পুঁজিবাদী সংকটের ফ্যাসিবাদী জবাবের বিকল্প জবাব কারুর হাতেই নেই। এটি শুধু আমাদের দেশেরই সমস্যা নয়, এই সমস্যার চরিত্র আন্তর্জাতিক। তাই বিজেপিকে শুধু নির্বাচনে হারিয়ে দিলেই ফ্যাসিবাদকে পরাস্ত করা, নির্মূল করা সম্ভব নয়। তাকে সাময়িকভাবে ঠেকিয়ে রাখা যায় মাত্র। কিন্তু এর মানে কি এই যে, শত্রুকে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করা না গেলেও তাকে সাময়িকভাবে ঠেকিয়ে রাখা, নিরস্ত এবং নিরস্ত্র করার চেষ্টাগুলি অর্থহীন? না, তা নয়। বরং তা অসীম গুরুত্বপূর্ণ। নিজেদের শক্তিকে বাড়িয়ে তোলা, ফ্যাসিবাদী প্রকল্পের বিকল্প প্রকল্পকে নির্মাণ করা এবং প্রতিষ্ঠা করার জন্যে যে সময় প্রয়োজন সেই সময়কে সাময়িক ছাড় দিয়ে হলেও কিনে নিতে পারা বা না পারা ফ্যাসিবাদী সংগ্রামের ভাগ্যকে অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এটি যে কোনো যুদ্ধেরই মৌলিক বিষয়। তাই বিজেপিকে কেন্দ্রীয় ক্ষমতা থেকে হঠিয়ে দেওয়া, দূরে রাখা কমিউনিষ্ট শক্তির কাছে অসীম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই আলোতেই আমাদের বিরোধী বুর্জোয়া পার্টিগুলির বিজেপি বিরোধী নির্বাচনী জোটকে দেখতে হবে, বিচার করতে হবে।
বিরোধী জোট
বিরোধী বুর্জোয়া পার্টিগুলির মধ্যেকার জোটের সবথেকে বড় সমস্যা হল তাদের মধ্যে একতার অভাব। এর কারণ এদের মধ্যে বিজেপির বিরুদ্ধে আদর্শনৈতিক বিরোধিতা বলে কিছু নেই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এদের আঞ্চলিক চরিত্র। এক কংগ্রেস বাদে অন্য কোনো দলই সঠিক অর্থে সর্বভারতীয় পার্টি নয়। আমাদের দেশে আঞ্চলিক দলগুলির উদ্ভব ও বিকাশের একটা ইতিহাস আছে। যাঁরা সে ইতিহাস খেয়াল করেছেন তাঁরাই দেখেছেন যে, আঞ্চলিক দলগুলি সর্বদাই নানা কারণে কেন্দ্রের ক্ষমতার উপর নির্ভরশীল। আমাদের দেশের নামমাত্র যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো থাকার ফলে রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকাংশই কেন্দ্রের হাতে স্তুপীকৃত হয়েছে। ফলে আঞ্চলিক শক্তিগুলিকে কেন্দ্রের মুখাপেক্ষী থাকতে হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এদের পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি। কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন সর্বভারতীয় দলগুলি দুর্নীতি করে না তা নয়, বরং দেখা যাবে অনেকগুণ বেশি করে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ক্ষমতা হাতে থাকার কারণে তাকে ঢেকে রাখা, চেপে রাখা সহজ। তুলনায় অনেক ছোটো মাপের দুর্নীতি করলেও আঞ্চলিক দলগুলির দুর্নীতি বেআব্রু হয়ে পড়ে সহজে। ফলে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল অতি সহজেই এই দলগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এই লেখা লিখতে লিখতেই মহারাষ্ট্রের নাটক ঘটে গেল। শারদ পাওয়ারের ন্যাশানালিস্ট কংগ্রেস পার্টি (এনসিপি) -তে ভাঙ্গন ঘটিয়ে অজিত পাওয়ার তার দলবল নিয়ে বেরিয়ে গেলেন এবং বিরোধী জোট থেকে সরাসরি বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ-তে যোগ দিলেন। পুরষ্কার হিসাবে পেলেন মহারাষ্ট্রের উপমুখ্যমন্ত্রীর পদ। যে এনসিপি-কে বিজেপি কিছুদিন আগে পর্যন্ত "সবথেকে বড় দুর্নীতিগ্রস্ত দল" বলে এল এবং "ভারী কারবাই" -এর হুমকি দিয়ে এল তারাই এখন অজিত পাওয়ারকে কোলে করে নিজেদের শিবিরে এনে ফেলল। এই ঘটনা আবারও দেখিয়ে দিল কেন্দ্রীয় ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে বিরোধী জোটের ওপর আঘাত করা কতই না সহজ বিষয়।
এইরকম নড়বড়ে অবস্থার মধ্যেই পাটনার বৈঠক হয়েছে। যে দলগুলি বৈঠকে যোগ দিয়েছে তাদের নিজেদের মধ্যেকার সমীকরণ বেশ জটিল। কংগ্রেস সর্বভারতীয় পার্টি হলেও বর্তমানে প্রয়োজনীয়ভাবে শক্তিশালী নয়। ফলে বিজেপি বিরোধী সর্বাত্মক অভিযানে যেতে গেলে তাদেরও বিরোধী জোট প্রয়োজন। এদিকে আঞ্চলিক ক্ষমতার দখল নিয়ে তাদের সঙ্গে এই আঞ্চলিক দলগুলির রাজ্যভিত্তিক প্রতিযোগিতা তুঙ্গে। আপ-এর সাথে দিল্লি, পাঞ্জাব এবং উত্তর ভারতের অন্যান্য রাজ্যগুলিতে তার তীব্র দ্বন্দ্ব রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জীর তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গেও তাদের তীব্র দ্বন্দ্ব রয়েছে। আঞ্চলিক দলগুলির মধ্যে যেহেতু আবার সর্বভারতীয় হয়ে উঠার বাসনাও থাকে তাই তৃণমূল কংগ্রেসের মতো দল যখনই অন্য রাজ্যে হাত বাড়িয়েছে তখনই কংগ্রেস সেটাকে তাদের দল ভাঙ্গানো বলেই দেখেছে। আর পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তো তৃণমূল কংগ্রেসকে "গিলে খেয়েছে" এই অভিযোগ আছেই। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য-ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে সিপিআইএম এবং তৃণমূলের দ্বন্দ্ব তো গগনচুম্বী। অবস্থা এমন যে, সিপিএমের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যস্তরের পার্টি তৃণমূলকেই প্রধান শত্রু জ্ঞান করে থাকে। বিজেপি আসলে আসুক, থাকলে থাকুক, কিন্তু তৃণমূল ধ্বংস হোক, এই হল তাদের রাজনৈতিক মনোবাসনা। তৃণমূল কংগ্রেসও রাজ্যের ইতিহাসে অভূতপূর্ব দুর্নীতিতে আচ্ছন্ন। বিজেপির সর্বভারতীয় দুর্নীতির কাছে তা যতই তুচ্ছ হোক না কেন, পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে তা নিঃসন্দেহে নজিরবিহীন। ফলে বিজেপি মমতাকে নাকে দড়ি ফিয়ে ঘোরানোর যে সুযোগটা পেয়েছে তাতে সিপিএম যথেষ্ট আমোদিত। এর ফলে সরকারটা পড়ে গেলেই এখন তাদের গায়ের জ্বালা মেটে এবং তাদের প্রায়শই এই অনুযোগ করতে দেখা যায় যে, মমতা ব্যানার্জীকে কেন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না! কিন্তু বিজেপিও ঘাঘু খেলোয়াড়। পশ্চিমবঙ্গের সরকারি ক্ষমতাকে তারা ততটাই ভাঙবে যতটা তারা নিজেরা পূরণ করতে পারবে। খামোকা সিপিএমের সুবিধা তারা করতে যাবেই বা কেন? সিপিএমের অরাজনৈতিক পার্টি র্যাঙ্কস অবশ্য এত কিছু বোঝে না। তারা আশায় আছে। ফলে পাটনার বৈঠকে মমতা ব্যানার্জীর সাথে একযোগে মিটিং করা দলীয় নেতৃত্বকে তাঁরা অস্বস্তিকর প্রশ্নের সামনে ফেলে দিয়েছেন যার পরিষ্কার জবাব নেতৃত্ব দিতে পারছেন না। রাজনীতি পরিষ্কার না থাকলে এমনই তো হবার কথা।
বিরোধী দলগুলির মধ্যে নিজেদের হিসাবনিকাশ রয়েছে। প্রত্যেকেই এই জোটে এসেছে দ্বৈত উদ্দেশ্য নিয়ে। এক, বিজেপিকে ঠেকানো। দুই, জোটকে ব্যবহার করে নিজেদের শক্তিসামর্থ্যগুরুত্ব বাড়িয়ে নেওয়া৷ অনেকের মধ্যেই আবার জোটকে নেতৃত্ব দেওয়ার আকাঙখা এবং বিজেপিকে হঠিয়ে জোট ক্ষমতায় আসলে টুক করে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে গিয়ে বসে পড়ার মনোবাঞ্চা প্রবল। প্রায় একই রকমের ভাবনাচিন্তা সকলেরই। ফলে নিজেদের মধ্যে রয়েছে তীব্র প্রতিযোগিতা, ঠেলাঠেলি, কনুই মারামারি। এখন এসব দেখে কারুর যদি মনে হয় যে, 'এদের দ্বারা হবেটা কী? হবে হচ্ছে ঘন্টা', তালে জেনে রাখা ভালো অফ্যাসিবাদী বুর্জোয়াদের জোট সর্বদেশে এবং সর্বসময়ে এমনই হয়। অন্যরকম কিছু হয়না। হবার কথাও নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই দলগুলিকে এক মঞ্চে টেনে এনেছে কে? টেনে এনেছে একটা ভয়। যে ভয়টা যথেষ্ট বাস্তব। বিরোধী রাজনীতির বাস্তুঘুঘুরা নিঃশ্বাসে বারুদের গন্ধ টের পেয়ে গেছে। তারা বুঝেছে যে, ২০২৫ সালটা ভারতীয় রাজনীতিতে যথেষ্ট বিপদজনক, খতরনাক্। আরএসএস-র প্রতিষ্ঠার একশো বছর পুর্তি হচ্ছে ঐ বছর। আর ২০২৪-এ যদি বিজেপি ফিরে আসতে পারে তাহলে ২০২৫-এ ভারতের শাসনব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন হবে। ঠিক কী হবে তা আগে থেকে পুরোটা ভেবে ফেলা হয়ত সম্ভব নয়, কিন্তু বিরোধী রাজনীতি করা যে প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠবে তা প্রায় নিশ্চিত। এখনই তা যথেষ্ট মুশকিল হয়ে উঠেছে। বিজেপির কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ না করে বিরোধী রাজনীতিতে টিঁকে থাকা আজই যে কতটা কঠিন হয়ে উঠেছে তা এরা হাড়ে হাড়ে বুঝেছে। ২০২৫-এ যদি বিজেপি ক্ষমতাসীন থাকে তবে তা যে একপ্রকার অসম্ভব হয়ে উঠবে তা বুঝতে এদের ভুল হয় নি। এই ভয় শত দ্বন্দ্ব ও দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও এই দলগুলিকে এক মঞ্চে টেনে এনেছে।
ভারত হিন্দুরাষ্ট্র হবে কিনা তা নিয়ে এদের ভাবনা-দুর্ভাবনা নেই। মুসলমানদের নাগরিকত্ব থাকবে কিনা তা নিয়ে এরা চিন্তিত নয়। অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার বাড়বে কিনা তা নিয়ে তাদের মাথাব্যাথা নেই। শ্রমিক কৃষক আমজনতার অবস্থা দুর্বিষহ হবে কিনা তা নিয়ে তারা থোড়াই পরোয়া করে। কৃষক আন্দোলন এবং মহিলা কুস্তিগীরদের লড়াইয়ে তেতে উঠা হরিয়ানার খাপ পঞ্চায়েতের নেতারা তো পরিষ্কারই বলে থাকেন যে, হরিয়ানা তো এমনিতেই 'হিন্দুরাষ্ট্র', হিন্দুরাষ্ট্রের জন্যে আমাদের বিজেপিকে প্রয়োজন নেই। কিন্তু হিন্দুরাষ্ট্রের মানে যদি হয় সার্বিক ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র যেখানে শাসন করবে বৃহৎ বুর্জোয়াদের একটা অতি ক্ষুদ্র অংশ, বাকিদের তাদের পায়ে নিজেদের স্বাধীনতা, শাসন, এমনকি অস্তিত্বকে সমর্পণ করতে হবে (ফ্যাসিবাদের চেহারা তো এরকমই), তাহলে তেমন হিন্দুরাষ্ট্রে এদের সকলেরই অসুবিধা আছে বৈ কি। শত দুর্বলতা ও নড়বড়ে অবস্থা সত্ত্বেও বিরোধী জোট গড়ে ওঠার বাস্তব ভিত্তি এটাই। অফ্যাসিবাদী বুর্জোয়াদের জোট সর্বকালে এবং সর্বদেশে এই জন্যেই গড়ে ওঠে। আর সে কারণেই এখানে নেতৃত্বের প্রশ্নটি অসীম গুরুত্বপূর্ণ।
শেষের কথা
ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা আমাদের এই শিক্ষাই দেয় যে, তাত্ত্বিক ও মতাদর্শগতভাবে বলীয়ান এবং গণভিত্তি সম্পন্ন কমিউনিষ্ট শক্তির নেতৃত্ব ছাড়া ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রাম সফল হয়না। সে সংগ্রাম যদি নির্বাচনী সংগ্রামের মত একটি খন্ডযুদ্ধও হয়, তাহলেও। ফ্যাসিবাদ যেহেতু একটি প্রতিক্রিয়াশীল গণ-আন্দোলন তাই ফ্যাসি-বিরোধী সংগ্রামও একটি পালটা গণ-আন্দোলন। প্রগতির পক্ষে গণ-আন্দোলন। স্বাভাবিকভাবেই মতাদর্শগতভাবে দুর্বল, দোদুল্যমান, নিজদ্বন্দ্বে দীর্ণ বুর্জোয়াদের জোটের পক্ষে সে গণ-আন্দোলন তৈরি করা মুশকিল। ভারতবর্ষের বর্তমান রাজনীতির সমস্যা ঠিক এই জায়গাতেই বড় গভীর গাড্ডায় পড়ে রয়েছে। অন্যদিকে সিপিএম কিছুতেই সর্বভারতীয় বাম-কমিউনিষ্ট জোট গড়ে তুলবে না। এঁরা রাজনীতিকে বুঝেছেন পাটিগণিত দিয়ে। কিন্তু পাটিগণিত দিয়ে উচ্চস্তরের গতিতত্ত্বকে ব্যাখ্যা করা যেমন সম্ভব নয়, ফ্যাসিবিরোধী রাজনীতিকে পরিচালনা করাও তেমন সম্ভব নয়। এটা ঠিকই যে, বিজেপি এখনও পর্যন্ত সংখ্যালঘু অংশের ভোটেই নির্বাচিত হয়েছে। এর কারণ বিরোধী ভোটের ভাগাভাগি। কিন্তু বিজেপি বিরোধী শক্তি একজায়গায় এসে গেলেই এই টুকরো ভোটব্যাঙ্কগুলো পরষ্পরের সাথে জোড়া লেগে যাবে না। এর জন্যেই প্রয়োজন ফ্যাসিবিরোধী গণ-আন্দোলন যা বিজেপিকে ক্ষমতার অলিন্দ থেকে ছুঁড়ে ফেলতে মতাদর্শগতভাবে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এটা গড়ে তুলতে পারেন একমাত্র কমিউনিষ্টরাই। সিপিএমের প্রকৃত চরিত্র যাই হোক না কেন, সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে সাধারণ জনতার কাছে তাঁরাই বৃহৎ বামশক্তি বলে পরিচিত। কিন্তু তাঁদের রাজনৈতিক লাইন তাঁদের ছুটিয়ে মারছে কংগ্রেসের পেছনে। তৃতীয় ধারার নকশালপন্থী শক্তিগুলির অবস্থা তো আরওই ছিন্নবিচ্ছিন্ন। এঁদের অনেকেই ফ্যাসিবাদের বিপদ দেখেন না। দেখলেও নির্বাচনী সংগ্রামে ফ্যাসিবাদকে মোকাবিলা করার গুরুত্ব বোঝেন না। আর বুঝলেও তাঁরাও পরষ্পরের সাথে একমঞ্চে আসতেও পারেন না। প্রকৃতপক্ষে তাঁদের একপ্রকার ঠুঁটো জগন্নাথ অবস্থা। এর মধ্যেও যাঁরা কিছুটা চেষ্টা করছেন তাঁরাও খুবই প্রান্তিক অবস্থানে রয়ে গেছেন। অথচ এই মুহুর্তে খুবই প্রয়োজন ছিল ভারতীয় পরিস্থিতিতে গ্রিসের 'সাইরিজা'-র মত একটি বৃহৎ বামমঞ্চ। যা গোটা দেশের মানুষের মধ্যে উদ্দীপনা তৈরি করতে পারত। ফ্যাসিবিরোধী সংগ্রামে শ্রমিক কৃষকের কন্ঠস্বরকে জোরালো করতে পারত। এক বিপুল গণ-আন্দোলন সৃষ্টি করে বিরোধী বুর্জোয়া শক্তির নড়বড়ে শিঁরদাঁড়ায় আঘাত করে তাকে সোজা করতে পারত। নয়া-উদারবাদকে প্রত্যাখ্যান করে ফ্যাসিবাদী প্রকল্পের এক বিকল্প জবাব দিতে পারত। বিরোধী বুর্জোয়াদের চেহারাছবি দেখে ভরসা না পাওয়া জনগণের কাছে নতুন দিনের আশাভরসা বয়ে আনতে পারত। শত দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা নিয়েও গত শতকের ফ্যাসিবিরোধী সংগ্রামে এসবই করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং তৃতীয় আন্তর্জাতিক। আজ করবে কে? আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বাদ দিন। আজ ভারতের রাজনীতির এই অত্যন্ত গম্ভীর সময়ে এই কাজ করবে কারা?
কমিউনিষ্ট তথা বামপন্থী শক্তির দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবার সময় কিন্তু সমাগত। সময় এখনও আছে।