পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

একটি অভাবনীয় ট্রেন দুর্ঘটনা ও সমাজ মাধ্যমের প্রতিক্রিয়া

  • 08 June, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 1778 view(s)
  • লিখেছেন : শোভনলাল চক্রবর্তী
এতোবড় একটা দুর্ঘটনার কী প্রতিক্রিয়া সমাজ জীবনে, কী প্রতিক্রিয়া সামাজিক মাধ্যমে? কেন মানুষ এইরকম আচরণ করছেন ?


বালেশ্বর ট্রেন দুর্ঘটনায় শোকস্তব্ধ গোটা দেশ। প্রাণ গিয়েছে ২৭৫ জনের। এই ঘটনার নেপথ্য কারণের খোঁজ এবং রেল পরিষেবা সচল করতে তৎপর প্রশাসন। কিন্তু, এরই মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে 'ভুয়ো' তথ্য ! ওড়িশা পুলিশের অফিসিয়াল টুইটার হ্যান্ডেল থেকে একটি টুইট করা হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, "বালেশ্বরের মর্মান্তিক রেল দুর্ঘটনাকে কিছু সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী সাম্প্রদায়িক রং দেওয়ার চেষ্টা করছে। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। এই দুর্ঘটনার কারণ জানার জন্য জিআরপি, ওড়িশা চেষ্টা করছে। দুর্ঘটনার সমস্ত দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে।" ওড়িশা পুলিশের এই পোস্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, বালেশ্বরে উদ্ধারকাজ শেষ হয়েছে। যাতে রেল পরিষেবা চালু হয়, সেই জন্য যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজ চলেছে, এবং দুর্ঘটনার ৫১ ঘণ্টা পরে রেল পরিষেবা চালু হয়েছে।

সমাজমাধ্যমে বেশ কয়েকটি  ভুয়ো খবর ও ছবি দুর্ঘটনার পরদিন  থেকেই ঘুরে বেড়াতে শুরু করে। তার মধ্যে যেমন ছিল আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার রেল দুর্ঘটনার ছবি বালেশ্বর - এর ছবি বলে চালানো।তেমনি বেশ কিছু বিভৎস ভাবে বিকৃত মৃতদেহের ছবি এই দুর্ঘটনার ছবি বলে চালানো হচ্ছিল, যেগুলি দেখেই বোঝা যাচ্ছিল যে ছবিগুলি ভারতীয়দের ছবি নয়। এই অবধি হলে তবু সহ্যের একটা সীমা থাকত। কিন্তু এর পর যেটা আমরা সমাজ মাধ্যমে দেখলাম তাতে মনে হল যে এবার সময় এসেছে সমাজ মাধ্যমের পায়ে শেকল দেওয়ার।

 ঠিক কি ছিল ওই বিকৃত পোস্টে? যাঁরা দেখেছেন তাঁরা জানেন,যাঁরা  দেখেননি তাঁদের জানা দরকার পোস্টটির বক্তব্য। আমরা সবাই জানি যে দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল শুক্রবার যেদিন মুসলমানদের কাছে পবিত্র নমাজের দিন বা জুম্মাবার। পোস্টটিতে রেল দুর্ঘটনায় উল্টে যাওয়া বগির বেশ কিছুটা পেছনে একটি বাড়ির চূড়ার ছবি দেখা যাচ্ছে।পোস্টে দাবি করা হয়েছিল যে ওই চূড়া একটি মসজিদের। ওই মসজিদের ভিতর থেকেই ষড়যন্ত্রকারীরা নাকি ষড়যন্ত্র করে এই দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। পোস্টে মোদিজিকে উদ্দেশ্য করে লেখা হয়েছে অবিলম্বে ওই মসজিদ ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে। মুহূর্তে হাত বদল করতে থাকে পোস্টটি।অবিলম্বে ভাইরাল হয়ে যায় সেটি। দুর্ঘটনা স্থলেও নিশ্চয় কেউ কেউ সেটি দেখে থাকবেন। এর পরেই ওড়িশা পুলিশ টুইট করে গোটা ব্যাপারটা অত্যন্ত দুঃখজনক বলে জানায়। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে সর্ব ভারতীয় মূল স্রোতের যে সমস্ত সংবাদ মাধ্যমের সাংবাদিকরা স্পটে উপস্থিত ছিলেন তাঁরা কেউ ওই মসজিদের অস্তিত্ব নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলেননি। নিউজ লন্ড্রির একজন সাংবাদিক যিনি ওখানে ছিলেন তিনি দেখতে পান যে বাড়ির চূড়াটি মসজিদের মত দেখাচ্ছে না বরং মন্দির বলে মনে হচ্ছে। তিনি দেড় কিলোমিটার দূরে ওই বাড়িতে পৌঁছে দেখেন যে সেটি একটি ইসকনের নির্মীয়মান মন্দির। ওই সাংবাদিক মন্দিরের মহান্তের সঙ্গে কথা বলে জানান যে, দুর্ঘটনার খবর পাওয়া মাত্র মন্দিরের ভক্ত ও সেবায়েতরা মিলে উপস্থিত উদ্ধারকারী দলের খাবারের ব্যবস্থা করা শুরু করেন। মহান্ত জানান যে যাঁরা এমন ভুয়ো বিকৃত সাম্প্রদায়িক খবর প্রচার করতে পারেন তাঁদের যেন শুভ বুদ্ধির উদয় হয়।

সেই আশা আমাদেরও।কিন্তু এই ব্যাপারটি মিটে যাওয়ার পরেও কয়েকটি প্রশ্ন থেকেই যায়। প্রথমত, এমন একটি জঘন্য পোস্ট ভুয়ো প্রমাণের পর কেউ বললেন না যে কাজটি ভুল হয়েছিল। তাঁদের এই নীরবতা আসলে সম্মতির লক্ষণ। অর্থাৎ যেখানে যেমন ভাবে পারো সংখ্যালঘুদের  কোণঠাসা করে যাও। আমরা যদি ভেবে বসি যে মন্দিরকে মসজিদ বানিয়ে যাঁরা সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ালেন তাঁরা প্রান্তিক মানুষ, তাঁদের সঙ্গে মূলস্রোতের কোনও সম্পর্ক নেই, তবে বিরাট ভুল হবে। আজ কিন্তু এই প্রান্তিকরাই মূলস্রোতকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। আর সেটাই গভীর চিন্তার বিষয়।মন্দির মসজিদ বাইনারি হিন্দুত্ববাদীদের রক্তে এমন ভাবে মিশেছে যে একটি মর্মান্তিক রেল দুর্ঘটনার মধ্যেও তারা ওই বাইনারিকে ঢুকিয়ে দিতে চাইছে।আর জেনে রাখবেন এতে পূর্ন সম্মতি রয়েছে সর্বোচ্চ নেতৃত্বের, যার মধ্যে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং।

সমাজ মাধ্যমে যখন একটি জঘন্যতম পোস্ট দেখলাম আমরা তখন রাজনৈতিক মঞ্চেও যা হল তা অনভিপ্রেত বললেও কম বলা হয়।দুর্ঘটনার পরের দিন আমরা দেখলাম দুই রেল আধিকারিকের কথোপকথনের অডিও ক্লিপ সমাজমধ্যমে চলে এল। এই  দুই রেল আধিকারিকের কথোপকথন পোস্ট করেছিলেন তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ। সেই অডিও কোথা থেকে এল? তাহলে কী কলকাতা পুলিশ কেন্দ্রীয় আধিকারিকদের ফোনে আড়ি পাতছে? স্বাভাবিক ভাবেই এই প্রশ্ন উঠছে। যাঁরা কেন্দ্রের বিরুদ্ধে পেগাসাস নিয়ে গলা ফাটান তাঁরা নিজেরাই যদি এমন করেন তবে বিপদ। এই অডিও কোথা থেকে এল, তা তদন্ত করে দেখা দরকার। এই বিষয়ে বিরোধী দলনেতার বক্তব্যের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন কুণাল ঘোষ। তিনি বলেছেন যা করেছেন তাতে কোনও ভেজাল নেই,তবে তিনি কিভাবে এই অডিও ক্লিপটি  পেলেন তা জানাননি। বালেশ্বরের ট্রেন দুর্ঘটনা নিয়ে তৃণমূল-বিজেপির কথার লড়াই চলছেই।একটি বিভৎস রেল দুর্ঘটনা ঘিরে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ এবং রাজীতিবিদরা সমাজ মাধ্যমে যা নমুনা রাখলেন তা ইতিহাসের এক অন্ধকারময় দিক হয়ে থাকবে। অন্যদিকে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে তাঁদের কথা যাঁরা সমাজ মাধ্যমের সাহায্যে উদ্ধার করেছেন আহত,নিহতদের পরিচয়, ঠিকানা, পৌঁছে গিয়েছেন তাঁদের বাড়িতে।প্রতিনিয়ত আপডেট দিয়েছেন ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামে।ফেসবুক লাইভ করে নিশ্চিন্ত করেছেন কত অজানা, অচেনা পরিবারকে। এই দুর্ঘটনায় যাঁরা আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন যে মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ তাঁরা ওই বাহানগর বাজার স্টেশন সংলগ্ন এলাকার সাধারণ গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ।সরকারি সাহায্যকারী দলের সঙ্গে সমানে দিন রাত এক করে তাঁরা ছিলেন উদ্ধারকার্যের প্রথম সারিতে।আমাদের নেতা মন্ত্রী ও সমাজ মাধ্যমে হিংসা ছড়ানো মানুষেরা তাঁদের থেকে শিখতে পারেন।

0 Comments

Post Comment