ক'দিন ধরেই ঝড় বয়ে যাচ্ছে অনন্যার মধ্যে । এক নিঃশব্দ ঝড় । সংসারের নিয়মিত কাজ, মানে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত গড়পরতা বাঙালি গৃহবধূরা যা যা করে থাকে, তা সবই সে করে যাচ্ছে নিয়ম করে। কিন্তু কাজে যত্নটা থাকছে না। মনটাও সরে সরে যাচ্ছে । অলীক কিছু বোঝেনি হয়তো । অবশ্য তার বোঝবার সময়ই বা কোথায় । সকাল থেকেই তো পার্টির কাজ । কোনো কোনো দিন দুপুরে ফেরে। স্নান খাওয়া দাওয়া, বিশ্রামের পর্ব মিটিয়ে আবার বেরিয়ে যায় । ফিরতে ফিরতে রাত । কথা বলার, মুখোমুখি বসার সময় তো নেই!
একমাত্র চিন্তা, মেয়ে অনুসূয়া । সামনেই উচ্চ মাধ্যমিক । নামী স্কুল । পড়া প্রজেক্ট টিউশান নিয়ে সেও ব্যস্ত । তারও সময় নেই । দৌড়াচ্ছে সকাল থেকে রাত। এইটুকু তো মেয়ে । এত দৌড়ানোর কী আছে! তাদের সময়ে তারা তো নিশ্চিন্ত ছিল স্কুলের পড়াটুকু নিয়ে । কই, ফেলে দেবার মত রেজাল্ট তো তার ছিল না। স্কুলে পাড়ায় কত-শত প্রশংসাও জুটেছিল । এ নিয়ে মেয়েকে একদিন অনন্যা বলেছিলেন, ' অনু তোদের স্কুলে এত চাপ কিসের রে, সারাদিনই ছুটছিস ?'
মেয়ে হাসতে হাসতে বলেছিল,' মা, তোমাদের সময় দিয়ে আমাদেরকে বিচার করতে এসো না। নাও দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ মুভিং ফাস্ট। আই হ্যাভ টু প্রিপিয়ার ফর দ্য ফরেন ইউনিভার্সিটি । এখানে পড়ে থাকলে হবে?'
অনন্যা অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। আঠারো না পেরোতেই মেয়ের এত ম্যাচিওরিটি! ভবিষ্যতের ভাবনাও ভেবে ফেলেছে, এখানে থাকলে কিছু হবে না! সেই মেয়েরও চোখ এড়ায়নি তার মায়ের এই পরিবর্তন । এর মধ্যে সে জিজ্ঞাসাও করেছে,' মা, হোয়াই আর য়্যু সো কুল, সামথিং রং?'
অনন্যা হেসে উত্তর দিয়েছেন,' না রে মা, কিছু হয় নি। এই ওয়েদারটার জন্যই শরীরটা কেমন মাঝে মাঝে ম্যাজ ম্যাজ করছে।'
খেতে খেতেই অনু উত্তর দিয়েছে,' ওকে । দেন কনসাল্ট আ ডক্টর ।'
আর কথা হয় নি। শুধু ডাক্তারের কাছে যাবার পরামর্শ! ডাক্তারের কাছে যাবার দরকার হবে না । ফোনে বললেই হবে অলীকবাবুর স্ত্রী বলছি। তাহলে বাড়িতে বসেই তাদের পরিষেবা পাওয়া যাবে । কিন্তু অনন্যা মনে মনে অন্য কিছু চাইছিলেন । মেয়ে একটু হাতটা ধরুক, কাঁধে মাথা রাখুক, পাশে বসুক দু'দন্ড। কিন্তু কোথায় কী-- কনসাল্ট আ ডক্টর
ও তো তাও মন্দের ভালো, জিজ্ঞেস করেছে। কিন্তু যে মানুষটার জন্য নিজের কেরিয়ার জলাঞ্জলি দিয়ে ঘর বাঁধল, ছোট ছোট শখ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে অন্য একটা স্বপ্নের পিছনে ছুটবে বলে ঘর ছাড়ল, সেই মানুষটা এতটা বদলে গেল কীভাবে?
পড়ন্ত বিকেলে পাঁচতলায় এই থ্রিবিএইচকে ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে বসে অনন্যা দিনের আলো নিভে আসা দেখছিল বা হয়ত কিছুই দেখছিল না। মাথায় একরাশ এলোমেলো চিন্তা । নিজের সঙ্গে লড়াই করতে করতে ক্লান্ত । এবার একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। জীবনের এখনও অনেকগুলো বছর পড়ে আছে সামনে । সবে তো পঁয়তাল্লিশ চলছে । ভারতীয়দের গড় আয়ু ধরলে আরো অন্তত কুড়ি-পঁচিশটা বছর বাঁচার কথা। যে স্বপ্নকে সামনে রেখে ঘর ছেড়েছিল, সেই স্বপ্নকে নিয়েই বাঁচতে হবে-- দিন বদলের স্বপ্ন, সমাজ বদলের স্বপ্ন । জানে একা একা সম্ভব নয় । তবুও ছোট ছোট বৃত্তে যারা কাজ করে চলেছেন নিঃস্বার্থ ভাবে, তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াবেন। হাতে হাতে কিছু নুড়ি পাথর না হয় সরিয়ে দেবেন।
নিঃস্বার্থ শব্দটা আর একবার উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল ছাত্র নেতা অলীকের সেই আগুনে বক্তৃতার কথা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে, শাসকের বিরুদ্ধে তার কথাগুলো মনে করলে আজও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। সেদিনের ছবিটা আজ এতগুলো বছর পরেও পরিষ্কার । মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছিল অলীকের কথা। বক্তৃতা শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও কয়েকটা মুহূর্ত দাঁড়িয়েছিল করিডরে । তারপরে ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়েছিল ছেলেটার সামনে । কে দেখছে, কি ভাবছে, এসব চিন্তা মাথাতেই আসেনি । সরাসরি বলেছিল,' আমি অনন্যা । ফাইনাল ইয়ার পল সায়েন্স । আপনি এতক্ষণ যা যা বললেন তা কি কোনোদিন সম্ভব হবে আমাদের দেশে?'
অলীক তাকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে ধীর গলায় বলেছিল,' বিশ্বাস করি সুসময় আসবে। টুডে অর টুমোরো। মানুষের জন্য নিঃস্বার্থ ভাবে কাজ করতে পারলে, তাদের বিশ্বাস অর্জন করতে পারলে, কাজটা কি খুব কঠিন?'
প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়েছিল আবার তার দিকে । অলীকের কথায় কী যেন এক সম্মোহন ছিল। কথা না বাড়িয়ে অলীক বলেছিল,' চলুন, আজকের এই আলাপ পর্বের মাঝে একটু চা পানের বিরতি নেওয়া যাক।'
তারপর ওদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকেও জড়িয়েছে। ক্যাম্পাসে মিটিং মিছিল পোস্টারিং। অলীক আর অনন্যা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছে । আপনি থেকে তুমিতে নেমে আসতে দেরি হয় নি। অলীকেরও ফাইনাল ইয়ার, তবে অন্য ডিপার্টমেন্ট । বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও ছড়িয়েছে অলীকের নাম। বিভিন্ন গণ আন্দোলনের মঞ্চে ডাক আসে বক্তৃতা দেবার। কাগজেও দু'চারবার ছবি ছাপা হয়েছে । দুজনে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে তখন।
স্বাভাবিক ভাবেই রাজনীতি করা ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি নয় অনন্যার -মা। বাঁধা আয় নেই , খাওয়াবে কী? সে চুপ করে সহ্য করেছে কয়েকটা মাস। আর ভিতরে ভিতরে পড়ানোর কাজ খুঁজে গিয়েছে স্কুল থেকে কলেজে। শেষে একটা কলেজে অতিথি শিক্ষকের কাজ পেয়ে যাবার পর জোর গলায় বাবা-মাকে বলতে পেরেছে,' অলীক অন্য রকম ছেলে। সাধারণ মানুষের জীবনকে বদলে দেবার কাজে নেমেছে ওরা। ওর পাশেই থাকব আমি।'
সেই বিশ্বাসের মূল্য এভাবে চোকাতে হবে তাকে? কুরে কুরে খায় এই সময় । কোথায় সেই নিঃস্বার্থ কাজের ইচ্ছে, আকুতি? বিশ্বাস কি মানুষ করেনি? ভোট রাজনীতির হাত ধরে অলীকদের দল ( এটা কি তার নিজেরও দল!) ক্ষমতা দখল করেছে । মানুষের সে কি উন্মাদনা । বাসে ট্রেনে বাজারে অফিসে মানুষের বাঁধ ভাঙা উচ্ছ্বাস আর সরল বিশ্বাস-- এবার নিশ্চয় একটা বদল আসবে। ছাত্র নেতা হিসাবে, যুব সম্প্রদায়ের মুখ হিসাবে অলীকও ভোটে লড়েছে এবং অনন্যাকে অবাক করে দিয়ে জিতেছে। বিরোধীদের পেশী শক্তি আর অর্থবলকে ভয় পেয়েছিল সে। মাঠে ময়দানে প্রচার করেছে। কত অচেনা মানুষের বাড়িতে রাত কাটিয়েছে। দেখেছে তাদের চোখে মুখে দিন বদলের চাপা উত্তেজনা । তারপরেও যে মানুষ এভাবে এগিয়ে আসবে ভাবতে পারেনি ও। সেখান থেকেই মানুষের প্রতি বিশ্বাস আরো গাঢ় হয়েছে। আর তাই আজ দুদশক পরে তার মনের মধ্যে এত লড়াই এত দ্বন্দ্ব । প্রতিনিয়ত মনে হয় এই প্রতারণার সঙ্গে সেও যুক্ত । মানুষের বিশ্বাস ভঙ্গের দায়ে সেও অভিযুক্ত ।
বদলটা প্রথম চোখে পড়ল বছর খানেক পর। মফস্বল শহরের ভাড়া বাড়িতে পার্টি কর্মী থেকে সাধারণ মানুষ সবার জন্যই ছিল অবারিত দ্বার। বাইরের ঘরে মাদুরের উপর বসে বসেই চলে চা-মুড়ি , আলোচনা, তর্ক । বছর খানেক পরে টেবিল চেয়ার ঢুকতেই প্রতিবাদ করেছিল অনন্যা,' এসবের কী দরকার? সবার সঙ্গে মাটিতে বসলেই তো ভাল।'
হাসতে হাসতে অলীক বলেছিল,' টেবিল চেয়ারে লেখালিখির সুবিধা ।'
এরও কিছুদিন পরে যখন অ্যান্টি চেম্বার তৈরি হল, তৈরি হল কাছের লোকের বৃত্ত, আড়াল, আর সাধারণ মানুষের অপেক্ষার সময় বাড়ল, অনন্যা বুঝেছে এবার থেকে তার দলও জনবিচ্ছিন্ন হতে শুরু করল। অনন্যা এসব নিয়ে অনুযোগ করলে অলীক তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেছে,' পার্টি চালাতে গেলে কিছু ডেকোরাম আছে। একটা দুরত্ব না রাখতে পারলে ওদের চোখে সম্ভ্রম, শ্রদ্ধা থাকবে না।'
অনন্যা ব্যঙ্গের সুরেই বলেছিল,' নাকি ভয়ের দুরত্ব তৈরি করতে চাও?'
তারপর তো অলীকের আরো উত্থান-- দলে, প্রশাসনে। কাজে কাজেই মফস্বলের ঠিকানা বদলে শহর কলকাতায় থিতু হওয়া। ছোট এক কামরার ফ্ল্যাট থেকে দুকামরা, দুকামরা থেকে এখন তিন কামরার এই বিশাল ফ্ল্যাট, সর্বক্ষণের গাড়ি ।
অনন্যা বুঝতে পারে সেই লড়াই আর নেই, বিশ্বাসও আজ মৃত। একজন নির্বাচিত জন প্রতিনিধির সরকারি আয় থেকে এই বৈভব বিলাসিতা কেনা যায়? কলকাতা আসায় কলেজের চাকরিটা ছাড়তে হয়েছিল আগেই । মন দিয়েছিল মেয়েকে মানুষ করার দিকে। তার চাহিদা তো কখনওই বেশি ছিল না। গাড়ি বাড়ির বিলাসিতা সে তো চায় নি। কথায় কথায় অলীককে বলেওছিল সে কথা,' এসবের কী দরকার আমাদের? দু'বেলা ভাত কাপড় তো ঠিক জোগাড় করে ফেলছিলাম আমরা । তোমার বেতনের পয়সায় এত সব সম্ভব?'
অলীক গম্ভীর গলায় উত্তর দিয়েছে,' যা বোঝো না, তা নিয়ে কথা বোলো না। এসব আজকাল সবাই পায়। বাড়িতে বসে সময় কাটছে না বোধহয় । চাও তো একটা কলেজে বলে দিই, পড়াতে শুরু কর।'
আর কথা বাড়ায় নি অনন্যা । তবে দয়ার দানও নিতে চায় নি সে। তিল তিল করে শক্তি সঞ্চয় করেছে। আর দেরি নয়। মেয়ের পরীক্ষার পরই জানিয়ে দিতে হবে সিদ্ধান্তটা। 'আগামী ' নামের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে কথা হয়ে গেছে ওর। শহর থেকে একটু দূরে কিছু অনাথ বাচ্চাদের পড়ানোর দায়িত্ব নিতে হবে ওকে। ওখানেই থাকা খাওয়া । বেতন কিছু নেই । অবশ্য দরকারটাই বা কি। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের মধ্যে মানুষ হবার স্বাভাবিক বোধগুলো চারিয়ে দিতে পারলে বদলাতেও পারে দিন।
হাত বাড়িয়ে মোবাইল ফোনটা টেনে নিলেন অনন্যা । কন্টাক্ট লিস্ট থেকে চেনা এক উকিলকে ফোন করলেন,' আগামী কাল একবার আসতে পারবেন এখানে? ডিভোর্সের একটা ফাইল তৈরি করতে হবে ।'