পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

করোনানামা~ একটি মুখফেরতা গল্প এবং আমরা

  • 01 April, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 1320 view(s)
  • লিখেছেন : নীহারুল ইসলাম
আমাদের ভিতরেও একটি গল্প আছে। একটি গানও আছে। সম্প্রীতির গল্প। সম্প্রীতির গান। এককথায় বেঁচে থাকার গল্প, গান। যে গল্প আমরা আমাদের অন্তর থেকে বের করে কাউকে কোনওদিন বলিনি। গানটাও শোনাই নি। তাই আজ তারা সুযোগ বুঝে যে কোনও অজুহাতে বেরিয়ে পড়ছে। শোধ তুলতে আমাদেরকে ধন্দে ফেলছে! সেই ধন্দে আমরা একে অপরের সঙ্গে ঝগড়া করছি। লড়ালড়ি করছি।

~

এক ছিল বউ। সে জন্ম থেকে একটা গল্প জানত আর একটা গান জানত। কিন্তু সে কখনও কাউকে ওই গল্প বলেনি, গানও শোনায়নি। আসলে সময় করে উঠতে পারেনি। কিংবা তার সাহস হয়নি। এভাবেই সে একদিন ভুলে যায় সেই গল্প আর গানকে। এদিকে তার ভিতরে থাকতে থাকতে ওই গল্প আর গানের দমবন্ধ অবস্থা। এই মরে কি সেই মরে! ভয়ে ওদের আকুলিবিকুলি শুরু হয়। ওরা বউটির ভিতর থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ছটফট শুরু করে।

একদিন বউটি হাঁ করে ঘুমোচ্ছিল। আর তার সেই হাঁ-মুখ দিয়ে প্রথমে গল্পটা বেরিয়ে এসে একজোড়া জুতো সেজে ঘরের দরজার বাইরে বসে রইল। তার দেখাদেখি গানটাও বেরিয়ে দরজার পাশের দেওয়ালের পেরেকে একটা জামা সেজে ঝুলে রইল।

সন্ধ্যাবেলা বউটির স্বামী বাড়ি ফিরে ওই জুতোজোড়া আর জামা দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘কে এসেছে?’

বউটি বলল, কই? কেউ না তো।’

‘তাহলে এই জুতোজোড়া আর ওই জামাটা কার?

বউটি বলল, ‘আমি তার কী জানি!

বউয়ের এই কথায় স্বামীর যেমন রাগ হল তেমনি সন্দেহ। তা থেকে এক কথা দু’কথা হতে হতে তাদের মধ্যে রীতিমতো ঝগড়া বেঁধে গেল। কিন্তু বউয়ের সঙ্গে ঝগড়ায় স্বামী কবে পেরে উঠেছে যে, আজ পেরে উঠবে? অগত্যা রণে ভঙ্গ দিয়ে স্বামী বেচারা লেপকাঁথা বগলদাবা করে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আশ্রয় নিল পাড়ার বটতলায়।

বউ কিছুতে বুঝতে পারছে না। সত্যি তো, জুতোজোড়া আর জামা এল কোথ্ থেকে? ভেবে ভেবে যখন সে কোনও উত্তর পেল না, কুপি নিভিয়ে শুয়ে পড়ল।

এটা যে পাড়ার ঘটনা, সেই পাড়ায় একটা রীতি প্রচলিত আছে। সেটা হল নিভে যাবার পর পাড়ার সব কুপি গিয়ে জড় হয় ওই বটতলায়। সারারাত গল্পগুজব করে কাটায়। কিন্তু ঘটনার রাত্রে সব কুপি এলেও শুধু একটি বাড়ির কুপি আসে না। সব কুপির দুশ্চিন্তা হয়। কী হল কে জানে!

যদিও একসময় সেই কুপিটা এল। বেশ দেরি করেই এল। আর সবাই তাকে চেপে ধরে জিজ্ঞেস করল, তোর আজ এত দেরি হল কেন?

সে বলল, আর বলিস না- বাড়িতে কর্তাগিন্নির জোর ঝগড়া!

‘কেন- কী নিয়ে?

সে বলল, কর্তা সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরে দেখে দরজার বাইরে চৌকাঠের গোড়ায় একজোড়া জুতো রাখা আর পাশের দেওয়ালের কাঁটায় একটা জামা ঝোলানো। তা নিয়ে বউকে জিজ্ঞাসা, এগুলো কার? কে এসেছে বাড়িতে? বউটি কিছুই বলতে পারেনা।’

‘কেন বলতে পারে না?

‘বলবে কী করে? সে তো কিছুই জানে না।’

‘জানে না মানে? বাড়িতে তো সে-ই ছিল!’

‘হ্যাঁ, বাড়িতে সে ছিল ঠিকই। কিন্তু তার ভিতরে যে একটা গল্প আর একটা গান ছিল তা সে জানত না। কখনও কাউকে বলেনি, কাউকে শোনায়নি। এভাবেই একদিন ওই গল্প আর গানের কথা সে ভুলে গেছিল। ওদিকে তার ভিতরে থাকতে থাকতে গল্প আর গানের দমবন্ধ অবস্থা। এই মরে কি সেই মরে! কিন্তু ওদেরও বাঁচার তীব্র ইচ্ছা ছিল। তাই ওরা বেরিয়ে আসার সুযোগ খুঁজছিল। ঘটনাচক্রে আজ বউটি স্বামীর অপেক্ষায় থাকতে থাকতে হঠাৎ হাঁ-মুখ করে ঘুমিয়ে পড়েছিল। সেই সুযোগে ওরা বউটির হাঁ-মুখ পেয়ে বেরিয়ে এসে জুতো আর জামা হয়ে শোধ তুলেছে।

পাশেই লেপকাঁথা মুড়ি দিয়ে স্বামী লোকটি শুয়েছিল। সে সব শুনল। এবং বুঝতে পারল তাহলে তার বউয়ের কোনও দোষ নেই। তাই সে রাত থাকতেই বাড়ি ফিরে গেল। বউয়ের কাছে ক্ষমা চাইল।

এতে বউটি আরও ধন্দে পড়ে গেল। সে তার স্বামীকে জিজ্ঞেস করল, কার গল্প? কার গান?

মুখফেরতা ঠিক এই গল্পের ওই বউটির মতো আমাদের অবস্থা। আমাদের ভিতরেও একটি গল্প আছে। একটি গানও আছে। সম্প্রীতির গল্প। সম্প্রীতির গান। এককথায় বেঁচে থাকার গল্প, গান। যে গল্প আমরা আমাদের অন্তর থেকে বের করে কাউকে কোনওদিন বলিনি। গানটাও শোনাই নি। তাই আজ তারা সুযোগ বুঝে যে কোনও অজুহাতে বেরিয়ে পড়ছে। শোধ তুলতে আমাদেরকে ধন্দে ফেলছে! সেই ধন্দে আমরা একে অপরের সঙ্গে ঝগড়া করছি। লড়ালড়ি করছি। দাঙ্গা বাধাচ্ছি। যা দেখে আমাদের বাড়ির নিভে যাওয়া কুপিরা রাতের অন্ধকারে পাড়ার বটতলায় গিয়ে আমাদের বোকামি নিয়ে হাসিঠাট্টা করছে। গুজব রটাচ্ছে।

ঋণস্বীকার : দেবেশ রায়

0 Comments

Post Comment