ঝোড়ো হাওয়া বইছে একটানা। ঝড়ের হু হু ডাকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বৃষ্টির ঘ্যানঘ্যানে আওয়াজে ঘুম এসে যাচ্ছে। নদীর জলে ঢেঊ ভাঙছে। শেষ খেয়ার ডাক পাড়ছে মাঝি। কিছুদিন হল সাইরেনও চালু হয়েছে।ওপারের আলোটা দপ্ করে জ্বলেই নিভে গেল।ঢুলুনি আসছে নিবারণের।রগড়ে রগড়ে চোখটাও লাল। তক্তোপোশটায় ছাড়পোকা হয়েছে অনেক। ওষুধ দেওয়া হয়নি অনেকদিন।তক্তোপোশের ওপর একটা চাটাই ,হ্যারিকেন। আর হাতপাখা একপাশে। ঠিক জানলার সামনে পয়সার বাক্সটা আর লম্বা খেরো খাতা।এখন তিন টাকা দাঁড়িয়েছে পারানির কড়ি। টিকিট চালু হয়নি এঘাটে।সবটাই বিশ্বাসে চলে।তা মজুমদারবাবুর বিশ্বাসে খামতি হয়নি এখনো। দশটায় শেষ খেয়া।তারপরেও মিনিট তিরিশের মত লাগে। মাঝিরা ক্লান্ত শরীরে টেনেটেনে নৌকাগুলো পাড়ে আনে,চেন আর নোঙরে আটকে রাখে,তারপর ওদের ছুটি। নিবারণও নিজেকে টেনে নিয়ে ফেরে সাইকেলে।
এসময় মজুমদার বাড়ির আলোটা টানে নিবারণকে। ওই বাড়িতে ফিরে নিজের ঘরের শেকলটা খুলবে নিবারণ।কাপড় ছাড়বে।হাতমুখ ধোবে। ঘরের একপাশে চাপা দেওয়া রুটিতরকারির থালাটা নিমেষের মধ্যে ফাঁকা হবে।তরকারিটা ঝাল ঝাল আলু পটলের।রুটিটা শক্ত। এ ব্যবস্থা গিন্নিমার।দুবেলাই ওরাই খাবার দেন। এ সময়টায় এত খিদে পায়।কখন যে গলা দিয়ে সবটাই নেমে যায়,টের পায়না ও।ঘরের খাটিয়ায় বিছানা গোটানোই থাকে। মশারির দড়ি পেরেকে ঝোলানো।মিনিট সাতেকের মধ্যে বিছানা করে শরীরটাকে গড়িয়ে দেয় নিবারণ।
বাড়িতে ঢুকলেই বড়বাবু আসেন একবার।“নিবারণ ! ফিরলি নাকি?”
“হ্যাঁ বড়বাবু!”
“তা এবেলা কত হল নিবারণ?
“ছ হাজার একশো দুটাকা বড়বাবু।”খুঁট খুলে টাকার থলিটা বড়বাবুকে দেয় নিবারণ।
কথা বাড়ান না উনি।ব্যাগ থেকে টাকা উপুড় করে এক হাতের তেলোয় রেখে ব্যাগ ফেরৎ দেন “অসুবিধে কিছু হয়নি তো?”
“না । তেমন কিছু না ।তবে ছেলু এখনো ফেরেনি।”
“ও হতচ্ছাড়াকে ভাগাতে হবে।”বড়বাবু সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে যান।নিবারণ ঘরে আসে।টাকা আজ পর্যন্ত তার সামনে গোনেননি বড়বাবু। যেমন কথাও বলেননি এর বেশি একটাও ।
সারা শরীরটা টাটিয়ে থাকে এই রাত টুকুর জন্য। বিছানায় পড়তেই ঘুমে এলিয়ে যায় শরীর। হাতপাখাটা এই দূর্দান্ত গরমেও কোন কাজে আসেনা। নিবারণ ঘুমোয়।প্রায় নিঃশব্দে রাত শেষ হয়।
# #
তখন বছর কুড়ি হবে।বাবার হাত ধরে গাঁ থেকে শহরে এসেছিল নিবারণ। মা মরতে দেশের বাড়ির পাট চুকিয়ে বাবার সঙ্গে এই বাড়িতে এসে ঢুকেছিল।তখন এ বাড়িটার এমন চাকচিক্য ছিলনা।হলুদ রঙের ঢাউস বাড়িটা তবু চোখ ধাঁধিয়েছিল নিবারণের। বাড়ির পেছনে সারি দেওয়া কতকগুলো টালির চালের ঘর। তারই একটাতে দরজা খুলে বলেছিল, বোস। সেই থেকে বসেবসেই গোটা কুড়ি বছর কেটে গেল।
প্রথমে এসে গমকলে লেগেছিল নিবারণ।বছর পাঁচেক একটানা কাজের পর এই নদীর ধারের গদিতে পাঠান বাবু।শ্যামলা রঙের ছিপছিপে চেহারা ছিল নিবারণের।গাঁয়ের বাড়িতে বাবার পাঠানো টাকায় মা ছেলের খুঁটে খাওয়া , দিন গুজরান।সে সময় কণ্ঠার উঁচু হাড়টা আয়নায় চোখে পড়ত নিবারণের।একমাথা চুল আঁচড়েও পেছনে পাঠানো যেত না।আয়নাটা বদলায়। এখন একটা গালভারি বয়স্ক লোকের মুখ।পাতলা চুলের মধ্যে দিয়ে সাদা চুলের আভাস, কপালের আঁকিবুকি।নিবারণ হাঁকে,তুমি কে বট?ডাকটা ফিরে আসে। মা ডাকত নিবু। বলত, “ডাগর ডোগর একটা মেয়ে পাই তো আমার নিবুর বে দিই।”
বুকের মধ্যে বাজে কথাগুলো।গদিতে বসে বসে গা গতর বেশ ভারি হয়েছে।পেট আর তলার দিকে চর্বি জমেছে খুব । সাইকেল চালাতে গিয়েও টের পায় নিবারণ।শুধু হুস হুস করে দিনগুলোর চলে যাওয়া টের পায় না যে কেন?
# #
ভোর সাড়ে চারটেয় উঠে কুয়োর জলে স্নান সারে নিবারণ।গরমকালে রাতেও জল ঢালে সারা শরীরে।বামুনদি একদিন শীতের ভোরে বলেছিল, “এখনও হিম পড়ছে।ঠান্ডা লেগে যাবে।ওই কুয়োর ঠান্ডা জলে...।”
নিবারণ থামেনি। সেই অস্পষ্ট কুয়াশায় বামুনদির অবয়ব ঘিরে মায়ের শরীর পলকা হাওয়ায় ভাসছিল। ঘোর লেগেছিল নিবারণের।
এখানে গদির ওপরে বসে ভাবে নিবারণ।আটটার নৌকার পরে আবার সোয়া আটটা,পরে আবার সাড়ে আট।এইভাবে সারাদিন নৌকার কড়ি গোনা। হিসাবের পাতায় দেনাপাওনার আঁক কষে কষে বুড়িয়ে যাওয়া দিনের ভাবনা ভাবে নিবারণ। নদী যেন তার মা। ঠান্ডা শরীর নিয়ে বয়ে যায়।ডাক দেয় ,নিবু,নিবুরে।
চটকাটা ভেঙে যায়।চায়ের দোকানের ছেলেটা ডাকছে, “নিবারণদা,নিবারণদা।”সেই কোন ভোরে ওঠা।পাখিদেরও শরীর আড়ষ্ট তখন।নিবারণ মশারি খুলে বাইরে বেরোয়।মাজন দলে দাঁত ঘষে।চোখে জলের ঝাপটা দিয়ে ঘুম তাড়ায়।তারপর সারাদিনের জমা ক্লান্তি । কখন যে ঘুম এসে যায়।বিকেলে মৌতাত জমে চায়ের।ছোটবাবু ভটভটি চেপে আসেন ঘাটে।পাড়ার ছোকরার দল বিড়ি টানে নিবারণের চাটাইয়ে বসে।বড় ভালো লাগে নিবারণের।জীবনের আঁচে শরীরটাকে তাতিয়ে নেয় সে।
ওই চাটাইয়ে বসে দেশের খবর,যুদ্ধুর খবর,মালোপাড়ার আগুনের বেত্তান্ত শোনে সে। পয়সা গোনে খচ্খচ্।বাক্সে ঢোকায়। বড় খারাপ লাগে যখন এই চাটাইয়ে বসে কানে আসে দুচোখ বোজা মানুষের চলে যাওয়ার ডাক।কাছেই শ্মশান।দিনের মধ্যে বারকয়েক ওই আওয়াজও কানে ঢোকে। এগিয়ে আসা শেষের দিনগুলো কড়া নাড়ে নিঃশব্দে।
# #
গদির ঘরে একটা রেডিও।তাতে খবর বলে ।গান বাজে।আজ বান আসার খবরটাও রেডিওতেই দিল। মাঝিরা সময়মতো নৌকা নিয়ে মাঝগঙ্গায় যায়।নদীতে ঢেউএর মাতামাতি,নদীর দুধারে ভিড় করা মানুষজন।ঘর থেকে বেরিয়ে আসে নিবারণ।ভিড় ঠেকায়।ছেলে বুড়ো সবাই দলবেঁধে বান দেখতে আসে।বারবার দেখেও পুরনো হয় না যে কেন,অবাক লাগে নিবারণের। কোথায় যেন মনে হয় নদীরও প্রাণ আছে।প্রতিবারই তাই নতুন লাগে আছড়ে পড়া ঢেউএর মাতামাতি। ছেলেরা মাঝনদীতে নৌকা থেকে ঝাঁপ দেয়।বুকের মধ্যে দুরদুর করে।তারপর মজা পায় যখন সাঁতার কেটে ওরা পাড়ে আসে।
ছেলুটা ভোগাচ্ছে।বেশ কদিন হল সাগরমেলার নাম করে গেছে,এখনও ফেরার নামটি নেই।বউটাকে ছেলুর পাওনাগন্ডা বুঝিয়ে দিতে হল। বয়স বেশি না ছেলুর।ওর বউএর আরো কম। লাল ডুরে শাড়ি পরা বউটা জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়াল, আঁচলের খুঁটে পয়সা বেঁধে যখন চলে গেল,বুকের মধ্যে হু হু করে উঠল নিবারণের। কে জানে কেন,মার কথা মনে পড়ছিল।বাবার টাকা এলে মা ঠিক এমনি করেই পিয়নকাকার কাছ থেকে টাকা নিয়ে আঁচলের খুঁটে বাঁধত। মাঝে মাঝে,খুব মাঝে মাঝে , মাঠ পেরিয়ে বাবার হাঁক শোনা যেত, “নিবু,নিবুরে!”
দৌড়ে যেত নিবারণ।ব্যস্ত হত মা। তাদের মাটির ঘরে উৎসবের আঁচ লাগত।
রোজ সকালের নৌকায় বেশ কিছু ছেলেমেয়ে বাবা মার হাত ধরে ওপারের কনভেণ্ট স্কুলে পড়তে যায়। ছোট ছোট বাচ্চাগুলো জলের বোতল আর ভারি ব্যাগের ভারে যেন নুয়ে পড়ে মাটিতে। বেলা বাড়ে। অফিসের বাবুদের, কলেজের ছোকরাদের সাইকেল ওঠে নৌকায়।আবার বিকেলে ডিউটি ফেরৎ মানুষের দল ঘরের দিকে ফিরতে থাকে।দিনের পর দিন একই ছবি।তবু ক্লান্ত লাগেনা।এক অদ্ভুত নেশার মত মানুষ দেখে নিবারণ।তাদের হাঁটা ,চলা,কথা বলা, দেখে দেখে আর আশ মেটেনা।
পুজোর সময় এপারের মানুষ ওপারে যায়,ওপারের মানুষ আসে এপারে। তখন অন্য লোকও বসে গদিতে।একা নিবারণের পক্ষে সামাল দেওয়া কঠিন হয়।মাঝিরা ওভারটাইম পায়। নিবারণও বেশ কিছু রোজগার করে।প্রতি পুজোয় বাবুর বাড়ি থেকে গিন্নিমা একটা পাজামা আর পাঞ্জাবী দেন তাকে।ভেতর বাড়িতে ডাক পড়ে তার। গিন্নিমার নাকের নাকছাবি জ্বলে। কেমন যেন দুর্গা প্রতিমার মত চকচক করে মুখটা।
মাঝে মাঝে ভোরে ঘুম ভাঙলে মনটা বড় ভারি লাগে নিবারণের। বাবা মা কেউ নেই।একটা এমন লোক নেই যে ‘নিবু’ বলে ডাকে। চারপাশের সাদা দেওয়ালগুলো যেন চাপতে আসে তাকে।পেরেকে পোঁতা আলগা ক্যালেণ্ডারের জীবন যেন নিবারণের।কোন শেকড় নেই।দিন ফুরোলেই আর কোন চিহ্ন থাকবে না। নিজের ঘরের থেকে নদীর ধারের গদিটা তবু ভালো।পাশেই একটা পুরনো বটগাছ,আদ্যিকালের ভাঙা সিঁড়ি,হারুদের চায়ের দোকান আর ওপারের মিটমিটে আলো।সব মিলিয়ে একটা চেনা গন্ধ,চেনা হাওয়ার স্পর্শ লাগে শরীরে।
যেদিন পূর্ণিমার চাঁদ ওঠে,নদীর বুকে ছায়া –আলোর খেলা দু চোখ ভরে দেখে নিবারণ।সব দুঃখ কষ্ট কেমন ভুলে যায় আপনা থেকে।
“নিবারণদা চা।ক-টা বাজল এখন?”
“এই সাড়ে সাতটা হল।”
এক্ষুনি ভিড় বাড়বে।এপারের হলে সাড়ে সাতটার শো দেখে অনেক মানুষ ওপারে যায়।তাই এপারের হলে ভালো বই এলে টের পায় নিবারণ।বাংলা বই ছাড়া সে আবার দেখে না।ভালো বই এলে ছোটবাবু ছুটি দেন তাকে।নিজে এসে গদিতে বসেন।অন্ধকার হলে নিবারণ সিনেমা দেখে। চায়ের দোকানের হারুকেও সঙ্গে নেয়।ও বেচারিরও সাতকুলে কেউ নেই। ‘দাদা’ বলে ডাকে।সব জায়গায় নিবারণের পেছন পেছন থাকে। কোথায়ই বা যায় নিবারণ।ওপারে রাসের মেলা বসে বছরে একবার।নাগরদোলা ,সার্কাস, পাঁপড়ভাজা আরো হরেক মজার ব্যবস্থা। দেখে দেখে আশ মেটে না। নিবারণ যায়।সঙ্গে থাকে হারু।
কিছুদিন হল ওপারের মিলটা বন্ধ হয়েছে।মানুষজন আর ভিড় করছে না।নৌকা ভর্তি লোক।সাইকেল আর দেখতে পাওয়া যায় না। মনটা বড় খারাপ লাগে। কি দিনকাল পড়েছে।এরমধ্যে আবার মিল বন্ধ হলে মানুষ খাবে কি? ঘাটে একটা লোক কৌটো নাড়ে।সাহায্যের টাকা তোলে।এভাবে কজনের আর খাবার জুটবে? ভাবে নিবারণ।
সেদিন নটার নৌকা সবে ছেড়েছে,একটা মেয়ে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল নিবারণের ঘরে।বাইরে অঝোরধারে বৃষ্টি পড়ছে, ঝোড়ো হাওয়ায় জলে ঢেউয়ের মাতামাতি বেড়েই চলেছে।এদিকে ঘরের মধ্যে মেয়েটা। ন-টার নৌকা ধরতে পারেনি। বৃষ্টিতে ভিজে জড়োসড়ো হয়ে দরজার কাছটিতে দাঁড়িয়ে আছে। জলে ভিজেছে সারা শরীর,হাতে একটা রঙিন ছাতা।সেটা থেকেও জল পড়ছে।মুখটাও শুকিয়ে গিয়েছে খুব। মায়া হল নিবারণের।গদির তলা থেকে নিজের নতুন গামছা বের করে দিল মেয়েটাকে।পোশাক দেখে মনে হল তেমন অবস্থা নয়।তাই সাহস করে গামছা দিল ও। কথা বাড়ায় না মেয়েটা। যতটা পারে জল মুছে গামছা ফেরৎ দেয় নিবারণকে।ঠান্ডা হাওয়ায় ভিজে শরীরে কাঁপুনি ধরেছে।
“হারু,হারু”-ডাক দেয় নিবারণ।হারু আসে।চা দেয়।মেয়েটা একটু গরম হয়। ন-টার পরে সেই সাড়ে নটার নৌকা। নিবারণের তক্তোপোশের একপাশে বসে মেয়েটা। ভিজেচুল খুলে দিয়েছে।
রঙ ময়লা হলেও চোখের চাহনি বড় মায়ায় ভরা। দেখে নিবারণ। মেয়েটাও অবাক হয়ে দেখে নিবারণকে। ওপারের চশমার কারখানায় কাজ করে। কারখানা বন্ধ হলে বেলাবেলি বাড়ি ফেরে।তবে এই ঘাটে পেরোয় না।আজ পিসির বাড়ি এসেছিল।তারপর বৃষ্টিতে আটকে যাওয়া।বাড়িতে একা মা।না ফিরলে খুব ভাববে।তাই এ ঘাটে এসেছে পার হবে বলে।মেয়েটার ভিজে শরীরের সোঁদা গন্ধ ভাসে বাতাসে।নিবারণ চুপ করে থাকে।বড় ভালো লাগে। হারু বকবক করে।“কি নাম গো তোমার?”
“যমুনা।”মেয়ে বলে। ভারি মিষ্টি আওয়াজ।!নিবারণের মনে হয় ঘরের মধ্যে পাখি ডাকছে।তবে মেয়ের বয়স তেমন কম নয়। পুরন্ত চেহারা।লম্বা চুল। আড়চোখে দেখে নিবারণ।বড় ভালো লাগে।
সাড়ে নটার নৌকায় মেয়েটা চলে গেল। নিবারণ ঠায় বসে।রাত দশটায় ঘরে ফেরা।রোজকার মত।তবু কেমন অন্যরকম লাগে।
যমুনা বলেছে হারুকে, “মানুষটা বড় ভালো।আমায় চেনে না,জানে না।তবু গামছা দিল।চা খাওয়াল।”হারু এসে বলছিল।সেই থেকে কথাটা কানে বাজছে।সাইকেল চালাতে চালাতে নিবারণ গুনগুন করে সুর ভাঁজে,-“পান খায়ে সাঁইয়া হামারা-”
কোথা থেকে যে সুর আসে গলায়।
# #
হারু বেজায় বিরক্ত। কোন কিছুতেই কেন যে মন নেই নিবারণের।সারাক্ষণ ঝিম মেরে আছে।কি যে ভাবে নিবারণ।এখন বর্ষা চলছে।নদীর বুক ভরা।আকাশ থেকে জল পড়ার বিরাম নেই।সারাক্ষণ জল ঝরছে।সন্ধে হতে না হতেই লোকের ভিড় কমতে থাকে।সারাদিন ধরে কি যে এক অপেক্ষায় থাকে নিবারণ।
লোক আসে যায়।নৌকার মাঝিরা হাঁক দেয়।ওপারের আলো জ্বলে নেভে।ক্যাশবাক্সে নিবারণ পয়সা রাখে।তেমন কেউ তো আসে না।আয়নায় মুখ দেখে নিবারণ।গোঁফের ফাঁকে রূপোলি ঝিলিক।চোখের মণি দুটো কেমন ঘসা কাঁচের মত হয়ে গিয়েছে।
আরেকটা মুখ ভাসে আয়নায়।লম্বাটে নাক।নাকের পাটায় ছোট্ট একটা সোনার ফুল।টানাটানা দুচোখ তুলে আয়নায় তাকিয়ে থাকে যমুনা।
একথাটা নিবারণ বলেনি হারুকে। হারু হাসবে।পাগল ভাববে তাকে।একরাতের ভিজে যাওয়া মেয়েটা কবে যে দখল নিয়েছে মনের ভেতরে।টের পায় নিবারণ।বুকের মধ্যে জলে ভাসে তার মুখ। সামনের নদীর মত ঢেউ ভাঙে নিবারণের সমস্ত ভেতর জুড়ে।
রোদে তেতে ওঠা জলের মত মেয়ের উষ্ণ শরীরে মনেমনে ভাসে নিবারণ।শব্দ ওঠে ছলাৎ ছলাৎ। তারপর ঢেউ তোলা শরীরে মুখ গুঁজে ওম নেয় সে। জল ভাঙে নিবারণের সমস্ত ভেতর জুড়ে।মাঝরাতে উঠে বাইরে যায় সে। এরকম অভিজ্ঞতা আগে হলেও এবারেরটা একেবারেই অন্যরকম।নিজের শরীর ভাবনায় নিজেই লজ্জা পায় নিবারণ।
হঠাৎ গ্রামের জন্য, ভিটের জন্য, মন হুহু করে তার।
হারু বলে, “কেউ কোথাও নেই।কার জন্য যাবে নিবারণদা?”
নিবারণ বলে “ভিটের জন্য।ভিটেটা তো আছে।”
দুদিন ছুটি নিয়ে নৌকা পেরোয় নিবারণ।শেয়ালদার ট্রেনে চাপে।দুপুর দুপুর গ্রামে পৌঁছেও যায়। হাঁটাপথে রওয়ানা দেয়। পথে যেতে যেতেই মনকেমন করে।প্রায় দশ বছর পরে আসা।পাকা রাস্তা ,বিজলিবাতির পোস্ট,একদম অন্যরকম লাগে।বাড়ির সামনের মেঠো রাস্তাটাও কেমন যেন ভদ্র ,সভ্য, হয়ে গিয়েছে।বাড়িটায় কাকারা বাস করছে।খুব যত্ন আত্তিও করে নিবারণকে।তবু মন যে কেন চঞ্চল হয়।সেই নদী,নিত্যনতুন মানুষ,গদির ঘর টানে নিবারণকে।পরদিন ভোর ভোর বেরিয়ে পড়ে সে।
ঘাটে এসে শোনে ছেলু নতুন বিয়ে করেছে। পুরনো বউকে পাঠিয়ে দিয়েছে দেশে।এখানে নতুন বউকে নিয়ে থাকবে সে।গা জ্বলে যায় রাগে।কিন্তু কিছু বলে না নিবারণ। ছেলুর নতুন বউ ঘাটে চান করতে আসে। হারু দেখায়, “নিবারণদা, ছেলুর দুনম্বর বউ। দেখো দেখো।”
আগের সেই ময়লা রঙের বউটা চোখে ভাসে ওর। লাল ডুরে শাড়ির আঁচলে পয়সা বেঁধেছিল।আর নিবারণ দেখেছিল তার মা যেন। সব কেমন এলোমেলো লাগে।
# #
কিছুদিন ধরে কি যে হয়েছে নিবারণের,কিছুই ভালো লাগে না।এই ছটফটানি,এই অস্থিরতা , তো আগে ছিল না।শরীর জুড়োতে গ্রামে গেল।ভিটেটা একইরকম আছে,তবু যেন কোথায় আলাদা!অচেনা! নদীর দিকে চেয়েই আগে দিন কাটাত।নৌকা যায় আসে। এখনো পয়সা নেয় ,ফেরৎ দেয় ও। তবে ঘাটের মানুষজন,ঢেউএর ওঠাপড়া ,কিছুই আর তেমন করে টানে না।
হারু বলে, “ নিবারণদা সিনেমা যাবে?ভালো বই এসেছে।”
হারুকে পয়সা দেয় নিবারণ।বলে, “তুই যা।”হারু চুপচাপ চলে যায়।
কদিন ধরেই কাশিটা পেয়ে বসেছে।নদীর জোলো হাওয়ায় ভেতরের হাড় অবধি শীতের কাঁপন লেগেছে।তবু গদিতে এসে বসছে নিবারণ।সন্ধে থেকে বার দুয়েক আদা চা খেয়েও কাশিটা কমানো যায়নি।অন্ধকারের ঝোঁকে বৃষ্টিটা জোরে এলো।রাত বাড়ছে।সাড়ে আটটার ভোঁ বাজতে না বাজতেই সারা পাড়া নিশুতি।ঢুলছিল নিবারণ।একঝাঁক মানুষের গলার আওয়াজে হুঁশ এলো।জানলার ফাঁকে হাত বাড়িয়ে পয়সা রাখছে সবাই।
“পয়সাটা”,গলাটা যেন কতকালের চেনা,চমকায় নিবারণ।বুকের মধ্যে ছলাৎ ছলাৎ বাজে।থাকতে না পেরে জানলা দিয়ে উঁকি মারে নিবারণ।
“কে?”
চমকায় মেয়েটা!
নাঃ ! এ অন্য কেউ। ঢক ঢক করে ঘটি তুলে জল খায়।স্বস্তির শ্বাস ফেলে নিবারণ।
বটগাছের পাতা দোলে,নদীর জলে বৃষ্টির আওয়াজ বাজে।দুচোখ বুঝে ভাবে নিবারণ।শূন্য হাওয়ায় তার ভাবনা দোলে ,নদীর বুকে গান হয়।এ নদীর নাম যমুনা।
# #